বাজারে কাগজের সংকট প্রকট, পুরনো বই ও কাগজ ‘রিসাইক্লিং’ মূল ভরসা

দেশে কাগজের সংকট প্রকট। খোলা বাজারে সচরাচর মিলছে না কাগজ। দামও চড়া। এ সংকটে দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপা। এছাড়া সংবাদপত্র মুদ্রণ এবং শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাগজ উৎপাদনের মূল উপকরণ ‘ভার্জিন পাল্প’ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে তা আমদানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। এতে দেশের বাজার থেকে পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করে ‘পাল্পবিহীন’ কাগজ উৎপাদন করছে মিলগুলো। এই কাগজই এখন মূল ভরসা।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপছে সরকার। এসব বই ছাপাতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজের প্রয়োজন। প্রতিবছর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এই বই ছাপা হয়। কিন্তু বাজারে কাগজ সংকটের কারণে এবার এখন পর্যন্ত পাঁচ কোটি বইও ছাপাতে পারেনি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)। ২০১৯-২০ সালেও এই সময়ে প্রায় অর্ধেক বই ছাপা শেষ হয়ে যেত।

দেশে শতাধিক কাগজ মিল রয়েছে। এর মধ্যে পাঠ্যবই ছাপার কার্যক্রমকে ঘিরেই দেশে অন্তত ১৫টি কাগজ মিল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পাঠ্যবই ছাপার দরপত্রে অংশ নেয়ার আগে ছাপাখানার মালিকরা কাগজ মিল মালিকদের সঙ্গে আগাম চুক্তি করে থাকে।

কিন্তু প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের দরপত্রে অংশ নেয়ার আগে বেশির ভাগ ছাপাখানা ঠিকমত চুক্তি করতে পারেনি। কারণ ডিপিই (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) গতবছরের বই ছাপার বিল পুরোপুরি পরিশোধ না করায় কাগজ মিল মালিকদের দেনা পরিশোধ করতে পারেনি ছাপাখানাগুলো। এ কারণে তারা এবার যথাসময়ে কাগজের চাহিদাপত্র দিতে পারেনি। এ কারণে মিলগুলোও কাগজ উৎপাদনেরর উপকরণ সংগ্রহণ করেনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ডলার সংকটের কারণে কাগজ উৎপাদনের প্রধান উপকরণ ‘ভার্জিন পাল্প’ আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। এতে পাঠ্যবই ছাপতে যে কাগজ ব্যবহার হয় সেই কাগজ বাজারে মিলছে না। এর মধ্যে প্রতিদিন মিলগুলো যে পরিমাণ উৎপাদন করতে পারছে তাতে দেশের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিত্যপ্রয়োজনীয়, সরকারি-বেসরকারি অফিসে দাপ্তরিক প্রয়োজনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনীয় কাগজের চাহিদার কাগজও সবসময় পাওয়া যাচ্ছে না।

এই সংকটের কারণে দাম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আবার এই কাগজও টনপ্রতি ৫/৭ হাজার টাকা বেশি দরে কিনে নিচ্ছে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা। এতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাজারে ‘পাল্পবিহীন’ কিছুটা ভালোমানের কাগজই প্রতিটন ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছয় মাস আগে দেশে এই কাগজের টনপ্রতি মূল্য ছিল অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কম।

এনসিটিবি এবং কাগজ কল মালিকরদের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজের জন্য ৮৫ শতাংশ উজ্জলতা থাকতে হয়। ভার্জিন পাল্প ছাড়া ‘রিসাইক্লিং ফাইবার’ দিয়ে তৈরি কাগজে ওই উজ্জলতা আসে না।

পুরনো কাগজেই ভরসা

‘রিসাইক্লিং ফাইবারে’ তৈরি কাগজে ৮০/৮২ শতাংশের ওপরে উজ্জলতা আসে না। সম্প্রতি কয়েকটি ছাপাখানায় ৭০ শতাংশের কম জিএসএম কাগজেও বই ছাপার প্রমাণ পেয়েছে এনসিটিবি।

জানা গেছে, দেশে ১২০টির মতো কাগজ মিল রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টির মতো মিল এনসিটিবি নির্ধারিত মানের কাগজ উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এসব মিলের উৎপাদন সক্ষমতাও অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। ‘ভার্জিন পাল্প আমদানি বন্ধ থাকা, গ্যাস সংকট, আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ও ডিপিইর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ১৫টি মিলের মধ্যে অন্তত সাতটি প্রতিষ্ঠান কাগজ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এ কারণে কাগজের সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে তারা শুধুমাত্র ‘রিসাইক্লিং ফাইবার’ অর্থাৎ’ বাজার থেকে পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করে পুনরায় তা উৎপাদন করছেন।

