তাঁর ছবির ভুবন

মইনুল ইসলাম জাবের

তিনি যেখানটিতে বসে ছবির প্ল্যান করেন, আর প্রচ্ছদ, অলংকরণ- এসব করতেন, সেটির অংশীদার ছিল আর অনেকে। ডাইনিং টেবিল বলেই- খাবার সময় পুরো বাড়ি শিল্পীর জায়গাটি দখল করত। আর সন্ধ্যাকালে বাড়ির নানা কালের নানা শিশুরা শিল্পীর ওই জায়গাটিকেই তাদের পড়া তৈরির যোগ্যস্থান ভাবত। মাঝে মাঝে জল রং কিংবা ড্রইংয়ে মগ্ন শিল্পী কাজ ছেড়ে পাশের শিক্ষার্থীকে পড়া বুঝিয়ে দিতেন, কিংবা শিক্ষার্থী যদি শিশুটি হয় তবে তার আবদার রাখতে স্থান ছেড়ে উঠে পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে ‘শিশু ভোলানাথ’ কিংবা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ থেকে পড়ে সেরে আবার ওই স্থানে জলে কালিতে ডুব দিতেন। অনাদিকালেরই গল্প বোধ হয় ছিল এটা! ভাবি এখন, এ বাড়িতে এমন কোনও শিশু নেই যে শিল্পীর শিল্পকর্মের এমন সহযোগী হয়নি। আমিও ছিলাম একসময়, হঠাৎ একরাতে না ফেরার দেশে চলে যাবার আগ পর্যন্তই ছিলাম।

আজিমপুরের যে বাড়িতে আমাদের বাসা- সেটি বয়সে অর্ধশতাব্দি পেরিয়েছে। আমার বাবা-মা দোতলার এই ফ্ল্যাটে থেকেছেন বহুকাল। শেখ সাহেব বাজার এলাকার ছাপড়া মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণমুখী গলি দিয়ে এগোলে গাছগাছালি ছাওয়া সাড়ে তিনতলা বাড়িটি চিনতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। পুরনো বাড়ি। স্থাপত্যশৈলীতে হয়ত অসাধারণ নয়। তবু বাইরের আঙ্গিকে জলযাত্রার জাহাজ-আকৃতি বেশ লাগে। বড় লোহার গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দা ছাড়িয়ে দোতলার সিঁড়ি মাড়িয়ে শেষে আমাদের ফ্ল্যাট। দরজা খুললেই ড্রইং কাম ডাইনিং কাম চিত্রশালা।

মাত্র ১৬/১৪ ফ্ল্যাটের ঘরটিতে কত কিছুর সমাহার! অভ্যর্থনার সোফা, সেন্টার টেবিল, ক্রোকারিজের কাবার্ড আর ছয়জনার ডাইনিং টেবিল তো কেবল আসবাবের ফিরিস্তি! এছাড়া রয়েছে দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো অ্যক্রিলিক, জলরং আর তেলরং-এর শিল্পকর্ম। ঘর সংলগ্ন বারান্দার ধারেই রাখা ছিল কাঠের ইজেল আর তার পাশেই সারে সারে শোয়ান ক্যানভাস। এগুলো থাকত কাজের অপেক্ষায়! বাবা যেহেতু গ্রাফিক ডিজাইনারও, প্রচ্ছদ, পোস্টার, মনোগ্রাম, লোগো- এসব করার কাগজ, কালি-তুলি, অ্যান্টিকাটার, কাটার-বোর্ড, এসবও এই ড্রইং রুমেই রাখা থাকত। ডাইনিং টেবিল সংলগ্ন একটি কাঠের তাকে ওসবের স্থান। ডাইনিং টেবিলটির বর্ণনা একটু পরেই দিচ্ছি। তার আগে বলে নিই সেন্টার টেবিলটির কথা- যেটি কাগজ আর সদ্য প্রেস ছাড়া নতুন বইয়ে থকত ঠাসা-বাবার প্রচ্ছদ করা বইয়ে।

ঘরটিতে আলোর অভাব নেই কোনও! বারান্দা সংলগ্ন দরজাটি ছাড়াও ঢাউস ঢাউস দুটি জানালা থেকে সূর্য ঠিকরোয়। গাছগাছালি ছাওয়া বাড়ি বলে বাবার কাজের জায়গার ডানের জানালাগুলো দিয়ে বাইরে তাকালেই সবুজের সমারোহ মন উদাস করে তোলে। ঢাকা শহরে থেকেও যেন শহরের বাইরে এ বাড়িটি। আম-কাঁঠাল-নারকেল-মেহেদি কোন গাছটি নেই বাড়িটির উঠোনে? বাবার ছবির সবুজের সমারোহ কী এই জানালা গলে পড়া সবুজেরই প্রতিবিম্ব?

