আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের প্রতিযোগিতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

আমি যখন টাকশালের নির্বাহী প্রধান তখন আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের পতাকা টাঙানো নিয়ে আমাকে সালিশ করতে হয়েছিল। বাদী-বিবাদী দুই দলই কর্মচারী-কর্মকর্তার ছেলেমেয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হওয়ার আগে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের সমর্থকেরা দৃশ্যমান একটি গোলচক্করে দুটি বিরাট ব্যানারের আকারে পতাকা টাঙিয়ে নিজেদের সরব উপস্থিতি প্রকাশ করতো। কিন্তু একবার আর্জেন্টিনার ব্যানার একটু বড় হওয়াতে ব্রাজিলের ব্যানার টানানোর জায়গা কমে যায়।

এ সমস্যার সমাধান কিভাবে যে করেছিলাম তা এখন আর মনে নেই। আমার ছেলে তানভীর আহমেদ অর্ণব আর্জেন্টিনার সমর্থক, তার অনেক কাজিন আবার ব্রাজিলের সমর্থক। ব্যানার আর পতাকার বিশালতা নিয়ে তাদের মধ্যেও খুনসুঁটি আছে। প্রতিযোগিতায় টিকার জন্য আমাকেও চারতলা ভবনের সমদৈর্ঘ্যরে ব্যানার তৈরির পয়সা ছেলে অর্ণবকে দিতে হয়েছিল।

চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার ফাইনালে উরুগুয়ে আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব লাভ করে। এবারের বিশ্বকাপ খেলা হবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। খেলা শুরু হবে নভেম্বরের ২০ তারিখে। উদ্বোধনী খেলা হবে স্বাগতিক দেশের সাথে ইকুয়েডরের। ৩২টি দলের খেলা হবে এক মাসব্যাপী। চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর কাতার জাতীয় দিবসে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে।

কাতারের ৫টি শহরের ৮টি মাঠে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এই খেলার আয়োজনে ব্যয় হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। কাতারের জন্য তা কোন সমস্যা নয়। কাতার পারস্য উপসাগরের একটি ধনী দেশ। এ দেশের ভূপৃষ্ঠে কোন জলাশয় না থাকলেও ভূগর্ভে রয়েছে তেল-গ্যাসের বিরাট মজুদ। কাতারে ফুটবলের তেমন কোন পরিকাঠামোই ছিল না, বিশ্বকাপ উপলক্ষে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে একের পর এক চোখ ধাঁধানো স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে। ব্যবহার হবে না বিধায় বিশ্বকাপ হয়ে গেলেই কয়েকটি স্টেডিয়াম ভেঙে ফেলা হবে।

খেলার আয়োজন একটি লাভজনক বিনিয়োগ, এই খেলা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ কাতার সফর করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হোটেলে স্থান সংকুলান হবে না বিধায় কাতার তিনটি বিলাসবহুল প্রমোদতরীর ব্যবস্থা করেছে, ইতোমধ্যে প্রমোদতরীর রুমের বুকিংও হয়ে গেছে। এ খেলার আয়োজন করতে পৃথিবীর অন্যান্য ধনী দেশও উন্মুখ হয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছে কাতার।

বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে ৩২টি দেশ, কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশে বসবাস করি তাদের কাছে বিশ্বকাপ মানেই শুধু দুইটি দেশ- আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। ইতালি এবং জার্মানি চারবার বিশ্বকাপ শিরোপা জিতলো, অথচ ইতালি বা জার্মানির উল্লেখযোগ্য কোন ভক্ত নেই। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকরা এই খেলার সাথে এত বেশি একাত্ম হয়ে যায় যে, অন্য সব কিছু তাদের কাছে তখন হয়ে যায় গৌণ। সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ ভবনে নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা উড়তে থাকবে, যুবকেরা এই দুই দেশের জার্সি পরে ঘুরে বেড়াবে, জার্সিসহ ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেবে।

