দুর্নীতির সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

দুর্নীতি কমবেশি সব দেশেই আছে। যারা দুর্নীতি করে অঢেল টাকার মালিক হন তারা সচরাচর সেই টাকা দেশে রাখেন না, বিদেশে পাচার করে দেন। কিছু দেশ আছে যারা অন্য দেশের দুর্নীতিবাজদের অর্থ সানন্দে গ্রহণ করে গোপন রাখে। তাই একবার বিদেশে পাচার হয়ে গেলে সেই টাকার হদিস পাওয়া সহজ নয়। এই ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহক ছাড়া আর কাউকে তথ্য সরবরাহ করে না। এক সময় প্রায় সব দেশের দুর্নীতিবাজদের টাকা রাখা হতো সুইজারল্যা-ের ব্যাংকগুলোতে। সুইজারল্যান্ডের কোন ব্যাংকে টাকা রাখা হলে তা গ্রাহকের মৃত্যুর পরও কেউ জানতে পারতো না, ফলে তা এক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হয়ে যেত। ব্যাংক একাউন্টের এমন গোপনীয়তা জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে সহায়ক বিবেচিত হওয়ায় তা প্রকাশের জন্য চাপ বাড়তে থাকে। জঙ্গি কর্মকা-ে অর্থের যোগানে ব্যাংকিং চ্যানেল যাতে অবাধে ব্যবহৃত না হয় সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপন একাউন্ট মনিটর করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এই চাপের কারণে ব্যাংকগুলো বর্তমানে কিছু তথ্য প্রকাশ করে এবং তাতেই আমরা অবৈধ অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিতে পারি। কিন্তু অবৈধ অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে প্রকাশিত তথ্য কোন কাজেই লাগে না।

ব্যাংকিং চ্যানেলে অবৈধ অর্থকে বৈধ করার কারসাজি রোধে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তবে এই ইউনিট অবৈধ অর্থ ফেরত আনার জন্য নয়, অবৈধ অর্থ যাতে কোনভাবেই জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে, পাশাপাশি ইরান, রাশিয়া, নর্থ কোরিয়ার মতো দেশে টাকা যাচ্ছে কিনা তাও মনিটর করে। আমাদের দেশেও এমন একটি ইউনিট রয়েছে। আমাদের এই ইউনিট বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থের তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। মুশকিল হচ্ছে ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সংগৃহীত তথ্য সাক্ষী বা প্রমাণ হিসেবে আদালতে ব্যবহার করা যায় না, শুধু দেশের অভ্যন্তরে অধিকতর তদন্তের কাজে ব্যবহার করা যায়। অধিকতর তদন্তের ভিত্তিতে দেশে দায়ের করা মামলায় অনুকূল রায় পাওয়া গেলেও বিদেশি ব্যাংক থেকে সহজে অবৈধ টাকা ফেরত আনা যায় না, বিদেশে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে মামলা করে পুনরায় জিততে হয়। শুধু তাই নয়, আরও প্রক্রিয়া রয়েছেÑ অর্থ ফেরত আনতে শুধু আদালতের অনুকূল রায়ই যথেষ্ট নয়, সংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে অবৈধ অর্থ প্রত্যাবর্তনের সমঝোতা চুক্তি থাকাও অপরিহার্য।

পি কে হালদার বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করেছে, পাচার করা অর্থ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগও করেছে, কিন্তু উদ্ধার করা যাচ্ছে না। ভারত সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তার সম্পদের হিসাবনিকাশ করছে। বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজরা অবৈধ টাকা হাতে এলেই ইংল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আবুধাবি প্রভৃতি দেশে পাচার করে দেয়। অর্থ পাচার করার আগে সন্তান বা স্ত্রীকে পাচার করা হয়। পাচার করা সন্তান বা স্ত্রীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত হলেই বাড়ি কেনা হয়। বাড়ি কেনার জন্য সহজ শর্তে প্রচুর ঋণ পাওয়া যায় ওই সব দেশে। বৈধ ঋণের সঙ্গে পাচার করা অবৈধ টাকা মিশে যায়। আমাদের দেশের ধনী লোকদের সবার নাকি বিদেশে রাজপ্রাসাদ তুল্য বাড়ি আছে, ওই সব বাড়িতে তাদের সন্তান বা স্ত্রী বসবাস করে, অথবা ভাড়া দেয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে প্রচুর খালি জায়গা পড়ে রয়েছে, থাকার মানুষ নেই। এ সব দেশে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। দুর্নীতিবাজরা এই সুযোগ গ্রহণ করছে এবং দেশগুলোও তাদের সাদরে বরণ করেও নিচ্ছে। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈধ-অবৈধ যাচাই করার কোন গরজ নেই। অবৈধ অর্থ দিয়ে বিদেশিদের ‘সেকেন্ড হোম’ তৈরি করার অবাধ নিশ্চিত সুযোগ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া।