জানতে চাইলে রশিদ পেপার মিলের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল হক সংবাদকে জানান, তাদের দুটি মিলের একটি বর্তমানে চালু আছে। ভার্জিন পাল্প আমদানি বন্ধ থাকায় তারা রিসাইক্লিং ‘ফাইবারে’ কাগজ উৎপাদন করছেন।

তাদের একটি মিলে গড়ে প্রতিদিন ৯০ টনের বেশি কাগজ উৎপাদন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কাগজের বাজার মূল্য বর্তমানে টনপ্রতি এক লাখ ১০ হাজার টাকার মতো হলেও আমরা এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সস্তায় ৯০ হাজার টাকা দরেই দিচ্ছি।’

ভার্জিন পাল্প আমদানি ছাড়া কাগজের সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে জহিরুল হক বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রচুর কাগজপত্র পড়ে আছে; তাছাড়া সারাদেশে দুই-তিন বছরের পুরনো এনসিটিবির বই পড়ে আছে যা দিয়ে প্রায় ২০ হাজার টন কাগজ উৎপাদন সম্ভব। এসব কাগজও বাজারে ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। পুরনো কাগজপত্র বাজারে আসলে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’

রাজা পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিল লিমিটেডের কর্মকর্তা খন্দকার মেজবাউল হক রন্ত সংবাদকে বলেন, ‘কাগজের দাম আরও বাড়বে। কারণ কোন ওয়েস্টেজ নেই। ক্যামিকেল পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুতের ঘাটতি। একেবারে বাজে একটা অবস্থা ধরে নিতে পারেন এ সময়ে ৫০ শতাংশের নিচে প্রডাকশন চলে আসছে। আমাদের টাকা আছে কিন্তু প্রোডাকশন করতে পারছি না। সব মিলে আমরা প্রোডাকশন ধরে রাখতে পারছি না। চাহিদা প্রচুর আছে। আমরা মাল দিতে পারছি না।’

ছাপাখানা মালিকদের উদ্বেগ

চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না মুদ্রণ শিল্পের মালিকরা। স্যালভো প্লাস নামের প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মাহমুদ আলম জুয়েল সংবাদকে বলেন, ‘সব কিছুরই দাম বাড়ছে, আমাদের দরকারি কাগজগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘যেখানে একটা প্লেট কাগজের দাম ছিল ১৭০ টাকা সেটা এখন ২২০ টাকা। এখনও পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আগামীতে কী হবে জানি না।’

সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাগজের সংকট কি না বোঝা যাচ্ছে না, কারণ টাকা দিলে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে। তবে তারা অল্প অল্প করে বেশি দামে বিক্রি করছে। যেখানে এক রিমে (ক্যালেন্ডারের কাগজ) কাগজে ৫০ টাকা বেশি হলে আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সেখানে রিমে দুই হাজার টাকা করে দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে ‘লোকাল’ কাগজগুলোর দামও অনেক বেড়ে গেছে।’

‘কালার ম্যাক্স’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম মোস্তফা সংবাদকে বলেন, ‘একটি প্লেট পাঁচ-সাত দিন আগেও যে দাম ছিল সেটার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। আমদানি কারকরা বলছেন এলসি সমস্যার কথা। আর মিল মালিকরা বলছেন ডলার ও বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির ম- বা ভার্জিন পাল্পের দর বাড়ার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে’।

এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কাগজ উৎপাদন কমছে জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘উৎপাদন কমার কারণে দাম বাড়ছে।’

ডিপিইর বিরুদ্ধে অভিযোগ

ছাপাখানাগুলোর মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে গত সপ্তাহে ‘২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত সময়ে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ’ শীর্ষক চিঠি দেয়া হয়।

এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কাজটি এনসিটিবি সম্পাদন করে থাকে; কিন্তু মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রথমে বিল এনসিটিবিকে সাবমিট করার পর ডিজি অফিস (ডিপিই) হয়ে এজি অফিস থেকে বিলের চেক প্রদান করা হয়। এই দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ার কারণে বিল পেতে বিলম্ব হয়। যার কারণে প্রিন্টার্সরা (ছাপাখানার মালিক) আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ চিঠিতে মাধ্যমিকের মতো এনসিটিবি থেকে বিল প্রদানের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়।

