আত্মবিনাশের কবি সিলভিয়া প্লাথ

কামরুল ইসলাম

The fountains are dry and the roses over.

Incense of death...

A blue mist is dragging the lake.

(The Manor Garden)

সিলভিয়া প্লাথ ছিলেন আমেরিকান কনফেশনাল কবিদের অন্যতম। সাহিত্যে কনফেশন বলতে বোঝায় সেই আত্মজীবনীমূলক রচনা (প্রকৃত কিংবা কাল্পনিক), যেখানে কারো জীবনের অন্তরঙ্গ কিংবা গুপ্ত আখ্যান প্রকাশিত হয়। সাহিত্যে এ ধরনের অন্তর্ভুক্তি ‘কনফেশনস অব সেইন্ট অগাস্টাইন’ (সি.এডি ৪০০) প্রকাশের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়, যেখানে দেখা যায় অগাস্টাইনের কৈশোরক পাপ এবং যৌবনের লাম্পট্য থেকে ক্রমশ খ্রিশ্চিয়ান ধর্মে দীক্ষা এবং দেহের ওপর আত্মার বিজয়ের এক নিপুণ চিত্র। এর পর আমরা দেখি টমাস ডি কুয়েন্সি’র ‘কনফেশনস অব অ্যান ইংলিশ অপিয়াম ইটার’ (১৮২২), যেখানে দেখা যায় লেখকের বাল্যজীবন এবং পরবর্তীতে ড্রাগাসক্ত হওয়ার কাহিনি। এছাড়া জাঁ জ্যাক রুশোর একান্ত আত্মজীবনী ‘কনফেশনস’ (১৭৮২-৮৯)-এর কথাও আমরা জানি। আঁদ্রে জিদ ‘ইফ ইট ডাই’তে (১৯২০ এবং ১৯২৪) এ ধরনের ফর্ম ব্যবহার করেছিলেন তার নিজের বাল্য থেকে বিবাহ পর্যন্ত সময়ের কাহিনি বর্ণনায়। এছাড়া বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমরা আমেরিকায় ‘কনফেশন ম্যাগাজিন’ও দেখেছি, যেখানে প্রকাশিত হতো ¯œায়ুতাড়িত আত্মজীবনীমূলক গল্প-উপন্যাস। 

ফরাসি সিম্বলিস্ট কবিদের প্রভাব, বিশেষভাবে বোদলেয়ার, র্যাঁবো এবং লাফর্গ, যারা Ôused poetry as a means of illuminating psychic regions in themselves that would otherwise have been kept concealed’গত শতকের গোড়ার দিকে অনেক কবির কবিতায়ই ফুটে ওঠে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকগুলো। এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ এজরা পাউন্ডের ‘ক্যান্টোজ’ এবং ইয়েটস-এর কিছু কবিতায় সেইসব অবক্ষয়ের চিত্র রয়েছে। এইসব কবিদের কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভূতিজাত ক্রাইসিস খুব কমই এসেছে, সামষ্টিক অনুভূতিজাত ক্রাইসিস-এর প্রামাণিক ও সাবলীল চিত্রায়ণই মুখ্য হয়ে উঠেছে বলা যায়।পরবর্তীতে এলিয়টের ‘ইমপার্সোনালিটি থিওরি’র বিপরীতে আমেরিকায় একদল কবির কবিতায় দেখা গেল একান্তই ব্যক্তিগত কষ্ট-যন্ত্রণা কিংবা নিজস্ব মানসিক অবস্থার রূপায়ন। এধরনের কবিতাকে আমেরিকান ক্রিটিক এম. এল রজেনথাল‘কনফেকশনাল’ নামে অভিহিত করেন। 

আমেরিকান কবিতায় অটোবায়োগ্রাফিক্যাল স্টাইলের উদগাতা কবি রবার্ট লাওয়েল। বিট কবিতার খোলামেলা ভাব এবং উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস-এর গাদ্যিক চপলতা তাঁকে এ ব্যাপারে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। রবার্ট লাওয়েলের এই নতুন কবিতা প্রায় সব আমেরিকান কবিদেরই প্রভাবিত করেছিল। এদের মধ্যে বিশেষভাবে একদল কবির ওপর এই প্রভাব সুদূরপ্রসারি হয়েছিল- যাদেরকে ‘কনফেশনাল পোয়েটস’ বলা হতো এবং এঁদের মধ্যে অ্যান সেক্সটন এবং সিলভিয়া প্লাথ ছিলেন সরাসরি তাঁর ছাত্রী। আরেকজন কবি জন বেরিম্যানও প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁর ‘ড্রিম সঙস’ (১৯৬৪, ১৯৬৮)-এ দেখা যায় আত্ম-প্রক্ষেপণের বিচিত্র বর্ণালি এবং ব্যক্তিগত ‘কমিট-ট্র্যাজিক ল্যামেন্ট’। উল্লেখ্য, এই তিনজন কবিই আত্মহননের মধ্য দিয়ে নিদারুণ যন্ত্রণাময় জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। আমাদের এই সময়ে আজকে আর্ট, নিউরোসিস এবং ম্যাডনেস-এর একটি সংযোগ-সূত্র স্থাপিত হয়েছে। এই নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত, ঘাত-প্রতিঘাতময়, বিচ্ছিন্নতার ছোবল-সন্ত্রাসে বিপর্যদস্ত, আত্মপীড়নে উদ্বাস্তু মানস-চেতনা থেকে স্নায়ু-বৈকল্যের কিংবা মনোবিকারগ্রস্ততার তথা পাগলামির জায়গাটি খুব বেশি দূরে নয়। যে-কারণে পৃথিবীর অনেক কবি-শিল্পীকেই আমরা শেষমেশ পাগল হয়ে যেতে দেখি কিংবা আত্মহননের মাধ্যমে জীবনযন্ত্রণার অবসান ঘটাতে দেখেছি। এই ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার ব্যাপারটিকে আমরা স্মরণে আনতে পারি কিংবা জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর (আত্মহত্যা?)বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।

আমেরিকান কবি ও ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্লাথ মৃত্য, নৈঃসঙ্গ্য ও আত্মবিনাশের শিল্পী হিসেবেই অধিক পরিচিত। স্মিথ কলেজের অভূতপূর্ব সাফল্য সত্ত্বেও তাঁর ভেতরে এক চরম মানসিক সঙ্কট দেখা দেয় এবং সে-সময়ে তাকে মানসিক হাসপাতালেও কাটাতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। প্লাথ তাঁর কবিতায় আত্মহননের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন। Lady Lazarus ও Daddy কবিতা দু’টিমূলত মৃত্যু তথা আত্মহননের দিকে যাত্রার ইঙ্গিত ‘অ্যাজ আ কাইন্ড অব রিবার্থ অব আইডেন্টিটি’।

ÔDying

is an art, like everything else.

I do it exceptionally well.

I do it so it feels like hell.

I do it so it feels real.

I guess you could sayI’ve a call.

