ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ৫

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সম্মানে ভর্তি হই ১৯৬৩ সালে। আমার বাবার তখন পোস্টিং ময়মনসিংহে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আমার স্কুল-জীবনের প্রথম ও শেষাংশ, এবং কলেজ জীবন পুরোটাই কেটেছে (ভাগ্যিস ঐ সময়টাতে বাবা বদলি হননি, নইলে আমাকে দু’তিনটে কলেজে পড়তে হতো) নওগাঁতে- তদানীন্তন রাজশাহী জেলার একটি ছোট্ট পরিচ্ছন্ন শহরে। নওগাঁ শহরের প্রেমে পড়েছিলাম আমি, এবং আরও অনেক আকর্ষণের ভেতর একটি অতিরিক্ত ও অন্যতম আকর্ষণ ছিল আমার বাবার অফিসের একজন তরুণ পিওন- তার সাথে আমার কোন প্রকার যোগাযোগ নেই সে প্রায় চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে, যদিও আমার জানা মতে সে এখনও জীবিত। তার অসীম সাহস (ঐ বয়সে তার সম্বন্ধে আমার তেমনই ধারণা ছিল), তার পেশীশক্তি (সে নওগাঁর প্রাথমিক শিক্ষকপ্রশিক্ষণ ইন্সটিট্যুট মাঠে রাখা একটি সিমেন্টের রোলার দুই হাতের জোরে খাড়া করতে পারত), তার প্রতিবাদী চরিত্র, জাগতিক বিষয়ে তার পরিচ্ছন্ন ধারণা, সারাদিন কায়িক শ্রম করার ক্ষমতা, এবং সর্বোপরি তার স্ত্রী ছাড়াও অন্য এক নারীর ভালবাসা আদায় করার (তার স্ত্রী সেটা অবগত ছিল) গুণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরবর্তীকালে সে এই নারীকে বিয়েও করেছিল- তার প্রথম স্ত্রীর অনুমতিতেই। আসলে তার প্রথম স্ত্রীর সন্তানধারণের সমস্যা ছিল বিধায় এই ঘটনাটি ঘটে। তবে নজরুল ইসলাম- এটিই তার নাম ছিল- তার এসব গুণাবলীর জন্য, শুধু আমার নয়, আমার মা-বাবারও অত্যন্ত প্রিয় এবং আস্থাভাজন ছিল একাধিক পিওনের ভেতর। নওগাঁ শহরের অলিগলি ওই চিনিয়েছে আমাকে এবং প্রতি সন্ধ্যাতে শহরের শ্রেষ্ঠ পেঁয়াজুর স্বাদ তারই সৌজন্যে আমি গ্রহণ করতে পেরেছি।

নওগাঁ শহরের প্রেমে পড়েছিলাম একাধিক কারণে। প্রথমত শহরটি শিল্পমনা ছিল- বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা- বছর জুড়েই হতো। স্কুল কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আবৃত্তি, মিলাদ, পুজোর অনুষ্ঠান তো হতোই, সেই সাথে হতো মহকুমার গণ্যমান্য মানুষদের এবং অনেক সময়ে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা এবং ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস টুর্নামেন্ট। শহরে একটি নান্দনিক পার্ক ছিল যেটির তখনকার নামটি মনে করতে পারছিনা (সম্ভবত ক্যাসেল পার্ক, গুগল ঘেঁটেও নামের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলাম না, যদিও নিশ্চিন্ত হলাম বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি ঔদাসীন্যের ব্যাপারে), যদিও এখন পার্কটির নামকরণ হয়েছে সম্ভবত নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্ক। এই পার্কটি মুক্তি সিনেমাহল এবং নওগাঁ পাবলিক লাইব্রেরি ও টেনিস গ্রাউন্ডের পাশে অবস্থিত। আমার ব্যক্তিগতভাবে এই স্থানগুলোতে- পার্কসহ বেশ যাতায়াত ছিল তিনটি কারণে: ঐ পাবলিক লাইব্রেরি, টেনিস গ্রাউন্ড, যেখানে আমার বাবা প্রতি বিকেলে টেনিস খেলতে যেতেন, এবং পার্কের পুকুরের ধারে বসে সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দেওয়া। পার্কটি ঐ বয়সে দারুণ নান্দনিক মনে হতো। এই পার্কে প্রতি শীতে শিল্প-বাণিজ্য প্রদর্শনী হতো যার আকর্ষণ ঐ বয়সে কম ছিল না।