ডাইনিং টেবিলটির দিকে তাকান যাক এবার। টেবিলটির অর্ধেক এবং লাগোয়া দুটো চেয়ারও ঠাসা কাগজ আর বইয়ে। একদম ডান কোণ সংলগ্ন চেয়ারটিতে বাবা বসে আঁকতেন। তাই টেবিলের এই প্রান্তে একটি কাটিং ম্যাট রাখা। তার সামনে একটি ফুলদানিতে ফুল, পাশে জলরং আর ক্রেওনের বাক্স, রুলার, কলমদানি, তুলিদানি ইত্যাদি। কত কত তুলি! ১, ২, ৩, ১০, ১১, ১২- কত কত নম্বর! কিছু তুলি তেলের, কিছু জলের আর অ্যাক্রিলিকের। আর আছে চাইনিজ ইঙ্কের শিশি ও ট্রেসিং পেপারের রোল। প্রতিদিন এদের ইস্তেমাল হতো প্রতিকৃতি আঁকার কাজে। টেবিলে যে কাগজের স্তূপের কথা বললাম তা একটু

ঝাড়লেই বেরুত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে আনিসুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদের ফটোগ্রাফ। প্রায় প্রতি হপ্তায় পত্রিকা কিংবা প্রচ্ছদপটে বাবার আঁকা নানা জনের প্রতিকৃতির উৎপাদন টেবিলের এই কোণটি থেকেই হতো।

আর হত প্রচ্ছদ, পোস্টার, ইলাস্ট্রেশন এবং মাঝে মাঝে নানান লেখা- যা কখনও স্মৃতিসিঞ্চন, কখনও ছড়া-কবিতা! এই কোণে বসে বাবা প্রথমে সারতেন তাঁর লে-আউট। তারপর তুলি কাগজের লড়াই শেষে উঠে পড়তেন তিনি। সেন্টার টেবিলে হার্ডবোর্ড বিছিয়ে বড় আর্ট পেপারে এঁটে দিতেন বাইকালার- মাল্টিকালার কাজ ও তার কালার স্কিম। ব্যাপারটি যত সহজে বলা গেল তত সহজ ছিল না মোটেই। কারণ বাবার কাজ ঠিক বসলাম আর হয়ে গেল পর্যায়ের নয়। আঁকার আগে অনেক পড়ার ও ভাবার অবসর মিলতে হতো তাঁর। তাই এক একটি কাজের জন্য প্রকাশক-লেখকদের ফোন সামলাতে এবং আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু বা কখনো-সখনো আগামি হপ্তার তারিখ দেওয়ার কাজটি করতে হতো এবাড়ির অধিবাসীদের। একতলা দোতলার একান্নবর্তিতার জন্যে বাড়ির প্রায় দশ-বারোজন অধিবাসীই অন্তত বাইরের মানুষের তোপ সামলাতে কাইয়ুমকে প্রায়শই সাহায্য করতেন।

ড্রইংরুমটির আরেক উপকরণ ছিল গান শোনার স্টেরিও সেটটি। গান-সিনেমা-বই-এ তিনটি যদি না থাকত কাইয়ুমও থাকতেন না। এগুলো তাঁর হাড়মজ্জার অংশ। কাজ করতে করতে, কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে! ‘নানা গানের মালা পরতে’ কাইয়ুম খুব ভালবাসতেন। তাঁর ‘লং প্লে’ সংগ্রহের কথা অনেকেই জানেন। সময়ের দাবিতে প্রযুক্তির পরিবর্তনে আইপ্যাড আর সিডি দখল করেছিল তাদের জায়গা। সন্তোষ সেনগুপ্ত, সুবিনয় রায়ের রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি কিংবা আধুনিক গান, আমজাদ আলী খাঁর সরোদ বাদন, কমলা ঝরিয়ার গান, শচীন কর্তার রেকর্ড থেকে শুরু করে পশ্চিমের হ্যারি বেলাফেন্টে, ন্যাটকিং কোল, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, কিংবা বেটোফেন, মোজার্ট বা শোপাঁর কঞ্চার্তো- এসব কিছুই কাইয়ুমকে প্রাণিত করত। গেল শতকের বিশের দশকের সংগীত কিংবা সত্তরের বিট জেনারেসনের গান- এসবই কাইয়ুমের আঁকার রসদ। সেই সঙ্গে সিনেমা। জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক, ফজলে লোহানী প্রমুখের বন্ধুতার সূত্রে কাইয়ুম একসময় চিত্রপরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। আলমগীর কবিরের সঙ্গে সিনে পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। অবজারভার গ্রুপের শিল্প-সম্পাদক হিসেবে চিত্রালী পত্রিকার সৌকর্য বর্ধনের দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। এতসব কিছুর পেছেনে ছিল ঢাকার প্রথম জীবনের মোহাম্মদ কিবরিয়া কিংবা নিতুন কুণ্ডুর সঙ্গে ‘সিজন টিকিটে সিনেমা’ দেখার নেশা। গেগরি পেক, গ্রেস কেলি, অড্রে হেপবার্ন, দিলিপ কুমার, সায়রা বানু, হাম্ফ্রি বোগার্ট- এঁরা সবাই কাইয়ুমের ছবিরও হিরো। প্রচ্ছদ কিম্বা পেইন্টিং যা কিছুই আঁকতেন তাতেই তাঁর সিনেমার নায়ক-নায়িকায় সম্মোহিত সত্তা প্রতিভাত হতো। ছবিতে নানা রঙের সন্নিবেশে কিংবা মানব-মানবীর উপস্থাপনে কাইয়ুম তাই সবশেষে জীবনের জয়গানই গাইতেন। সিনেমার জাঁকজমক হয়ত থাকত না, থাকত না উচ্ছ্বাসের আতিশয্য কিন্তু গ্রামীণ জীবন, লোকজ মটিফ কিম্বা প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধার সরল চিত্রেণের পেছনে দিগি¦জয়ী নায়কেরাই ফুটে উঠত যেন।