(Lady Lazarus). 

Lady Lazarus ও Daddy

এই দু’টি কবিতায় সরাসরি প্রকাশিত লেখকের ব্যক্তিগত অবসেশন এতটাই গভীর ও ব্যাপৃত যে সমালোচকরা তাঁকে  ‘কনফেশনাল পোয়েটস’-এর তালিকায় রেখেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।

নিচের কটি লাইন যেন আত্মহননের শেষ অঙ্ক- So daddy, I’m finally through.

The black telephone’s off at the root,

The voices just can’t worm through.

( Daddy)

সিলভিয়া প্লাথ ছিলেন ব্রিটিশ রাজকবি (১৯৩০-১৯৯৮) টেড হিউজের (অ্যাডওয়ার্ড জেমস টেড হিউজ) প্রথম স্ত্রী। অস্ট্রিয়ান

এবং জার্মান পিতা-মাতার সন্তান প্লাথ ১৯৩২ সালের ২৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্সের বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে স্মিথ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি ফুলব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এখানে অধ্যয়নকালে ইংরেজ কবি টেড হিউজের সাথে তাঁর পরিচয় হয় এবং ১৯৫৬ সালের ১৬ জুন তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে চলে যান।১৯৬২ সালে এই দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটে। প্লাথ তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় বিষণœতা ও অবসাদে ভুগেছেন। তাঁকে বেশ ঘন ঘন ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি(ইসিটি)দিয়ে চিকিৎসা করা হতো। এবং শেষে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে নেন । উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালের প্রারম্ভে যখন প্লাথ ও অ্যান সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪) বোস্টন ভার্সিটিতে তাঁর (টেড হিউজ) সেমিনারে নিয়মিত, সে-সময়ে তরুণী প্লাথকে তিনি এভাবে স্মরণ করেছেন- Air of maddening docility… I sensed her abashment and distinction and never guessed her appalling and triumphant fulfillment. বিয়ের প্রথম বছর দুজনেই স্বপ্নিল সুখের এক রঙিন কুটির থেকে আকাশে উড়িয়েছিলেন প্রজাপতির সবুজ উপাখ্যান। দুই কবি একে অপরকে উৎসাহ দিয়েছেন কবিতার নানা বিষয়ে। ক্যামব্রিজের লেখাপড়া শেষ হলে তিনি কিছুকাল স্মিথ কলেজে পড়ানোর কাজে নিউ ইংল্যান্ডে কাটান।  

তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘দ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ (১৯৬০) প্রকাশিত হলে তা সমালোচকদের নজরে আসে এবং এ-সময়ে পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়।‘দ্য কলোসাস’-এ আমরা দেখি কবির একান্ত নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ এবং তার নিয়তির অনিবার্যতা,যা গড়ে উঠেছিল পিতার সাথে তার বিশেষ সম্পর্কের সুতো ধরেই।রোডস-এর বিশাল কলোসাস- ফাদার-ফিগার হিসেবে চিহ্নিত সেই অতিকায় স্ট্যাচু যা দাঁড়িয়ে আছে একটি পোতাশ্রয়ের পাশে, কিন্তু কবিতায় তিনি এটাকে একটি ধ্বংসস্তূপ হিসেবে দেখিয়েছেন।এই কবিতায় তিনি মৃত পিতাকে সম্বোধন করেছেন এবং নিজের জীবনের অর্থ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন- Thirty years I have laboured/To dredge the silt from your throat/I am none the wiser. ওই সালে তিনি আবার লন্ডনে ফিরে যান। ১৯৬০ এবং ১৯৬২-তে কন্যা ফ্রিয়েদা এবং পুত্র নিকোলাসের জন্ম। ঠিক এ-সময়ে হিউজ অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়লে প্লাথের জীবনে নেমে আসে দুর্নিবার অন্ধকার। অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণায় তিনি দুটো শীত তাঁদের কান্ট্রিহাউস ডেবনেই কাটান। 

সিলভিয়া প্লাথের বাবা অটো প্লাথ মারা যান ১৯৪০-এ, যখন সিলভিয়ার বয়স মাত্র ৮ বছর। প্রুসিয়ান এই জার্মান অধ্যাপক ছিলেন প্লাথের মায়ের শিক্ষক এবং ২১ বছরের বড়ো। জীববিজ্ঞানী অটো প্লাথ সাংসারিক জীবনে ছিলেন একজন স্বৈরাচার। তিনি তাঁর স্ত্রীকে কখনো স্বাধীনতা দেননি, বরং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছেন ক্রমাগত আর এইসব অত্যাচার ও নির্যাতন সিলভিয়ার নরম মনে প্রভাব ফেলেছিল দারুণভাবে। জেদী,রুক্ষ মেজাজী এই বিজ্ঞানী নিজের মতামতকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন, যা তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। 

প্লাথের বাবার মৃত্যু হয়েছিল ডায়াবেটিসে, কিন্তু তিনি ডাক্তারের কোনো পরামর্শ ছাড়াই ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁর ক্যান্সার হয়েছে, যাতে পরিবারের সবাই তাঁর সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। এভাবে বাড়িতে দুরারোগ্য রোগের কথা বলে যে-কয় বছর তিনি বেঁচে ছিলেন সে-কয় বছর তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা নিদারুণ মানসিক কষ্টে অতিবাহিত করেছিলেন। ‘ড্যাডি’ কবিতায় তাঁর বিবাহ, বাল্যকাল এবং তাঁর পিতা-মাতার বিয়ের নানাবিধ যন্ত্রণাকাতর অনুভূতির কথা রয়েছে। 

টেড হিউজের আচরণ তাঁর কাছে এতই বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল যে পরিশেষে তিনি আইনসম্মতভাবে আলাদ হয়ে যান। তাঁর মায়ের যন্ত্রণাময় জীবনের পুনরাবৃত্তি তাঁর জীবনে, দুটো সন্তান নিয়ে একাকী পথচলা এবং পিতাকে নিয়ে তার নানামুখী গভীর ক্রোধ তাঁর কবিতায় দেখা দেয়। ‘ড্যাডি’ কবিতায় তিনি তাঁর পিতাকে তাঁর স্বামীর সাথে তুলনা করেছেন  এবং তাঁর নষ্ট বিবাহ-জীবনের জন্যও দায়ী করেছেন অনেকখানি। দুর্বিসহ জীবনের দাঁড় টানা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। 

