আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গঠনরীতি নিয়মিত বাহিনীগুলোর তুলনায় স্বতন্ত্র। এই বাহিনীর আদি সংগঠন আনসার বাহিনীর পত্তন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার আদর্শে। সমাজের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এবং সজ্জন ব্যক্তিরা আনসার বাহিনীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দলে দলে এ বাহিনীর সদস্য হতে থাকেন। এ সময়ে সামাজিক সম্মান এবং সেবার গৌরব মানুষকে অনুপ্রাণিত করতো এ বাহিনীর সদস্য হওয়ার জন্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের এ বাহিনী পুনর্গঠিত হয়। গ্রাম-বাংলার অধিকতর সুরক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জননিরাপত্তার জন্য গঠিত হয় গ্রাম প্রতিরক্ষা দল। এ সময়ে সংগঠনটি পরিব্যপ্ত হয়ে দেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম প্রতিরক্ষা দল মূলত চীনের জনভিত্তিক উন্নয়ন ও জননিরাপত্তার কৌশল অবলম্বনে সৃজন করা হয়। সময়ের আবর্তে আনসার বাহিনীতে পরিপূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের সাথে গ্রাম প্রতিরক্ষা দলে লক্ষ লক্ষ যুবক যোগদান করে। নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্বে এক অনন্য জনকেন্দ্রিক, যুবজনভিত্তিক, জনবান্ধব ও জনকল্যাণমুখী জননিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী নবরূপে আবির্ভূত হয়।

৬০ লক্ষাধিক সদস্য সদস্যার সমন্বয়ে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা ভিডিপি দেশের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। দেশের প্রতিটি গ্রাম-মহল্লায় ভিত্তিপির ৩২ জন পুরুষ ও ৩২ জন মহিলার সমন্বয়ে ২টি করে প্লাটুন হয়েছে। দেশের সব স্তরের নারী ও পুরুষকে উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করে তৃণমূল তথা গ্রাম-মহল্লা পর্যায়ে জনগণের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অনৈতিক, অসামাজিক, ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী এবং বে-আইনি কার্যক্রম বিরোধী মনোভাব তৈরির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ভিডিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি পেশাভিত্তিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভিডিপি সদস্য- সদস্যাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সারা বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। ৬৪টি জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বছরব্যাপী নানা ধরনের কর্মমুখী ও পেশা নির্বাচনভিত্তিক প্রশিক্ষণ পরিচালিনা হয়। ভিডিপি সদস্যদের একটি অংশ অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। নির্বাচনে সশস্ত্র দায়িত্ব পালন এবং জাতীয় জরুরি প্রয়োজনে দায়িত্ব পালনে এ জনগোষ্ঠীকে সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় ভিডিপি সদস্যদের ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ প্রদান করে সর্বাগ্রে সারা প্রদানকারী দল হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

‘শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় সর্বত্র আমরা’ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মূলমন্ত্র। এ লক্ষ্য প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ বিশাল সদস্য-সদস্যাদের জীবন উন্নয়নের মান পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া মানব সৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবিলার ব্যাপারে এ বাহিনীর সদস্য-সদস্যাগণকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গ্রামে গ্রামে প্লাটুন গঠন করে গ্রাম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আত্মসচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে এবং অন্যায়, অনাচার, অসাম্য, বিভেদ ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের জন্য তৈরি করে সমাজকে কলুষমুক্ত করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। সামাজিক জননিরাপত্তার বিঘ্ন সৃষ্টিকারী, হঠকারী ও দুষ্ট ক্ষতকে উৎপাটন করে সাবলীল সমাজ গড়ার জন্য এক মহান আদর্শে উজ্জীবিত করার প্রয়াস নিয়েছে বর্তমান সরকার। আর আনসার ভিডিপি আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামীণ মানুষকে সুস্থ সমাজবোধ ও নৈতিকতার আলোকে আলোকিত করে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে একটি সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন আজ আমাদের প্রত্যাশা। প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার সম্মিলন সূত্র তথা সক্ষমতার সৃষ্টিতে তেমন কোনো বাস্তব পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা নেই। কোনোরকম দায়সারাভাবে চালিয়ে নিয়ে যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা হচ্ছে। বাস্তবতা, সময়োপযোগিতা ও আধুনিকতার মানে এ বাহিনী এখনো যথেষ্টভাবে পিছিয়ে আছে।

