খেলোয়াড় হতে চাই ইতি আক্তার

‘আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম। বোতল টোকাইতাম, ভিক্ষা করতাম, নেশাও করতাম। সারাদিন ডান্ডি (নেশা জাতীয় দ্রব্য) খাইতাম। কতদিন না খায়া ছিলাম। যখন খিদা লাগত তখন বেশি বেশি কইরা ডান্ডি খাইতাম। মানুষ খুব খরাপ কথা কইত। কত মারত’Ñ এই কথাগুলো বলছিল সম্প্রতি পথশিশুদের নিয়ে কাতার বিশ্ব কাপে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ইতি আক্তার।

ইতি আক্তার। বয়স ১২ কি ১৩। বাড়ি ভৈরব। এটুকুই তার স্বাভাবিক অতীত। বাবা-মা, ভাই-বোন হয়তো সবাই আছে। কিন্তু ইতির কাছে তাদের কোন স্মৃতি নাই, স্থানও নাই। সে এখন আর মনে করতে চায় না তার পরিবারের কথা। তার জন্ম বৃত্তান্ত। তার স্মৃতিতে এখন শুধুই নষ্ট মানুষ আর নোংরা জীবনের কদর্যতা, যা এখনো তার এই ছোট্ট জীবনে মন খারাপের কারণ। এখনো ঘুমের মধ্যে তাকে তাড়া করে ফেরে সেই রাস্তার অতীত। তখন চুপ হয়ে যায়, আপন মনে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। কারণ এই বয়সেই সমাজের অন্ধকার জায়গাগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তার।

ইতির সঙ্গে কথা হয়, লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে থাকা পথশিশুদের একটি আশ্রমে। এই সংগঠনটি (লীডো) প্রায় ২ বছর আগে ইতিকে ঢাকার এয়ারপোর্টের ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে এই আশ্রমে।

‘তখনকার ইতির সঙ্গে এখনকার ইতিকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না। যখন তাকে আনা হয় তখন আকাশ আর এখন পাতাল। নানভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। ব্যবহার ছিল রুক্ষ-’ বলেন এই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়নকারী মো. সোহেল রানা।

ছোট্ট হালকা পাতলা মিষ্টি চেহেরার ইতি, ডিফেন্সে খেলে। হালকা শরীরে শক্ত বল পায়ে পায়ে এগিয়ে নেয়া ইতি এখন নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত।

ইতি বলে, ‘কেমনে এইহানে (ঢাকা এয়ারপোর্টে) আসছি এহন আর মনে নাই। আমরা ৩ ভাই ৩ বোন এইটা মনে আছে। আর কিছু মনে নাই। আমি এহন আর কিছু মনে করতেও চাই না’- এ কথা বলে কিছুটা উদাস হয়ে যায় যেন ইতি।

তুমি তো প্লেনে উঠেছো, বিদেশে গিয়া খেলে আসলে, কেমন লাগলো- এমন প্রশ্নে ইতির চোখ-মুখ আলোকিত হয়ে যায়। গদ গদ গলায় বলে, ‘আমি তো আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম, প্লেন উড়তে নামতে দেখতাম। কোনদিন ভাবি নাই প্লেনে উঠতে পারব। প্রথমে খুব ভয় পাইছিলাম। কত কিছু খাইতে দিছে প্লেনে।’

‘আগে এই খাবারগুলা মাইনষেরা খাইতো চায়া চায়া দেখতাম, চাইতাম। কেউ একটু খায়া তার অর্ধেক খাওয়াটা দিত, কেউ আবার গালি দিত। সেই খাবারগুলা আমারে যখন খাইতে দিছে, সেইটা দেইখা আমার খুব কান্না আইসা পড়ছিল’।

‘তবে কাতার গিয়া ওই সব খাবার খাইতে খাইতে তখন বুঝছি আমাদের খাবারই ভালো।’

ইতি আপন মনে বলতে থাকে, ‘আমার তো ঘরবাড়ি বাপ-মা কেউ আছিলো না। নেশা কইরা রাস্তায় ঘুমায় পড়তাম। কত মাইনষে যে আমারে ১০ টেকা ২০ টেকা দিয়া কত কিছু করছে।’

তুমি এখন কি করছ কী হতে চাও এমন প্রশ্নের জবাবে ইতি বলে, ‘আমি এখন কেলাস (ক্লাস) ওয়ানে পড়ি। ভালোভাবে খেলাধুলা করে একজন খেলোয়াড় হতে চাই। আমি দেখাতে চাই ভালোভাবে ট্রেনিং দিলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারি। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই। রাস্তার বাচ্চারাও যে কিছু করতে পারে তা দেখাতে চাই। আর আমার মতো পথশিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা।’

আরও খবর
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতার সমালোচনা করলেন রাষ্ট্রপতি
‘কর আহরণ বাড়াতে পেশাদার ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন’
পথশিশুদের বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের ১১ শিশু
ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছা অনেক জেসমিন আক্তার
খিলগাঁও ফ্লাইওভারে তিন বন্ধুর মৃত্যু, দুবাই ফিরে যাওয়া হলো না মেহেদীর
গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ভিডিও ধারণ, মামলা হলেও ৮ দিনে আসামি গ্রেপ্তার হয়নি
কৃষকের অ্যাপের মাধ্যমে ধান কেনাসহ ১৩ নির্দেশনা
রায়পুরায় টেঁটাযুদ্ধে নিহত ১, আহত ১০
কক্সবাজার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিসে দুর্নীতি, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
চনপাড়ার বজলুরের বিরুদ্ধে র‌্যাবের ৩ মামলা, ২১ দিনের রিমান্ড আবেদন