জীবনের শেষ কয়েক মাস দুর্মর মানসিক ঘোরের মধ্যে তিনি যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, সেগুলোই মূলত প্লাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁর এই সময়ের লেখা কবিতাগুলো ‘এরিয়েল’-এ স্থান পায়। এরিয়েল’কে বলা হয়ে থাকে ‘দ্য ডায়েলেক্ট অব ডেথ’; এই সংকলনের কবিতাগুলোয় মৃত্যুই প্রধান থিম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মুখোশে মৃত্যুর পদচারণায় উন্মুখর এই গ্রন্থ। জীবনের চারদিকে যখন ঘনিয়ে আসে নগ্ন অন্ধকার, কোনোছিুই যখন আর দেখা যায় না, না শান্তি, না সুখ কিংবা একটুখানি প্রেমময় কণ্ঠস্বর আশ্বাসের, বেঁচে থাকার মতো মন্ত্রে ভরপুর, তখন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তির পথ করে নেয়। কম্পাউন্ড-সিম্বলের মধ্য দিয়ে প্লাথ তাঁর একধরনের হিমশীতল,বিফল বিচ্ছন্নতা,নিঃসঙ্গ,অর্থহীন অস্তিত্বেরে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।তাঁর কবিতায় চাঁদ কিংবা ছায়াপথ বন্ধ্যত্ব কিংবা হতাশার ইমেজ নিয়ে হাজির হয়।কখনো কোনো সৌন্দর্যও যেন ধ্বংসের ইঙ্গিতে ভাস্বর হয়ে উঠছে। অনেক ইমেজের যুক্তস্বর উদ্ভাসিত করে তাঁর মনোজগতের মানচিত্র।

This is the light of the mind,cold and planetary.

The trees of the mind are black.The light is blue.

এরিয়েল-এর কবিতাগুলোয় ব্যক্তিগত জগতের যে নকশা দেখি আমরা তার অধিকাংশ পথই মৃত্যুর দিকে হেলানো।এখানে এই বইয়ের কবিতাগুলোর দুটি পথ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি পথের কবিতায় আমরা খুঁজে পাই তার পরিচয়ের অনুভূতিমালা এবং অন্যের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। দ্বিতীয় গ্রুপের কবিতাগুলো চলে গেছে মৃত্যুর ভয়াল সুড়ঙ্গ পথে এবং এক অদ্ভুত বিশ্বাসের ভেতর দিয়ে যেখানে পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে।

‘এরিয়েল’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পরে। রবার্ট লাওয়েল তাঁর এই সংকলনের কবিতাগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন: তাঁর এই কবিতাগুলো এক বিস্ময়কর রূপান্তর যা অন্য সমস্ত কবিতাকে অতিক্রম করেছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর আত্মহত্যার পর তার লেখনী এবং ব্যক্তিজীবন নিয়ে অনেকেই মেতে ওঠেন এবং দশ  মাসে ‘এরিয়েল’ বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৫০০০ কপি। উল্লেখ্য, তাঁর ‘দ্য কলোসাস’-এর কবিতাগুলো তাঁর পরের কবিতাগুলোর মতো অতোটা শক্তিশালী নয়, যদিও এটি নিঃসন্দেহে একটি ইম্প্রেসিভ কাব্য-সংকলন। তবে ‘দ্য কলোসাস’-এর বেশকিছু কবিতায় তিনি পরের কবিতার মতোই শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। এদের মধ্যে ‘অল দ্য ডেড ডিয়ারস’ ‘ব্ল্যাক বুক ইন রেইনি ওয়েদার’ এবং ‘সুইসাইড অফ এগ রক’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে ‘ক্রসিং দ্য ওয়াটার’ এবং ‘উইন্টার ট্রিজ’ নামে তাঁর আরো দুটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিভিন্ন সময়ের গদ্য লেখার সংকলন ‘জনি প্যানিক অ্যান্ড দ্য বাইবেল অব ড্রিমস’। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য কালেক্টেড পোয়েমস’ যেখানে তাঁর অনেক অপ্রকাশিত কবিতার খোঁজখবর পাওয়া যায়।এই বই প্রকাশিত হলে ১৯৮২ সালে তিনি মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার পান। ফবার অ্যান্ড ফেবার থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘সিলেক্টড পোয়েমস’।

প্লাথ এবং অ্যান সেক্সটন অনেকবার আত্মহত্যা নিয়ে গল্প-গুজব করেছেন। আত্মহত্যার বিষয়টি তখন তাদের কাছে কোনো সিরিয়াস বিষয় ছিল না। এই দুই কবি জীবন থেকে মুক্তির এই সহজ অথচ কঠিন পথটিই বেছেনিয়েছিলেন। অ্যান সেক্সটন অনেকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর গাড়ির ভেতরে কার্বন-মনোক্সাইড ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শেষ করেছিলেন।জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মানসিক অস্থিরতায় ভুগেছেন। থেরাপিস্ট ড. মার্টিনের পরামর্শে তিনি তাঁর কবিতায় জীবনের অস্থিরতা, মানসিক আবেগ ও যন্ত্রণাময় অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে থাকেন। ১৯৬৭ সালে এই কবি তাঁর কবিতার বই ‘লিভ অর ডাই’-এর জন্য পুলিৎজার প্রাইজ পেয়েছিলেন।আমেরিকান কবি হার্ট ক্রেন মাত্র ৩২ বছর বয়সে নৌকো থেকে মেক্সিকান উপসাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মাঝে মাঝে এই কবির কথা মনে হলে আমি নৌকো,জাহাজ, উপসাগর কিংবা সমুদ্রের মধ্যে আত্মহননের একটি যোগসূত্র খুঁজি। জন বেরিম্যান ১৯৭২ সালে একটি ব্রিজ থেকে ৯০ ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

১৯৬৩ সালে প্লাথের আত্মহত্যার পর টেড হিউজ প্রায় তিন বছর কোনো কবিতাই লেখেননি। তিন বছর পরে অবশ্য তিনি প্রচুর লেখালেখি করেন। প্লাথের সাথে তাঁর বিবাহের ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর দীর্ঘ নীরবতার পর ১৯৯৮ সালে ‘বার্থডে লেটার্স’-এর কবিতাগুলোতে প্রথম মুখ খোলেন। তাঁর কবিতা বিষয়ে টেড হিউজ লিখেছেন: She faced a task in herself and her poetry is the record of her progress in the task… The poems are chapter in a mythology.