বিশ্বের ১১টি দেশের ৬০০ সাংবাদিক যে ১ কোটি ২০ লাখ গোপন নথি ফাঁস করেছে তা থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ক্ষমতাধর কিছু লোক অবৈধভাবে অর্জিত প্রচুর ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার করে তা লুকিয়ে রেখেছে এবং এদের মধ্যে ৯০টি দেশের ৩০০ জনেরও বেশি রাজনীতিক রয়েছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদও রয়েছেন। ফাঁস করা গোপন নথি মোতাবেক পাকিস্তান এবং ভারত থেকে পাচার করা অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেবিরোধী দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই সব বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় যায় তখন তারাই আবার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে থাকে।

ইন্দিরা গান্ধীর সময় তেল কেলেঙ্কারি, রাজীব গান্ধীর শাসনামলে বোফর্স কেলেঙ্কারি সারা ভারতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে আলোড়ন তুলেছিল কয়লা কেলেঙ্কারি, চপার কেলেঙ্কারি, টাটা ট্রাক কেলেঙ্কারি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি রাহুল গান্ধী প্রায়শই বলে থাকেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। ১৯৯৬ সনে বেনজির ভুট্টোকে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শুধু বরখাস্ত করা হয়নি, তার স্বামীর সঙ্গে তাকে পাঁচ বছরের কারাদ-ও দেয়া হয়েছিল। ২০১৬ সনে পানামা পেপারস প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দুর্নীতি ফাঁস করলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হন, নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করেন। নওয়াজ শরীফের পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন শহীদ খাকান আব্বাসি, তাকেও দুর্নীতির দায়ে পরে ২০১৯ সনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ইমরান খান ক্ষমতায় আসার আগে পাকিস্তানে দুর্নীতির অবসান ঘটানোর জোরালো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমরান খানের আমলে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি ধারণা সূচকে পাকিস্তানের চার পয়েন্ট অবনতি ঘটে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে পার্লামেন্টের সদস্য পদে ইমরান খানকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়ার পেছনে বিগত ২০ বছর যাবত রাজাপাকসে পরিবারের লুটপাটকে দায়ী করা হয়ে থাকে।

খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ স্বীকার করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস ২০০৯ সালে ঘুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সিমেন্সের অ্যাকাউন্টগুলোর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মামলা দায়ের করে। পরবর্তীকালে কোকোর সিঙ্গাপুর একাউন্ট থেকে দুই মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সহযোগী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘুষ ও মানি লন্ডারিং কার্যক্রমের তদন্ত করেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে যে সব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বা বিদেশে গ্রহণ করা হয়েছে সেই সব অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এফবিআইকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুরোধ করেছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগ তারেক রহমানকে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে সাত বছরের কারাদ- প্রদান করে। এই মামলায় এফবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা সাক্ষী দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়াও দুর্নীতির অভিযোগে সাজা ভোগ করছেন।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়, কোন মন্ত্রী বা আমলা ঘুষ-দুর্নীতির জন্য বিচারের সম্মুখীন হয়ে শাস্তি ভোগ করেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার হুমকি দিচ্ছে বিএনপি, মামলা হলে কিছু দুর্নীতিবাজ শাস্তি ভোগ করবে। আমাদের দেশের জনগণের চরিত্র অদ্ভুত, সবাই দুর্নীতির বিচার চায়, কিন্তু নিজ দলের নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বাস করে না। তাই বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও আওয়ামী লীগ থেকে বলা হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এমন বক্তব্য আওয়ামী লীগ কর্মী এবং সমর্থকরা বিশ্বাসও করবেন। এখন একই আচরণ করছে বিএনপি। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিএনপির নেতাদের শাস্তি হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি বলছে, ‘এইসব আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’। বিচারের রায়কেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি এবং বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করলে, সব দলের জন্য গ্রহণযোগ্য রায় পাওয়ার উপায় কী?