শহরে দু’টি সিনেমা হল ছিল- মুক্তি (যার নাম আগেই উল্লেখ করেছি) এবং তাজ। এই হল দু’টির মর্নিং শোতে ইংরেজি সিনেমা এবং স্বাভাবিক শোতে ভারতীয় হিন্দি/উর্দু এবং বাংলা চলচ্চিত্র হতো। তাজ সিনেমা হলটি ভারি সুন্দর ছিল- আমার সেই তরুণ বয়সে এই হলটিকে মনে হতো একটি আধুনিকতম প্রেক্ষাগৃহ। হলটি ছিল নওগাঁ শহরের যমুনা (লিটল যমুনা) নদীর ওপর দিয়ে পার হয়ে লর্ড লিটন ব্রিজের অপর প্রান্তে নওগাঁ-সান্তাহার রাস্তার ওপর। এই রাস্তা দিয়ে তখন ঘোড়াটানা টমটম নওগাঁ-সান্তাহার যাতায়াত করত। ব্রিজটি আমার নস্টালজিয়া, কারণ এর ওপর দিয়ে আমি অসংখ্যবার হেঁটেছি ঐ তাজ সিনেমা হলে সিনেমা দেখার জন্য। শুনেছি ব্রিজটি নাকি একবার ভেঙে পড়েছিল এবং পরে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তি সিনেমা হলটি- সে আমলে যেমনটা হতো- একটি গুদাম ঘরকে প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত করলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। এমন একটি সিনেমা হল সান্তাহারেও ছিল যেখানে আমি দিলীপ কুমার-নাদিরা অভিনীত ভারতবর্ষেরপ্রথম রঙিন সিনেমা “আন” দেখেছিলাম। আমার নিয়মিত অভ্যাস ছিল ঐ তাজ সিনেমা হলে মর্নিং শোতে ইংরেজি সিনেমা দেখা। তবে আমাদের যুগে সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রায় সবগুলো চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি, অপরাজিত, জলসাঘর, তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা, অজয় করের জিঘাংসা, শ্যামলী, অসিত সেনের দ্বীপ জ্বেলে যাই, ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, এবং এও মনে পড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক উপন্যাসের চলচ্চিত্র রুটিনভাবে দেখেছি, যার ভেতর নিষ্কৃতি, মেজদিদি এবং বড়দিদি দেখে হলে বসে অনেক কেঁদেছি। ঐ বয়সে অযান্ত্রিক আমি তেমন উপভোগ করিনি, যদিও উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক সিনেমা দেখে কম শিহরিত হইনি, এবং মায়ামৃগ সিনেমায় উত্তমকে পার্শ্বচরিত্রে, এবং বিশ্বজিৎ ও সন্ধ্যা রায়কে মূল চরিত্রে দেখে মনঃকষ্টে ভুগেছি বৈকি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম এবং তখন অযান্ত্রিক বেশ কয়েকবার দেখে মনে হয়েছে এই চলচ্চিত্রটির জন্য ঋত্বিক ঘটকের অস্কার পাবার যোগ্যতা সম্ভবত ছিল। মানুষ এবং পশুর সম্পর্কের জন্য যদি লাইফ অব পাই ২০১২ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেতে পারে, তবে মানুষের সাথে যন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে সেই ১৯৫৮ সালে প্রস্তুত চলচ্চিত্র কেন এত অবহেলিত হবে! সেই সাথে ১৯৩৬ সালে চার্লি চ্যাপলিন লিখিত-পরিচালিত চলচ্চিত্র “মডার্ন টাইমস”-এর কথাও মনে আসছে। আর্থিক মন্দা এবং শিল্পায়নের উৎকর্ষের চাপে মানুষ কীভাবে নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে ত্রিশের দশকে তারই দলিল এই নির্বাক

চলচ্চিত্র। দু’দশক দু’বছর পর ঋত্বিক সুবোধ ঘোষের উপন্যাস নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত এক দৃষ্টিতে সবাক যুগে একটি অযান্ত্রিক ছবি বানালেন, যেখানে নির্বাক-নিষ্প্রাণ এক যন্ত্র, ট্যাক্সি, সবাক প্রাণময় একজন মানুষের বন্ধু-সুহৃদ হয়ে উঠলো। যন্ত্রের সাথে বসবাস করতে করতে সময়ে মানুষের বোধ ও অনুভূতি কীভাবে বদলে যায় তারই আখ্যান অযান্ত্রিক।