মৃত্যুর আগে‘এরিয়েল’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে ডেস্কে রেখে যান। টেড হিউজ কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন এই পাণ্ডুলিপিতে, যা নিয়ে অনেক প্রতিবাদও হয়েছিল। তবে অনেকেই বলেছেন, তিনি বরং প্লাথের ব্যাপারে এই ক্ষেত্রে বেশ সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও যখন সারা পৃথিবীর মানুষ ঔৎসুক্য-ভরে তাঁর কবিতা পাঠ করে, আবিষ্কার করে বিস্ময়কর অনেককিছু, তাঁকে নিয়ে চলে লেখালেখি কিংবা  গবেষণা,তখন একথা ভাবতেই হয় যে, তিনি একটু একটু করে মৃত্যু পান করে শেষে আত্মহননের অনিবার্য চিতায় রেখে গেছেন কবিতার অমৃত পুষ্পাঞ্জলি অনাগত সময়ের জন্য।তিনি কখনো নিজেকে কোনো সুস্থির বাতাবরণে প্রশান্তভাবে বাঁধতে পারেননি। ২০১৩ সালে যখন প্লাথের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে, তখন তাঁর জীবনের গল্পের পাত্র-পাত্রীদের প্রায় সবাই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। প্লাথের মা অরেলিয়া প্লাথ ১৯৭৫ সালে তাঁর উল্লেখযোগ্য চিঠিগুলো নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করেন “Letters Home” নামে। টেড হিউজের পিতা-মাতার কাছে লেখা  প্লাথের একটি চিঠিতে তিনি তাঁদের ছেলের সাথে তাঁর বসবাসের যন্ত্রণাকে গোপন করেছেন।

তাঁর মা অরেলিয়া ১৯৯৪ সালে মারা যান। প্লাথের মৃত্যুর পর টেড হিউজ তার ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নেন; ১৯৭০ সালে পুনরায় বিয়ে করেন ক্যারোল অরচার্ডকে এবং ব্রিটিশ পোয়েট লরিয়েট হন (১৯৮৪-১৯৯৮)। তাঁর পুত্র নিকোলাস হিউজ আলাস্কায় মৎস্যবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার সময় ২০০৯ সালে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।যতোদূর জানা যায়, কবি ও চিত্রকর  মেয়ে ফ্রিয়েদা এখনো বেঁচে আছেন এবং ওয়েলস-এ বসবাস করছেন।জনৈক সমালোচক মতে-In Hughes, Plath found not only a husband and companion but also a deep and exceedingly mercurial subject.

আমরা কবির অন্যতম সমালোচক জর্জ স্টেডের সাথে একমত যে, যখনই তার কবিতা পড়তে যাই,তখনই আমরা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করি- ‘We canot avoid reading her poetry and brooding over her life.’

ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে তিনি লিখেছিলেন তাঁর  আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্য বেল জার’ (১৯৬৩)। এই উপন্যাসের নায়িকা ইস্থার গ্রিনউডও আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এখানে আমরা একজন যন্ত্রণাকাতর তরুণীর বিদীর্ণ হৃদয়ের রক্তক্ষরণের দৃশ্য দেখি- 

The silence depressed me.It was not the silence of silence.It was my own silence…I thought Iwould swim out until I was too tired to swim back. As I paddled on, my heartbeat boomed like a dull motor in my ears.I am I am I am.বাবার অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ তাঁর মা নিয়মিত স্লিপিং পিল খেতেন।প্লাথও স্লিপিং পিল-এ আসক্ত ছিলেন এবংনিয়মিত ধূমপান করতেন (যা তিনি আগে পছন্দ করতেন না)। তাঁর জীবনের শেষ সাত মাসের দুর্বিসহতার ইতিহাস আমরা দেখতে পাই তাঁর চিঠিপত্রে।তখন তিনি এবং হিউজ আলাদা হয়ে গেছেন। অসুস্থ চিন্তার মধ্যে ডুবে, তিনি এক চরম জ্বরগ্রস্ত মানুষের মতো ঘোরের মধ্যে অদ্ভুত জিনিসপত্র দেখতে পাচ্ছিলেন- অসংখ্য হাত-পা, মুণ্ডু কাটা মানুষের মুখ, মৌমাছি কিংবা হিমশীতল চাঁদের অবয়ব। তিনি তখন একই সাথে মাতা, লেখক এবং অনেকটা ভয়ভাবনাহীন, বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী  মানুষ। জীবনে যার তখন কোনো ইতিবাচক ভাবনা নেই।হিউজ তখন সপ্তাহে একবার নিয়মিতভাবে আসতেন ঠিক সান্তা ক্লজের মতো, যেন তিনি মহাপ্রলয়ের বার্তা নিয়ে আসছেন।আমরা আশ্চর্য হই এই ভেবে যে,এই মানসিক বিপর্যয়ের সময়েই তিনি এরিয়েল-এর বিখ্যাত কবিতাগুলো লিখে ফেলেন।ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য এবং সেগুলো বিবিসিতে রেকর্ড-এর জন্য ছেলেমেয়েরা জেগে ওঠার আগেই,প্রভাতের নীল আলোয় তিনি সেসব কবিতা লিখে ফেলতেন।এই কবিতাগুলো কিন্তু বিভ্রান্ত মনের কোনো সংগূঢ় বিষয় নয়, যেরকমভাবে একসময় ভাবা হতো। এই কবিতাগুলোর মধ্যে চরম যন্ত্রণা কিংবা চরম আনন্দেরও উদ্ভাসন দেখা যায়।এই যে সবকিছুর পরিবেষ্টনে,যন্ত্রণার বৈচিত্র্যে সৃষ্টির  অনিন্দ্য কারুকাজ, যা তার প্রতিভার বিস্ময়কর চূড়াবিহারী অভিজ্ঞান,যা আমাদের কবিতা নিয়ে পূর্বভাবনাকে তছনছ করে দেয়।আমরা আগেই বলেছি এরিয়েল-এর কবিতাগুলো তিনি ঊষালগ্নে রচনা করেছেন। লেখালেখি শেষ করতেন যখন পাখির কলতানে কিংবা শিশুদের হৈচৈ-এ  মুখরিত হতো সকালের শীতল বাতাস- The child’s cry / Melts in the wall.১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে যখন হিউজের সাথে তাঁর পুনর্মিলনের সব আশা ভেস্তে গেল, তিনি কোর্ট গ্রিনের বসবাস গুটিয়ে  লন্ডনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠলেন, যেখানে কবি ইয়েটস তাঁর বালকবেলায় বসবাস করেছিলেন।এসময় তিনি তাঁর মাকে লিখলেন Well, here I am! Safely in Yeats’ house! My bedroom will be my study—it faces the rising sun. ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ তাঁর শেষ বিস্তৃত চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর চিকিৎসককে What appalls me is the return of my madness, my paralysis, my fear & vision of the worst—cowardly withdrawal, a mental hospital, lobotomies.এক সপ্তাহ পরে তিনি গ্যাসের চুল্লিতে মাথা ঢুকিয়ে ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।উল্লেখ্য, সিলভিয়া প্লাথ প্রথমবার  ২০ বছর বয়সে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি বেশ কিছু কলোত্তীর্ণ কবিতা লিখে গেছেন, যা তাঁর যন্ত্রণা-পীড়িত হৃদয় থেকে উৎসারিত। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভ্যুতে জয়েস ক্যারল ওটস প্লাথ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন- one of the most celebrated and controversial of postwar poets writing in English. তাঁর যন্ত্রণাময় জীবনের গল্প ও মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে ২০০৩ সালে  যে বায়োপিক নির্মিত হয়, তা আমাদের দারূণভাবে আলোড়িত করে, সেখানে আমরা এক নি:সঙ্গ,হতাশাগ্রস্ত কবির বিচূর্ণ আত্মার বিনম্র ক্রন্দনের চিত্ররূপ দেখি।

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৪

আত্মবিনাশের কবি সিলভিয়া প্লাথ

কামরুল ইসলাম

image

সিলভিয়া প্লাথ

The fountains are dry and the roses over.