বিল প্রদানের প্রতিবন্ধকতা জরুরিভাবে নিরসনের দাবি জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘টেন্ডার শিডিউলের ওয়ারেন্টি প্রিরিউড পার হওয়ার পরও গত দুই বছর অন্যায়ভাবে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের বিল থেকে অযাচিত ও অনৈতিকভাবে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকা জরিমানা হিসেবে কর্তন করে রেখে দিয়েছে, যার কারণে প্রেসগুলো আর্থিকভাবে বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্তনকৃত টাকা প্রেস মালিকদের ফেরত প্রদান না করার কারণে প্রেস মালিকরা প্রাইমারির বই ছাপার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনার আশ^াসে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানসমূহ চুক্তিপত্র সম্পাদন করেছে।’

এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে দেয়া চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ‘বিগত বছরগুলোতে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কার্যাদেশের মেয়াদ ছিল ৯৮ দিন এবং ৮৪ দিন। কিন্তু ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে হঠাৎ করে কার্যাদেশের মেয়াদ ৯৮ দিন থেকে কমিয়ে ৫০ দিন করা হয়েছে এবং প্রতি লটে ৫০ শতাংশ পাঠ্যপুস্তক কার্যাদেশের মেয়াদের ৫০ শতাংশ সময়ের মধ্যে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের বিধান করা হয়েছে। যার ফলে নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ করার বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হবে।’

২০২২ শিক্ষাবর্ষের ২০ শতাংশ বিল এখন পর্যন্ত অনেক প্রতিষ্ঠান পায়নি অভিযোগ করে ছাপাখানা মালিকরা বলছেন, ‘পিজির (জামানত) মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও পিজি ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকসমূহ পুনরায় পিজি দিতে অনীহা প্রকাশ করছে।’ তারা জরুরিভত্তিতে এই বিল ছাড়েরর দাবি করেছেন।

ডিপিইর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এবং ডিপিইর উপসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ছাপাখানাগুলোর জামানত আটকে রয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ডিপিইর ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, তারা ছাপাখানা মালিকদের বকেয়া বিল (জামানত) ছাড়ের বিষয়ে ‘সর্বাত্মক’ চেষ্টা-তদবির করছেন।

তিনি বলেন, ‘এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। বাজারে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। দামও চড়া। অনেক মিলও উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। পাল্প আমদানিতেও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।’ এই সংকট কাটাতে তারা কাগজ মিল মালিক এবং ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম।

সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২ , ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৫ রবিউস সানি ১৪৪৪

বাজারে কাগজের সংকট প্রকট, পুরনো বই ও কাগজ ‘রিসাইক্লিং’ মূল ভরসা

রাকিব উদ্দিন/শাফিউল ইমরান

image

দেশে কাগজের সংকট প্রকট। খোলা বাজারে সচরাচর মিলছে না কাগজ। দামও চড়া। এ সংকটে দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপা। এছাড়া সংবাদপত্র মুদ্রণ এবং শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাগজ উৎপাদনের মূল উপকরণ ‘ভার্জিন পাল্প’ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে তা আমদানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। এতে দেশের বাজার থেকে পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করে ‘পাল্পবিহীন’ কাগজ উৎপাদন করছে মিলগুলো। এই কাগজই এখন মূল ভরসা।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপছে সরকার। এসব বই ছাপাতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজের প্রয়োজন। প্রতিবছর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এই বই ছাপা হয়। কিন্তু বাজারে কাগজ সংকটের কারণে এবার এখন পর্যন্ত পাঁচ কোটি বইও ছাপাতে পারেনি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)। ২০১৯-২০ সালেও এই সময়ে প্রায় অর্ধেক বই ছাপা শেষ হয়ে যেত।

দেশে শতাধিক কাগজ মিল রয়েছে। এর মধ্যে পাঠ্যবই ছাপার কার্যক্রমকে ঘিরেই দেশে অন্তত ১৫টি কাগজ মিল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পাঠ্যবই ছাপার দরপত্রে অংশ নেয়ার আগে ছাপাখানার মালিকরা কাগজ মিল মালিকদের সঙ্গে আগাম চুক্তি করে থাকে।

কিন্তু প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের দরপত্রে অংশ নেয়ার আগে বেশির ভাগ ছাপাখানা ঠিকমত চুক্তি করতে পারেনি। কারণ ডিপিই (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) গতবছরের বই ছাপার বিল পুরোপুরি পরিশোধ না করায় কাগজ মিল মালিকদের দেনা পরিশোধ করতে পারেনি ছাপাখানাগুলো। এ কারণে তারা এবার যথাসময়ে কাগজের চাহিদাপত্র দিতে পারেনি। এ কারণে মিলগুলোও কাগজ উৎপাদনেরর উপকরণ সংগ্রহণ করেনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ডলার সংকটের কারণে কাগজ উৎপাদনের প্রধান উপকরণ ‘ভার্জিন পাল্প’ আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। এতে পাঠ্যবই ছাপতে যে কাগজ ব্যবহার হয় সেই কাগজ বাজারে মিলছে না। এর মধ্যে প্রতিদিন মিলগুলো যে পরিমাণ উৎপাদন করতে পারছে তাতে দেশের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিত্যপ্রয়োজনীয়, সরকারি-বেসরকারি অফিসে দাপ্তরিক প্রয়োজনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনীয় কাগজের চাহিদার কাগজও সবসময় পাওয়া যাচ্ছে না।

এই সংকটের কারণে দাম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আবার এই কাগজও টনপ্রতি ৫/৭ হাজার টাকা বেশি দরে কিনে নিচ্ছে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা। এতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাজারে ‘পাল্পবিহীন’ কিছুটা ভালোমানের কাগজই প্রতিটন ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছয় মাস আগে দেশে এই কাগজের টনপ্রতি মূল্য ছিল অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কম।

এনসিটিবি এবং কাগজ কল মালিকরদের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজের জন্য ৮৫ শতাংশ উজ্জলতা থাকতে হয়। ভার্জিন পাল্প ছাড়া ‘রিসাইক্লিং ফাইবার’ দিয়ে তৈরি কাগজে ওই উজ্জলতা আসে না।

পুরনো কাগজেই ভরসা

‘রিসাইক্লিং ফাইবারে’ তৈরি কাগজে ৮০/৮২ শতাংশের ওপরে উজ্জলতা আসে না। সম্প্রতি কয়েকটি ছাপাখানায় ৭০ শতাংশের কম জিএসএম কাগজেও বই ছাপার প্রমাণ পেয়েছে এনসিটিবি।

জানা গেছে, দেশে ১২০টির মতো কাগজ মিল রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টির মতো মিল এনসিটিবি নির্ধারিত মানের কাগজ উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এসব মিলের উৎপাদন সক্ষমতাও অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। ‘ভার্জিন পাল্প আমদানি বন্ধ থাকা, গ্যাস সংকট, আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ও ডিপিইর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ১৫টি মিলের মধ্যে অন্তত সাতটি প্রতিষ্ঠান কাগজ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এ কারণে কাগজের সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে তারা শুধুমাত্র ‘রিসাইক্লিং ফাইবার’ অর্থাৎ’ বাজার থেকে পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করে পুনরায় তা উৎপাদন করছেন।

জানতে চাইলে রশিদ পেপার মিলের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল হক সংবাদকে জানান, তাদের দুটি মিলের একটি বর্তমানে চালু আছে। ভার্জিন পাল্প আমদানি বন্ধ থাকায় তারা রিসাইক্লিং ‘ফাইবারে’ কাগজ উৎপাদন করছেন।

তাদের একটি মিলে গড়ে প্রতিদিন ৯০ টনের বেশি কাগজ উৎপাদন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কাগজের বাজার মূল্য বর্তমানে টনপ্রতি এক লাখ ১০ হাজার টাকার মতো হলেও আমরা এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সস্তায় ৯০ হাজার টাকা দরেই দিচ্ছি।’

ভার্জিন পাল্প আমদানি ছাড়া কাগজের সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে জহিরুল হক বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রচুর কাগজপত্র পড়ে আছে; তাছাড়া সারাদেশে দুই-তিন বছরের পুরনো এনসিটিবির বই পড়ে আছে যা দিয়ে প্রায় ২০ হাজার টন কাগজ উৎপাদন সম্ভব। এসব কাগজও বাজারে ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। পুরনো কাগজপত্র বাজারে আসলে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’

রাজা পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিল লিমিটেডের কর্মকর্তা খন্দকার মেজবাউল হক রন্ত সংবাদকে বলেন, ‘কাগজের দাম আরও বাড়বে। কারণ কোন ওয়েস্টেজ নেই। ক্যামিকেল পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুতের ঘাটতি। একেবারে বাজে একটা অবস্থা ধরে নিতে পারেন এ সময়ে ৫০ শতাংশের নিচে প্রডাকশন চলে আসছে। আমাদের টাকা আছে কিন্তু প্রোডাকশন করতে পারছি না। সব মিলে আমরা প্রোডাকশন ধরে রাখতে পারছি না। চাহিদা প্রচুর আছে। আমরা মাল দিতে পারছি না।’

