শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরীর শি ল্পিত কবিতা

মা, মাটি ও মানুষের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ ২০১৪ সালে বড্ড অভাবনীয়, অদৃষ্টপূর্ব এবং অতি আকস্মিক একটি বেদনাময় শিল্প-ঘটনা। একজন পরিপূর্ণ সবুজ মনের শিল্পীর তিরোধান একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে সত্যিই অচিন্ত্যনীয়। সচরাচর কখনো দেখা যায় না, আশাও বোধ করি ভবিষ্যতে এমনটি আর দেখা নাও যেতে পারে। রং, রেখা, প্রকৃতি, মানুষ, পাখি, মেঘ, নদী আর গ্রাম নিয়ে তাঁর শিল্প-নৌকা উজ্জ্বল আর বর্ণময় জগৎ পরিভ্রমণ করে ফিরতো দর্শকদের মন ও মননে। বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর এত সবুজ রঙ-নির্ভর সৃষ্টিতে এমন গভীরতায় মগ্ন হতে দেখা যায় না। চাষি, মাঝি, শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাস্তবনির্ভর প্রতিচ্ছবি যেমন প্রাকৃতিক এক অনায়াস-লব্ধ সাবলীল ভঙ্গি ও করণ-কৌশলে তার সতেজ তুলি ও চিত্রপটে বর্ণ-সুষময়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠতো তেমনি করে কাগজে-কলমে অস্ফুট কবিতার পঙ্ক্তিতেও বাঙময় হয়ে ধরা দিতে দেখা গেছে। এই বিষয়ে তিনি নিভৃতচারী এক প্রচারবিমুখী স্বভাবের আড়ালে থাকা কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কবিতা সৃষ্টি আত্মকথা-মাধ্যম স্বগোতক্তি, দিনলিপি লেখার মতন। এই কথকতা প্রকাশিত হওয়ার পর আর তা কবির নিজের অধীনে থাকে না। সবার জন্য যখন সেটি যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষমও সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন তাই কবিতা হয়ে ওঠে। পাঠকের মনের কথা কবিতার চরণে রূপ নেয়, কবি তখন আপন হয়ে ওঠেন। তার কবিতা শব্দের অদৃশ্য এক মনো সেতুতে সৃষ্টির মাধুর্যে মনোময়তা খুঁজে পায়। শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরী চিত্রশিল্প সৃষ্টি যেমন করেছেন, এর পাশাপাশি কবিতাশিল্পও নির্মাণ করতে মনোযোগ দিয়েছেন এবং অনেকদিন ধরে এমনটি করে গেছেন। তাই এপ্রিল ১০, ২০১৩ এই দিনে বৈশাখ ১৪২০ শীর্ষক কবিতায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঘটনায় প্রদীপ্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুপ্রাণিত সিক্ত সেই সময়ের প্রজন্ম চত্বর নিয়ে অনায়াসে উচ্চারণ করেন মৃদু কণ্ঠে- ‘মানুষের মাঝে আলো জ্বালাতে/ চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আক্ষেপ ছিল তার অন্ধকারে/ যতবার আলো জ্বালাতে চাই/ নিভে যায় বারে বারে।/... তাড়াতে পারিনি সরীসৃপ/ তুলেছে ফণা, ঢেকেছে সূর্যদীপ। কাটাতেই হবে এই ঘোর আমানিশা/প্রজন্ম চত্বরই দেখাবে আমাদের/ নতুন পথের দিশা।’ এমনই কবির আশা ও স্বপ্ন। শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরী এক শিল্পাড়ং-এ মালদ্বীপ গিয়েছিলেন অনেক শিল্পীদের সঙ্গে। সেখানকার অর্থাৎ মালদ্বীপের নীল সমুদ্র, অবারিত জলরাশি, তার মধ্যে ভাসমান পদ্মফুলের পাতার মতো দ্বীপসমূহ- সেই প্রেক্ষিতে বেশ

