জঙ্গি ছিনতাই, নজরে থাকা পরিকল্পনাকারী ও ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিরা অধরা

আদালতপাড়া থেকে পুলিশের ওপর হামলা করে নিছিয়ে নেয়া দুই জঙ্গি এবং ঘটনায় পরিকল্পনাকারীরা ‘নজরদারিতে রয়েছে’ পুলিশ এমনটা দাবি করলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা খুব সহজ কাজ হবে না বলে মনে করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৩ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তাদেরও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর আদালতপাড়ায় পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে। আগে আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের যেমন ঢিলেঢালা ভাব ছিল, জঙ্গি ছিনতাই হওয়ার পর সে অবস্থা থেকে সরে এসে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করেছে পুলিশ। এদিকে আদালতপাড়া থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি সদস্যকে ছিনতাই অপরারেশনে নেতৃত্বদানকারীর নাম-পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এই অপারেশনে তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগীকেও শনাক্ত করা হয়েছে। জঙ্গি ছিনতাই অপারেশনে নেতৃত্বদানকারীসহ সবাইকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমরা কাজ করছি।

পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ ইউনিট এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডিআইজি মনিরুজ্জামান সংবাদকে জানিয়েছেন, আদালতপাড়া থেকে যে দুজন জঙ্গি ছিনতাই হয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে এটিইউর একাধিক টিম। কিভাবে কাদের নির্দেশে এ হামলা ও দুজন জঙ্গিকে ছিনতাই করা হয়েছে সে বিষয়েও তারা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে।

পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছে, যে দু’জন জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের অবস্থান এখনও শনাক্ত হয়নি। কারণ পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের গ্রেপ্তার খুবই কঠিন কাজ। তবে তাদের ধরতে বেশ সময় লাগতে পারে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে যে ৩ জন জঙ্গিকে তাদের সহযোগীরা পুলিশকে হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের আমরা ধরতে পারিনি। যদিও একজন পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে মারা গেছেন।

তিনি বলেন, আদালতপাড়া থেকে এভাবে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা জঙ্গিদের শক্তি সম্পর্কে একটি নতুন বার্তা দিয়েছে। আমরা সব সময় বলে আসছি জঙ্গিরা যেকোন সময় যেকোন ঘটনা ঘটাতে সক্ষম এবং আদালতপাড়া থেকে তাদের সহযোগীরা যে দুজনকে ছিনিয়ে নিয়েছে সেটি প্রমাণ করে।

পুলিশ কর্মকতার ভাষ্য, জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে হামলার মতো ঘটনা না ঘটাতে পারলেও আদালতপাড়া থেকে তারা দু’জন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার মতো কাজ করে দেখিয়েছে। এটি বড় ধরনের বার্তা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘দুর্বলতার’ বিষয়ে।

আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার

এদিকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে ঢাকার আদালত চত্বরের নিরাপত্তা জোরদারে নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। আদালতের হাজতখানায় যুক্ত হয়েছে ৬০টি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট। বড় সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি আসামি আনা-নেয়ার সময় এখন থেকে পুলিশ সদস্যরা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরবেন।

পুলিশ সূত্র বলছে, তাদের ৩০টি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও ৩০টি হেলমেট পুলিশের প্রশিকিউশন বিভাগে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আদালতপাড়ায় জঙ্গি বা বড় সন্ত্রাসী এমন আসামিদের আদালতে হাজির করা এবং তাদের হাজতখানায় পাহড়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের জন্য এসব সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দুই জঙ্গি আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার পর থেকে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আরও অনেক বেশি সতর্ক।’

আদালত সূত্র জানিয়েছে, আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আদালত চত্বরে ভ্রাম্যমাণ কোন দোকানপাট বসতে দেয়া হয়নি। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে আদালতে পুলিশের উপস্থিতি বেশি দেখতে পাচ্ছি। এ ধরনের নিরাপত্তা যদি সারা বছর থাকে, তাহলে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী অনেক উপকৃত হবেন। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়া কিংবা অন্য কোন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কমে যাবে।’

প্রতিবেদন দিতে সময় চেয়েছে ডিএমপির তদন্ত কমিটি

মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময় চেয়েছে ডিএমপির গঠিত তদন্ত কমিটি। গত রোববার দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় ডিএমপির পক্ষ থেকে যে কমিটি গঠন করা হয় তাদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি আসামি ছিনতাইয়ের মাস্টারমাইন্ড হলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান সমন্বয়ক মেজর (চাকরিচ্যূত) সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। তার অনুমতিতে এই ছিনতাই অপারেশন পরিচালনা করেন সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান মশিউর রহমান ওরফে আইমান। গ্রেপ্তার থাকা জঙ্গি আরাফাত ও সবুরকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, কনডেম সেলে থাকা ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামিরা প্রায় সময় মোবাইল ফোনে যোগযোগ করতেন। কারাগারে বসেই পরিকল্পনা হয় আসামি ছিনতাইয়ের। প্রথমে ত্রিশালের জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো প্রিজনভ্যানে হামলার করে সহযোগীদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে কাশিমপুর থেকে পুরান ঢাকায় আদালত পর্যন্ত আনা-নেয়ার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা করাটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাদের। তাই তুলনামূলক কম নিরাপত্তা থাকায় ছিনতাই অপারেশনের স্পট হিসেবে বেছে নেয় আদালত প্রাঙ্গণকে। আর অপারেশনের জঙ্গি সদস্যদের ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছিল সহযোগীরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি

জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ডিএমপি থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এবার নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। চার সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করে সম্প্রতি সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, গত রোববার ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাজাপ্রাপ্ত আবু সিদ্দিক ওরফে সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীম ওরফে ইমরানকে (ব্লগার দীপন এবং অভিজিৎ হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-ের আদেশপ্রাপ্ত আসামি) তার সহযোগীরা পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কারা অনুবিভাগ) এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন পুলিশ পরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নয়), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক এবং ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কমিটি আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে এতে জানানো হয়।

কারাগারে জঙ্গিদের পরিকল্পনার বিষয়ে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা

এদিকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা কাশিমপুর কারাগারে বসে হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে এমন কথা আসার পর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পর্যবেক্ষণে নিয়েছে। যদিও এ ঘটনার পর থেকে কারাগারে বন্দী থাকা জঙ্গিসহ সব ধরনের আসামিদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান টেলিফোনে সংবাদকে জানান, কারাগারে সব বন্দীদের কারাবিধি অনুযায়ী রাখা হয়। এখন কথা উঠেছে জঙ্গিরা কারাগারে বসে নানা পরিকল্পনা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যদি এমন কোন তথ্য আসে তাহলে কারা কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিবে। জঙ্গিদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের কারো বিরুদ্ধে প্রমাণ মিললে বা গাফলতি পেলে অবস্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত রোববার ঢাকার আদালতে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এ ঘটনায় লালবাগ থানায় ৭ থেকে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০ থেকে ২২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ঘটনায় দেশ-বিদেশে বেশ আলোড়ন তৈরি করে। পুলিশ যদিও দাবি করেছে, এ ঘটনায় পরিকল্পনাকারী শনাক্ত। তবে তাদের এখনও আইনের আওতায় আনা যায়নি। পলাতক জঙ্গিদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।

বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২ , ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৪

জঙ্গি ছিনতাই, নজরে থাকা পরিকল্পনাকারী ও ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিরা অধরা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

আদালতপাড়া থেকে পুলিশের ওপর হামলা করে নিছিয়ে নেয়া দুই জঙ্গি এবং ঘটনায় পরিকল্পনাকারীরা ‘নজরদারিতে রয়েছে’ পুলিশ এমনটা দাবি করলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা খুব সহজ কাজ হবে না বলে মনে করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৩ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তাদেরও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর আদালতপাড়ায় পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে। আগে আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের যেমন ঢিলেঢালা ভাব ছিল, জঙ্গি ছিনতাই হওয়ার পর সে অবস্থা থেকে সরে এসে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করেছে পুলিশ। এদিকে আদালতপাড়া থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি সদস্যকে ছিনতাই অপরারেশনে নেতৃত্বদানকারীর নাম-পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এই অপারেশনে তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগীকেও শনাক্ত করা হয়েছে। জঙ্গি ছিনতাই অপারেশনে নেতৃত্বদানকারীসহ সবাইকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমরা কাজ করছি।

পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ ইউনিট এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডিআইজি মনিরুজ্জামান সংবাদকে জানিয়েছেন, আদালতপাড়া থেকে যে দুজন জঙ্গি ছিনতাই হয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে এটিইউর একাধিক টিম। কিভাবে কাদের নির্দেশে এ হামলা ও দুজন জঙ্গিকে ছিনতাই করা হয়েছে সে বিষয়েও তারা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে।

পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছে, যে দু’জন জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের অবস্থান এখনও শনাক্ত হয়নি। কারণ পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের গ্রেপ্তার খুবই কঠিন কাজ। তবে তাদের ধরতে বেশ সময় লাগতে পারে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে যে ৩ জন জঙ্গিকে তাদের সহযোগীরা পুলিশকে হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের আমরা ধরতে পারিনি। যদিও একজন পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে মারা গেছেন।

তিনি বলেন, আদালতপাড়া থেকে এভাবে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা জঙ্গিদের শক্তি সম্পর্কে একটি নতুন বার্তা দিয়েছে। আমরা সব সময় বলে আসছি জঙ্গিরা যেকোন সময় যেকোন ঘটনা ঘটাতে সক্ষম এবং আদালতপাড়া থেকে তাদের সহযোগীরা যে দুজনকে ছিনিয়ে নিয়েছে সেটি প্রমাণ করে।

