কক্সবাজার : পাঁচ শতাধিক হোটেলের মধ্যে পরিবেশের ছাড়পত্র আছে মাত্র ১৫টিতে

কক্সবাজারে ৫ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজের ইটিপি প্ল্যান্ট ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। হোটেলগুলোর স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় মানব বর্জ্যগুলো বিভিন্ন নালা, পুকুর, খাল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। ফলে আশঙ্কাজনকভাবে বঙ্গোপসাগর দূষিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সৈকতের নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে এরকম মারাত্মাক দূষণ।

স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটন, দেশীয় পর্যটক, ট্যুর অপারেটর ও হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের দায়িত্বহীনতার আচরণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অক্ষমতার কারণে প্রতিনিয়ত কক্সবাজারসহ আশপাশের পর্যটন এলাকা মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ না নিতে পারলে কক্সবাজার শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন। কক্সবাজার শহর, সমুদ্র সৈকত ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অপরিচ্ছন্নতার ছাপ। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে সৈকতে দৃশ্যমান ময়লা না থাকলেও সন্ধ্যার পর মশার যন্ত্রণায় বসে থাকা যায় না। পুরো শহরজুড়েই মশার এই রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। সুয়ারেজ সিস্টেম না থাকায় হোটেল-মোটেল থেকে তরল বর্জ্য ড্রেন দিয়ে পড়ছে বাঁকখালী নদীতে। এরপর তা ঘিরে মিশেছে সমুদ্রে। এছাড়া এসব ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। মশার উৎপত্তিও হচ্ছে এসব ড্রেনে।

এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে ৫৩৪টি হোটেলের ইটিপি ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব হোটেলের কর্তৃপক্ষকে শুনানির জন্য নিয়মিত নোটিশ দিচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়। পর্যটন শহরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মানুষ হোটেল গড়ছে, ব্যবসা করছে। কিন্তু মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন ইটিপি নেই।

এ পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম সংবাদকে জানান, স্যুয়ারেজ সিস্টেম বাস্তবায়নে ট্যুর অপারেটর, হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সবার একান্ত সহযোগিতা দরকার।

তিনি জানান, কক্সবাজারে ৫ শতাধিক হোটেল রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ থেকে ২০টির মতো হোটেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। আর কিছু হোটেল ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু ওই আবেদনগুলোতে কাগজপত্র সংকট থাকায় ছাড়পত্র পাচ্ছে না।

সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম আরও জানান, যেসব হোটেলে ছাড়পত্র নেই ওইসব হোটেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় থেকে এনফোর্সের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, সমুদ্র দূষণের জন্য পর্যটন নগরীতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থানও দায়ী। তার মতে, রোহিঙ্গা আগমনের ফলে পাহাড় কেটে তাদের জন্য ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। সেসব ক্যাম্পের বর্জ্য গিয়ে মিশছে নাফ নদে। পরে তা যাচ্ছে সমুদ্রে।

তিনি মনে করেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হোটেল-মোটেল জোনসহ চারদিকে নতুন করে উদ্যোগ নেয়া উচিত। সরকারের সঙ্গে একযোগে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগী হতে হবে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য কক্সবাজারে ৫১৬টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। এসব স্থানেই প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, যার বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়ছে।

এ ছাড়া পাহাড়ি ঢলের প্রবাহমান বাঁকখালী নদীতে পৌরসভার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে বিপুল সম্ভাবনার কথা বলা হলেও দূষণের ফলে তা খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁকখালী নদীর উজানে ৩৫০ থেকে ৫০০ মিটার প্রশস্থতা থাকলেও মোহনায় তা সর্বোচ্চ ৫০ মিটার। এখানে পৌরসভার বর্জ্য ফেলে, তার ওপর নদী ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলে হাউজিং প্রকল্প করা হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংস করা এসব প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করছে একাধিক সিন্ডিকেট।

এদিকে বাঁকখালী নদীতে বর্জ্য ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কেএম তারিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, নদীতে নয়, ময়লা রাখা হচ্ছে খোলা জায়গায়। সেখানে এটি পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

এ ছাড়া শোধনাগারের জন্য সদর উপজেলার পিএমখালীতে ৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্লান্ট স্থাপন করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। এটি হলে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটা সমাধান হবে।

শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২ , ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৪