কয়েকটি কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। ছোট ছোট কথা, নিবিড় অনুভূতি, রৌদ্রাভ নিঃসীম দিগন্তরেখা আকাশ ও সমুদ্রের মিলিত প্রান্তর, প্রকৃতির মধ্যে মানুষের সামান্য বিন্দুবৎ অস্তিত্ব এইসব নিয়ে কবির হার্দ্র্য উচ্চারণ- বান্দোসে নেমেছে সন্ধ্যা/ চারদিকে আলোকোজ্জ্বল/ দ্বীপমালা/ গভীর গাঢ় নীলে/ কথোপকথন/.... ফেনিল ঢেউয়ের/ আসা আর যাওয়া-/ আকাশের অগুনতি তারা ছুঁয়ে/ দক্ষিণ সমুদ্র থেকে ভেসে আসা শীতল হাওয়া। নিসর্গের মধ্যে শুধু জল আর জল, বাতাস, মেঘ, আকাশ- এসবের মধ্যে কবি হারিয়ে যান অবলীলায় অবধারিতভাবে অনায়াসে। কবি চোখ মেলে দূরদৃষ্টিতে অবলোকন করেন- ‘ওখানে জলের ফিরোজা রঙ/ খড়ে ছাওয়া কুটিরের সারি-/ যেখানে অতিথির/ অবকাশ যাপন।/... অদূরেই বিশাল সমুদ্র জাহাজ/ আলোয় আলোয় ভাসমান/ ইন্ডিগো আকাশে নাচে/ বর্ণালি সাম্পান।’ কবির কথামালা সরাসরি, স্বাধীন ও প্রত্যক্ষ। কোনো ভণিতা, প্রাককথন বা ভূমিকা নেই। পাঠকের মর্মমূলে নিবিড়ভাবে বেজে ওঠে শব্দবীণা। তারা শিউরে ওঠেন যেন নিজেরা নিজস্ব ও একান্ত ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন। এইভাবে কবি শব্দে শব্দে এক শব্দসেতু নির্মাণ করে তার ওপর দিয়ে সবাইকে পারপারের ব্যবস্থা করে দেন। সব কথা মাথায় নিয়ে বলা যায়- শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী কবি কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে ওঠেন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের গভীর অনুভবে তার স্বচ্ছ ও স্পষ্ট উচ্চারণে। তার নজর ছিল সর্বত্র ও ওজর ছিল সর্বজনীনয়তায় ব্যাপ্ত। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, বন্ধনশিল্প, ভাস্কর্য, ভ্রমণশিল্প, লোকশিল্প, মৃৎশিল্প, বয়নশিল্প, প্রায় প্রতিটি শিল্প মাধ্যমে উৎসাহী ছিলেন। বই, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, পুতুল ও মুখোশের সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি শিল্পী তো ছিলেন শুধু চিত্রপটের নয়, শাড়ি, ফতুয়া, উত্তরীয় এসবের নকশা করেছেন, বই ও পত্রিকার প্রচ্ছদ, অলংকরণ করেছেন, পোস্টার, লিফলেট, সড়কসজ্জা, তোরণ, অক্ষর ও কবিতার চরণ দিয়ে জামা-কাপড় অর্থাৎ দৃশ্যমান মাধ্যমের প্রায় সর্বত্র তার সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, কবিতা নির্মাণ করেছেন বেশ স্বাভাবিক ছন্দে। জাপনে ভ্রমণের ওপর তার টোকিও শীর্ষক কবিতা বেশ চলমান যেমন- সম্মুখে পশ্চাতে ত্রিতলে- দ্বিতলে/ ভূতলে সমতলে বধমান ট্রেনে/ হলুদ সবুজ রুপালি লাল/ রকমারি লাইনে/... রোদবৃষ্টির সকাল-সন্ধ্যায়/ মাদকতাময়ী স্বর্ণাভা সুন্দরী/ নিয়ন বাতির জ্বালা আর নেভা/ টোকিও এখন ব্যস্ত নগরী। শিল্পীদের মধ্যে সাহিত্যচর্চা কম দেখা যায়। তুবও তাদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম মতুর্জা বশীর, রশীদ চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, ধীরেন বোস এবং আরও অনেকেই উল্লেখ্য। শিল্পী মুতর্জা বশীর বহুদিন থেকে কবিতা সৃষ্টি করে চলেছেন। তাঁর কবিতাগ্রন্থ এসরেনুর কথা মনে পড়ে। ইত্তেফাক পত্রিকায় নিয়মিত শিল্পকলাবিষয়ক গবেষণা ও বিশ্লেষণ ধর্মী শিল্প রচনা করেছেন- যা শিল্প বোদ্ধাদের মনোযোগ কেড়েছে। শিল্পী হাশেম খান গল্প ও শিল্পকলা রচনা- বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য উপহার দিয়েছেন। শিল্পী রফিকুন নবীও এরকম রচনা ছাড়া ভ্রমণ কথা, রম্য কথন ইত্যাদি লিখে সাহিত্যে সংযোজন করেছেন। কবিতায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী পাঠককে বিমোহিত করছিলেন। তার কথা, অনুভূতি ও ভাষা মনের অতল থেকে ভেসে আসা যেন জল রঙে শব্দের বন্ধনে কবিতার বর্ণে প্রতিভাস হয়ে উঠে এসেছে। কবি আদ্যোপান্ত চিত্রশিল্পের সুসময় কবিতার প্রেমে ও মানুষের ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিলেন। তাই তিনি তার মর্ম উচ্চারণে বলে ওঠেন, নিয়ে যেতে পারি, রাজেশ্বরীর মধুকণ্ঠে/ রবীন্দ্রনাথের গান/ নিয়ে যেতে পারি শচীনকত্তার/ গোধূলিবেলার তানে/ নিয়ে যেতে পারি যা কিছু আছে/ ভালোবাসিবার জন্য শুধু পারি না নিতে ভালোবাসা তোমার/ হারায় রঙের প্লাবনে/ শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরী তার সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের জন্য চিরদিন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৪

শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরীর শি ল্পিত কবিতা

রবিউল হুসাইন

image

মা, মাটি ও মানুষের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ ২০১৪ সালে বড্ড অভাবনীয়, অদৃষ্টপূর্ব এবং অতি আকস্মিক একটি বেদনাময় শিল্প-ঘটনা। একজন পরিপূর্ণ সবুজ মনের শিল্পীর তিরোধান একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে সত্যিই অচিন্ত্যনীয়। সচরাচর কখনো দেখা যায় না, আশাও বোধ করি ভবিষ্যতে এমনটি আর দেখা নাও যেতে পারে। রং, রেখা, প্রকৃতি, মানুষ, পাখি, মেঘ, নদী আর গ্রাম নিয়ে তাঁর শিল্প-নৌকা উজ্জ্বল আর বর্ণময় জগৎ পরিভ্রমণ করে ফিরতো দর্শকদের মন ও মননে। বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর এত সবুজ রঙ-নির্ভর সৃষ্টিতে এমন গভীরতায় মগ্ন হতে দেখা যায় না। চাষি, মাঝি, শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাস্তবনির্ভর প্রতিচ্ছবি যেমন প্রাকৃতিক এক অনায়াস-লব্ধ সাবলীল ভঙ্গি ও করণ-কৌশলে তার সতেজ তুলি ও চিত্রপটে বর্ণ-সুষময়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠতো তেমনি করে কাগজে-কলমে অস্ফুট কবিতার পঙ্ক্তিতেও বাঙময় হয়ে ধরা দিতে দেখা গেছে। এই বিষয়ে তিনি নিভৃতচারী এক প্রচারবিমুখী স্বভাবের আড়ালে থাকা কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কবিতা সৃষ্টি আত্মকথা-মাধ্যম স্বগোতক্তি, দিনলিপি লেখার মতন। এই কথকতা প্রকাশিত হওয়ার