এই সময়ে অনেক ভারতীয় হিন্দি এবং পাকিস্তানি উর্দু সিনেমা দেখেছি, কারণ তখন পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমা পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি- নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর। আমাদের যুগে দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, অশোক কুমার, কিশোর কুমার, মেহমুদ, প্রাণ, নাদিরা, মিনা কুমারী, মধুবালা, হেলেন, মালা সিনহা এবং অরও অনেকের সিনেমা আমরা দেখেছি। পাকিস্তানি নায়ক-নায়িকাদের ভেতর দেখেছিলাম সন্তোষ কুমার, সুধীর, জীয়া মহিউদ্দিন, সাবিহা, নিলু, শামিম আরা, ফরিদা জালাল, জাহরাকে। এদের ভেতর সাবিহা-সন্তোষ জুটি খুবই দর্শকপ্রিয় ছিল। জীয়া মহীউদ্দিন ষাটের দশকে ভীষণ দামী অভনেতা হিসেবে সম্মান পেতো ১৯৬২ সালে লরেন্স অব অ্যারাবিয়াতে তার পিটার ও’টুল, অ্যালেক গিনেস, অ্যান্থনি কুইন, জ্যাক হকিন্স এবং ওমার শরিফের মতো জাঁদরেল হলিউডি অভিনেতাদের সাথে অভিনয় করার কারণে। পরবর্তীতে জীয়াকে পাকিস্তান টেলিভিশনে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান করতে দেখা গেছে, মহিউদ্দিন শো শিরোনামে ১৯৬৯ সাল থেকে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে অন্যান্য বাঙালি অভিনেতাদের ছাড়াও যেসব উর্দুভাষী পাকিস্তানি অভিনেতাদের পেয়েছিলাম তাঁদের ভেতর দর্শকপ্রিয়রা ছিল মোহাম্মদ আলি, ওয়াহিদ মুরাদ, দর্পণ, জেবা, নাদিমদের- যতদূর মনে পড়ে নাদিম প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে ঢাকাতে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছে। মজার ব্যাপার হলো পাকিস্তানের সবচাইতে দর্শক-নন্দিত উর্দু চলচ্চিত্র- যেমন জাগো হুয়া সাভেরা, চান্দা, প্রিত না জানে রিত, তালাস, সঙ্গম, তানহা, মিলন, বাহানা ইত্যাদি- এসবগুলোই হয়েছে ঢাকাতে।

নওগাঁতে আমাদের বাসা ছিল ঐ যমুনা নদীর ধারে মহকুমা কর্মকর্তার (এসডিও) বাসার ঠিক পাশেই। মনে আছে তখন নওগাঁর এসডিও ছিলেন আবদুর রব চৌধুরী যিনি দেশ স্বাধীন হবার পর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৯১-১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রতিবেশীরূপে তাঁর, তাঁর স্ত্রী ও ছেলের (তখন তার বয়স ৬/৭ হবে) সাথে বেশ হৃদ্যতা ছিল। একবার বেশ রাতে আমাদের বাসার উঠোনে (তখন সরকারি বাসাগুলোতেও বেশ বড় উঠোন থাকতো) হঠাৎ করে একটি শিয়াল ঢুকে পড়েছিল যাকে দেখে আমরা তিন ভাইবোন সমস্বরে ডাকাত পড়ার মতো চিৎকার শুরু করেছিলাম (বাবা বাসায় ছিলেন না, কারণ তিনি সন্ধ্যা হলেই নওগাঁর অফিসার্স রিক্রিয়েশন ক্লাবে তাস খেলতে যেতেন। বাবা একসময় এই ক্লাবের প্রেসিডেন্টও ছিলেন)। ফলে পাশের বাসা থেকে আবদুর রব চৌধুরীর স্ত্রী, পিওন-চাপরাশিসহ, দৌড়ে এসেছিলেন আমাদের বিপদের কথা শঙ্কা করে। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিল এবং পরবর্তীকালে দেখা হলেই আমরা ভাইবোনেরা তাঁর কাছ থেকে বেশ প্রীতিকর হাস্যরসিকতা শুনতাম।

আমাদের বাসাটা নওগাঁর প্রধান রাস্তার পাশেই ছিল। নওগাঁতে প্রতি বুধবারে গ্রামের মতো হাট বসতো এবং আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা জনাকীর্ণ হয়ে উঠতো। বাড়ির বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে একজন জাদুকর জাদু দেখাতো খোলা আকাশের নিচে। আমিও অনেকবার অবাক চোখে এই জাদু দেখেছি। সবচাইতে বিস্ময়কর ছিল, সে একটা বাচ্চা ছেলেকে সবার সামনে ধামাচাপা দিত তারপর বেশ খানিকক্ষণ তার ডুগডুগি বাজিয়ে ধামা উল্টিয়ে দেখাত ছেলেটি সেখানে নেই। এরপর ছেলেটির সাথে সে কথা বলতো, এবং ছেলেটির কথা শূন্য থেকে ভেসে আসতো। কোনও জাদুকরী প্রস্তুতি ছাড়া খোলা আকাশের নিচে মানুষ উধাও করে দেয়া এবং তার সাথে কথা বলা দেখে আমি অভিভূত হতাম এবং এখনো ভাবি সেই যাদু পি সি সরকার কিংবা ডেভিড কপারফিল্ডের চাইতে কোনো অংশেই অবহেলার ছিল না। সেই সাথে ছিল রঙিন ছবি টাঙিয়ে শিলাজুত বা শিলাজাত বিক্রির বক্তৃতা। এটি এক অর্থে আমার যৌনচেতনার প্রথম পাঠ, কারণ এই ঔষধটি বিক্রির জন্য যে যৌনতথ্যের বর্ণনা দেয়া হতো তা ঐ বয়সের অবদমিত যৌনকৌতূহলকে অনেকটাই ভ্রান্ত পথে মিটিয়েছি আমি। জানি না কেন আমরা এখনও এ ব্যাপারে এত রাখঢাক করে তরুণ-তরুণীদের ভুল তথ্য দেবার পথ প্রশস্ত করি।