গ্রামীণ মানুষ রয়েছেন কাইয়ুমের ছবির এক বিরাট অংশজুড়ে। গ্রামকে কাইয়ুম সেই পনের-ষোল বছর বয়সে ছেড়ে এলেও ছবির মাঝে সেই স্মৃতি ধরে রেখে ছিলেন জীবনের শেষদিন অব্দি। গ্রাম থেকেই নেওয়া উপকরণ, গ্রামের চাষী-মাঝি-পাতাকুড়ানি কিংবা অপেক্ষারতা মা-জায়া- এঁরা সবাই কাইয়ুমের ছবিতে আসেন কখনো মুক্তিযোদ্ধা, কখনো নবান্নের আনন্দে উদ্বেলিত চরিত্ররূপে। এতসব চরিত্রের উপস্থাপন আবার হয় চিরায়ত লোকসম্ভার- পিঠার ছাঁচ, নৌকার গলুই এর কারুকাজ, হাতে টেপা পুতুলের ফর্ম, নকশীকাঁথা কিংবা জামদানির নকশা ইত্যাদির সংশ্লেষণে। মূর্ত এবং বিমূর্তের সংযোগ-সম্ভাবনাকে বার বার কাইয়ুম চিত্রাবদ্ধ করতে চেয়েছেন- মাধ্যম তার প্রচ্ছদ হোক কিংবা ক্যনভাস। বাঙলার লোকজ কলায় অবগাহন করা অপরাপর সব শিল্পীর বিপরীতে ঠিক এই খানটাতেই কাইয়ুমের পথ অন্য দিকে বেঁকে গেছে। গ্রাম ও তার শিল্পকে ভালবেসে তার সাথে দর্শকের শুধুমাত্র পরিচয় করিয়ে দেবার কাজটিতে থেমে থাকেননি তিনি কখনো। বরং তার নির্যাস গায়ে মেখে নতুন করে তাকে বুঝে নিয়ে তারপর নিজের মত করে তার প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন এবং অবশ্যই মেতেছেন চিত্রতলে মূর্ত ও বিমূর্তের সংস্থিতি স্থাপনের কঠিন খেলায়। গ্রামকে তাঁর স্মৃতির সম্ভার করে, শহুরে কিন্তু শিল্পীত দৃষ্টিতে তাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। হাজার বছরের গ্রামীণ কলা যা হাজার বছরেও পরিবর্তিত হতো না কিংবা বিলীন হতো- সে শিল্পই কাইয়ুম তাঁর আধুনিক দৃষ্টিতে আবার করে দেখেছেন, নতুন করে এঁকেছেন। জাপানি প্রিন্ট যেমন ইউরোপকে ইম্প্রেশনিজম শিখিয়েছিল, আফ্রিকার পুতুল যেমন মাতিয়েছিল কিউবিজমে, তেমনি কাইয়ুম তাঁর গুরু জয়নুল-কামরুলের মতোই বাংলার লোকজ মোটিফে হয়েছিলেন উজ্জীবিত। তাই শহরের মানুষ হয়েও গ্রামজীবনের অক্ষরেই তাঁর চিত্রভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। লোকজ কলার স্টাইলাইত ছন্দে আপাত গ্রামীণ দৃশ্য-কেশবিন্যাসরতা নারী, ঘুড়ি ওড়ানো বালক, নৌকার মাঝি, মাথায় কাপড় জড়ানো মুক্তিযোদ্ধা কিংবা খোঁয়াড় ছাড়া গরু কাইয়ুমের নতুন অক্ষরে গল্পের বাইরের অন্য গল্পকেই জোর প্রকাশেরত। তাঁর ছবিতে অতীত কিংবা বর্তমানের সমাজচিত্র এভাবেই বিমূর্তরূপে প্রতিভাত হয় মূর্ত প্রতীকে।

কাইয়ুম এ ভাষা পেলেন কোথায়? হতে পারে পঞ্চাশের এপার বাংলার জাগরণ, হতে পারে তাঁর প্রিয় ইউরোপীয় শিল্পী ভ্যান গঘ, গঁগার জীবনাবেগ কিম্বা ব্রাক পিকাসোর মূর্ত প্রতীকে বিমূর্তায়নের প্রভাব। কারণ যা-ই হোক কাইয়ুম তার নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছেন বহুদিনের সাধনায়। শুধু তেলচিত্রের ক্যানভাসে বন্দি থাকলে হয়তবা যা সম্ভব হোত না। জীবিকার তাড়নায়ই কমার্সিয়াল আর্ট-পোস্টার, প্রচ্ছদ, মনোগ্রাম, পত্রিকার সৌকর্য বর্ধন, পেইজ মেকআপ- এসবে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে জড়িত ছিলেন তিনি। কাইয়ুমের চিত্রভাষ্য নির্মাণে এই শিল্পমাধ্যমের অবদান তাই অপরিসীম। এই শিল্পের কারণেই কাইয়ুম পরেছেন অগাধ, মিশেছেন অগণিত মানুষের সাথে, দেখেছেন, শুনেছেন, এবং অনুভব করেছেন সাধারণ মানুষের শিল্পোপাখ্যান। প্রচ্ছদ আর পত্রিকার জন্যই কাইয়ুম তাঁর চিত্রভাষ্যে সাধারণকেও শিক্ষিত করেছেন। আর তাতে লাভ হয়েছে তাঁরই- প্রচ্ছদের ফরমায়েশি শিল্পই পরে পেইন্টিং-এর উপাখ্যান হয়েছে। একটু আগে যে বলেছিলাম সিনেমার নায়কদের কথা-কাইয়ুম যখন আঁকতেন, তখন সাধারণ মানুষকেই তিনি তাঁর সিনেমার নায়ক ভেবে নিতেন। চিত্রমোদীরাও তাই আনন্দ পান নিজেকে কাইয়ুমের চিত্রেকল্পে খুঁজে পেয়ে।