১৯৪৮ সালে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ধারণা থেকে আনসার বাহিনীর জন্ম হয়েছিল। যে প্রেক্ষাপটে সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য এ বাহিনীর জন্ম- সেই মূল প্রেক্ষাপট এখনো বিদ্যমান না থাকলেও সাহায্য সহায়তায় বা কারো মূল কাজের সহযাগী হলে এমনটাকে দোষণীয় বলা যায় না। এতে যদিও আইডেন্টিটি সমস্যার একটি বাতাবরণ তৈরি হয়ে থাকে। আর এ বাতাবরণের আড়ালে ক্যাডার সার্ভিসের ভাবমূর্তির ওপর একটি প্রচ্ছন্ন বা পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় বলেই প্রতীয়মান। এতে বাহিনীতে কর্মরত ক্যাডার সার্ভিসের অফিসারদের মধ্যে একটি ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়।

পাকিস্তানি শাসকেরা ১৯৭১ সালে আনসার সংগঠনকে রাজাকার বাহিনীতে পরিণত করে। এতদসত্ত্বেও আনসারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানের মাধ্যমে এ বাহিনী ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আনসার বাহিনীকে পুনর্জীবন প্রদান করে। এমনকি বাহিনীকে একটি সুসংগঠিত বাহিনীর মর্যাদা দেয়া হবে তাও অঙ্গীকার করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, জাতির পিতার সেই আশা পূরণের আগেই দুর্বৃত্তরা সপরিবারে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সময়ের ব্যপ্ত পরিসরে এ সরকার আনসার বাহিনীর সদস্যদের কল্যাণার্থে কিছু ভালো কাজ করে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বটে।

১৯৭৬ সালের ৫ জানুয়ারি জন্ম নেয় গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার কয়েক মাস পরের ঘটনা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরহুম জিয়াউর রহমান আনসারের সাথে ভিডিপি উইং যুক্ত করে দুটি আলাদা অধিদপ্তর হিসেবে বাহিনীকে পরিচালনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য দেশপ্রেম, রাজনীতি যাই হোক না কেন, সেই থেকে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর এযাবৎ কোন কাঠামোগত পরিবর্তন আসেনি। গ্রামের ভিডিপি সদস্য-সদস্যারা তালিকাভুক্তির পরে শুধু একটি নামমাত্র প্রশিক্ষণ সুবিধা পায়। আর প্রয়োজনমাফিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ হিসেবে সামান্য ভাতার বিনিময়ে নির্বাচনকালীন কর্তব্য পালন করে থাকে। অধিকন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে রেললাইন পাহারা, সড়ক পাহারা ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে; যা স্বেচ্ছাশ্রমের মূল কনসেপ্টের সাথে সাংঘর্ষিক। যাকে ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার বলে মনে হয়।

দুর্বল প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিকসের অভাবে তাদের কাছে সেরকম আশানুরূপ ফলাফল আসে না। নিরাপত্তা ও সমাজ উন্নয়নে নির্ভরতায় সাধারণ জনগণের আস্থার জায়গাটিতে একটি নড়বড়ে অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। তবে ৫ জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ভিডিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কথা বাহিনীর সদস্য-সদস্যারাই ভালোভাবে জ্ঞাত নয়। এর বড় কারণ হচ্ছে- সদস্য-সদস্যাদের প্রকৃতপক্ষে সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি না দিয়ে শুধুমাত্র কাগজি হিসাবের মধ্যে আত্মতৃপ্তি লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