বাসার সামনে বিশাল খোলা জায়গা এবং পেছনেও খালি জায়গার পর ছিল যমুনা নদী। বাবা এই খালি জায়গাতে মহাকুমা কৃষি অফিস থেকে ট্রাক্টর এনে শীতের সব্জি চাষ করাতেন- ফুল কপি, আলু, টমেটো, বাঁধাকপি, গাজর, মটরশুঁটি এবং এমন আরও। এসবের যতœ করতো ঐ নজরুল ইসলাম এবং অন্য একজন বিহারী পিওন খোদাবক্স খান। বাসার পেছনে যমুনা নদীতে হতো আমার সাঁতারের পারফেকশন (কারণ আমি আগেই সাঁতারটা রপ্ত করেছিলাম সান্তাহারে আমাদের তখনকার বাসস্থানের সামনের পুকুরে দাপাদাপি করে)।

এভাবেই আমার নওগাঁ জীবনের নস্টালজিয়ার পরিপূর্ণতা এবং কলেজ-জীবনের সমাপ্তি, কারণ ১৯৬৩ সালে আমার বাবা বদলি হন ময়মনসিংহে। তখন আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফলে অপেক্ষা ছিল রেজাল্টের। আমার রেজাল্ট বেরুবার পর আমি সিদ্ধান্তমতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় এসে ওয়ারির ৯/১ রেঙ্কিন স্ট্রিটে আমার এক চাচাতো বোনের বাড়িতে উঠি। এ বাড়িটি বেশকিছু ইতিহাসের সাক্ষী যার ভেতর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধও অন্তর্গত। আমার এই বোনের বাসাতেই কিংবদন্তিতুল্য বিখ্যাত সাংবাদিক ওবায়েদ উল হক নিচতলাতে থাকতেন। তাঁর বড় ছেলে মাশুকুল হক আমার বয়সী এবং আমরা একই বছরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। আমার চাচাতো ভাইও (আমার ঐ চাচাতো বোনের ছোট ভাই) আমার সাথেই পাশ করেছিল। ও পড়তো ঢাকা কলেজে ঐ বোনের বাসায় থেকে, এবং ফলে মাশুকের সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা আগে থেকেই ছিল। এরই সাথে আরও একজন, যার নাম আমি সঠিক মনে করতে পারছি না, যতদূর মনে পড়ে সে সম্ভবত ঢাকা কলেজের বিখ্যাত ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের আত্মীয়ই ছিল, তার সাথে পরিচয় হয়। আমি ওদের বন্ধু হয়ে গেলাম তাৎক্ষণিক। আমরা তিনজন- আমি, সাদুল্লাহ (আমার চাচাতো ভাই) এবং শেষোক্ত সাদুল্লাহর সেই নাম-ভুলে-যাওয়া সহপাঠী- একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য নেয়া শুরু করলাম। কোনো অজ্ঞাত কারণে মাশুক আমাদের সাথে তেমন ঘোরাফেরা করতো না, যদিও প্রতি সন্ধ্যাতে তার ঘরে বসে (ঘরটা ছিল একতলার ঠিক সিঁড়িরে নিচে এবং অত্যন্ত সংকীর্ণ, যদিও খুবই প্রাইভেট) তার সাথে সাদুল্লাহ এবং আমি সারাদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতাম। মাশুক বেশ সিগারেট খেত- মাঝেমধ্যে সাদুল্লাহও- কিন্তু আমি ছিলাম গোবেচারা গুড বয়, ঠোঁটে সিগারেট ঠেকাতাম না। ওরা বেশ মেয়েদের নিয়ে মুখরোচক গল্প করতো যা শুনতে আমার বেশ ভালই লাগতো, কিন্তু আমার নিজের ঐ সময় পর্যন্ত মেয়েদের সাথে মেলামেশা করার সাহস বা অভিজ্ঞতা ছিল না যদিও আমি স্কুলে কিছুটা সময় এবং কলেজে পুরোটা সময়ই মেয়েদের সাথেই পড়াশোনা করেছি। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা বেশ লাজুকতার মধ্যেই কেটেছে, তবে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকাকালে আমি আমার কথাবার্তাতে বেশ “ফাজিল” হয়ে উঠেছিলাম। মেয়েদের সাথে মেশার লাজুকতা বা শীতলতা থেকে আমার প্রকৃত উত্তরণ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর থেকে। সেটা আর এক স্মৃতি-অধ্যায়। (চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৪