পর আর তা কবির নিজের অধীনে থাকে না। সবার জন্য যখন সেটি যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষমও সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন তাই কবিতা হয়ে ওঠে। পাঠকের মনের কথা কবিতার চরণে রূপ নেয়, কবি তখন আপন হয়ে ওঠেন। তার কবিতা শব্দের অদৃশ্য এক মনো সেতুতে সৃষ্টির মাধুর্যে মনোময়তা খুঁজে পায়। শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরী চিত্রশিল্প সৃষ্টি যেমন করেছেন, এর পাশাপাশি কবিতাশিল্পও নির্মাণ করতে মনোযোগ দিয়েছেন এবং অনেকদিন ধরে এমনটি করে গেছেন। তাই এপ্রিল ১০, ২০১৩ এই দিনে বৈশাখ ১৪২০ শীর্ষক কবিতায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঘটনায় প্রদীপ্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুপ্রাণিত সিক্ত সেই সময়ের প্রজন্ম চত্বর নিয়ে অনায়াসে উচ্চারণ করেন মৃদু কণ্ঠে- ‘মানুষের মাঝে আলো জ্বালাতে/ চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আক্ষেপ ছিল তার অন্ধকারে/ যতবার আলো জ্বালাতে চাই/ নিভে যায় বারে বারে।/... তাড়াতে পারিনি সরীসৃপ/ তুলেছে ফণা, ঢেকেছে সূর্যদীপ। কাটাতেই হবে এই ঘোর আমানিশা/প্রজন্ম চত্বরই দেখাবে আমাদের/ নতুন পথের দিশা।’ এমনই কবির আশা ও স্বপ্ন। শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরী এক শিল্পাড়ং-এ মালদ্বীপ গিয়েছিলেন অনেক শিল্পীদের সঙ্গে। সেখানকার অর্থাৎ মালদ্বীপের নীল সমুদ্র, অবারিত জলরাশি, তার মধ্যে ভাসমান পদ্মফুলের পাতার মতো দ্বীপসমূহ- সেই প্রেক্ষিতে বেশ

কয়েকটি কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। ছোট ছোট কথা, নিবিড় অনুভূতি, রৌদ্রাভ নিঃসীম দিগন্তরেখা আকাশ ও সমুদ্রের মিলিত প্রান্তর, প্রকৃতির মধ্যে মানুষের সামান্য বিন্দুবৎ অস্তিত্ব এইসব নিয়ে কবির হার্দ্র্য উচ্চারণ- বান্দোসে নেমেছে সন্ধ্যা/ চারদিকে আলোকোজ্জ্বল/ দ্বীপমালা/ গভীর গাঢ় নীলে/ কথোপকথন/.... ফেনিল ঢেউয়ের/ আসা আর যাওয়া-/ আকাশের অগুনতি তারা ছুঁয়ে/ দক্ষিণ সমুদ্র থেকে ভেসে আসা শীতল হাওয়া। নিসর্গের মধ্যে শুধু জল আর জল, বাতাস, মেঘ, আকাশ- এসবের মধ্যে কবি হারিয়ে যান অবলীলায় অবধারিতভাবে অনায়াসে। কবি চোখ মেলে দূরদৃষ্টিতে অবলোকন করেন- ‘ওখানে জলের ফিরোজা রঙ/ খড়ে ছাওয়া কুটিরের সারি-/ যেখানে অতিথির/ অবকাশ যাপন।/... অদূরেই বিশাল সমুদ্র জাহাজ/ আলোয় আলোয় ভাসমান/ ইন্ডিগো আকাশে নাচে/ বর্ণালি সাম্পান।’ কবির কথামালা সরাসরি, স্বাধীন ও প্রত্যক্ষ। কোনো ভণিতা, প্রাককথন বা ভূমিকা নেই। পাঠকের মর্মমূলে নিবিড়ভাবে বেজে ওঠে শব্দবীণা। তারা শিউরে ওঠেন যেন নিজেরা নিজস্ব ও একান্ত ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন। এইভাবে কবি শব্দে শব্দে এক শব্দসেতু নির্মাণ করে তার ওপর দিয়ে সবাইকে পারপারের ব্যবস্থা করে দেন। সব কথা মাথায় নিয়ে বলা যায়- শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী কবি কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে ওঠেন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের গভীর অনুভবে তার স্বচ্ছ ও স্পষ্ট উচ্চারণে। তার নজর ছিল সর্বত্র ও ওজর ছিল সর্বজনীনয়তায় ব্যাপ্ত। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, বন্ধনশিল্প, ভাস্কর্য, ভ্রমণশিল্প, লোকশিল্প, মৃৎশিল্প, বয়নশিল্প, প্রায় প্রতিটি শিল্প মাধ্যমে উৎসাহী ছিলেন। বই, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, পুতুল ও মুখোশের সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি শিল্পী তো ছিলেন শুধু চিত্রপটের নয়, শাড়ি, ফতুয়া, উত্তরীয় এসবের নকশা করেছেন, বই ও পত্রিকার প্রচ্ছদ, অলংকরণ করেছেন, পোস্টার, লিফলেট, সড়কসজ্জা, তোরণ, অক্ষর ও কবিতার চরণ দিয়ে জামা-কাপড় অর্থাৎ দৃশ্যমান মাধ্যমের প্রায় সর্বত্র তার সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, কবিতা নির্মাণ করেছেন বেশ স্বাভাবিক ছন্দে। জাপনে ভ্রমণের ওপর তার টোকিও শীর্ষক কবিতা বেশ চলমান যেমন- সম্মুখে পশ্চাতে ত্রিতলে- দ্বিতলে/ ভূতলে সমতলে বধমান ট্রেনে/ হলুদ সবুজ রুপালি লাল/ রকমারি লাইনে/... রোদবৃষ্টির সকাল-সন্ধ্যায়/ মাদকতাময়ী স্বর্ণাভা সুন্দরী/ নিয়ন বাতির জ্বালা আর নেভা/ টোকিও এখন ব্যস্ত নগরী। শিল্পীদের মধ্যে সাহিত্যচর্চা কম দেখা যায়। তুবও তাদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম মতুর্জা বশীর, রশীদ চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, ধীরেন বোস এবং আরও অনেকেই উল্লেখ্য। শিল্পী মুতর্জা বশীর বহুদিন থেকে কবিতা সৃষ্টি করে চলেছেন। তাঁর কবিতাগ্রন্থ এসরেনুর কথা মনে পড়ে। ইত্তেফাক পত্রিকায় নিয়মিত শিল্পকলাবিষয়ক গবেষণা ও বিশ্লেষণ ধর্মী শিল্প রচনা করেছেন- যা শিল্প বোদ্ধাদের মনোযোগ কেড়েছে। শিল্পী হাশেম খান গল্প ও শিল্পকলা রচনা- বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য উপহার দিয়েছেন। শিল্পী রফিকুন নবীও এরকম রচনা ছাড়া ভ্রমণ কথা, রম্য কথন ইত্যাদি লিখে সাহিত্যে সংযোজন করেছেন। কবিতায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী পাঠককে বিমোহিত করছিলেন। তার কথা, অনুভূতি ও ভাষা মনের অতল থেকে ভেসে আসা যেন জল রঙে শব্দের বন্ধনে কবিতার বর্ণে প্রতিভাস হয়ে উঠে এসেছে। কবি আদ্যোপান্ত চিত্রশিল্পের সুসময় কবিতার প্রেমে ও মানুষের ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিলেন। তাই তিনি তার মর্ম উচ্চারণে বলে ওঠেন, নিয়ে যেতে পারি, রাজেশ্বরীর মধুকণ্ঠে/ রবীন্দ্রনাথের গান/ নিয়ে যেতে পারি শচীনকত্তার/ গোধূলিবেলার তানে/ নিয়ে যেতে পারি যা কিছু আছে/ ভালোবাসিবার জন্য শুধু পারি না নিতে ভালোবাসা তোমার/ হারায় রঙের প্লাবনে/ শিল্পী-কবি কাইয়ুম চৌধুরী তার সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের জন্য চিরদিন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।