Incense of death...

A blue mist is dragging the lake.

(The Manor Garden)

সিলভিয়া প্লাথ ছিলেন আমেরিকান কনফেশনাল কবিদের অন্যতম। সাহিত্যে কনফেশন বলতে বোঝায় সেই আত্মজীবনীমূলক রচনা (প্রকৃত কিংবা কাল্পনিক), যেখানে কারো জীবনের অন্তরঙ্গ কিংবা গুপ্ত আখ্যান প্রকাশিত হয়। সাহিত্যে এ ধরনের অন্তর্ভুক্তি ‘কনফেশনস অব সেইন্ট অগাস্টাইন’ (সি.এডি ৪০০) প্রকাশের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়, যেখানে দেখা যায় অগাস্টাইনের কৈশোরক পাপ এবং যৌবনের লাম্পট্য থেকে ক্রমশ খ্রিশ্চিয়ান ধর্মে দীক্ষা এবং দেহের ওপর আত্মার বিজয়ের এক নিপুণ চিত্র। এর পর আমরা দেখি টমাস ডি কুয়েন্সি’র ‘কনফেশনস অব অ্যান ইংলিশ অপিয়াম ইটার’ (১৮২২), যেখানে দেখা যায় লেখকের বাল্যজীবন এবং পরবর্তীতে ড্রাগাসক্ত হওয়ার কাহিনি। এছাড়া জাঁ জ্যাক রুশোর একান্ত আত্মজীবনী ‘কনফেশনস’ (১৭৮২-৮৯)-এর কথাও আমরা জানি। আঁদ্রে জিদ ‘ইফ ইট ডাই’তে (১৯২০ এবং ১৯২৪) এ ধরনের ফর্ম ব্যবহার করেছিলেন তার নিজের বাল্য থেকে বিবাহ পর্যন্ত সময়ের কাহিনি বর্ণনায়। এছাড়া বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমরা আমেরিকায় ‘কনফেশন ম্যাগাজিন’ও দেখেছি, যেখানে প্রকাশিত হতো ¯œায়ুতাড়িত আত্মজীবনীমূলক গল্প-উপন্যাস। 

ফরাসি সিম্বলিস্ট কবিদের প্রভাব, বিশেষভাবে বোদলেয়ার, র্যাঁবো এবং লাফর্গ, যারা Ôused poetry as a means of illuminating psychic regions in themselves that would otherwise have been kept concealed’গত শতকের গোড়ার দিকে অনেক কবির কবিতায়ই ফুটে ওঠে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকগুলো। এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ এজরা পাউন্ডের ‘ক্যান্টোজ’ এবং ইয়েটস-এর কিছু কবিতায় সেইসব অবক্ষয়ের চিত্র রয়েছে। এইসব কবিদের কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভূতিজাত ক্রাইসিস খুব কমই এসেছে, সামষ্টিক অনুভূতিজাত ক্রাইসিস-এর প্রামাণিক ও সাবলীল চিত্রায়ণই মুখ্য হয়ে উঠেছে বলা যায়।পরবর্তীতে এলিয়টের ‘ইমপার্সোনালিটি থিওরি’র বিপরীতে আমেরিকায় একদল কবির কবিতায় দেখা গেল একান্তই ব্যক্তিগত কষ্ট-যন্ত্রণা কিংবা নিজস্ব মানসিক অবস্থার রূপায়ন। এধরনের কবিতাকে আমেরিকান ক্রিটিক এম. এল রজেনথাল‘কনফেকশনাল’ নামে অভিহিত করেন। 

আমেরিকান কবিতায় অটোবায়োগ্রাফিক্যাল স্টাইলের উদগাতা কবি রবার্ট লাওয়েল। বিট কবিতার খোলামেলা ভাব এবং উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস-এর গাদ্যিক চপলতা তাঁকে এ ব্যাপারে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। রবার্ট লাওয়েলের এই নতুন কবিতা প্রায় সব আমেরিকান কবিদেরই প্রভাবিত করেছিল। এদের মধ্যে বিশেষভাবে একদল কবির ওপর এই প্রভাব সুদূরপ্রসারি হয়েছিল- যাদেরকে ‘কনফেশনাল পোয়েটস’ বলা হতো এবং এঁদের মধ্যে অ্যান সেক্সটন এবং সিলভিয়া প্লাথ ছিলেন সরাসরি তাঁর ছাত্রী। আরেকজন কবি জন বেরিম্যানও প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁর ‘ড্রিম সঙস’ (১৯৬৪, ১৯৬৮)-এ দেখা যায় আত্ম-প্রক্ষেপণের বিচিত্র বর্ণালি এবং ব্যক্তিগত ‘কমিট-ট্র্যাজিক ল্যামেন্ট’। উল্লেখ্য, এই তিনজন কবিই আত্মহননের মধ্য দিয়ে নিদারুণ যন্ত্রণাময় জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। আমাদের এই সময়ে আজকে আর্ট, নিউরোসিস এবং ম্যাডনেস-এর একটি সংযোগ-সূত্র স্থাপিত হয়েছে। এই নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত, ঘাত-প্রতিঘাতময়, বিচ্ছিন্নতার ছোবল-সন্ত্রাসে বিপর্যদস্ত, আত্মপীড়নে উদ্বাস্তু মানস-চেতনা থেকে স্নায়ু-বৈকল্যের কিংবা মনোবিকারগ্রস্ততার তথা পাগলামির জায়গাটি খুব বেশি দূরে নয়। যে-কারণে পৃথিবীর অনেক কবি-শিল্পীকেই আমরা শেষমেশ পাগল হয়ে যেতে দেখি কিংবা আত্মহননের মাধ্যমে জীবনযন্ত্রণার অবসান ঘটাতে দেখেছি। এই ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার ব্যাপারটিকে আমরা স্মরণে আনতে পারি কিংবা জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর (আত্মহত্যা?)বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।

আমেরিকান কবি ও ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্লাথ মৃত্য, নৈঃসঙ্গ্য ও আত্মবিনাশের শিল্পী হিসেবেই অধিক পরিচিত। স্মিথ কলেজের অভূতপূর্ব সাফল্য সত্ত্বেও তাঁর ভেতরে এক চরম মানসিক সঙ্কট দেখা দেয় এবং সে-সময়ে তাকে মানসিক হাসপাতালেও কাটাতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। প্লাথ তাঁর কবিতায় আত্মহননের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন। Lady Lazarus ও Daddy কবিতা দু’টিমূলত মৃত্যু তথা আত্মহননের দিকে যাত্রার ইঙ্গিত ‘অ্যাজ আ কাইন্ড অব রিবার্থ অব আইডেন্টিটি’।

ÔDying

is an art, like everything else.

I do it exceptionally well.

I do it so it feels like hell.

I do it so it feels real.