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ৫

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সম্মানে ভর্তি হই ১৯৬৩ সালে। আমার বাবার তখন পোস্টিং ময়মনসিংহে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আমার স্কুল-জীবনের প্রথম ও শেষাংশ, এবং কলেজ জীবন পুরোটাই কেটেছে (ভাগ্যিস ঐ সময়টাতে বাবা বদলি হননি, নইলে আমাকে দু’তিনটে কলেজে পড়তে হতো) নওগাঁতে- তদানীন্তন রাজশাহী জেলার একটি ছোট্ট পরিচ্ছন্ন শহরে। নওগাঁ শহরের প্রেমে পড়েছিলাম আমি, এবং আরও অনেক আকর্ষণের ভেতর একটি অতিরিক্ত ও অন্যতম আকর্ষণ ছিল আমার বাবার অফিসের একজন তরুণ পিওন- তার সাথে আমার কোন প্রকার যোগাযোগ নেই সে প্রায় চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে, যদিও আমার জানা মতে সে এখনও জীবিত। তার অসীম সাহস (ঐ বয়সে তার সম্বন্ধে আমার তেমনই ধারণা ছিল), তার পেশীশক্তি (সে নওগাঁর প্রাথমিক শিক্ষকপ্রশিক্ষণ ইন্সটিট্যুট মাঠে রাখা একটি সিমেন্টের রোলার দুই হাতের জোরে খাড়া করতে পারত), তার প্রতিবাদী চরিত্র, জাগতিক বিষয়ে তার পরিচ্ছন্ন ধারণা, সারাদিন কায়িক শ্রম করার ক্ষমতা, এবং সর্বোপরি তার স্ত্রী ছাড়াও অন্য এক নারীর ভালবাসা আদায় করার (তার স্ত্রী সেটা অবগত ছিল) গুণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরবর্তীকালে সে এই নারীকে বিয়েও করেছিল- তার প্রথম স্ত্রীর অনুমতিতেই। আসলে তার প্রথম স্ত্রীর সন্তানধারণের সমস্যা ছিল বিধায় এই ঘটনাটি ঘটে। তবে নজরুল ইসলাম- এটিই তার নাম ছিল- তার এসব গুণাবলীর জন্য, শুধু আমার নয়, আমার মা-বাবারও অত্যন্ত প্রিয় এবং আস্থাভাজন ছিল একাধিক পিওনের ভেতর। নওগাঁ শহরের অলিগলি ওই চিনিয়েছে আমাকে এবং প্রতি সন্ধ্যাতে শহরের শ্রেষ্ঠ পেঁয়াজুর স্বাদ তারই সৌজন্যে আমি গ্রহণ করতে পেরেছি।

নওগাঁ শহরের প্রেমে পড়েছিলাম একাধিক কারণে। প্রথমত শহরটি শিল্পমনা ছিল- বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা- বছর জুড়েই হতো। স্কুল কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আবৃত্তি, মিলাদ, পুজোর অনুষ্ঠান তো হতোই, সেই সাথে হতো মহকুমার গণ্যমান্য মানুষদের এবং অনেক সময়ে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা এবং ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস টুর্নামেন্ট। শহরে একটি নান্দনিক পার্ক ছিল যেটির তখনকার নামটি মনে করতে পারছিনা (সম্ভবত ক্যাসেল পার্ক, গুগল ঘেঁটেও নামের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলাম না, যদিও নিশ্চিন্ত হলাম বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি ঔদাসীন্যের ব্যাপারে), যদিও এখন পার্কটির নামকরণ হয়েছে সম্ভবত নওগাঁ জেলা পরিষদ পার্ক। এই পার্কটি মুক্তি সিনেমাহল এবং নওগাঁ পাবলিক লাইব্রেরি ও টেনিস গ্রাউন্ডের পাশে অবস্থিত। আমার ব্যক্তিগতভাবে এই স্থানগুলোতে- পার্কসহ বেশ যাতায়াত ছিল তিনটি কারণে: ঐ পাবলিক লাইব্রেরি, টেনিস গ্রাউন্ড, যেখানে আমার বাবা প্রতি বিকেলে টেনিস খেলতে যেতেন, এবং পার্কের পুকুরের ধারে বসে সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দেওয়া। পার্কটি ঐ বয়সে দারুণ নান্দনিক মনে হতো। এই পার্কে প্রতি শীতে শিল্প-বাণিজ্য প্রদর্শনী হতো যার আকর্ষণ ঐ বয়সে কম ছিল না।