পরিবারের শিশুদেরও এ সময় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জার্সির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার পতাকার বিপুল সমারোহ দেখে একবার এক জেলা প্রশাসক ক্ষেপে সব পতাকা বিভিন্ন ভবন থেকে নামানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রতি নমনীয় ছিলেন বিধায় উক্ত জেলা প্রশাসককে থেমে যেতে হয়েছিল। বিশ্বকাপ নিয়ে বিভাজিত এই দুই সমর্থক দলের মুখোমুখি অবস্থানেও একবার পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৮২ সালে সংঘটিত ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রাজিলের সমর্থকেরাও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিয়েছিল।

বিশ্বকাপ বিজয়ী দেশের ফুটবল খেলোয়াড়রা নিজেদের জার্সিতে তারকা ব্যবহার করতে পারে; প্রতিটি তারকা একটি বিশ্বকাপ শিরোপা নির্দেশ করে। পাঁচটি শিরোপা জিতে ব্রাজিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল দল। তারা প্রতিবার শৈল্পিক ও নান্দনিক ফুটবল খেলা উপহার দিয়ে থাকে। সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেছেন ব্রাজিলের পেলে। তিনি তিনবার বিশ্বকাপ জয়ী একমাত্র ফুটবলার। তাই ব্রাজিলের ফুটবল দলকে সমর্থন করা যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত। অন্যদিকে আর্জেন্টিনাও সেরা দল, তারাও পৃথিবীর সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের উপহার দিয়েছে।

ম্যারাডোনা ও মেসির নাম জানে না এমন কোন ফুটবল প্রেমিক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই দুইজন ফুটবলারের কারণেই সারা বিশ্বে আর্জেন্টিনা সমধিক পরিচিত। শুধু ফুটবলের জন্যই এই দুইটি দেশের সাথে সারা পৃথিবীর ফুটবল প্রেমিকদের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আর্জেন্টিনার সমর্থক গোষ্ঠী সারা পৃথিবীব্যাপী। তাই এই দুই দেশের ফুটবল দলের সমর্থনে পতাকা বানানো, জার্সি পরা, আতশবাজি ফোটানো, জিতলে উৎসব করা, হারলে মন খারাপ করাÑ সবই স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু যা সমর্থনযোগ্য নয় তা হচ্ছে, হাজার মাইল দূরের দুটি দেশের ফুটবল দলকে সমর্থন করতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে, বন্ধুর সাথে, পরিচিতজনের সাথে, প্রতিবেশীর সাথে, সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা। একটি দলকে ভালোবাসলে আরেকটি দলকে ঘৃণা করতে হবে কেন? মেসি এবং নেইমার দুইজনই ভালো খেলে- একজনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার পাশাপাশি অন্যজনকে পচানোর দৃষ্টিকটু কসরত উত্তেজনা তৈরি করে।

খেলা নিয়ে এমন মুখোমুখি অবস্থান হানাহানির উদ্ভব ঘটায়। টি-২০ বিশ্বকাপেও ভারত এবং পাকিস্তান সমর্থকদের মধ্যে বিকৃত মানসিকতার লক্ষণ দেখা গেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে খেলার চেয়ে রাজনীতিটাই মুখ্য। খেলার চেয়ে রাজনীতি মুখ্য বিধায় ভারত আর পাকিস্তানের সব খেলায় বাংলাদেশের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলার সাথে আমাদের দেশীয় রাজনীতির সম্পর্ক না থাকলেও খেলার সমর্থন নিয়ে সৃষ্ট সংঘাতেও বহু সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সৃষ্ট হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা খেলার আনন্দ আর বিনোদনকে নষ্ট করে দেয়।

আমি বিশ্বকাপে রোমানিয়ার ফুটবল দলের সমর্থক ছিলাম। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি হলে রোমানিয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির পাওলো রসির খেলা দেখার জন্য রাত জেগেছিলাম। আমাদের পরিবারের সদস্যের মধ্যে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের সমর্থক রয়েছে, তাদের মধ্যে খুনসুঁটি হয়, কিন্তু মনোমালিন্য হয় না। প্রতিপক্ষ দলের পরাজয় কামনা করা স্বাভাবিক, নিজের দলের জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু পরাজয় কামনা আর আনন্দকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ সমর্থক কারো সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা গর্হিত কাজ। চরম ইয়ার্কি-মশকরা শুধু সম্পর্ক নষ্ট করে না, ঘৃণাও ছড়ায়।

আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল কোন দেশই আমাদের স্বদেশভূমি নয়। তাদের জনগণ বাংলাদেশকে আদৌ চেনে কিনা সন্দেহ। এক সময় মালয়েশিয়ার জনগণও বাংলাদেশ চিনতো না। ১৯৮৯ সালে সেন্ট্রাল ব্যাংকিং কোর্সে অংশ নিতে গিয়ে এর প্রমাণ পেয়েছিলাম। ক্লাসে শিক্ষক বাংলাদেশের অবস্থান জানার আগ্রহ প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর শোনার জন্য কোর্সে অংশ নেওয়া প্রায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও মালয়েশিয়ার লোকজন তা শুনেছে বলে মনে হয়নি। তবে এখন চেনে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশও এখন বাংলাদেশকে চেনে এবং জানে। বাংলাদেশের এমন পরিচিতি গড়ে উঠা সত্ত্বেও ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মানুষ হয়তো বাংলাদেশের নামও শোনেনি। না শোনার কারণও রয়েছেÑ এই দুটি দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুবই কম।

তাই এবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল কেন্দ্রিক সহিংসতা, বিরোধ, কিংবা অহেতুক সংঘাত হবে নাÑ এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষ ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থন বা বিরোধিতা করতে গিয়ে পারষ্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করছে, প্রতিপক্ষকে আঘাত করছে বা মেরে ফেলছেÑ এটা ব্যক্তি কিংবা জাতির জন্য লজ্জাকর। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ সব দলের সমর্থকদের জন্য শুভেচ্ছা রইলো।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]

রবিবার, ২০ নভেম্বর ২০২২ , ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৪

আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের প্রতিযোগিতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

আমি যখন টাকশালের নির্বাহী প্রধান তখন আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের পতাকা টাঙানো নিয়ে আমাকে সালিশ করতে হয়েছিল। বাদী-বিবাদী দুই দলই কর্মচারী-কর্মকর্তার ছেলেমেয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হওয়ার আগে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের সমর্থকেরা দৃশ্যমান একটি গোলচক্করে দুটি বিরাট ব্যানারের আকারে পতাকা টাঙিয়ে নিজেদের সরব উপস্থিতি প্রকাশ করতো। কিন্তু একবার আর্জেন্টিনার ব্যানার একটু বড় হওয়াতে ব্রাজিলের ব্যানার টানানোর জায়গা কমে যায়।

এ সমস্যার সমাধান কিভাবে যে করেছিলাম তা এখন আর মনে নেই। আমার ছেলে তানভীর আহমেদ অর্ণব আর্জেন্টিনার সমর্থক, তার অনেক কাজিন আবার ব্রাজিলের সমর্থক। ব্যানার আর পতাকার বিশালতা নিয়ে তাদের মধ্যেও খুনসুঁটি আছে। প্রতিযোগিতায় টিকার জন্য আমাকেও চারতলা ভবনের সমদৈর্ঘ্যরে ব্যানার তৈরির পয়সা ছেলে অর্ণবকে দিতে হয়েছিল।

চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার ফাইনালে উরুগুয়ে আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব লাভ করে। এবারের বিশ্বকাপ খেলা হবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। খেলা শুরু হবে নভেম্বরের ২০ তারিখে। উদ্বোধনী খেলা হবে স্বাগতিক দেশের সাথে ইকুয়েডরের। ৩২টি দলের খেলা হবে এক মাসব্যাপী। চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর কাতার জাতীয় দিবসে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে।

