বিদ্যুৎ : পাইকারিতে বেড়েছে, গ্রাহক পর্যায়ে আপাতত নয়

পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি); যা আগামী ডিসেম্বর মাস থেকেই কার্যকর হবে।

সাধারণত পাইকারিতে দাম বাড়ানোর পরই খুচরা পর্যায়ে সাধারণ গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়ে। তবে এজন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোকে বিইআরসির কাছে আবেদন করতে হয়। এরপর শুনানি করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন।

পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ৫ টাকা ১৭ পয়সা। বিইআরসির ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতি ইউনিটে এক টাকা তিন পয়সা বেড়ে ডিসেম্বর থেকে তা হবে ৬ টাকা ২০ পয়সা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আপিল এবং ‘সরকারের ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি’ বিবেচনায় নিয়ে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে গতকাল দুপুর ১২টায় ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানান বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল।

কমিশন হিসাব করে দেখেছে, নতুন মূল্য কার্যকর হওয়ার ফলে পিডিবির আয় বছরে আট হাজার কোটি টাকা বাড়বে। ইউনিট প্রতি দাম বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৮ পয়সা করলে পিডিবি পুরো ১৭ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি থেকে পিডিবি মুক্ত হতে পারত।

সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির কাছ থেকে প্রথমে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর সেই বিদ্যুৎ পাইকারি (বাল্ক) মূল্যে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে।

বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইকারি মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে সারাদেশে খুচরা মূল্যে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি করে। পাইকারিতে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হলেও এখনই গ্রাহকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। কারণ খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে চাইলে বিইআরসির কাছে আবেদন করতে হবে।

ইতোমধ্যে সেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে বলে ডিপিডিসিসহ অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তাদের আবেদন পেলে গণশুনানি করে খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিইআরসি।

তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, ‘গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ-জ্বালানির প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। দাম বাড়বে কি না, সেটাও নির্ভর করতে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে। সবকিছু যাচাই বাছাই করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

গত ১২ জানুয়ারি পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে পিডিবি। তথ্যের অসম্পূর্ণতা থাকায় তা আমলে না নিয়ে পুনরায় আবেদন করার নির্দেশনা দেয় বিইআরসি। এরপর পুনরায় আবেদন জমা দিলে তা নিয়ে ১৮ মে শুনানির আয়োজন করা হয়। এতে ভর্তুকি ছাড়া ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন টিম। (টিইটি)। তবে ক্যাব ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন শুনানিতে। বিদ্যুৎ খাতের অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলেন তারা।

শুনানি শেষে ১৩ অক্টোবর পাইকারি বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। এ সময় বলা হয়, ভোক্তার ওপর দাম বাড়ানোর প্রভাব কী হবে; এর কোন মূল্যায়ন করেনি তারা। তথ্যের অস্বচ্ছতার কারণে পিডিবির তথ্য-উপাত্ত যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা যায়নি। কোন পক্ষের আপত্তি থাকলে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে আপিল করার কথাও বলা হয় আদেশে। এরপর গত ১৩ নভেম্বর আপিল করে পিডিবি, যা গতকাল আমলে নিয়ে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় কমিশন।

নতুন পাইকারি মূল্যহার অনুযায়ী শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ডেসকোর ৩৩ কেভি লাইনে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৭ টাকা ৭৪ পয়সা। আর ডিপিডিসির ৩৩ কেভি লাইনের বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৭ টাকা ৭২ পয়সা।

আরইবির সমিতিগুলোর ৩৩ কেভি লাইনের জন্য প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ৫ টাকা ৩৯ পয়সা যা, পাইকারি বিদ্যুতের সর্বনিম্ন দর। এছাড়া, নেসকোর ৬ টাকা ২০ পয়সা, ওজোপাডিকোর ৬ টাকা ৬২ পয়সা এবং পিডিবির দর ধরা হয়েছে ৬ টাকা ৭৮ পয়সা।

২৩০ কেভি, ১৩২ কেভি লাইনের জন্য সবগুলো কোম্পানির একই দর রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩০ কেভি লাইনে প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ৬০ পয়সা এবং ১৩২ কেভি লাইনে ধরা হয়েছে ৭ টাকা ৬৩ পয়সা।

পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘পিডিবি যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে না পারায় প্রথমে দাম বাড়ায়নি বিইআরসি। এখন পিডিবি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা নিয়ে ক্যাব ও অন্য পক্ষের বক্তব্য নিতে হবে। তাই পুনরায় শুনানি ছাড়া দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই।’

এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, ‘শুনানি করেই তো আদেশ দেয়া হয়েছিল। সেই আদেশের ওপর আপিল করেছে পিডিবি। তাই এখন আর শুনানির প্রয়োজন নেই।’

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল সচিবালয়ে বলেন, ‘বিইআরসি তাদের মতো করে বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে তারা ঘোষণা দিয়েও দাম বাড়ায়নি। সবকিছু তারা যাচাই-বাছাই করেই করেছে।’

বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় প্রতি বছরই বিরাট অঙ্কের লোকসান গোনে পিডিবি। তবে এই টাকা ভর্তুকি হিসেবে দেয় সরকার।