I guess you could sayI’ve a call.

(Lady Lazarus). 

Lady Lazarus ও Daddy

এই দু’টি কবিতায় সরাসরি প্রকাশিত লেখকের ব্যক্তিগত অবসেশন এতটাই গভীর ও ব্যাপৃত যে সমালোচকরা তাঁকে  ‘কনফেশনাল পোয়েটস’-এর তালিকায় রেখেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।

নিচের কটি লাইন যেন আত্মহননের শেষ অঙ্ক- So daddy, I’m finally through.

The black telephone’s off at the root,

The voices just can’t worm through.

( Daddy)

সিলভিয়া প্লাথ ছিলেন ব্রিটিশ রাজকবি (১৯৩০-১৯৯৮) টেড হিউজের (অ্যাডওয়ার্ড জেমস টেড হিউজ) প্রথম স্ত্রী। অস্ট্রিয়ান

এবং জার্মান পিতা-মাতার সন্তান প্লাথ ১৯৩২ সালের ২৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্সের বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে স্মিথ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি ফুলব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এখানে অধ্যয়নকালে ইংরেজ কবি টেড হিউজের সাথে তাঁর পরিচয় হয় এবং ১৯৫৬ সালের ১৬ জুন তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে চলে যান।১৯৬২ সালে এই দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটে। প্লাথ তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় বিষণœতা ও অবসাদে ভুগেছেন। তাঁকে বেশ ঘন ঘন ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি(ইসিটি)দিয়ে চিকিৎসা করা হতো। এবং শেষে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে নেন । উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালের প্রারম্ভে যখন প্লাথ ও অ্যান সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪) বোস্টন ভার্সিটিতে তাঁর (টেড হিউজ) সেমিনারে নিয়মিত, সে-সময়ে তরুণী প্লাথকে তিনি এভাবে স্মরণ করেছেন- Air of maddening docility… I sensed her abashment and distinction and never guessed her appalling and triumphant fulfillment. বিয়ের প্রথম বছর দুজনেই স্বপ্নিল সুখের এক রঙিন কুটির থেকে আকাশে উড়িয়েছিলেন প্রজাপতির সবুজ উপাখ্যান। দুই কবি একে অপরকে উৎসাহ দিয়েছেন কবিতার নানা বিষয়ে। ক্যামব্রিজের লেখাপড়া শেষ হলে তিনি কিছুকাল স্মিথ কলেজে পড়ানোর কাজে নিউ ইংল্যান্ডে কাটান।  

তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘দ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ (১৯৬০) প্রকাশিত হলে তা সমালোচকদের নজরে আসে এবং এ-সময়ে পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়।‘দ্য কলোসাস’-এ আমরা দেখি কবির একান্ত নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ এবং তার নিয়তির অনিবার্যতা,যা গড়ে উঠেছিল পিতার সাথে তার বিশেষ সম্পর্কের সুতো ধরেই।রোডস-এর বিশাল কলোসাস- ফাদার-ফিগার হিসেবে চিহ্নিত সেই অতিকায় স্ট্যাচু যা দাঁড়িয়ে আছে একটি পোতাশ্রয়ের পাশে, কিন্তু কবিতায় তিনি এটাকে একটি ধ্বংসস্তূপ হিসেবে দেখিয়েছেন।এই কবিতায় তিনি মৃত পিতাকে সম্বোধন করেছেন এবং নিজের জীবনের অর্থ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন- Thirty years I have laboured/To dredge the silt from your throat/I am none the wiser. ওই সালে তিনি আবার লন্ডনে ফিরে যান। ১৯৬০ এবং ১৯৬২-তে কন্যা ফ্রিয়েদা এবং পুত্র নিকোলাসের জন্ম। ঠিক এ-সময়ে হিউজ অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়লে প্লাথের জীবনে নেমে আসে দুর্নিবার অন্ধকার। অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণায় তিনি দুটো শীত তাঁদের কান্ট্রিহাউস ডেবনেই কাটান। 

সিলভিয়া প্লাথের বাবা অটো প্লাথ মারা যান ১৯৪০-এ, যখন সিলভিয়ার বয়স মাত্র ৮ বছর। প্রুসিয়ান এই জার্মান অধ্যাপক ছিলেন প্লাথের মায়ের শিক্ষক এবং ২১ বছরের বড়ো। জীববিজ্ঞানী অটো প্লাথ সাংসারিক জীবনে ছিলেন একজন স্বৈরাচার। তিনি তাঁর স্ত্রীকে কখনো স্বাধীনতা দেননি, বরং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছেন ক্রমাগত আর এইসব অত্যাচার ও নির্যাতন সিলভিয়ার নরম মনে প্রভাব ফেলেছিল দারুণভাবে। জেদী,রুক্ষ মেজাজী এই বিজ্ঞানী নিজের মতামতকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন, যা তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। 

প্লাথের বাবার মৃত্যু হয়েছিল ডায়াবেটিসে, কিন্তু তিনি ডাক্তারের কোনো পরামর্শ ছাড়াই ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁর ক্যান্সার হয়েছে, যাতে পরিবারের সবাই তাঁর সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। এভাবে বাড়িতে দুরারোগ্য রোগের কথা বলে যে-কয় বছর তিনি বেঁচে ছিলেন সে-কয় বছর তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা নিদারুণ মানসিক কষ্টে অতিবাহিত করেছিলেন। ‘ড্যাডি’ কবিতায় তাঁর বিবাহ, বাল্যকাল এবং তাঁর পিতা-মাতার বিয়ের নানাবিধ যন্ত্রণাকাতর অনুভূতির কথা রয়েছে। 

টেড হিউজের আচরণ তাঁর কাছে এতই বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল যে পরিশেষে তিনি আইনসম্মতভাবে আলাদ হয়ে যান। তাঁর মায়ের যন্ত্রণাময় জীবনের পুনরাবৃত্তি তাঁর জীবনে, দুটো সন্তান নিয়ে একাকী পথচলা এবং পিতাকে নিয়ে তার নানামুখী গভীর ক্রোধ তাঁর কবিতায় দেখা দেয়। ‘ড্যাডি’ কবিতায় তিনি তাঁর পিতাকে তাঁর স্বামীর সাথে তুলনা করেছেন  এবং তাঁর নষ্ট বিবাহ-জীবনের জন্যও দায়ী করেছেন অনেকখানি। দুর্বিসহ জীবনের দাঁড় টানা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। 