আজিমপুরের এই বাড়িতেই বাবা তাঁর বড় ছবিরও ‘সুরুয়াত’ করতেন। ডাইনিং টেবিলের কোনায় বসে করতেন লে-আউট। এরপর রুলার পেনসিলে ছক কাটতেন ছবিতে- পরবর্তীকালে ক্যানভাসে তেলরং ঠিক ঠিক মত মাখাতে যাতে বেগ পেতে না হয়। স্থানের সংকুলান হতো না বলেই বড় কাজ তিনি আজিমপুরে করতে পারতেন না। নয়াপল্টনের গাছগাছালিবিহীন অতি ঝকঝকে আধুনিক ফ্ল্যাটে তাই তাঁকে প্রাত্যহিক হতে হতো। প্রাতঃভ্রমণ সেরে, আটারুটি-তরকারি মুখে পুরে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ঘণ্টা তিনেকের জন্যে তিনি আসেতেন এই ফ্ল্যাটে। আজিমপুরের সবুজ এখানে নেই। তবে প্রথমজীবন থেকেই বড় স্পেসে কাজ করার সুযোগের যে অভাব কাইয়ুম অনুভব করতেন তার কিছুটা হলেও এখানে মিটেছিল। স্টুডিওর যেখানটিতে ইজেলে ক্যানভাস দাঁড় করাতেন তিনি, তার ঠিক পেছনেই প্রমাণ সাইজের একটি আয়না রাখা।ছবিকে ভালভাবে উপলবদ্ধি করতে গেলে তাকে দূর থেকে দেখাটা খুব জরুরি। স্থানের অভাব মেটাতে এই আয়নাটির প্রতিবিম্ব তাই মাঝে মাঝেই বেশ সাহায্য করত।

এই ফ্ল্যাটটিতেই বাবার সর্বাধিক বইয়ের সংগ্রহ। নিজের করা প্রচ্ছদের বইগুলোতো আছেই, আরও আছে দেশি-বিদেশি নামকরা প্রচ্ছদশিল্পীর কাজের নমুনা, চিত্রকলা, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান- নানা বিষয়ের বই। বইয়ের ঝোঁকের কথা যে বলেছিলাম তাতে বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য সর্বভুকই বলা চলে বাবাকে। তবে প্রযুক্তির পঠনের চাইতে আত্মচরিতে অবগাহনেই তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল। অবসরে তাই তাঁর হাতে সর্বাধিক থাকত স্মরণীয়দের আত্মকথার বই।

ওবাড়ির দেয়ালে যেমন পুরনো ছবি টাঙানো, এ বাড়ির দেয়াল তেমনি ভরা নতুন ছবিতে। যেগুলোতে ‘সই’ করা- সেগুলো ‘ফিনিশটড ওয়ার্ক’। ছবি শুরু করার চাইতে শেষ করাটাই জেন বড় কঠিন। কাইয়ুমের দেয়ালেও তাই দিনের পর দিন অসমাপ্ত ছবি ঝুলে থাকত। অভ্যাগতরা ভাবতেন আর কী কাজ বাকি? কাইয়ুমের কাছে এ ছিল ছবির সাথে যুদ্ধ। মাঝে মাঝে ছবিই বলত ‘আমার এখানে কিছু কর’, মাঝে মাঝে কাইয়ুম মুছে দেতেন ছবির নানা অংশ। যুদ্ধশেষের ছবি আর লে-আউটের ছবিতে তাই অনেক সমইয়েই মিল পাওয়া দুষ্কর হতো।

আউটডোরের কাজে বাবা সুখ পেতেন না। বাইরে বেরিয়ে করেন ছোটখাট স্কেচ, কিংবা নোট। আর ঘরে ফিরে এ-বাড়ি অ-বাড়ি মিলিয়ে নোটের ওপর ভরসা করে এঁকে ফেলতেন তাঁর চিত্রোপন্যাস। বাইরের দৃশ্যকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে লোকজমোটিফের আগুনে পুড়িয়ে তিনি তৈরি করতেন একদম নতুন গল্প। কাইয়ুমের নারী, গাছ, পাখি, সূর্য, নৌকা- তাই নতুন সৃষ্টি। যেন জামদানি কিংবা টেপা পুতুল কিংবা পিঠার নকশারাই উঠে আসছে বারে বারে এদের মাধ্যমে জারিত হয়ে।

তাঁর কবিতা পড়বার আর লিখবার কথা অন্য লেখার জন্য তুলে রাখছি। দিনে অন্তত একতা ভাল কবিতা পরে ঘুমুতে যেতেন তিনি। দেশি বিদেশি কবিতার ভাব-ভাষা, হলিউডের সিনেমা, ভ্যানগঘ-পিকাশোর চিত্রভাষ্য, রবীন্দ্রনাথ আর বাংলার লোকজমোটিফ- কাইয়ুমের জীবনে এঁরাই বারে বারে পথ দেখিয়েছে- কেউ প্রকাশ্যে কেউ অপ্রকাশ্যে। বাংলা এবং বাংলার বাইরের পৃথিবীকে একত্রে মিলিয়ে নতুন ছবির ভুবন সৃষ্টিই যেন ছিল কাইয়ুমের নিরন্তর প্রচেষ্টা। তাই এত কিছু জানার , দেখার সংগ্রহ করার নিঃসীম ঝোঁক। বাবার স্টুডিওর এপাশ-ওপাশে ছড়িয়ে থাকা নানান উপকরণ এখন সেই আপরিমেয় শিল্পপ্রীতি আার প্রাণশক্তির নীরব সাক্ষী হয়ে বর্তমান।