পিডিবি জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতি ৩১ হাজার কোটি টাকা পেরিয়ে যায়। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। তারা বলছে, এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই তাদের লোকসান হয়েছে আট হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। অর্থবিভাগ ভর্তুকির অর্থ ছাড় না করায় বেসরাকরি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ৫ মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। গত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলো পিডিবির কাছে ৩৩ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা পাবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকেও আর্থিক সহায়তা নিচ্ছে সরকার। এসব সংস্থা ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে।

গত ২ নভেম্বর পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগ ও ৬ নভেম্বর বিইআরসির সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকা সফরকারী আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এ সময় বিদ্যুতের দাম, ভর্তুকি ও পিডিবির লোকসান নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ১৩ নভেম্বর কমিশনের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে পিডিবি, যা আমলে নিল বিইআরসি।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়, যা ওই বছর মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়।

ওই সময় পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়, যা আগে ৪ টাকা ৭৭ পয়সা ছিল। তখন সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়, যা আগে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা ছিল।

এবার পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১৯.৯২ শতাংশ বেড়েছে। সর্বশেষ বৃদ্ধির হিসাব অনুযায়ী, এবার খুচরা পর্যায়েও ১২.৫৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা।

ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ১১ বছরে ১০ দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর জুনে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ক্যাব জানায়, গত ১১ বছরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ এবং খুচরা বিদ্যুতের দাম ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।

চলতি বছর জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। ৬ আগস্ট বাড়ানো ডিজেল ও কেরোসিনে সাড়ে ৪২ শতাংশ এবং পেট্রল ও অকটেনে ৫১ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এতে ডিজেল ও কেরোসিন প্রতি লিটার ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের লিটার ৮৯ টাকা থেকে হয় ১৩৫ টাকা। এর প্রভাব পড়ে পরিবহণ, নিত্যপণ্যের বাজার, সব রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনসহ নানা খাতে। পরে ২৯ আগস্ট চার ধরনের জ্বালানিতে লিটারে ৫ টাকা করে হ্রাস করে সরকার।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দা ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বাংলাদেশে নিত্যপ্রণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। এই সময়, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়ে যাবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ। রাষ্ট্রীয় ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব গ্রাহককে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৮০টি সমিতির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ অধিকাংশ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে। আরইবির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০।

ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ঢাকা উত্তরে এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ঢাকা দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ শহরে বিদ্যুৎ বিতরণ করে।

এছাড়া, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোড (পিডিবি) ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহরাঞ্চলে, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে এবং নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ বা বিক্রি করে।

মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০২২ , ০৭ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৪

বিদ্যুৎ : পাইকারিতে বেড়েছে, গ্রাহক পর্যায়ে আপাতত নয়

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি); যা আগামী ডিসেম্বর মাস থেকেই কার্যকর হবে।

সাধারণত পাইকারিতে দাম বাড়ানোর পরই খুচরা পর্যায়ে সাধারণ গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়ে। তবে এজন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোকে বিইআরসির কাছে আবেদন করতে হয়। এরপর শুনানি করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন।

পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ৫ টাকা ১৭ পয়সা। বিইআরসির ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতি ইউনিটে এক টাকা তিন পয়সা বেড়ে ডিসেম্বর থেকে তা হবে ৬ টাকা ২০ পয়সা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আপিল এবং ‘সরকারের ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি’ বিবেচনায় নিয়ে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে গতকাল দুপুর ১২টায় ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানান বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল।

কমিশন হিসাব করে দেখেছে, নতুন মূল্য কার্যকর হওয়ার ফলে পিডিবির আয় বছরে আট হাজার কোটি টাকা বাড়বে। ইউনিট প্রতি দাম বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৮ পয়সা করলে পিডিবি পুরো ১৭ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি থেকে পিডিবি মুক্ত হতে পারত।

সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির কাছ থেকে প্রথমে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর সেই বিদ্যুৎ পাইকারি (বাল্ক) মূল্যে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে।

বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইকারি মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে সারাদেশে খুচরা মূল্যে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি করে। পাইকারিতে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হলেও এখনই গ্রাহকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। কারণ খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে চাইলে বিইআরসির কাছে আবেদন করতে হবে।

ইতোমধ্যে সেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে বলে ডিপিডিসিসহ অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তাদের আবেদন পেলে গণশুনানি করে খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিইআরসি।

তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, ‘গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ-জ্বালানির প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। দাম বাড়বে কি না, সেটাও নির্ভর করতে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে। সবকিছু যাচাই বাছাই করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

গত ১২ জানুয়ারি পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে পিডিবি। তথ্যের অসম্পূর্ণতা থাকায় তা আমলে না নিয়ে পুনরায় আবেদন করার নির্দেশনা দেয় বিইআরসি। এরপর পুনরায় আবেদন জমা দিলে তা নিয়ে ১৮ মে শুনানির আয়োজন করা হয়। এতে ভর্তুকি ছাড়া ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন টিম। (টিইটি)। তবে ক্যাব ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন শুনানিতে। বিদ্যুৎ খাতের অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলেন তারা।