শহরে দু’টি সিনেমা হল ছিল- মুক্তি (যার নাম আগেই উল্লেখ করেছি) এবং তাজ। এই হল দু’টির মর্নিং শোতে ইংরেজি সিনেমা এবং স্বাভাবিক শোতে ভারতীয় হিন্দি/উর্দু এবং বাংলা চলচ্চিত্র হতো। তাজ সিনেমা হলটি ভারি সুন্দর ছিল- আমার সেই তরুণ বয়সে এই হলটিকে মনে হতো একটি আধুনিকতম প্রেক্ষাগৃহ। হলটি ছিল নওগাঁ শহরের যমুনা (লিটল যমুনা) নদীর ওপর দিয়ে পার হয়ে লর্ড লিটন ব্রিজের অপর প্রান্তে নওগাঁ-সান্তাহার রাস্তার ওপর। এই রাস্তা দিয়ে তখন ঘোড়াটানা টমটম নওগাঁ-সান্তাহার যাতায়াত করত। ব্রিজটি আমার নস্টালজিয়া, কারণ এর ওপর দিয়ে আমি অসংখ্যবার হেঁটেছি ঐ তাজ সিনেমা হলে সিনেমা দেখার জন্য। শুনেছি ব্রিজটি নাকি একবার ভেঙে পড়েছিল এবং পরে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তি সিনেমা হলটি- সে আমলে যেমনটা হতো- একটি গুদাম ঘরকে প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত করলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। এমন একটি সিনেমা হল সান্তাহারেও ছিল যেখানে আমি দিলীপ কুমার-নাদিরা অভিনীত ভারতবর্ষেরপ্রথম রঙিন সিনেমা “আন” দেখেছিলাম। আমার নিয়মিত অভ্যাস ছিল ঐ তাজ সিনেমা হলে মর্নিং শোতে ইংরেজি সিনেমা দেখা। তবে আমাদের যুগে সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রায় সবগুলো চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি, অপরাজিত, জলসাঘর, তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা, অজয় করের জিঘাংসা, শ্যামলী, অসিত সেনের দ্বীপ জ্বেলে যাই, ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, এবং এও মনে পড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক উপন্যাসের চলচ্চিত্র রুটিনভাবে দেখেছি, যার ভেতর নিষ্কৃতি, মেজদিদি এবং বড়দিদি দেখে হলে বসে অনেক কেঁদেছি। ঐ বয়সে অযান্ত্রিক আমি তেমন উপভোগ করিনি, যদিও উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক সিনেমা দেখে কম শিহরিত হইনি, এবং মায়ামৃগ সিনেমায় উত্তমকে পার্শ্বচরিত্রে, এবং বিশ্বজিৎ ও সন্ধ্যা রায়কে মূল চরিত্রে দেখে মনঃকষ্টে ভুগেছি বৈকি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম এবং তখন অযান্ত্রিক বেশ কয়েকবার দেখে মনে হয়েছে এই চলচ্চিত্রটির জন্য ঋত্বিক ঘটকের অস্কার পাবার যোগ্যতা সম্ভবত ছিল। মানুষ এবং পশুর সম্পর্কের জন্য যদি লাইফ অব পাই ২০১২ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেতে পারে, তবে মানুষের সাথে যন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে সেই ১৯৫৮ সালে প্রস্তুত চলচ্চিত্র কেন এত অবহেলিত হবে! সেই সাথে ১৯৩৬ সালে চার্লি চ্যাপলিন লিখিত-পরিচালিত চলচ্চিত্র “মডার্ন টাইমস”-এর কথাও মনে আসছে। আর্থিক মন্দা এবং শিল্পায়নের উৎকর্ষের চাপে মানুষ কীভাবে নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে ত্রিশের দশকে তারই দলিল এই নির্বাক

চলচ্চিত্র। দু’দশক দু’বছর পর ঋত্বিক সুবোধ ঘোষের উপন্যাস নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত এক দৃষ্টিতে সবাক যুগে একটি অযান্ত্রিক ছবি বানালেন, যেখানে নির্বাক-নিষ্প্রাণ এক যন্ত্র, ট্যাক্সি, সবাক প্রাণময় একজন মানুষের বন্ধু-সুহৃদ হয়ে উঠলো। যন্ত্রের সাথে বসবাস করতে করতে সময়ে মানুষের বোধ ও অনুভূতি কীভাবে বদলে যায় তারই আখ্যান অযান্ত্রিক।