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৪

তাঁর ছবির ভুবন

মইনুল ইসলাম জাবের

image

তিনি যেখানটিতে বসে ছবির প্ল্যান করেন, আর প্রচ্ছদ, অলংকরণ- এসব করতেন, সেটির অংশীদার ছিল আর অনেকে। ডাইনিং টেবিল বলেই- খাবার সময় পুরো বাড়ি শিল্পীর জায়গাটি দখল করত। আর সন্ধ্যাকালে বাড়ির নানা কালের নানা শিশুরা শিল্পীর ওই জায়গাটিকেই তাদের পড়া তৈরির যোগ্যস্থান ভাবত। মাঝে মাঝে জল রং কিংবা ড্রইংয়ে মগ্ন শিল্পী কাজ ছেড়ে পাশের শিক্ষার্থীকে পড়া বুঝিয়ে দিতেন, কিংবা শিক্ষার্থী যদি শিশুটি হয় তবে তার আবদার রাখতে স্থান ছেড়ে উঠে পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে ‘শিশু ভোলানাথ’ কিংবা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ থেকে পড়ে সেরে আবার ওই স্থানে জলে কালিতে ডুব দিতেন। অনাদিকালেরই গল্প বোধ হয় ছিল এটা! ভাবি এখন, এ বাড়িতে এমন কোনও শিশু নেই যে শিল্পীর শিল্পকর্মের এমন সহযোগী হয়নি। আমিও ছিলাম একসময়, হঠাৎ একরাতে না ফেরার দেশে চলে যাবার আগ পর্যন্তই ছিলাম।

আজিমপুরের যে বাড়িতে আমাদের বাসা- সেটি বয়সে অর্ধশতাব্দি পেরিয়েছে। আমার বাবা-মা দোতলার এই ফ্ল্যাটে থেকেছেন বহুকাল। শেখ সাহেব বাজার এলাকার ছাপড়া মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণমুখী গলি দিয়ে এগোলে গাছগাছালি ছাওয়া সাড়ে তিনতলা বাড়িটি চিনতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। পুরনো বাড়ি। স্থাপত্যশৈলীতে হয়ত অসাধারণ নয়। তবু বাইরের আঙ্গিকে জলযাত্রার জাহাজ-আকৃতি বেশ লাগে। বড় লোহার গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দা ছাড়িয়ে দোতলার সিঁড়ি মাড়িয়ে শেষে আমাদের ফ্ল্যাট। দরজা খুললেই ড্রইং কাম ডাইনিং কাম চিত্রশালা।

মাত্র ১৬/১৪ ফ্ল্যাটের ঘরটিতে কত কিছুর সমাহার! অভ্যর্থনার সোফা, সেন্টার টেবিল, ক্রোকারিজের কাবার্ড আর ছয়জনার ডাইনিং টেবিল তো কেবল আসবাবের ফিরিস্তি! এছাড়া রয়েছে দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো অ্যক্রিলিক, জলরং আর তেলরং-এর শিল্পকর্ম। ঘর সংলগ্ন বারান্দার ধারেই রাখা ছিল কাঠের ইজেল আর তার পাশেই সারে সারে শোয়ান ক্যানভাস। এগুলো থাকত কাজের অপেক্ষায়! বাবা যেহেতু গ্রাফিক ডিজাইনারও, প্রচ্ছদ, পোস্টার, মনোগ্রাম, লোগো- এসব করার কাগজ, কালি-তুলি, অ্যান্টিকাটার, কাটার-বোর্ড, এসবও এই ড্রইং রুমেই রাখা থাকত। ডাইনিং টেবিল সংলগ্ন একটি কাঠের তাকে ওসবের স্থান। ডাইনিং টেবিলটির বর্ণনা একটু পরেই দিচ্ছি। তার আগে বলে নিই সেন্টার টেবিলটির কথা- যেটি কাগজ আর সদ্য প্রেস ছাড়া নতুন বইয়ে থকত ঠাসা-বাবার প্রচ্ছদ করা বইয়ে।

ঘরটিতে আলোর অভাব নেই কোনও! বারান্দা সংলগ্ন দরজাটি ছাড়াও ঢাউস ঢাউস দুটি জানালা থেকে সূর্য ঠিকরোয়। গাছগাছালি ছাওয়া বাড়ি বলে বাবার কাজের জায়গার ডানের জানালাগুলো দিয়ে বাইরে তাকালেই সবুজের সমারোহ মন উদাস করে তোলে। ঢাকা শহরে থেকেও যেন শহরের বাইরে এ বাড়িটি। আম-কাঁঠাল-নারকেল-মেহেদি কোন গাছটি নেই বাড়িটির উঠোনে? বাবার ছবির সবুজের সমারোহ কী এই জানালা গলে পড়া সবুজেরই প্রতিবিম্ব?

ডাইনিং টেবিলটির দিকে তাকান যাক এবার। টেবিলটির অর্ধেক এবং লাগোয়া দুটো চেয়ারও ঠাসা কাগজ আর বইয়ে। একদম ডান কোণ সংলগ্ন চেয়ারটিতে বাবা বসে আঁকতেন। তাই টেবিলের এই প্রান্তে একটি কাটিং ম্যাট রাখা। তার সামনে একটি ফুলদানিতে ফুল, পাশে জলরং আর ক্রেওনের বাক্স, রুলার, কলমদানি, তুলিদানি ইত্যাদি। কত কত তুলি! ১, ২, ৩, ১০, ১১, ১২- কত কত নম্বর! কিছু তুলি তেলের, কিছু জলের আর অ্যাক্রিলিকের। আর আছে চাইনিজ ইঙ্কের শিশি ও ট্রেসিং পেপারের রোল। প্রতিদিন এদের ইস্তেমাল হতো প্রতিকৃতি আঁকার কাজে। টেবিলে যে কাগজের স্তূপের কথা বললাম তা একটু

ঝাড়লেই বেরুত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে আনিসুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদের ফটোগ্রাফ। প্রায় প্রতি হপ্তায় পত্রিকা কিংবা প্রচ্ছদপটে বাবার আঁকা নানা জনের প্রতিকৃতির উৎপাদন টেবিলের এই কোণটি থেকেই হতো।

আর হত প্রচ্ছদ, পোস্টার, ইলাস্ট্রেশন এবং মাঝে মাঝে নানান লেখা- যা কখনও স্মৃতিসিঞ্চন, কখনও ছড়া-কবিতা! এই কোণে বসে বাবা প্রথমে সারতেন তাঁর লে-আউট। তারপর তুলি কাগজের লড়াই শেষে উঠে পড়তেন তিনি। সেন্টার টেবিলে হার্ডবোর্ড বিছিয়ে বড় আর্ট পেপারে এঁটে দিতেন বাইকালার- মাল্টিকালার কাজ ও তার কালার স্কিম। ব্যাপারটি যত সহজে বলা গেল তত সহজ ছিল না মোটেই। কারণ বাবার কাজ ঠিক বসলাম আর হয়ে গেল পর্যায়ের নয়। আঁকার আগে অনেক পড়ার ও ভাবার অবসর মিলতে হতো তাঁর। তাই এক একটি কাজের জন্য প্রকাশক-লেখকদের ফোন সামলাতে এবং আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু বা কখনো-সখনো আগামি হপ্তার তারিখ দেওয়ার কাজটি করতে হতো এবাড়ির অধিবাসীদের। একতলা দোতলার একান্নবর্তিতার জন্যে বাড়ির প্রায় দশ-বারোজন অধিবাসীই অন্তত বাইরের মানুষের তোপ সামলাতে কাইয়ুমকে প্রায়শই সাহায্য করতেন।

ড্রইংরুমটির আরেক উপকরণ ছিল গান শোনার স্টেরিও সেটটি। গান-সিনেমা-বই-এ তিনটি যদি না থাকত কাইয়ুমও থাকতেন না। এগুলো তাঁর হাড়মজ্জার অংশ। কাজ করতে করতে, কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে! ‘নানা গানের মালা পরতে’ কাইয়ুম খুব ভালবাসতেন। তাঁর ‘লং প্লে’ সংগ্রহের কথা অনেকেই জানেন। সময়ের দাবিতে প্রযুক্তির পরিবর্তনে আইপ্যাড আর সিডি দখল করেছিল তাদের জায়গা। সন্তোষ সেনগুপ্ত, সুবিনয় রায়ের রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি কিংবা আধুনিক গান, আমজাদ আলী খাঁর সরোদ বাদন, কমলা ঝরিয়ার গান, শচীন কর্তার রেকর্ড থেকে শুরু করে পশ্চিমের হ্যারি বেলাফেন্টে, ন্যাটকিং কোল, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, কিংবা বেটোফেন, মোজার্ট বা শোপাঁর কঞ্চার্তো- এসব কিছুই কাইয়ুমকে প্রাণিত করত। গেল শতকের বিশের দশকের সংগীত কিংবা সত্তরের বিট জেনারেসনের গান- এসবই কাইয়ুমের আঁকার রসদ। সেই সঙ্গে সিনেমা। জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক, ফজলে লোহানী প্রমুখের বন্ধুতার সূত্রে কাইয়ুম একসময় চিত্রপরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। আলমগীর কবিরের সঙ্গে সিনে পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। অবজারভার গ্রুপের শিল্প-সম্পাদক হিসেবে চিত্রালী পত্রিকার সৌকর্য বর্ধনের দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। এতসব কিছুর পেছেনে ছিল ঢাকার প্রথম জীবনের মোহাম্মদ কিবরিয়া কিংবা নিতুন কুণ্ডুর সঙ্গে ‘সিজন টিকিটে সিনেমা’ দেখার নেশা। গেগরি পেক, গ্রেস কেলি, অড্রে হেপবার্ন, দিলিপ কুমার, সায়রা বানু, হাম্ফ্রি বোগার্ট- এঁরা সবাই কাইয়ুমের ছবিরও হিরো। প্রচ্ছদ কিম্বা পেইন্টিং যা কিছুই আঁকতেন তাতেই তাঁর সিনেমার নায়ক-নায়িকায় সম্মোহিত সত্তা প্রতিভাত হতো। ছবিতে নানা রঙের সন্নিবেশে কিংবা মানব-মানবীর উপস্থাপনে কাইয়ুম তাই সবশেষে জীবনের জয়গানই গাইতেন। সিনেমার জাঁকজমক হয়ত থাকত না, থাকত না উচ্ছ্বাসের আতিশয্য কিন্তু গ্রামীণ জীবন, লোকজ মটিফ কিম্বা প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধার সরল চিত্রেণের পেছনে দিগি¦জয়ী নায়কেরাই ফুটে উঠত যেন।

