মিথ্যা বিয়ে, মিথ্যা কাবিননামা, যৌতুকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তুরাগ থানার রাজাবাড়ী এলাকায় একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা মামলা, মিথ্যা দলিল, মিথ্যা বিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করে আসছে। চক্রটি মিথ্যা কাবিননামা তৈরি করে মিথ্যা স্ত্রী সাজিয়ে কখনো নারী নির্যাতন কখনো যৌতুকের মামলায় ফাঁসিয়ে নগদ অর্থ, সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে নিরীহ মানুষকে সর্বস্বান্ত করারও প্রমাণ আছে বলে এলাকার মানুষ জানায়।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন রাজাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কাশেমের ছেলে মো. শাহজালাল মিয়া। বয়স ৩৪। কয়েকবছর কম্বোডিয়ায় থেকে বয়স্ক বাবা অসুস্থ হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে যৌতুকের মামলার আসামি হিসেবে তিনি গ্রেপ্তার হন। জেলও খাটেন দুই দিন।

শাহজালাল সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিয়েশাদি কিছু হয় নাই। কিন্তু আমার নামে যৌতুকের মামলা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যৌতুক আইনে একটি মামলা দায়ের করে রোকসনা বেগম (৩০) নামের এক নারী। মামলায় তার পিতার নাম দেয়া হয় মৃত ইউসুফ মোল্লা আর মাতার নাম ফাতেমা খাতুন এবং ঠিকানা দেয়া হয় সাং মহনপুর, পো. আলগা, থানা- নবাবগঞ্জ, জেলা- ঢাকা। এই ঠিকানা, না-ধাম সবই ভুয়া।’

শাহজালাল বলেন, ‘মামলার বাদী রোকসানাকে আমি চিনি না, কোনদিন দেখিওনি। মামলায় যে ফোন নম্বর দেয়া হয়েছিল সেগুলোও ছিল ভুল। একটা নম্বর খোলা পাওয়া গিয়েছিল। সেই নম্বরে ফোন দিলে এক বুয়া (বাসার কাজের লোক) ফোন ধরে।’

শাহজালাল মিয়া বলেন, ‘এই চক্রটি প্রথমে নজর রাখে, কাকে তাদের ফাঁদে ফেলা যায়। আসলে আমার বাবার বয়স হয়ে গেছে। একটাই বোন, ওরও বিয়ে হয়ে গেছে। আমি বাবার একমাত্র ছেলে। স্বাভাবিকভাবে বাবার ব্যবসা এখন আমিই দেখাশোনা করি। তাই আমারে ফাঁসানো খুব সোজা। আমি ভয় পেয়ে ওদের কথামতো টাকা পয়সা দিয়া দিব এটাই ছিল ওদের পরিকল্পনা।’

‘এই চক্রটি মনে করছে আমার কাছ থেকে টাকা বাইর করা সম্ভব। নারী নির্যাতন বা যৌতুকের মামলা দিলে আমি ভয় পেয়ে তারা যা বলবে তাই করবো। কিন্তু আমি সেটা হতে দেই নাই। ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনেকেই নিষেধ করছিল, কিন্তু আমি মনে করছি কাউরে না কাউরে আগায় আসা দরকার।’

চক্রটি তাদের পরিকল্পনা মতো এগিয়েও গিয়েছিল। যৌতুক মামলার আসামি করে গ্রেপ্তার করে দুই দিন জেলও খাটেন। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে পাল্টা মামলা করেন শাহজালাল।

শাহজালালকে দেয়া মামলার বিবরণীতে যা লেখা আছে তা হলো- ‘১৪/০৫/২০১২ইং তারিখে দুই লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া ব্যবসায়ী মো. শাহজালাল মিয়ার সঙ্গে মামলার বাদী রোকসানার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই বাদী রোকসানা বেগমের কাছে ২নং বিবাদীর সহায়তায় ১নং বিবাদী বিভিন্ন সময় যৌতুক বাবদ দুই লাখ টাকা দাবি করে আসছিল। বাদী যৌতুকের দুই লাখ টাকা দিতে না পারায় তার ওপর বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত বিবাদী মো. শাহজালাল মিয়া । এক পর্যায় নির্যাতনে অসহ্য হয়ে ১০/০৯/২০২০ইং তারিখে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে উক্ত মামলাটি দায়ের করেন রোকসনা বেগম।

পরে উক্ত মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে গত ৩/১১/২০২০ইং তুরাগ থানা পুলিশ মামলার দুই বিবাদীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেন। পরে দুই দিন কারাবাসের পর দুই বিবাদী জামিনে মুক্তি পান। আর জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরেই তারা জানতে পারেন মামলার বিষয়টি। পরে বেশ কিছুদিন মামলাটি চললেও বাদী বা সাক্ষীদের দেখা পাননি আদালত ও মামলার বিবাদীরা। এমনকি মামলায় উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়েও মামলার বাদী বা সাক্ষীদের কোন হদিস মেলেনি। পরে মামলার আসামিদের বেকসুল খালাস প্রদান করে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন আদালত।

পরে এই মামলার ১নং বিবাদী মো. শাহজালাল মিয়া বাদী হয়ে মিথ্যা মামলার বাদীসহ মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করলে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেন।

মামলায় যে ৫ জনকে আসামি করেন শাহজালাল তারা হলেন, রোকসানা বেগম, মো. ইয়াকুব আলী, মো. সাগর, মো. আবুল কাশেম ও মো. সেলিম।

শাহজালাল জানান, ‘আমার বিরুদ্ধে যে মামলাটি করা হয়েছিল সেই মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট ছিল বলেই আদালত আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। আর আমি যাদের আসামি করেছি এরা সবাই ওই মিথ্যা কাবিননামায় সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দিয়েছে।’

শাহজালাল অভিযোগ করে বলেন, ‘জানতে পেরেছি, আমাদের এলাকার শুক্কুর আলীর ছেলে নুরুন্নবী ওরফে নুরুদ্দিন ও পার্শ্ববর্তী ভাটুলিয়া এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছেলে গোলাম রাসেল সেইয়াল তাদের দলের নারী সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সাক্ষী বানিয়ে আমার ও আমার প্রতিবেশী ইয়াকুব কবিরের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা করে।’

‘আমি এই চক্রের কবল থেকে বাঁচতে, এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছি’ বলে জানান তিনি।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই (সিআইডি) মো. আইয়ুব আলী সংবাদকে বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত চলছে। তাই এই মুহূর্তে কোন কথা বলা ঠিক হবে না’। তবে খুব শীঘ্রই প্রতিবেদন দিতে পারবেন বলে জানান এই তদন্ত কর্মকর্তা।

বিষয়টি জানতে নুরুন্নবী ওরফে নুরুদ্দিন ও গোলাম রাসেল সেইয়ালের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

রবিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২২ , ১২ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ৩১ রবিউস সানি ১৪৪৪

প্রতারণার নতুন কৌশল

মিথ্যা বিয়ে, মিথ্যা কাবিননামা, যৌতুকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তুরাগ থানার রাজাবাড়ী এলাকায় একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা মামলা, মিথ্যা দলিল, মিথ্যা বিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করে আসছে। চক্রটি মিথ্যা কাবিননামা তৈরি করে মিথ্যা স্ত্রী সাজিয়ে কখনো নারী নির্যাতন কখনো যৌতুকের মামলায় ফাঁসিয়ে নগদ অর্থ, সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে নিরীহ মানুষকে সর্বস্বান্ত করারও প্রমাণ আছে বলে এলাকার মানুষ জানায়।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন রাজাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কাশেমের ছেলে মো. শাহজালাল মিয়া। বয়স ৩৪। কয়েকবছর কম্বোডিয়ায় থেকে বয়স্ক বাবা অসুস্থ হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে যৌতুকের মামলার আসামি হিসেবে তিনি গ্রেপ্তার হন। জেলও খাটেন দুই দিন।

শাহজালাল সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিয়েশাদি কিছু হয় নাই। কিন্তু আমার নামে যৌতুকের মামলা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যৌতুক আইনে একটি মামলা দায়ের করে রোকসনা বেগম (৩০) নামের এক নারী। মামলায় তার পিতার নাম দেয়া হয় মৃত ইউসুফ মোল্লা আর মাতার নাম ফাতেমা খাতুন এবং ঠিকানা দেয়া হয় সাং মহনপুর, পো. আলগা, থানা- নবাবগঞ্জ, জেলা- ঢাকা। এই ঠিকানা, না-ধাম সবই ভুয়া।’

শাহজালাল বলেন, ‘মামলার বাদী রোকসানাকে আমি চিনি না, কোনদিন দেখিওনি। মামলায় যে ফোন নম্বর দেয়া হয়েছিল সেগুলোও ছিল ভুল। একটা নম্বর খোলা পাওয়া গিয়েছিল। সেই নম্বরে ফোন দিলে এক বুয়া (বাসার কাজের লোক) ফোন ধরে।’

শাহজালাল মিয়া বলেন, ‘এই চক্রটি প্রথমে নজর রাখে, কাকে তাদের ফাঁদে ফেলা যায়। আসলে আমার বাবার বয়স হয়ে গেছে। একটাই বোন, ওরও বিয়ে হয়ে গেছে। আমি বাবার একমাত্র ছেলে। স্বাভাবিকভাবে বাবার ব্যবসা এখন আমিই দেখাশোনা করি। তাই আমারে ফাঁসানো খুব সোজা। আমি ভয় পেয়ে ওদের কথামতো টাকা পয়সা দিয়া দিব এটাই ছিল ওদের পরিকল্পনা।’

‘এই চক্রটি মনে করছে আমার কাছ থেকে টাকা বাইর করা সম্ভব। নারী নির্যাতন বা যৌতুকের মামলা দিলে আমি ভয় পেয়ে তারা যা বলবে তাই করবো। কিন্তু আমি সেটা হতে দেই নাই। ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনেকেই নিষেধ করছিল, কিন্তু আমি মনে করছি কাউরে না কাউরে আগায় আসা দরকার।’

চক্রটি তাদের পরিকল্পনা মতো এগিয়েও গিয়েছিল। যৌতুক মামলার আসামি করে গ্রেপ্তার করে দুই দিন জেলও খাটেন। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে পাল্টা মামলা করেন শাহজালাল।

শাহজালালকে দেয়া মামলার বিবরণীতে যা লেখা আছে তা হলো- ‘১৪/০৫/২০১২ইং তারিখে দুই লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া ব্যবসায়ী মো. শাহজালাল মিয়ার সঙ্গে মামলার বাদী রোকসানার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই বাদী রোকসানা বেগমের কাছে ২নং বিবাদীর সহায়তায় ১নং বিবাদী বিভিন্ন সময় যৌতুক বাবদ দুই লাখ টাকা দাবি করে আসছিল। বাদী যৌতুকের দুই লাখ টাকা দিতে না পারায় তার ওপর বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত বিবাদী মো. শাহজালাল মিয়া । এক পর্যায় নির্যাতনে অসহ্য হয়ে ১০/০৯/২০২০ইং তারিখে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে উক্ত মামলাটি দায়ের করেন রোকসনা বেগম।

পরে উক্ত মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে গত ৩/১১/২০২০ইং তুরাগ থানা পুলিশ মামলার দুই বিবাদীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেন। পরে দুই দিন কারাবাসের পর দুই বিবাদী জামিনে মুক্তি পান। আর জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরেই তারা জানতে পারেন মামলার বিষয়টি। পরে বেশ কিছুদিন মামলাটি চললেও বাদী বা সাক্ষীদের দেখা পাননি আদালত ও মামলার বিবাদীরা। এমনকি মামলায় উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়েও মামলার বাদী বা সাক্ষীদের কোন হদিস মেলেনি। পরে মামলার আসামিদের বেকসুল খালাস প্রদান করে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন আদালত।

পরে এই মামলার ১নং বিবাদী মো. শাহজালাল মিয়া বাদী হয়ে মিথ্যা মামলার বাদীসহ মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করলে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেন।

মামলায় যে ৫ জনকে আসামি করেন শাহজালাল তারা হলেন, রোকসানা বেগম, মো. ইয়াকুব আলী, মো. সাগর, মো. আবুল কাশেম ও মো. সেলিম।

শাহজালাল জানান, ‘আমার বিরুদ্ধে যে মামলাটি করা হয়েছিল সেই মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট ছিল বলেই আদালত আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। আর আমি যাদের আসামি করেছি এরা সবাই ওই মিথ্যা কাবিননামায় সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দিয়েছে।’

শাহজালাল অভিযোগ করে বলেন, ‘জানতে পেরেছি, আমাদের এলাকার শুক্কুর আলীর ছেলে নুরুন্নবী ওরফে নুরুদ্দিন ও পার্শ্ববর্তী ভাটুলিয়া এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছেলে গোলাম রাসেল সেইয়াল তাদের দলের নারী সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সাক্ষী বানিয়ে আমার ও আমার প্রতিবেশী ইয়াকুব কবিরের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা করে।’

‘আমি এই চক্রের কবল থেকে বাঁচতে, এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছি’ বলে জানান তিনি।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই (সিআইডি) মো. আইয়ুব আলী সংবাদকে বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত চলছে। তাই এই মুহূর্তে কোন কথা বলা ঠিক হবে না’। তবে খুব শীঘ্রই প্রতিবেদন দিতে পারবেন বলে জানান এই তদন্ত কর্মকর্তা।

বিষয়টি জানতে নুরুন্নবী ওরফে নুরুদ্দিন ও গোলাম রাসেল সেইয়ালের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।