জীবনের শেষ কয়েক মাস দুর্মর মানসিক ঘোরের মধ্যে তিনি যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, সেগুলোই মূলত প্লাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁর এই সময়ের লেখা কবিতাগুলো ‘এরিয়েল’-এ স্থান পায়। এরিয়েল’কে বলা হয়ে থাকে ‘দ্য ডায়েলেক্ট অব ডেথ’; এই সংকলনের কবিতাগুলোয় মৃত্যুই প্রধান থিম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মুখোশে মৃত্যুর পদচারণায় উন্মুখর এই গ্রন্থ। জীবনের চারদিকে যখন ঘনিয়ে আসে নগ্ন অন্ধকার, কোনোছিুই যখন আর দেখা যায় না, না শান্তি, না সুখ কিংবা একটুখানি প্রেমময় কণ্ঠস্বর আশ্বাসের, বেঁচে থাকার মতো মন্ত্রে ভরপুর, তখন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তির পথ করে নেয়। কম্পাউন্ড-সিম্বলের মধ্য দিয়ে প্লাথ তাঁর একধরনের হিমশীতল,বিফল বিচ্ছন্নতা,নিঃসঙ্গ,অর্থহীন অস্তিত্বেরে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।তাঁর কবিতায় চাঁদ কিংবা ছায়াপথ বন্ধ্যত্ব কিংবা হতাশার ইমেজ নিয়ে হাজির হয়।কখনো কোনো সৌন্দর্যও যেন ধ্বংসের ইঙ্গিতে ভাস্বর হয়ে উঠছে। অনেক ইমেজের যুক্তস্বর উদ্ভাসিত করে তাঁর মনোজগতের মানচিত্র।

This is the light of the mind,cold and planetary.

The trees of the mind are black.The light is blue.

এরিয়েল-এর কবিতাগুলোয় ব্যক্তিগত জগতের যে নকশা দেখি আমরা তার অধিকাংশ পথই মৃত্যুর দিকে হেলানো।এখানে এই বইয়ের কবিতাগুলোর দুটি পথ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি পথের কবিতায় আমরা খুঁজে পাই তার পরিচয়ের অনুভূতিমালা এবং অন্যের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। দ্বিতীয় গ্রুপের কবিতাগুলো চলে গেছে মৃত্যুর ভয়াল সুড়ঙ্গ পথে এবং এক অদ্ভুত বিশ্বাসের ভেতর দিয়ে যেখানে পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে।

‘এরিয়েল’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পরে। রবার্ট লাওয়েল তাঁর এই সংকলনের কবিতাগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন: তাঁর এই কবিতাগুলো এক বিস্ময়কর রূপান্তর যা অন্য সমস্ত কবিতাকে অতিক্রম করেছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর আত্মহত্যার পর তার লেখনী এবং ব্যক্তিজীবন নিয়ে অনেকেই মেতে ওঠেন এবং দশ  মাসে ‘এরিয়েল’ বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৫০০০ কপি। উল্লেখ্য, তাঁর ‘দ্য কলোসাস’-এর কবিতাগুলো তাঁর পরের কবিতাগুলোর মতো অতোটা শক্তিশালী নয়, যদিও এটি নিঃসন্দেহে একটি ইম্প্রেসিভ কাব্য-সংকলন। তবে ‘দ্য কলোসাস’-এর বেশকিছু কবিতায় তিনি পরের কবিতার মতোই শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। এদের মধ্যে ‘অল দ্য ডেড ডিয়ারস’ ‘ব্ল্যাক বুক ইন রেইনি ওয়েদার’ এবং ‘সুইসাইড অফ এগ রক’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে ‘ক্রসিং দ্য ওয়াটার’ এবং ‘উইন্টার ট্রিজ’ নামে তাঁর আরো দুটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিভিন্ন সময়ের গদ্য লেখার সংকলন ‘জনি প্যানিক অ্যান্ড দ্য বাইবেল অব ড্রিমস’। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য কালেক্টেড পোয়েমস’ যেখানে তাঁর অনেক অপ্রকাশিত কবিতার খোঁজখবর পাওয়া যায়।এই বই প্রকাশিত হলে ১৯৮২ সালে তিনি মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার পান। ফবার অ্যান্ড ফেবার থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘সিলেক্টড পোয়েমস’।

প্লাথ এবং অ্যান সেক্সটন অনেকবার আত্মহত্যা নিয়ে গল্প-গুজব করেছেন। আত্মহত্যার বিষয়টি তখন তাদের কাছে কোনো সিরিয়াস বিষয় ছিল না। এই দুই কবি জীবন থেকে মুক্তির এই সহজ অথচ কঠিন পথটিই বেছেনিয়েছিলেন। অ্যান সেক্সটন অনেকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর গাড়ির ভেতরে কার্বন-মনোক্সাইড ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শেষ করেছিলেন।জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মানসিক অস্থিরতায় ভুগেছেন। থেরাপিস্ট ড. মার্টিনের পরামর্শে তিনি তাঁর কবিতায় জীবনের অস্থিরতা, মানসিক আবেগ ও যন্ত্রণাময় অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে থাকেন। ১৯৬৭ সালে এই কবি তাঁর কবিতার বই ‘লিভ অর ডাই’-এর জন্য পুলিৎজার প্রাইজ পেয়েছিলেন।আমেরিকান কবি হার্ট ক্রেন মাত্র ৩২ বছর বয়সে নৌকো থেকে মেক্সিকান উপসাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মাঝে মাঝে এই কবির কথা মনে হলে আমি নৌকো,জাহাজ, উপসাগর কিংবা সমুদ্রের মধ্যে আত্মহননের একটি যোগসূত্র খুঁজি। জন বেরিম্যান ১৯৭২ সালে একটি ব্রিজ থেকে ৯০ ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

১৯৬৩ সালে প্লাথের আত্মহত্যার পর টেড হিউজ প্রায় তিন বছর কোনো কবিতাই লেখেননি। তিন বছর পরে অবশ্য তিনি প্রচুর লেখালেখি করেন। প্লাথের সাথে তাঁর বিবাহের ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর দীর্ঘ নীরবতার পর ১৯৯৮ সালে ‘বার্থডে লেটার্স’-এর কবিতাগুলোতে প্রথম মুখ খোলেন। তাঁর কবিতা বিষয়ে টেড হিউজ লিখেছেন: She faced a task in herself and her poetry is the record of her progress in the task… The poems are chapter in a mythology.