শুনানি শেষে ১৩ অক্টোবর পাইকারি বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। এ সময় বলা হয়, ভোক্তার ওপর দাম বাড়ানোর প্রভাব কী হবে; এর কোন মূল্যায়ন করেনি তারা। তথ্যের অস্বচ্ছতার কারণে পিডিবির তথ্য-উপাত্ত যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা যায়নি। কোন পক্ষের আপত্তি থাকলে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে আপিল করার কথাও বলা হয় আদেশে। এরপর গত ১৩ নভেম্বর আপিল করে পিডিবি, যা গতকাল আমলে নিয়ে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় কমিশন।

নতুন পাইকারি মূল্যহার অনুযায়ী শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ডেসকোর ৩৩ কেভি লাইনে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৭ টাকা ৭৪ পয়সা। আর ডিপিডিসির ৩৩ কেভি লাইনের বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৭ টাকা ৭২ পয়সা।

আরইবির সমিতিগুলোর ৩৩ কেভি লাইনের জন্য প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ৫ টাকা ৩৯ পয়সা যা, পাইকারি বিদ্যুতের সর্বনিম্ন দর। এছাড়া, নেসকোর ৬ টাকা ২০ পয়সা, ওজোপাডিকোর ৬ টাকা ৬২ পয়সা এবং পিডিবির দর ধরা হয়েছে ৬ টাকা ৭৮ পয়সা।

২৩০ কেভি, ১৩২ কেভি লাইনের জন্য সবগুলো কোম্পানির একই দর রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩০ কেভি লাইনে প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ৬০ পয়সা এবং ১৩২ কেভি লাইনে ধরা হয়েছে ৭ টাকা ৬৩ পয়সা।

পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘পিডিবি যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে না পারায় প্রথমে দাম বাড়ায়নি বিইআরসি। এখন পিডিবি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা নিয়ে ক্যাব ও অন্য পক্ষের বক্তব্য নিতে হবে। তাই পুনরায় শুনানি ছাড়া দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই।’

এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, ‘শুনানি করেই তো আদেশ দেয়া হয়েছিল। সেই আদেশের ওপর আপিল করেছে পিডিবি। তাই এখন আর শুনানির প্রয়োজন নেই।’

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল সচিবালয়ে বলেন, ‘বিইআরসি তাদের মতো করে বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে তারা ঘোষণা দিয়েও দাম বাড়ায়নি। সবকিছু তারা যাচাই-বাছাই করেই করেছে।’

বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় প্রতি বছরই বিরাট অঙ্কের লোকসান গোনে পিডিবি। তবে এই টাকা ভর্তুকি হিসেবে দেয় সরকার।

পিডিবি জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতি ৩১ হাজার কোটি টাকা পেরিয়ে যায়। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। তারা বলছে, এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই তাদের লোকসান হয়েছে আট হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। অর্থবিভাগ ভর্তুকির অর্থ ছাড় না করায় বেসরাকরি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ৫ মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। গত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলো পিডিবির কাছে ৩৩ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা পাবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকেও আর্থিক সহায়তা নিচ্ছে সরকার। এসব সংস্থা ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে।

গত ২ নভেম্বর পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগ ও ৬ নভেম্বর বিইআরসির সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকা সফরকারী আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এ সময় বিদ্যুতের দাম, ভর্তুকি ও পিডিবির লোকসান নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ১৩ নভেম্বর কমিশনের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে পিডিবি, যা আমলে নিল বিইআরসি।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়, যা ওই বছর মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়।

ওই সময় পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়, যা আগে ৪ টাকা ৭৭ পয়সা ছিল। তখন সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়, যা আগে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা ছিল।

এবার পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১৯.৯২ শতাংশ বেড়েছে। সর্বশেষ বৃদ্ধির হিসাব অনুযায়ী, এবার খুচরা পর্যায়েও ১২.৫৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা।

ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ১১ বছরে ১০ দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর জুনে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ক্যাব জানায়, গত ১১ বছরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ এবং খুচরা বিদ্যুতের দাম ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।

চলতি বছর জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। ৬ আগস্ট বাড়ানো ডিজেল ও কেরোসিনে সাড়ে ৪২ শতাংশ এবং পেট্রল ও অকটেনে ৫১ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এতে ডিজেল ও কেরোসিন প্রতি লিটার ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের লিটার ৮৯ টাকা থেকে হয় ১৩৫ টাকা। এর প্রভাব পড়ে পরিবহণ, নিত্যপণ্যের বাজার, সব রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনসহ নানা খাতে। পরে ২৯ আগস্ট চার ধরনের জ্বালানিতে লিটারে ৫ টাকা করে হ্রাস করে সরকার।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দা ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বাংলাদেশে নিত্যপ্রণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। এই সময়, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়ে যাবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ। রাষ্ট্রীয় ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব গ্রাহককে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৮০টি সমিতির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ অধিকাংশ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে। আরইবির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০।

ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ঢাকা উত্তরে এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ঢাকা দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ শহরে বিদ্যুৎ বিতরণ করে।

এছাড়া, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোড (পিডিবি) ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহরাঞ্চলে, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে এবং নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ বা বিক্রি করে।