গ্রামীণ মানুষ রয়েছেন কাইয়ুমের ছবির এক বিরাট অংশজুড়ে। গ্রামকে কাইয়ুম সেই পনের-ষোল বছর বয়সে ছেড়ে এলেও ছবির মাঝে সেই স্মৃতি ধরে রেখে ছিলেন জীবনের শেষদিন অব্দি। গ্রাম থেকেই নেওয়া উপকরণ, গ্রামের চাষী-মাঝি-পাতাকুড়ানি কিংবা অপেক্ষারতা মা-জায়া- এঁরা সবাই কাইয়ুমের ছবিতে আসেন কখনো মুক্তিযোদ্ধা, কখনো নবান্নের আনন্দে উদ্বেলিত চরিত্ররূপে। এতসব চরিত্রের উপস্থাপন আবার হয় চিরায়ত লোকসম্ভার- পিঠার ছাঁচ, নৌকার গলুই এর কারুকাজ, হাতে টেপা পুতুলের ফর্ম, নকশীকাঁথা কিংবা জামদানির নকশা ইত্যাদির সংশ্লেষণে। মূর্ত এবং বিমূর্তের সংযোগ-সম্ভাবনাকে বার বার কাইয়ুম চিত্রাবদ্ধ করতে চেয়েছেন- মাধ্যম তার প্রচ্ছদ হোক কিংবা ক্যনভাস। বাঙলার লোকজ কলায় অবগাহন করা অপরাপর সব শিল্পীর বিপরীতে ঠিক এই খানটাতেই কাইয়ুমের পথ অন্য দিকে বেঁকে গেছে। গ্রাম ও তার শিল্পকে ভালবেসে তার সাথে দর্শকের শুধুমাত্র পরিচয় করিয়ে দেবার কাজটিতে থেমে থাকেননি তিনি কখনো। বরং তার নির্যাস গায়ে মেখে নতুন করে তাকে বুঝে নিয়ে তারপর নিজের মত করে তার প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন এবং অবশ্যই মেতেছেন চিত্রতলে মূর্ত ও বিমূর্তের সংস্থিতি স্থাপনের কঠিন খেলায়। গ্রামকে তাঁর স্মৃতির সম্ভার করে, শহুরে কিন্তু শিল্পীত দৃষ্টিতে তাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। হাজার বছরের গ্রামীণ কলা যা হাজার বছরেও পরিবর্তিত হতো না কিংবা বিলীন হতো- সে শিল্পই কাইয়ুম তাঁর আধুনিক দৃষ্টিতে আবার করে দেখেছেন, নতুন করে এঁকেছেন। জাপানি প্রিন্ট যেমন ইউরোপকে ইম্প্রেশনিজম শিখিয়েছিল, আফ্রিকার পুতুল যেমন মাতিয়েছিল কিউবিজমে, তেমনি কাইয়ুম তাঁর গুরু জয়নুল-কামরুলের মতোই বাংলার লোকজ মোটিফে হয়েছিলেন উজ্জীবিত। তাই শহরের মানুষ হয়েও গ্রামজীবনের অক্ষরেই তাঁর চিত্রভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। লোকজ কলার স্টাইলাইত ছন্দে আপাত গ্রামীণ দৃশ্য-কেশবিন্যাসরতা নারী, ঘুড়ি ওড়ানো বালক, নৌকার মাঝি, মাথায় কাপড় জড়ানো মুক্তিযোদ্ধা কিংবা খোঁয়াড় ছাড়া গরু কাইয়ুমের নতুন অক্ষরে গল্পের বাইরের অন্য গল্পকেই জোর প্রকাশেরত। তাঁর ছবিতে অতীত কিংবা বর্তমানের সমাজচিত্র এভাবেই বিমূর্তরূপে প্রতিভাত হয় মূর্ত প্রতীকে।

কাইয়ুম এ ভাষা পেলেন কোথায়? হতে পারে পঞ্চাশের এপার বাংলার জাগরণ, হতে পারে তাঁর প্রিয় ইউরোপীয় শিল্পী ভ্যান গঘ, গঁগার জীবনাবেগ কিম্বা ব্রাক পিকাসোর মূর্ত প্রতীকে বিমূর্তায়নের প্রভাব। কারণ যা-ই হোক কাইয়ুম তার নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছেন বহুদিনের সাধনায়। শুধু তেলচিত্রের ক্যানভাসে বন্দি থাকলে হয়তবা যা সম্ভব হোত না। জীবিকার তাড়নায়ই কমার্সিয়াল আর্ট-পোস্টার, প্রচ্ছদ, মনোগ্রাম, পত্রিকার সৌকর্য বর্ধন, পেইজ মেকআপ- এসবে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে জড়িত ছিলেন তিনি। কাইয়ুমের চিত্রভাষ্য নির্মাণে এই শিল্পমাধ্যমের অবদান তাই অপরিসীম। এই শিল্পের কারণেই কাইয়ুম পরেছেন অগাধ, মিশেছেন অগণিত মানুষের সাথে, দেখেছেন, শুনেছেন, এবং অনুভব করেছেন সাধারণ মানুষের শিল্পোপাখ্যান। প্রচ্ছদ আর পত্রিকার জন্যই কাইয়ুম তাঁর চিত্রভাষ্যে সাধারণকেও শিক্ষিত করেছেন। আর তাতে লাভ হয়েছে তাঁরই- প্রচ্ছদের ফরমায়েশি শিল্পই পরে পেইন্টিং-এর উপাখ্যান হয়েছে। একটু আগে যে বলেছিলাম সিনেমার নায়কদের কথা-কাইয়ুম যখন আঁকতেন, তখন সাধারণ মানুষকেই তিনি তাঁর সিনেমার নায়ক ভেবে নিতেন। চিত্রমোদীরাও তাই আনন্দ পান নিজেকে কাইয়ুমের চিত্রেকল্পে খুঁজে পেয়ে।