পুলিশ কর্মকতার ভাষ্য, জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে হামলার মতো ঘটনা না ঘটাতে পারলেও আদালতপাড়া থেকে তারা দু’জন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার মতো কাজ করে দেখিয়েছে। এটি বড় ধরনের বার্তা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘দুর্বলতার’ বিষয়ে।

আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার

এদিকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে ঢাকার আদালত চত্বরের নিরাপত্তা জোরদারে নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। আদালতের হাজতখানায় যুক্ত হয়েছে ৬০টি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট। বড় সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি আসামি আনা-নেয়ার সময় এখন থেকে পুলিশ সদস্যরা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরবেন।

পুলিশ সূত্র বলছে, তাদের ৩০টি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও ৩০টি হেলমেট পুলিশের প্রশিকিউশন বিভাগে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আদালতপাড়ায় জঙ্গি বা বড় সন্ত্রাসী এমন আসামিদের আদালতে হাজির করা এবং তাদের হাজতখানায় পাহড়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের জন্য এসব সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দুই জঙ্গি আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার পর থেকে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আরও অনেক বেশি সতর্ক।’

আদালত সূত্র জানিয়েছে, আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আদালত চত্বরে ভ্রাম্যমাণ কোন দোকানপাট বসতে দেয়া হয়নি। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে আদালতে পুলিশের উপস্থিতি বেশি দেখতে পাচ্ছি। এ ধরনের নিরাপত্তা যদি সারা বছর থাকে, তাহলে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী অনেক উপকৃত হবেন। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়া কিংবা অন্য কোন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কমে যাবে।’

প্রতিবেদন দিতে সময় চেয়েছে ডিএমপির তদন্ত কমিটি

মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময় চেয়েছে ডিএমপির গঠিত তদন্ত কমিটি। গত রোববার দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় ডিএমপির পক্ষ থেকে যে কমিটি গঠন করা হয় তাদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি আসামি ছিনতাইয়ের মাস্টারমাইন্ড হলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান সমন্বয়ক মেজর (চাকরিচ্যূত) সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। তার অনুমতিতে এই ছিনতাই অপারেশন পরিচালনা করেন সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান মশিউর রহমান ওরফে আইমান। গ্রেপ্তার থাকা জঙ্গি আরাফাত ও সবুরকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, কনডেম সেলে থাকা ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামিরা প্রায় সময় মোবাইল ফোনে যোগযোগ করতেন। কারাগারে বসেই পরিকল্পনা হয় আসামি ছিনতাইয়ের। প্রথমে ত্রিশালের জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো প্রিজনভ্যানে হামলার করে সহযোগীদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে কাশিমপুর থেকে পুরান ঢাকায় আদালত পর্যন্ত আনা-নেয়ার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা করাটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাদের। তাই তুলনামূলক কম নিরাপত্তা থাকায় ছিনতাই অপারেশনের স্পট হিসেবে বেছে নেয় আদালত প্রাঙ্গণকে। আর অপারেশনের জঙ্গি সদস্যদের ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছিল সহযোগীরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি

জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ডিএমপি থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এবার নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। চার সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করে সম্প্রতি সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, গত রোববার ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাজাপ্রাপ্ত আবু সিদ্দিক ওরফে সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীম ওরফে ইমরানকে (ব্লগার দীপন এবং অভিজিৎ হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-ের আদেশপ্রাপ্ত আসামি) তার সহযোগীরা পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কারা অনুবিভাগ) এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন পুলিশ পরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নয়), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক এবং ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কমিটি আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে এতে জানানো হয়।

কারাগারে জঙ্গিদের পরিকল্পনার বিষয়ে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা

এদিকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা কাশিমপুর কারাগারে বসে হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে এমন কথা আসার পর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পর্যবেক্ষণে নিয়েছে। যদিও এ ঘটনার পর থেকে কারাগারে বন্দী থাকা জঙ্গিসহ সব ধরনের আসামিদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান টেলিফোনে সংবাদকে জানান, কারাগারে সব বন্দীদের কারাবিধি অনুযায়ী রাখা হয়। এখন কথা উঠেছে জঙ্গিরা কারাগারে বসে নানা পরিকল্পনা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যদি এমন কোন তথ্য আসে তাহলে কারা কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিবে। জঙ্গিদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের কারো বিরুদ্ধে প্রমাণ মিললে বা গাফলতি পেলে অবস্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত রোববার ঢাকার আদালতে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এ ঘটনায় লালবাগ থানায় ৭ থেকে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০ থেকে ২২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ঘটনায় দেশ-বিদেশে বেশ আলোড়ন তৈরি করে। পুলিশ যদিও দাবি করেছে, এ ঘটনায় পরিকল্পনাকারী শনাক্ত। তবে তাদের এখনও আইনের আওতায় আনা যায়নি। পলাতক জঙ্গিদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।