কাতারের ৫টি শহরের ৮টি মাঠে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এই খেলার আয়োজনে ব্যয় হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। কাতারের জন্য তা কোন সমস্যা নয়। কাতার পারস্য উপসাগরের একটি ধনী দেশ। এ দেশের ভূপৃষ্ঠে কোন জলাশয় না থাকলেও ভূগর্ভে রয়েছে তেল-গ্যাসের বিরাট মজুদ। কাতারে ফুটবলের তেমন কোন পরিকাঠামোই ছিল না, বিশ্বকাপ উপলক্ষে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে একের পর এক চোখ ধাঁধানো স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে। ব্যবহার হবে না বিধায় বিশ্বকাপ হয়ে গেলেই কয়েকটি স্টেডিয়াম ভেঙে ফেলা হবে।

খেলার আয়োজন একটি লাভজনক বিনিয়োগ, এই খেলা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ কাতার সফর করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হোটেলে স্থান সংকুলান হবে না বিধায় কাতার তিনটি বিলাসবহুল প্রমোদতরীর ব্যবস্থা করেছে, ইতোমধ্যে প্রমোদতরীর রুমের বুকিংও হয়ে গেছে। এ খেলার আয়োজন করতে পৃথিবীর অন্যান্য ধনী দেশও উন্মুখ হয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছে কাতার।

বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে ৩২টি দেশ, কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশে বসবাস করি তাদের কাছে বিশ্বকাপ মানেই শুধু দুইটি দেশ- আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। ইতালি এবং জার্মানি চারবার বিশ্বকাপ শিরোপা জিতলো, অথচ ইতালি বা জার্মানির উল্লেখযোগ্য কোন ভক্ত নেই। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকরা এই খেলার সাথে এত বেশি একাত্ম হয়ে যায় যে, অন্য সব কিছু তাদের কাছে তখন হয়ে যায় গৌণ। সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ ভবনে নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা উড়তে থাকবে, যুবকেরা এই দুই দেশের জার্সি পরে ঘুরে বেড়াবে, জার্সিসহ ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেবে।

পরিবারের শিশুদেরও এ সময় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জার্সির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার পতাকার বিপুল সমারোহ দেখে একবার এক জেলা প্রশাসক ক্ষেপে সব পতাকা বিভিন্ন ভবন থেকে নামানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রতি নমনীয় ছিলেন বিধায় উক্ত জেলা প্রশাসককে থেমে যেতে হয়েছিল। বিশ্বকাপ নিয়ে বিভাজিত এই দুই সমর্থক দলের মুখোমুখি অবস্থানেও একবার পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৮২ সালে সংঘটিত ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রাজিলের সমর্থকেরাও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিয়েছিল।

বিশ্বকাপ বিজয়ী দেশের ফুটবল খেলোয়াড়রা নিজেদের জার্সিতে তারকা ব্যবহার করতে পারে; প্রতিটি তারকা একটি বিশ্বকাপ শিরোপা নির্দেশ করে। পাঁচটি শিরোপা জিতে ব্রাজিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল দল। তারা প্রতিবার শৈল্পিক ও নান্দনিক ফুটবল খেলা উপহার দিয়ে থাকে। সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেছেন ব্রাজিলের পেলে। তিনি তিনবার বিশ্বকাপ জয়ী একমাত্র ফুটবলার। তাই ব্রাজিলের ফুটবল দলকে সমর্থন করা যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত। অন্যদিকে আর্জেন্টিনাও সেরা দল, তারাও পৃথিবীর সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের উপহার দিয়েছে।