এই সময়ে অনেক ভারতীয় হিন্দি এবং পাকিস্তানি উর্দু সিনেমা দেখেছি, কারণ তখন পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমা পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি- নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর। আমাদের যুগে দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, অশোক কুমার, কিশোর কুমার, মেহমুদ, প্রাণ, নাদিরা, মিনা কুমারী, মধুবালা, হেলেন, মালা সিনহা এবং অরও অনেকের সিনেমা আমরা দেখেছি। পাকিস্তানি নায়ক-নায়িকাদের ভেতর দেখেছিলাম সন্তোষ কুমার, সুধীর, জীয়া মহিউদ্দিন, সাবিহা, নিলু, শামিম আরা, ফরিদা জালাল, জাহরাকে। এদের ভেতর সাবিহা-সন্তোষ জুটি খুবই দর্শকপ্রিয় ছিল। জীয়া মহীউদ্দিন ষাটের দশকে ভীষণ দামী অভনেতা হিসেবে সম্মান পেতো ১৯৬২ সালে লরেন্স অব অ্যারাবিয়াতে তার পিটার ও’টুল, অ্যালেক গিনেস, অ্যান্থনি কুইন, জ্যাক হকিন্স এবং ওমার শরিফের মতো জাঁদরেল হলিউডি অভিনেতাদের সাথে অভিনয় করার কারণে। পরবর্তীতে জীয়াকে পাকিস্তান টেলিভিশনে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান করতে দেখা গেছে, মহিউদ্দিন শো শিরোনামে ১৯৬৯ সাল থেকে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে অন্যান্য বাঙালি অভিনেতাদের ছাড়াও যেসব উর্দুভাষী পাকিস্তানি অভিনেতাদের পেয়েছিলাম তাঁদের ভেতর দর্শকপ্রিয়রা ছিল মোহাম্মদ আলি, ওয়াহিদ মুরাদ, দর্পণ, জেবা, নাদিমদের- যতদূর মনে পড়ে নাদিম প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে ঢাকাতে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছে। মজার ব্যাপার হলো পাকিস্তানের সবচাইতে দর্শক-নন্দিত উর্দু চলচ্চিত্র- যেমন জাগো হুয়া সাভেরা, চান্দা, প্রিত না জানে রিত, তালাস, সঙ্গম, তানহা, মিলন, বাহানা ইত্যাদি- এসবগুলোই হয়েছে ঢাকাতে।

নওগাঁতে আমাদের বাসা ছিল ঐ যমুনা নদীর ধারে মহকুমা কর্মকর্তার (এসডিও) বাসার ঠিক পাশেই। মনে আছে তখন নওগাঁর এসডিও ছিলেন আবদুর রব চৌধুরী যিনি দেশ স্বাধীন হবার পর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৯১-১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রতিবেশীরূপে তাঁর, তাঁর স্ত্রী ও ছেলের (তখন তার বয়স ৬/৭ হবে) সাথে বেশ হৃদ্যতা ছিল। একবার বেশ রাতে আমাদের বাসার উঠোনে (তখন সরকারি বাসাগুলোতেও বেশ বড় উঠোন থাকতো) হঠাৎ করে একটি শিয়াল ঢুকে পড়েছিল যাকে দেখে আমরা তিন ভাইবোন সমস্বরে ডাকাত পড়ার মতো চিৎকার শুরু করেছিলাম (বাবা বাসায় ছিলেন না, কারণ তিনি সন্ধ্যা হলেই নওগাঁর অফিসার্স রিক্রিয়েশন ক্লাবে তাস খেলতে যেতেন। বাবা একসময় এই ক্লাবের প্রেসিডেন্টও ছিলেন)। ফলে পাশের বাসা থেকে আবদুর রব চৌধুরীর স্ত্রী, পিওন-চাপরাশিসহ, দৌড়ে এসেছিলেন আমাদের বিপদের কথা শঙ্কা করে। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিল এবং পরবর্তীকালে দেখা হলেই আমরা ভাইবোনেরা তাঁর কাছ থেকে বেশ প্রীতিকর হাস্যরসিকতা শুনতাম।

আমাদের বাসাটা নওগাঁর প্রধান রাস্তার পাশেই ছিল। নওগাঁতে প্রতি বুধবারে গ্রামের মতো হাট বসতো এবং আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা জনাকীর্ণ হয়ে উঠতো। বাড়ির বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে একজন জাদুকর জাদু দেখাতো খোলা আকাশের নিচে। আমিও অনেকবার অবাক চোখে এই জাদু দেখেছি। সবচাইতে বিস্ময়কর ছিল, সে একটা বাচ্চা ছেলেকে সবার সামনে ধামাচাপা দিত তারপর বেশ খানিকক্ষণ তার ডুগডুগি বাজিয়ে ধামা উল্টিয়ে দেখাত ছেলেটি সেখানে নেই। এরপর ছেলেটির সাথে সে কথা বলতো, এবং ছেলেটির কথা শূন্য থেকে ভেসে আসতো। কোনও জাদুকরী প্রস্তুতি ছাড়া খোলা আকাশের নিচে মানুষ উধাও করে দেয়া এবং তার সাথে কথা বলা দেখে আমি অভিভূত হতাম এবং এখনো ভাবি সেই যাদু পি সি সরকার কিংবা ডেভিড কপারফিল্ডের চাইতে কোনো অংশেই অবহেলার ছিল না। সেই সাথে ছিল রঙিন ছবি টাঙিয়ে শিলাজুত বা শিলাজাত বিক্রির বক্তৃতা। এটি এক অর্থে আমার যৌনচেতনার প্রথম পাঠ, কারণ এই ঔষধটি বিক্রির জন্য যে যৌনতথ্যের বর্ণনা দেয়া হতো তা ঐ বয়সের অবদমিত যৌনকৌতূহলকে অনেকটাই ভ্রান্ত পথে মিটিয়েছি আমি। জানি না কেন আমরা এখনও এ ব্যাপারে এত রাখঢাক করে তরুণ-তরুণীদের ভুল তথ্য দেবার পথ প্রশস্ত করি।