আজিমপুরের এই বাড়িতেই বাবা তাঁর বড় ছবিরও ‘সুরুয়াত’ করতেন। ডাইনিং টেবিলের কোনায় বসে করতেন লে-আউট। এরপর রুলার পেনসিলে ছক কাটতেন ছবিতে- পরবর্তীকালে ক্যানভাসে তেলরং ঠিক ঠিক মত মাখাতে যাতে বেগ পেতে না হয়। স্থানের সংকুলান হতো না বলেই বড় কাজ তিনি আজিমপুরে করতে পারতেন না। নয়াপল্টনের গাছগাছালিবিহীন অতি ঝকঝকে আধুনিক ফ্ল্যাটে তাই তাঁকে প্রাত্যহিক হতে হতো। প্রাতঃভ্রমণ সেরে, আটারুটি-তরকারি মুখে পুরে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ঘণ্টা তিনেকের জন্যে তিনি আসেতেন এই ফ্ল্যাটে। আজিমপুরের সবুজ এখানে নেই। তবে প্রথমজীবন থেকেই বড় স্পেসে কাজ করার সুযোগের যে অভাব কাইয়ুম অনুভব করতেন তার কিছুটা হলেও এখানে মিটেছিল। স্টুডিওর যেখানটিতে ইজেলে ক্যানভাস দাঁড় করাতেন তিনি, তার ঠিক পেছনেই প্রমাণ সাইজের একটি আয়না রাখা।ছবিকে ভালভাবে উপলবদ্ধি করতে গেলে তাকে দূর থেকে দেখাটা খুব জরুরি। স্থানের অভাব মেটাতে এই আয়নাটির প্রতিবিম্ব তাই মাঝে মাঝেই বেশ সাহায্য করত।

এই ফ্ল্যাটটিতেই বাবার সর্বাধিক বইয়ের সংগ্রহ। নিজের করা প্রচ্ছদের বইগুলোতো আছেই, আরও আছে দেশি-বিদেশি নামকরা প্রচ্ছদশিল্পীর কাজের নমুনা, চিত্রকলা, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান- নানা বিষয়ের বই। বইয়ের ঝোঁকের কথা যে বলেছিলাম তাতে বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য সর্বভুকই বলা চলে বাবাকে। তবে প্রযুক্তির পঠনের চাইতে আত্মচরিতে অবগাহনেই তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল। অবসরে তাই তাঁর হাতে সর্বাধিক থাকত স্মরণীয়দের আত্মকথার বই।

ওবাড়ির দেয়ালে যেমন পুরনো ছবি টাঙানো, এ বাড়ির দেয়াল তেমনি ভরা নতুন ছবিতে। যেগুলোতে ‘সই’ করা- সেগুলো ‘ফিনিশটড ওয়ার্ক’। ছবি শুরু করার চাইতে শেষ করাটাই জেন বড় কঠিন। কাইয়ুমের দেয়ালেও তাই দিনের পর দিন অসমাপ্ত ছবি ঝুলে থাকত। অভ্যাগতরা ভাবতেন আর কী কাজ বাকি? কাইয়ুমের কাছে এ ছিল ছবির সাথে যুদ্ধ। মাঝে মাঝে ছবিই বলত ‘আমার এখানে কিছু কর’, মাঝে মাঝে কাইয়ুম মুছে দেতেন ছবির নানা অংশ। যুদ্ধশেষের ছবি আর লে-আউটের ছবিতে তাই অনেক সমইয়েই মিল পাওয়া দুষ্কর হতো।

আউটডোরের কাজে বাবা সুখ পেতেন না। বাইরে বেরিয়ে করেন ছোটখাট স্কেচ, কিংবা নোট। আর ঘরে ফিরে এ-বাড়ি অ-বাড়ি মিলিয়ে নোটের ওপর ভরসা করে এঁকে ফেলতেন তাঁর চিত্রোপন্যাস। বাইরের দৃশ্যকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে লোকজমোটিফের আগুনে পুড়িয়ে তিনি তৈরি করতেন একদম নতুন গল্প। কাইয়ুমের নারী, গাছ, পাখি, সূর্য, নৌকা- তাই নতুন সৃষ্টি। যেন জামদানি কিংবা টেপা পুতুল কিংবা পিঠার নকশারাই উঠে আসছে বারে বারে এদের মাধ্যমে জারিত হয়ে।

তাঁর কবিতা পড়বার আর লিখবার কথা অন্য লেখার জন্য তুলে রাখছি। দিনে অন্তত একতা ভাল কবিতা পরে ঘুমুতে যেতেন তিনি। দেশি বিদেশি কবিতার ভাব-ভাষা, হলিউডের সিনেমা, ভ্যানগঘ-পিকাশোর চিত্রভাষ্য, রবীন্দ্রনাথ আর বাংলার লোকজমোটিফ- কাইয়ুমের জীবনে এঁরাই বারে বারে পথ দেখিয়েছে- কেউ প্রকাশ্যে কেউ অপ্রকাশ্যে। বাংলা এবং বাংলার বাইরের পৃথিবীকে একত্রে মিলিয়ে নতুন ছবির ভুবন সৃষ্টিই যেন ছিল কাইয়ুমের নিরন্তর প্রচেষ্টা। তাই এত কিছু জানার , দেখার সংগ্রহ করার নিঃসীম ঝোঁক। বাবার স্টুডিওর এপাশ-ওপাশে ছড়িয়ে থাকা নানান উপকরণ এখন সেই আপরিমেয় শিল্পপ্রীতি আার প্রাণশক্তির নীরব সাক্ষী হয়ে বর্তমান।