ম্যারাডোনা ও মেসির নাম জানে না এমন কোন ফুটবল প্রেমিক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই দুইজন ফুটবলারের কারণেই সারা বিশ্বে আর্জেন্টিনা সমধিক পরিচিত। শুধু ফুটবলের জন্যই এই দুইটি দেশের সাথে সারা পৃথিবীর ফুটবল প্রেমিকদের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আর্জেন্টিনার সমর্থক গোষ্ঠী সারা পৃথিবীব্যাপী। তাই এই দুই দেশের ফুটবল দলের সমর্থনে পতাকা বানানো, জার্সি পরা, আতশবাজি ফোটানো, জিতলে উৎসব করা, হারলে মন খারাপ করাÑ সবই স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু যা সমর্থনযোগ্য নয় তা হচ্ছে, হাজার মাইল দূরের দুটি দেশের ফুটবল দলকে সমর্থন করতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে, বন্ধুর সাথে, পরিচিতজনের সাথে, প্রতিবেশীর সাথে, সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা। একটি দলকে ভালোবাসলে আরেকটি দলকে ঘৃণা করতে হবে কেন? মেসি এবং নেইমার দুইজনই ভালো খেলে- একজনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার পাশাপাশি অন্যজনকে পচানোর দৃষ্টিকটু কসরত উত্তেজনা তৈরি করে।

খেলা নিয়ে এমন মুখোমুখি অবস্থান হানাহানির উদ্ভব ঘটায়। টি-২০ বিশ্বকাপেও ভারত এবং পাকিস্তান সমর্থকদের মধ্যে বিকৃত মানসিকতার লক্ষণ দেখা গেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে খেলার চেয়ে রাজনীতিটাই মুখ্য। খেলার চেয়ে রাজনীতি মুখ্য বিধায় ভারত আর পাকিস্তানের সব খেলায় বাংলাদেশের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলার সাথে আমাদের দেশীয় রাজনীতির সম্পর্ক না থাকলেও খেলার সমর্থন নিয়ে সৃষ্ট সংঘাতেও বহু সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সৃষ্ট হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা খেলার আনন্দ আর বিনোদনকে নষ্ট করে দেয়।

আমি বিশ্বকাপে রোমানিয়ার ফুটবল দলের সমর্থক ছিলাম। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি হলে রোমানিয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির পাওলো রসির খেলা দেখার জন্য রাত জেগেছিলাম। আমাদের পরিবারের সদস্যের মধ্যে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের সমর্থক রয়েছে, তাদের মধ্যে খুনসুঁটি হয়, কিন্তু মনোমালিন্য হয় না। প্রতিপক্ষ দলের পরাজয় কামনা করা স্বাভাবিক, নিজের দলের জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু পরাজয় কামনা আর আনন্দকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ সমর্থক কারো সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা গর্হিত কাজ। চরম ইয়ার্কি-মশকরা শুধু সম্পর্ক নষ্ট করে না, ঘৃণাও ছড়ায়।

আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল কোন দেশই আমাদের স্বদেশভূমি নয়। তাদের জনগণ বাংলাদেশকে আদৌ চেনে কিনা সন্দেহ। এক সময় মালয়েশিয়ার জনগণও বাংলাদেশ চিনতো না। ১৯৮৯ সালে সেন্ট্রাল ব্যাংকিং কোর্সে অংশ নিতে গিয়ে এর প্রমাণ পেয়েছিলাম। ক্লাসে শিক্ষক বাংলাদেশের অবস্থান জানার আগ্রহ প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর শোনার জন্য কোর্সে অংশ নেওয়া প্রায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও মালয়েশিয়ার লোকজন তা শুনেছে বলে মনে হয়নি। তবে এখন চেনে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশও এখন বাংলাদেশকে চেনে এবং জানে। বাংলাদেশের এমন পরিচিতি গড়ে উঠা সত্ত্বেও ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মানুষ হয়তো বাংলাদেশের নামও শোনেনি। না শোনার কারণও রয়েছেÑ এই দুটি দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুবই কম।

তাই এবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল কেন্দ্রিক সহিংসতা, বিরোধ, কিংবা অহেতুক সংঘাত হবে নাÑ এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষ ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থন বা বিরোধিতা করতে গিয়ে পারষ্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করছে, প্রতিপক্ষকে আঘাত করছে বা মেরে ফেলছেÑ এটা ব্যক্তি কিংবা জাতির জন্য লজ্জাকর। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ সব দলের সমর্থকদের জন্য শুভেচ্ছা রইলো।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]