ছাপাখানা মালিকদের উদ্বেগ

চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না মুদ্রণ শিল্পের মালিকরা। স্যালভো প্লাস নামের প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মাহমুদ আলম জুয়েল সংবাদকে বলেন, ‘সব কিছুরই দাম বাড়ছে, আমাদের দরকারি কাগজগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘যেখানে একটা প্লেট কাগজের দাম ছিল ১৭০ টাকা সেটা এখন ২২০ টাকা। এখনও পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আগামীতে কী হবে জানি না।’

সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাগজের সংকট কি না বোঝা যাচ্ছে না, কারণ টাকা দিলে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে। তবে তারা অল্প অল্প করে বেশি দামে বিক্রি করছে। যেখানে এক রিমে (ক্যালেন্ডারের কাগজ) কাগজে ৫০ টাকা বেশি হলে আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সেখানে রিমে দুই হাজার টাকা করে দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে ‘লোকাল’ কাগজগুলোর দামও অনেক বেড়ে গেছে।’

‘কালার ম্যাক্স’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম মোস্তফা সংবাদকে বলেন, ‘একটি প্লেট পাঁচ-সাত দিন আগেও যে দাম ছিল সেটার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। আমদানি কারকরা বলছেন এলসি সমস্যার কথা। আর মিল মালিকরা বলছেন ডলার ও বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির ম- বা ভার্জিন পাল্পের দর বাড়ার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে’।

এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কাগজ উৎপাদন কমছে জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘উৎপাদন কমার কারণে দাম বাড়ছে।’

ডিপিইর বিরুদ্ধে অভিযোগ

ছাপাখানাগুলোর মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে গত সপ্তাহে ‘২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত সময়ে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ’ শীর্ষক চিঠি দেয়া হয়।

এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কাজটি এনসিটিবি সম্পাদন করে থাকে; কিন্তু মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রথমে বিল এনসিটিবিকে সাবমিট করার পর ডিজি অফিস (ডিপিই) হয়ে এজি অফিস থেকে বিলের চেক প্রদান করা হয়। এই দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ার কারণে বিল পেতে বিলম্ব হয়। যার কারণে প্রিন্টার্সরা (ছাপাখানার মালিক) আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ চিঠিতে মাধ্যমিকের মতো এনসিটিবি থেকে বিল প্রদানের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়।

বিল প্রদানের প্রতিবন্ধকতা জরুরিভাবে নিরসনের দাবি জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘টেন্ডার শিডিউলের ওয়ারেন্টি প্রিরিউড পার হওয়ার পরও গত দুই বছর অন্যায়ভাবে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের বিল থেকে অযাচিত ও অনৈতিকভাবে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকা জরিমানা হিসেবে কর্তন করে রেখে দিয়েছে, যার কারণে প্রেসগুলো আর্থিকভাবে বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্তনকৃত টাকা প্রেস মালিকদের ফেরত প্রদান না করার কারণে প্রেস মালিকরা প্রাইমারির বই ছাপার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনার আশ^াসে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানসমূহ চুক্তিপত্র সম্পাদন করেছে।’

এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে দেয়া চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ‘বিগত বছরগুলোতে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কার্যাদেশের মেয়াদ ছিল ৯৮ দিন এবং ৮৪ দিন। কিন্তু ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে হঠাৎ করে কার্যাদেশের মেয়াদ ৯৮ দিন থেকে কমিয়ে ৫০ দিন করা হয়েছে এবং প্রতি লটে ৫০ শতাংশ পাঠ্যপুস্তক কার্যাদেশের মেয়াদের ৫০ শতাংশ সময়ের মধ্যে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের বিধান করা হয়েছে। যার ফলে নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ করার বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হবে।’

২০২২ শিক্ষাবর্ষের ২০ শতাংশ বিল এখন পর্যন্ত অনেক প্রতিষ্ঠান পায়নি অভিযোগ করে ছাপাখানা মালিকরা বলছেন, ‘পিজির (জামানত) মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও পিজি ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকসমূহ পুনরায় পিজি দিতে অনীহা প্রকাশ করছে।’ তারা জরুরিভত্তিতে এই বিল ছাড়েরর দাবি করেছেন।

ডিপিইর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এবং ডিপিইর উপসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ছাপাখানাগুলোর জামানত আটকে রয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ডিপিইর ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, তারা ছাপাখানা মালিকদের বকেয়া বিল (জামানত) ছাড়ের বিষয়ে ‘সর্বাত্মক’ চেষ্টা-তদবির করছেন।

তিনি বলেন, ‘এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। বাজারে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। দামও চড়া। অনেক মিলও উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। পাল্প আমদানিতেও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।’ এই সংকট কাটাতে তারা কাগজ মিল মালিক এবং ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম।