বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রথম টিউবের কাজ শেষ, যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে জানুয়ারিতে

চট্টগ্রামের লুসাই কন্যা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের একটি টিউবের অবকাঠামো (পূর্ত) নির্মাণ শতভাগ শেষ হয়েছে। গতকাল সকালে টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম টানেলের কাজের এই সমাপ্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।

দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশের প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল জানুয়ারিতে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে টানেলের ৯৪ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিমি এবং এতে দুটি টিউব রয়েছে। প্রতিটিতে দুটি লেন রয়েছে। এই দুটি টিউব তিনটি জংশনের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হবে। এই ক্রস প্যাসেজগুলো জরুরি পরিস্থিতিতে অন্যান্য টিউবগুলোতে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কি.মি. এবং ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার।

মূল টানেলের পশ্চিম এবং পূর্ব দিকে একটি ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে।

বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় প্রায় ১০,৫৩৭ কোটি টাকা।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন।

টানেলটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং আনোয়ারায় কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মধ্যে নদীর তলদেশে সংযোগ স্থাপন করছে।

দক্ষিণ টিউবের কাজ সমাপ্তি উদ্যাপনের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস চট্টগ্রামে উদ্যাপনের স্থান পরিদর্শন করেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কায়কাউস বলেন, টানেলটি জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি টানেলটি চট্টগ্রামের যানজট পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি ঘটাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সমাপ্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রমুখ।

এছাড়া পতেঙ্গায় টানেলস্থলে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল আলম চৌধুরী নওফেল, চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিন মিং, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন ও প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদসহ স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ শেষ হওয়া উদ্যাপনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়।

টানেলে চীনের অর্থায়ন : স্মৃতিচারণ সচিবের

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সঙ্গে অবকাঠামো ও আর্থিকভাবে যুক্ত রয়েছে চীন। তবে শুরুতে এই টানেল অর্থায়নে রাজি ছিল না তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টার পরও রাজি হয়নি তারা। পরে সেখানে এক নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কনভেনশনাল ডিপ্লোম্যাসির কারণে তা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

গতকাল কর্নফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপনী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে সেই স্মৃতিচারণ করেন সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমার মনে আছে, ২০১৪ সালের সেই সোমবার, সেদিন আমরা যখন প্রথম এই টানেলের পরিকল্পনা করি, তখন চীনের একটা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তবে প্রথমে তারা এই টানেল করতে আগ্রহী ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর কনভেনশনাল ডিপ্লোম্যাসির বাইরে গিয়ে যেটা করেছেন সেটার বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে এই টানেল।’

সেসময়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘চীন আমাদের প্রথমে কথা দিল, তারা টানেল করে দেয়ার জন্য সবরকম ঋণ ও সহায়তা দেবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের জুলাই মাসের ফার্স্ট উইকে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যান। তখন ব্রিজ ডিভিশন থেকে আমাদের ইনডাক্ট করা হলো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখম চীনে গেলাম, সব চুক্তিপত্র নিয়ে যেদিন সন্ধ্যায় মিটিং হবে, তার আগেরদিন রাতে আমাদের জানানো হলো— চীনা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই প্রজেক্টে তারা সহায়তা দিতে প্রস্তুত নন। এরপর আমরা রাত ১টা-২টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অনেক নেগোসিয়েশন করার পর ওনারা রাজি হলেন না।’

তিনি বলেন, ‘পরদিন যখন ২টার সময় মিটিং শুরু হলো, তখন প্রধানমন্ত্রী বলার পর চাইনিজ সরকার বিনীতভাবে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বলার পরেও তারা সম্মত হননি।’

‘এজন্য আমরা একটু মনোকষ্টে ছিলাম’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে ডিনারের সময় প্রধানমন্ত্রী একটা আনকনভেনশনাল ডিপ্লোমেটিক আলোচনা তুলে এই টানেলের বিষয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাইনিজ সরকার আমাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। যদি এইভাবে ফিরিয়ে দেয় তাহলে ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে বা মানুষের মধ্যে কী ধরনের মনোভাব তৈরি হতে পারে সেটি উল্লেখ করেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী)। আরও বলেন, আপনারাই আমাদের ইনভাইট করেছেন, আমরা আপনাদের কাছে চাইনি।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘তখন চীনা প্রাইম মিনিস্টার আমাদের ডাকলেন, আর সবাইকে ইন্সট্রাকশন দিলেন। ডাইনিং টেবিলেই চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টার ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চাইনিজ কমার্স মিনিস্টার, ফাইন্যান্স মিনিস্টার এবং আমরা যখন আলোচনা শুরু করলাম, তখন প্রধানমন্ত্রীর কথায় চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টার কনভিন্স হলেন। তখন তিনি ভোর ৪টায় একটি লেট নাইট ডিনার আহ্বান করলেন। যেখানে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথাও জানালেন।