কক্সবাজার : পাঁচ শতাধিক হোটেলের মধ্যে পরিবেশের ছাড়পত্র আছে মাত্র ১৫টিতে

জসিম সিদ্দিকী, কক্সবাজার

কক্সবাজারে ৫ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজের ইটিপি প্ল্যান্ট ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। হোটেলগুলোর স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় মানব বর্জ্যগুলো বিভিন্ন নালা, পুকুর, খাল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। ফলে আশঙ্কাজনকভাবে বঙ্গোপসাগর দূষিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সৈকতের নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে এরকম মারাত্মাক দূষণ।

স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটন, দেশীয় পর্যটক, ট্যুর অপারেটর ও হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের দায়িত্বহীনতার আচরণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অক্ষমতার কারণে প্রতিনিয়ত কক্সবাজারসহ আশপাশের পর্যটন এলাকা মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ না নিতে পারলে কক্সবাজার শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন। কক্সবাজার শহর, সমুদ্র সৈকত ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অপরিচ্ছন্নতার ছাপ। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে সৈকতে দৃশ্যমান ময়লা না থাকলেও সন্ধ্যার পর মশার যন্ত্রণায় বসে থাকা যায় না। পুরো শহরজুড়েই মশার এই রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। সুয়ারেজ সিস্টেম না থাকায় হোটেল-মোটেল থেকে তরল বর্জ্য ড্রেন দিয়ে পড়ছে বাঁকখালী নদীতে। এরপর তা ঘিরে মিশেছে সমুদ্রে। এছাড়া এসব ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। মশার উৎপত্তিও হচ্ছে এসব ড্রেনে।

এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে ৫৩৪টি হোটেলের ইটিপি ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব হোটেলের কর্তৃপক্ষকে শুনানির জন্য নিয়মিত নোটিশ দিচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়। পর্যটন শহরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মানুষ হোটেল গড়ছে, ব্যবসা করছে। কিন্তু মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন ইটিপি নেই।

এ পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম সংবাদকে জানান, স্যুয়ারেজ সিস্টেম বাস্তবায়নে ট্যুর অপারেটর, হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সবার একান্ত সহযোগিতা দরকার।

তিনি জানান, কক্সবাজারে ৫ শতাধিক হোটেল রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ থেকে ২০টির মতো হোটেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। আর কিছু হোটেল ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু ওই আবেদনগুলোতে কাগজপত্র সংকট থাকায় ছাড়পত্র পাচ্ছে না।

সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম আরও জানান, যেসব হোটেলে ছাড়পত্র নেই ওইসব হোটেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় থেকে এনফোর্সের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, সমুদ্র দূষণের জন্য পর্যটন নগরীতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থানও দায়ী। তার মতে, রোহিঙ্গা আগমনের ফলে পাহাড় কেটে তাদের জন্য ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। সেসব ক্যাম্পের বর্জ্য গিয়ে মিশছে নাফ নদে। পরে তা যাচ্ছে সমুদ্রে।

তিনি মনে করেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হোটেল-মোটেল জোনসহ চারদিকে নতুন করে উদ্যোগ নেয়া উচিত। সরকারের সঙ্গে একযোগে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগী হতে হবে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য কক্সবাজারে ৫১৬টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। এসব স্থানেই প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, যার বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়ছে।

এ ছাড়া পাহাড়ি ঢলের প্রবাহমান বাঁকখালী নদীতে পৌরসভার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে বিপুল সম্ভাবনার কথা বলা হলেও দূষণের ফলে তা খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁকখালী নদীর উজানে ৩৫০ থেকে ৫০০ মিটার প্রশস্থতা থাকলেও মোহনায় তা সর্বোচ্চ ৫০ মিটার। এখানে পৌরসভার বর্জ্য ফেলে, তার ওপর নদী ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলে হাউজিং প্রকল্প করা হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংস করা এসব প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করছে একাধিক সিন্ডিকেট।

এদিকে বাঁকখালী নদীতে বর্জ্য ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কেএম তারিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, নদীতে নয়, ময়লা রাখা হচ্ছে খোলা জায়গায়। সেখানে এটি পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

এ ছাড়া শোধনাগারের জন্য সদর উপজেলার পিএমখালীতে ৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্লান্ট স্থাপন করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। এটি হলে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটা সমাধান হবে।