বাসার সামনে বিশাল খোলা জায়গা এবং পেছনেও খালি জায়গার পর ছিল যমুনা নদী। বাবা এই খালি জায়গাতে মহাকুমা কৃষি অফিস থেকে ট্রাক্টর এনে শীতের সব্জি চাষ করাতেন- ফুল কপি, আলু, টমেটো, বাঁধাকপি, গাজর, মটরশুঁটি এবং এমন আরও। এসবের যতœ করতো ঐ নজরুল ইসলাম এবং অন্য একজন বিহারী পিওন খোদাবক্স খান। বাসার পেছনে যমুনা নদীতে হতো আমার সাঁতারের পারফেকশন (কারণ আমি আগেই সাঁতারটা রপ্ত করেছিলাম সান্তাহারে আমাদের তখনকার বাসস্থানের সামনের পুকুরে দাপাদাপি করে)।

এভাবেই আমার নওগাঁ জীবনের নস্টালজিয়ার পরিপূর্ণতা এবং কলেজ-জীবনের সমাপ্তি, কারণ ১৯৬৩ সালে আমার বাবা বদলি হন ময়মনসিংহে। তখন আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফলে অপেক্ষা ছিল রেজাল্টের। আমার রেজাল্ট বেরুবার পর আমি সিদ্ধান্তমতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় এসে ওয়ারির ৯/১ রেঙ্কিন স্ট্রিটে আমার এক চাচাতো বোনের বাড়িতে উঠি। এ বাড়িটি বেশকিছু ইতিহাসের সাক্ষী যার ভেতর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধও অন্তর্গত। আমার এই বোনের বাসাতেই কিংবদন্তিতুল্য বিখ্যাত সাংবাদিক ওবায়েদ উল হক নিচতলাতে থাকতেন। তাঁর বড় ছেলে মাশুকুল হক আমার বয়সী এবং আমরা একই বছরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। আমার চাচাতো ভাইও (আমার ঐ চাচাতো বোনের ছোট ভাই) আমার সাথেই পাশ করেছিল। ও পড়তো ঢাকা কলেজে ঐ বোনের বাসায় থেকে, এবং ফলে মাশুকের সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা আগে থেকেই ছিল। এরই সাথে আরও একজন, যার নাম আমি সঠিক মনে করতে পারছি না, যতদূর মনে পড়ে সে সম্ভবত ঢাকা কলেজের বিখ্যাত ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের আত্মীয়ই ছিল, তার সাথে পরিচয় হয়। আমি ওদের বন্ধু হয়ে গেলাম তাৎক্ষণিক। আমরা তিনজন- আমি, সাদুল্লাহ (আমার চাচাতো ভাই) এবং শেষোক্ত সাদুল্লাহর সেই নাম-ভুলে-যাওয়া সহপাঠী- একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য নেয়া শুরু করলাম। কোনো অজ্ঞাত কারণে মাশুক আমাদের সাথে তেমন ঘোরাফেরা করতো না, যদিও প্রতি সন্ধ্যাতে তার ঘরে বসে (ঘরটা ছিল একতলার ঠিক সিঁড়িরে নিচে এবং অত্যন্ত সংকীর্ণ, যদিও খুবই প্রাইভেট) তার সাথে সাদুল্লাহ এবং আমি সারাদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতাম। মাশুক বেশ সিগারেট খেত- মাঝেমধ্যে সাদুল্লাহও- কিন্তু আমি ছিলাম গোবেচারা গুড বয়, ঠোঁটে সিগারেট ঠেকাতাম না। ওরা বেশ মেয়েদের নিয়ে মুখরোচক গল্প করতো যা শুনতে আমার বেশ ভালই লাগতো, কিন্তু আমার নিজের ঐ সময় পর্যন্ত মেয়েদের সাথে মেলামেশা করার সাহস বা অভিজ্ঞতা ছিল না যদিও আমি স্কুলে কিছুটা সময় এবং কলেজে পুরোটা সময়ই মেয়েদের সাথেই পড়াশোনা করেছি। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা বেশ লাজুকতার মধ্যেই কেটেছে, তবে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকাকালে আমি আমার কথাবার্তাতে বেশ “ফাজিল” হয়ে উঠেছিলাম। মেয়েদের সাথে মেশার লাজুকতা বা শীতলতা থেকে আমার প্রকৃত উত্তরণ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর থেকে। সেটা আর এক স্মৃতি-অধ্যায়। (চলবে)