অর্থাৎ কাজীর গরু কেতাবে আছে, বাস্তবে নেই- এরকমটাই যেন চিত্র। অধিকন্তু বছরে একবার সফিপুর একাডেমিতে সুসজ্জিত প্যারেড করে বাহিনী কোন চমক ও কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছে বা কোন চটকদার বাহিনীতে রূপান্তর লাভ করেছে- এমনটা জোর দাবি দেয়া চলে না। এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি- চকচক করলেই সোনা হয় না। যাই হোক, ভিডিপি কর্মীদের গ্রহণযোগ্য কাঠামোর মাধ্যমে পরিকল্পিত কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে সুন্দরভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করা সময়ের দাবি। তাদের কখনো প্যারা মিলিটারি, কখনো স্বেচ্ছাসেবী এরকম নামকরণের মাধ্যমে তাদের উপহাস করা হয় বলে মনে হয়। সুতরাং আনসার ভিডিপি সংস্কার আজ সময়ের দাবি। তাকে সুগঠিত পুনর্জীবন প্রদান করে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে; যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই অপরিহার্য।

৬০ লক্ষাধিক জনবলের একটি বিশাল বাহিনী বাংলাদেশ আনসার ভিডিপিকে মানবসম্পদ উন্নয়নের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি সামাজিক আন্দোলনের কাঠামোতে দাঁড় করানো সম্ভব। আজ আমাদের কাছে প্রশ্ন- বাংলাদেশ আনসার ভিডিপি কতটা সামর্থ্যরে অধিকারী হয়েছে বা বাংলাদেশ আনসার ভিডিপিকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের নিরিখে কতটা প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করা হয়েছে- তা বিবেচনার দাবি রাখে। সমস্যার সম্ভাবনা পর্যালোচনাতে এটা প্রতীয়মান হয় যে, এই বাহিনীর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হবে, দেশ সমৃদ্ধ হবে এবং সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।

তাই এ বাহিনীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর স্বার্থে পরিকল্পিত নিবিড় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এছাড়া জননিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও ফোর্সেস গোল বাস্তবায়নে আনসার ভিডিপিকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করে বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২ , ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৪

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গঠনরীতি নিয়মিত বাহিনীগুলোর তুলনায় স্বতন্ত্র। এই বাহিনীর আদি সংগঠন আনসার বাহিনীর পত্তন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার আদর্শে। সমাজের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এবং সজ্জন ব্যক্তিরা আনসার বাহিনীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দলে দলে এ বাহিনীর সদস্য হতে থাকেন। এ সময়ে সামাজিক সম্মান এবং সেবার গৌরব মানুষকে অনুপ্রাণিত করতো এ বাহিনীর সদস্য হওয়ার জন্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের এ বাহিনী পুনর্গঠিত হয়। গ্রাম-বাংলার অধিকতর সুরক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জননিরাপত্তার জন্য গঠিত হয় গ্রাম প্রতিরক্ষা দল। এ সময়ে সংগঠনটি পরিব্যপ্ত হয়ে দেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম প্রতিরক্ষা দল মূলত চীনের জনভিত্তিক উন্নয়ন ও জননিরাপত্তার কৌশল অবলম্বনে সৃজন করা হয়। সময়ের আবর্তে আনসার বাহিনীতে পরিপূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের সাথে গ্রাম প্রতিরক্ষা দলে লক্ষ লক্ষ যুবক যোগদান করে। নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্বে এক অনন্য জনকেন্দ্রিক, যুবজনভিত্তিক, জনবান্ধব ও জনকল্যাণমুখী জননিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী নবরূপে আবির্ভূত হয়।