সচিব বলেন, ‘তখন প্রধানমন্ত্রী চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টারকে বললেন, আপনার আসার দরকার নেই। আমার বড় স্যুইটে বড় ড্রইংরুম আছে, সেখানে বসেই চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলবো। পরে রাত ১২টায় প্রধানমন্ত্রীর রুমে বসে চাইনিজ কমার্স মিনিস্টার ও আমরা চুক্তিটা স্বাক্ষর করেছি। আর এখানে আনকনভেশনাল ডিপ্লোমেটিক এফোর্ট না থাকলে এটা কোনভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না।’

তিনি বলেন, রাত ১২টায় আমরা যখন চুক্তি স্বাক্ষর করে বের হয়ে যাই তখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের বললেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছো। আমি বললাম স্যার (প্রধানমন্ত্রী), আমাদের তো কাজ শেষ। আমরা রুমে চলে যাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তোমরা কোথাও যাবে না। না খেয়ে আছো। টেবিলে ভাত, সবজি, ডাল, গরুর মাংস আছে খেয়ে যাও। উনি এই বিষয়টিও খেয়াল করেছেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে খেতে পারিনি, আসলেই আমরা অভুক্ত ছিলাম। এই যে এত বিপর্যয়ের মধ্যে, এত টেনশনের মধ্যেও আমাদের ব্যক্তিগত দিকগুলোও খেয়াল রেখেছেন, তা না হলে এটা আসলে বাস্তবে রূপ নিত না। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।’

এ সময় এই টানেল নির্মাণে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

রবিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২২ , ১২ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ৩১ রবিউস সানি ১৪৪৪

বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রথম টিউবের কাজ শেষ, যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে জানুয়ারিতে

চট্টগ্রাম ব্যুরো

image

চট্টগ্রামের লুসাই কন্যা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের একটি টিউবের অবকাঠামো (পূর্ত) নির্মাণ শতভাগ শেষ হয়েছে। গতকাল সকালে টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম টানেলের কাজের এই সমাপ্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।

দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশের প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল জানুয়ারিতে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে টানেলের ৯৪ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিমি এবং এতে দুটি টিউব রয়েছে। প্রতিটিতে দুটি লেন রয়েছে। এই দুটি টিউব তিনটি জংশনের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হবে। এই ক্রস প্যাসেজগুলো জরুরি পরিস্থিতিতে অন্যান্য টিউবগুলোতে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কি.মি. এবং ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার।

মূল টানেলের পশ্চিম এবং পূর্ব দিকে একটি ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে।

বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় প্রায় ১০,৫৩৭ কোটি টাকা।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন।

টানেলটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং আনোয়ারায় কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মধ্যে নদীর তলদেশে সংযোগ স্থাপন করছে।

দক্ষিণ টিউবের কাজ সমাপ্তি উদ্যাপনের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস চট্টগ্রামে উদ্যাপনের স্থান পরিদর্শন করেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কায়কাউস বলেন, টানেলটি জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি টানেলটি চট্টগ্রামের যানজট পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি ঘটাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সমাপ্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রমুখ।

এছাড়া পতেঙ্গায় টানেলস্থলে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল আলম চৌধুরী নওফেল, চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিন মিং, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন ও প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদসহ স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ শেষ হওয়া উদ্যাপনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়।

টানেলে চীনের অর্থায়ন : স্মৃতিচারণ সচিবের

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সঙ্গে অবকাঠামো ও আর্থিকভাবে যুক্ত রয়েছে চীন। তবে শুরুতে এই টানেল অর্থায়নে রাজি ছিল না তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টার পরও রাজি হয়নি তারা। পরে সেখানে এক নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কনভেনশনাল ডিপ্লোম্যাসির কারণে তা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