মৃত্যুর আগে‘এরিয়েল’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে ডেস্কে রেখে যান। টেড হিউজ কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন এই পাণ্ডুলিপিতে, যা নিয়ে অনেক প্রতিবাদও হয়েছিল। তবে অনেকেই বলেছেন, তিনি বরং প্লাথের ব্যাপারে এই ক্ষেত্রে বেশ সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও যখন সারা পৃথিবীর মানুষ ঔৎসুক্য-ভরে তাঁর কবিতা পাঠ করে, আবিষ্কার করে বিস্ময়কর অনেককিছু, তাঁকে নিয়ে চলে লেখালেখি কিংবা  গবেষণা,তখন একথা ভাবতেই হয় যে, তিনি একটু একটু করে মৃত্যু পান করে শেষে আত্মহননের অনিবার্য চিতায় রেখে গেছেন কবিতার অমৃত পুষ্পাঞ্জলি অনাগত সময়ের জন্য।তিনি কখনো নিজেকে কোনো সুস্থির বাতাবরণে প্রশান্তভাবে বাঁধতে পারেননি। ২০১৩ সালে যখন প্লাথের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে, তখন তাঁর জীবনের গল্পের পাত্র-পাত্রীদের প্রায় সবাই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। প্লাথের মা অরেলিয়া প্লাথ ১৯৭৫ সালে তাঁর উল্লেখযোগ্য চিঠিগুলো নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করেন “Letters Home” নামে। টেড হিউজের পিতা-মাতার কাছে লেখা  প্লাথের একটি চিঠিতে তিনি তাঁদের ছেলের সাথে তাঁর বসবাসের যন্ত্রণাকে গোপন করেছেন।

তাঁর মা অরেলিয়া ১৯৯৪ সালে মারা যান। প্লাথের মৃত্যুর পর টেড হিউজ তার ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নেন; ১৯৭০ সালে পুনরায় বিয়ে করেন ক্যারোল অরচার্ডকে এবং ব্রিটিশ পোয়েট লরিয়েট হন (১৯৮৪-১৯৯৮)। তাঁর পুত্র নিকোলাস হিউজ আলাস্কায় মৎস্যবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার সময় ২০০৯ সালে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।যতোদূর জানা যায়, কবি ও চিত্রকর  মেয়ে ফ্রিয়েদা এখনো বেঁচে আছেন এবং ওয়েলস-এ বসবাস করছেন।জনৈক সমালোচক মতে-In Hughes, Plath found not only a husband and companion but also a deep and exceedingly mercurial subject.

আমরা কবির অন্যতম সমালোচক জর্জ স্টেডের সাথে একমত যে, যখনই তার কবিতা পড়তে যাই,তখনই আমরা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করি- ‘We canot avoid reading her poetry and brooding over her life.’

ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে তিনি লিখেছিলেন তাঁর  আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্য বেল জার’ (১৯৬৩)। এই উপন্যাসের নায়িকা ইস্থার গ্রিনউডও আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এখানে আমরা একজন যন্ত্রণাকাতর তরুণীর বিদীর্ণ হৃদয়ের রক্তক্ষরণের দৃশ্য দেখি- 

The silence depressed me.It was not the silence of silence.It was my own silence…I thought Iwould swim out until I was too tired to swim back. As I paddled on, my heartbeat boomed like a dull motor in my ears.I am I am I am.বাবার অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ তাঁর মা নিয়মিত স্লিপিং পিল খেতেন।প্লাথও স্লিপিং পিল-এ আসক্ত ছিলেন এবংনিয়মিত ধূমপান করতেন (যা তিনি আগে পছন্দ করতেন না)। তাঁর জীবনের শেষ সাত মাসের দুর্বিসহতার ইতিহাস আমরা দেখতে পাই তাঁর চিঠিপত্রে।তখন তিনি এবং হিউজ আলাদা হয়ে গেছেন। অসুস্থ চিন্তার মধ্যে ডুবে, তিনি এক চরম জ্বরগ্রস্ত মানুষের মতো ঘোরের মধ্যে অদ্ভুত জিনিসপত্র দেখতে পাচ্ছিলেন- অসংখ্য হাত-পা, মুণ্ডু কাটা মানুষের মুখ, মৌমাছি কিংবা হিমশীতল চাঁদের অবয়ব। তিনি তখন একই সাথে মাতা, লেখক এবং অনেকটা ভয়ভাবনাহীন, বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী  মানুষ। জীবনে যার তখন কোনো ইতিবাচক ভাবনা নেই।হিউজ তখন সপ্তাহে একবার নিয়মিতভাবে আসতেন ঠিক সান্তা ক্লজের মতো, যেন তিনি মহাপ্রলয়ের বার্তা নিয়ে আসছেন।আমরা আশ্চর্য হই এই ভেবে যে,এই মানসিক বিপর্যয়ের সময়েই তিনি এরিয়েল-এর বিখ্যাত কবিতাগুলো লিখে ফেলেন।ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য এবং সেগুলো বিবিসিতে রেকর্ড-এর জন্য ছেলেমেয়েরা জেগে ওঠার আগেই,প্রভাতের নীল আলোয় তিনি সেসব কবিতা লিখে ফেলতেন।এই কবিতাগুলো কিন্তু বিভ্রান্ত মনের কোনো সংগূঢ় বিষয় নয়, যেরকমভাবে একসময় ভাবা হতো। এই কবিতাগুলোর মধ্যে চরম যন্ত্রণা কিংবা চরম আনন্দেরও উদ্ভাসন দেখা যায়।এই যে সবকিছুর পরিবেষ্টনে,যন্ত্রণার বৈচিত্র্যে সৃষ্টির  অনিন্দ্য কারুকাজ, যা তার প্রতিভার বিস্ময়কর চূড়াবিহারী অভিজ্ঞান,যা আমাদের কবিতা নিয়ে পূর্বভাবনাকে তছনছ করে দেয়।আমরা আগেই বলেছি এরিয়েল-এর কবিতাগুলো তিনি ঊষালগ্নে রচনা করেছেন। লেখালেখি শেষ করতেন যখন পাখির কলতানে কিংবা শিশুদের হৈচৈ-এ  মুখরিত হতো সকালের শীতল বাতাস- The child’s cry / Melts in the wall.১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে যখন হিউজের সাথে তাঁর পুনর্মিলনের সব আশা ভেস্তে গেল, তিনি কোর্ট গ্রিনের বসবাস গুটিয়ে  লন্ডনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠলেন, যেখানে কবি ইয়েটস তাঁর বালকবেলায় বসবাস করেছিলেন।এসময় তিনি তাঁর মাকে লিখলেন Well, here I am! Safely in Yeats’ house! My bedroom will be my study—it faces the rising sun. ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ তাঁর শেষ বিস্তৃত চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর চিকিৎসককে What appalls me is the return of my madness, my paralysis, my fear & vision of the worst—cowardly withdrawal, a mental hospital, lobotomies.এক সপ্তাহ পরে তিনি গ্যাসের চুল্লিতে মাথা ঢুকিয়ে ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন।উল্লেখ্য, সিলভিয়া প্লাথ প্রথমবার  ২০ বছর বয়সে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি বেশ কিছু কলোত্তীর্ণ কবিতা লিখে গেছেন, যা তাঁর যন্ত্রণা-পীড়িত হৃদয় থেকে উৎসারিত। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভ্যুতে জয়েস ক্যারল ওটস প্লাথ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন- one of the most celebrated and controversial of postwar poets writing in English. তাঁর যন্ত্রণাময় জীবনের গল্প ও মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে ২০০৩ সালে  যে বায়োপিক নির্মিত হয়, তা আমাদের দারূণভাবে আলোড়িত করে, সেখানে আমরা এক নি:সঙ্গ,হতাশাগ্রস্ত কবির বিচূর্ণ আত্মার বিনম্র ক্রন্দনের চিত্ররূপ দেখি।