৬০ লক্ষাধিক সদস্য সদস্যার সমন্বয়ে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা ভিডিপি দেশের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। দেশের প্রতিটি গ্রাম-মহল্লায় ভিত্তিপির ৩২ জন পুরুষ ও ৩২ জন মহিলার সমন্বয়ে ২টি করে প্লাটুন হয়েছে। দেশের সব স্তরের নারী ও পুরুষকে উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করে তৃণমূল তথা গ্রাম-মহল্লা পর্যায়ে জনগণের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অনৈতিক, অসামাজিক, ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী এবং বে-আইনি কার্যক্রম বিরোধী মনোভাব তৈরির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ভিডিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি পেশাভিত্তিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভিডিপি সদস্য- সদস্যাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সারা বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। ৬৪টি জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বছরব্যাপী নানা ধরনের কর্মমুখী ও পেশা নির্বাচনভিত্তিক প্রশিক্ষণ পরিচালিনা হয়। ভিডিপি সদস্যদের একটি অংশ অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। নির্বাচনে সশস্ত্র দায়িত্ব পালন এবং জাতীয় জরুরি প্রয়োজনে দায়িত্ব পালনে এ জনগোষ্ঠীকে সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় ভিডিপি সদস্যদের ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ প্রদান করে সর্বাগ্রে সারা প্রদানকারী দল হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

‘শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় সর্বত্র আমরা’ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মূলমন্ত্র। এ লক্ষ্য প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ বিশাল সদস্য-সদস্যাদের জীবন উন্নয়নের মান পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া মানব সৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবিলার ব্যাপারে এ বাহিনীর সদস্য-সদস্যাগণকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গ্রামে গ্রামে প্লাটুন গঠন করে গ্রাম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আত্মসচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে এবং অন্যায়, অনাচার, অসাম্য, বিভেদ ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের জন্য তৈরি করে সমাজকে কলুষমুক্ত করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। সামাজিক জননিরাপত্তার বিঘ্ন সৃষ্টিকারী, হঠকারী ও দুষ্ট ক্ষতকে উৎপাটন করে সাবলীল সমাজ গড়ার জন্য এক মহান আদর্শে উজ্জীবিত করার প্রয়াস নিয়েছে বর্তমান সরকার। আর আনসার ভিডিপি আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামীণ মানুষকে সুস্থ সমাজবোধ ও নৈতিকতার আলোকে আলোকিত করে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে একটি সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন আজ আমাদের প্রত্যাশা। প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার সম্মিলন সূত্র তথা সক্ষমতার সৃষ্টিতে তেমন কোনো বাস্তব পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা নেই। কোনোরকম দায়সারাভাবে চালিয়ে নিয়ে যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা হচ্ছে। বাস্তবতা, সময়োপযোগিতা ও আধুনিকতার মানে এ বাহিনী এখনো যথেষ্টভাবে পিছিয়ে আছে।

১৯৪৮ সালে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ধারণা থেকে আনসার বাহিনীর জন্ম হয়েছিল। যে প্রেক্ষাপটে সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য এ বাহিনীর জন্ম- সেই মূল প্রেক্ষাপট এখনো বিদ্যমান না থাকলেও সাহায্য সহায়তায় বা কারো মূল কাজের সহযাগী হলে এমনটাকে দোষণীয় বলা যায় না। এতে যদিও আইডেন্টিটি সমস্যার একটি বাতাবরণ তৈরি হয়ে থাকে। আর এ বাতাবরণের আড়ালে ক্যাডার সার্ভিসের ভাবমূর্তির ওপর একটি প্রচ্ছন্ন বা পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় বলেই প্রতীয়মান। এতে বাহিনীতে কর্মরত ক্যাডার সার্ভিসের অফিসারদের মধ্যে একটি ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়।

পাকিস্তানি শাসকেরা ১৯৭১ সালে আনসার সংগঠনকে রাজাকার বাহিনীতে পরিণত করে। এতদসত্ত্বেও আনসারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানের মাধ্যমে এ বাহিনী ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আনসার বাহিনীকে পুনর্জীবন প্রদান করে। এমনকি বাহিনীকে একটি সুসংগঠিত বাহিনীর মর্যাদা দেয়া হবে তাও অঙ্গীকার করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, জাতির পিতার সেই আশা পূরণের আগেই দুর্বৃত্তরা সপরিবারে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সময়ের ব্যপ্ত পরিসরে এ সরকার আনসার বাহিনীর সদস্যদের কল্যাণার্থে কিছু ভালো কাজ করে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বটে।