গতকাল কর্নফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপনী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে সেই স্মৃতিচারণ করেন সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমার মনে আছে, ২০১৪ সালের সেই সোমবার, সেদিন আমরা যখন প্রথম এই টানেলের পরিকল্পনা করি, তখন চীনের একটা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তবে প্রথমে তারা এই টানেল করতে আগ্রহী ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর কনভেনশনাল ডিপ্লোম্যাসির বাইরে গিয়ে যেটা করেছেন সেটার বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে এই টানেল।’

সেসময়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘চীন আমাদের প্রথমে কথা দিল, তারা টানেল করে দেয়ার জন্য সবরকম ঋণ ও সহায়তা দেবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের জুলাই মাসের ফার্স্ট উইকে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যান। তখন ব্রিজ ডিভিশন থেকে আমাদের ইনডাক্ট করা হলো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখম চীনে গেলাম, সব চুক্তিপত্র নিয়ে যেদিন সন্ধ্যায় মিটিং হবে, তার আগেরদিন রাতে আমাদের জানানো হলো— চীনা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই প্রজেক্টে তারা সহায়তা দিতে প্রস্তুত নন। এরপর আমরা রাত ১টা-২টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অনেক নেগোসিয়েশন করার পর ওনারা রাজি হলেন না।’

তিনি বলেন, ‘পরদিন যখন ২টার সময় মিটিং শুরু হলো, তখন প্রধানমন্ত্রী বলার পর চাইনিজ সরকার বিনীতভাবে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বলার পরেও তারা সম্মত হননি।’

‘এজন্য আমরা একটু মনোকষ্টে ছিলাম’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে ডিনারের সময় প্রধানমন্ত্রী একটা আনকনভেনশনাল ডিপ্লোমেটিক আলোচনা তুলে এই টানেলের বিষয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাইনিজ সরকার আমাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। যদি এইভাবে ফিরিয়ে দেয় তাহলে ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে বা মানুষের মধ্যে কী ধরনের মনোভাব তৈরি হতে পারে সেটি উল্লেখ করেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী)। আরও বলেন, আপনারাই আমাদের ইনভাইট করেছেন, আমরা আপনাদের কাছে চাইনি।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘তখন চীনা প্রাইম মিনিস্টার আমাদের ডাকলেন, আর সবাইকে ইন্সট্রাকশন দিলেন। ডাইনিং টেবিলেই চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টার ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চাইনিজ কমার্স মিনিস্টার, ফাইন্যান্স মিনিস্টার এবং আমরা যখন আলোচনা শুরু করলাম, তখন প্রধানমন্ত্রীর কথায় চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টার কনভিন্স হলেন। তখন তিনি ভোর ৪টায় একটি লেট নাইট ডিনার আহ্বান করলেন। যেখানে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথাও জানালেন।

সচিব বলেন, ‘তখন প্রধানমন্ত্রী চাইনিজ প্রাইম মিনিস্টারকে বললেন, আপনার আসার দরকার নেই। আমার বড় স্যুইটে বড় ড্রইংরুম আছে, সেখানে বসেই চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলবো। পরে রাত ১২টায় প্রধানমন্ত্রীর রুমে বসে চাইনিজ কমার্স মিনিস্টার ও আমরা চুক্তিটা স্বাক্ষর করেছি। আর এখানে আনকনভেশনাল ডিপ্লোমেটিক এফোর্ট না থাকলে এটা কোনভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না।’

তিনি বলেন, রাত ১২টায় আমরা যখন চুক্তি স্বাক্ষর করে বের হয়ে যাই তখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের বললেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছো। আমি বললাম স্যার (প্রধানমন্ত্রী), আমাদের তো কাজ শেষ। আমরা রুমে চলে যাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তোমরা কোথাও যাবে না। না খেয়ে আছো। টেবিলে ভাত, সবজি, ডাল, গরুর মাংস আছে খেয়ে যাও। উনি এই বিষয়টিও খেয়াল করেছেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে খেতে পারিনি, আসলেই আমরা অভুক্ত ছিলাম। এই যে এত বিপর্যয়ের মধ্যে, এত টেনশনের মধ্যেও আমাদের ব্যক্তিগত দিকগুলোও খেয়াল রেখেছেন, তা না হলে এটা আসলে বাস্তবে রূপ নিত না। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।’

এ সময় এই টানেল নির্মাণে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।