রবিবার, ২০ নভেম্বর ২০২২ , ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৪

খেলোয়াড় হতে চাই ইতি আক্তার

‘আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম। বোতল টোকাইতাম, ভিক্ষা করতাম, নেশাও করতাম। সারাদিন ডান্ডি (নেশা জাতীয় দ্রব্য) খাইতাম। কতদিন না খায়া ছিলাম। যখন খিদা লাগত তখন বেশি বেশি কইরা ডান্ডি খাইতাম। মানুষ খুব খরাপ কথা কইত। কত মারত’Ñ এই কথাগুলো বলছিল সম্প্রতি পথশিশুদের নিয়ে কাতার বিশ্ব কাপে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ইতি আক্তার।

ইতি আক্তার। বয়স ১২ কি ১৩। বাড়ি ভৈরব। এটুকুই তার স্বাভাবিক অতীত। বাবা-মা, ভাই-বোন হয়তো সবাই আছে। কিন্তু ইতির কাছে তাদের কোন স্মৃতি নাই, স্থানও নাই। সে এখন আর মনে করতে চায় না তার পরিবারের কথা। তার জন্ম বৃত্তান্ত। তার স্মৃতিতে এখন শুধুই নষ্ট মানুষ আর নোংরা জীবনের কদর্যতা, যা এখনো তার এই ছোট্ট জীবনে মন খারাপের কারণ। এখনো ঘুমের মধ্যে তাকে তাড়া করে ফেরে সেই রাস্তার অতীত। তখন চুপ হয়ে যায়, আপন মনে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। কারণ এই বয়সেই সমাজের অন্ধকার জায়গাগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তার।

ইতির সঙ্গে কথা হয়, লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে থাকা পথশিশুদের একটি আশ্রমে। এই সংগঠনটি (লীডো) প্রায় ২ বছর আগে ইতিকে ঢাকার এয়ারপোর্টের ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে এই আশ্রমে।

‘তখনকার ইতির সঙ্গে এখনকার ইতিকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না। যখন তাকে আনা হয় তখন আকাশ আর এখন পাতাল। নানভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। ব্যবহার ছিল রুক্ষ-’ বলেন এই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়নকারী মো. সোহেল রানা।

ছোট্ট হালকা পাতলা মিষ্টি চেহেরার ইতি, ডিফেন্সে খেলে। হালকা শরীরে শক্ত বল পায়ে পায়ে এগিয়ে নেয়া ইতি এখন নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত।

ইতি বলে, ‘কেমনে এইহানে (ঢাকা এয়ারপোর্টে) আসছি এহন আর মনে নাই। আমরা ৩ ভাই ৩ বোন এইটা মনে আছে। আর কিছু মনে নাই। আমি এহন আর কিছু মনে করতেও চাই না’- এ কথা বলে কিছুটা উদাস হয়ে যায় যেন ইতি।

তুমি তো প্লেনে উঠেছো, বিদেশে গিয়া খেলে আসলে, কেমন লাগলো- এমন প্রশ্নে ইতির চোখ-মুখ আলোকিত হয়ে যায়। গদ গদ গলায় বলে, ‘আমি তো আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম, প্লেন উড়তে নামতে দেখতাম। কোনদিন ভাবি নাই প্লেনে উঠতে পারব। প্রথমে খুব ভয় পাইছিলাম। কত কিছু খাইতে দিছে প্লেনে।’

‘আগে এই খাবারগুলা মাইনষেরা খাইতো চায়া চায়া দেখতাম, চাইতাম। কেউ একটু খায়া তার অর্ধেক খাওয়াটা দিত, কেউ আবার গালি দিত। সেই খাবারগুলা আমারে যখন খাইতে দিছে, সেইটা দেইখা আমার খুব কান্না আইসা পড়ছিল’।

‘তবে কাতার গিয়া ওই সব খাবার খাইতে খাইতে তখন বুঝছি আমাদের খাবারই ভালো।’

ইতি আপন মনে বলতে থাকে, ‘আমার তো ঘরবাড়ি বাপ-মা কেউ আছিলো না। নেশা কইরা রাস্তায় ঘুমায় পড়তাম। কত মাইনষে যে আমারে ১০ টেকা ২০ টেকা দিয়া কত কিছু করছে।’

তুমি এখন কি করছ কী হতে চাও এমন প্রশ্নের জবাবে ইতি বলে, ‘আমি এখন কেলাস (ক্লাস) ওয়ানে পড়ি। ভালোভাবে খেলাধুলা করে একজন খেলোয়াড় হতে চাই। আমি দেখাতে চাই ভালোভাবে ট্রেনিং দিলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারি। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই। রাস্তার বাচ্চারাও যে কিছু করতে পারে তা দেখাতে চাই। আর আমার মতো পথশিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা।’