১৯৭৬ সালের ৫ জানুয়ারি জন্ম নেয় গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার কয়েক মাস পরের ঘটনা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরহুম জিয়াউর রহমান আনসারের সাথে ভিডিপি উইং যুক্ত করে দুটি আলাদা অধিদপ্তর হিসেবে বাহিনীকে পরিচালনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য দেশপ্রেম, রাজনীতি যাই হোক না কেন, সেই থেকে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর এযাবৎ কোন কাঠামোগত পরিবর্তন আসেনি। গ্রামের ভিডিপি সদস্য-সদস্যারা তালিকাভুক্তির পরে শুধু একটি নামমাত্র প্রশিক্ষণ সুবিধা পায়। আর প্রয়োজনমাফিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ হিসেবে সামান্য ভাতার বিনিময়ে নির্বাচনকালীন কর্তব্য পালন করে থাকে। অধিকন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে রেললাইন পাহারা, সড়ক পাহারা ও জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে; যা স্বেচ্ছাশ্রমের মূল কনসেপ্টের সাথে সাংঘর্ষিক। যাকে ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার বলে মনে হয়।

দুর্বল প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিকসের অভাবে তাদের কাছে সেরকম আশানুরূপ ফলাফল আসে না। নিরাপত্তা ও সমাজ উন্নয়নে নির্ভরতায় সাধারণ জনগণের আস্থার জায়গাটিতে একটি নড়বড়ে অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। তবে ৫ জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ভিডিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কথা বাহিনীর সদস্য-সদস্যারাই ভালোভাবে জ্ঞাত নয়। এর বড় কারণ হচ্ছে- সদস্য-সদস্যাদের প্রকৃতপক্ষে সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি না দিয়ে শুধুমাত্র কাগজি হিসাবের মধ্যে আত্মতৃপ্তি লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

অর্থাৎ কাজীর গরু কেতাবে আছে, বাস্তবে নেই- এরকমটাই যেন চিত্র। অধিকন্তু বছরে একবার সফিপুর একাডেমিতে সুসজ্জিত প্যারেড করে বাহিনী কোন চমক ও কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছে বা কোন চটকদার বাহিনীতে রূপান্তর লাভ করেছে- এমনটা জোর দাবি দেয়া চলে না। এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি- চকচক করলেই সোনা হয় না। যাই হোক, ভিডিপি কর্মীদের গ্রহণযোগ্য কাঠামোর মাধ্যমে পরিকল্পিত কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে সুন্দরভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করা সময়ের দাবি। তাদের কখনো প্যারা মিলিটারি, কখনো স্বেচ্ছাসেবী এরকম নামকরণের মাধ্যমে তাদের উপহাস করা হয় বলে মনে হয়। সুতরাং আনসার ভিডিপি সংস্কার আজ সময়ের দাবি। তাকে সুগঠিত পুনর্জীবন প্রদান করে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে; যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই অপরিহার্য।

৬০ লক্ষাধিক জনবলের একটি বিশাল বাহিনী বাংলাদেশ আনসার ভিডিপিকে মানবসম্পদ উন্নয়নের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি সামাজিক আন্দোলনের কাঠামোতে দাঁড় করানো সম্ভব। আজ আমাদের কাছে প্রশ্ন- বাংলাদেশ আনসার ভিডিপি কতটা সামর্থ্যরে অধিকারী হয়েছে বা বাংলাদেশ আনসার ভিডিপিকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের নিরিখে কতটা প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করা হয়েছে- তা বিবেচনার দাবি রাখে। সমস্যার সম্ভাবনা পর্যালোচনাতে এটা প্রতীয়মান হয় যে, এই বাহিনীর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হবে, দেশ সমৃদ্ধ হবে এবং সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।

তাই এ বাহিনীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর স্বার্থে পরিকল্পিত নিবিড় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এছাড়া জননিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও ফোর্সেস গোল বাস্তবায়নে আনসার ভিডিপিকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করে বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]