বিচারের রায় যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখন বিচার করে দুর্নীতি দূর করা প্রায় অসম্ভব। তাই দুর্নীতি কমার কোন লক্ষণ নেই। প্রতিটি অফিসের কর্মকা- সম্পাদনে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দুর্নীতির কারণ নিয়ে আরেকটি কলাম লিখার ইচ্ছে থাকায় এখানে তাই বিশদ বর্ণনা দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। তবে দুর্নীতি কমানো গেলে অর্থের পাচারও কমবে, অর্থের পাচার কমানো গেলে দুর্নীতিও কমবে। দুর্নীতির প্রধান কারণ সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব। দুর্নীতির অঢেল অর্থ দেশের অভ্যন্তরে রাখার বৈধ পথ খুঁজে না পেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকগুলো বিদেশে পাচার করে। আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সৎ ও সতর্ক হলে এই পাচার কিছুটা কমানো সম্ভব। এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে মনিটরিং জোরদার করেছে; এই মনিটরিং ফলপ্রসূ হলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে যাবে। অর্থ পাচারের আরেকটি মুখ্য মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডি রোধ করা কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে মর্মে ঘোষণা দিয়েছে। এ সব ঘোষণা অর্থহীন। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে ৬-৭ টাকা বেশি বিধায় হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে গেছে। অবশ্য সম্প্রতি কয়েকজন হুন্ডি ব্যবসায়ীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, পুলিশি তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। আমাদের বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সক্রিয় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থাও নেয়া যায়। মনে রাখতে হবে, অর্থ একবার পাচার হয়ে গেলে তা উদ্ধার করা প্রায়ই অসম্ভব।

সমাজে দুর্নীতিবাজদের অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো আমাদের নেতা, আমলা, ব্যবসায়ীরা যখন দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি করে, তখন এই দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২২ , ১২ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ৩১ রবিউস সানি ১৪৪৪

দুর্নীতির সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

দুর্নীতি কমবেশি সব দেশেই আছে। যারা দুর্নীতি করে অঢেল টাকার মালিক হন তারা সচরাচর সেই টাকা দেশে রাখেন না, বিদেশে পাচার করে দেন। কিছু দেশ আছে যারা অন্য দেশের দুর্নীতিবাজদের অর্থ সানন্দে গ্রহণ করে গোপন রাখে। তাই একবার বিদেশে পাচার হয়ে গেলে সেই টাকার হদিস পাওয়া সহজ নয়। এই ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহক ছাড়া আর কাউকে তথ্য সরবরাহ করে না। এক সময় প্রায় সব দেশের দুর্নীতিবাজদের টাকা রাখা হতো সুইজারল্যা-ের ব্যাংকগুলোতে। সুইজারল্যান্ডের কোন ব্যাংকে টাকা রাখা হলে তা গ্রাহকের মৃত্যুর পরও কেউ জানতে পারতো না, ফলে তা এক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হয়ে যেত। ব্যাংক একাউন্টের এমন গোপনীয়তা জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে সহায়ক বিবেচিত হওয়ায় তা প্রকাশের জন্য চাপ বাড়তে থাকে। জঙ্গি কর্মকা-ে অর্থের যোগানে ব্যাংকিং চ্যানেল যাতে অবাধে ব্যবহৃত না হয় সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপন একাউন্ট মনিটর করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এই চাপের কারণে ব্যাংকগুলো বর্তমানে কিছু তথ্য প্রকাশ করে এবং তাতেই আমরা অবৈধ অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিতে পারি। কিন্তু অবৈধ অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে প্রকাশিত তথ্য কোন কাজেই লাগে না।

ব্যাংকিং চ্যানেলে অবৈধ অর্থকে বৈধ করার কারসাজি রোধে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তবে এই ইউনিট অবৈধ অর্থ ফেরত আনার জন্য নয়, অবৈধ অর্থ যাতে কোনভাবেই জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে, পাশাপাশি ইরান, রাশিয়া, নর্থ কোরিয়ার মতো দেশে টাকা যাচ্ছে কিনা তাও মনিটর করে। আমাদের দেশেও এমন একটি ইউনিট রয়েছে। আমাদের এই ইউনিট বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থের তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। মুশকিল হচ্ছে ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সংগৃহীত তথ্য সাক্ষী বা প্রমাণ হিসেবে আদালতে ব্যবহার করা যায় না, শুধু দেশের অভ্যন্তরে অধিকতর তদন্তের কাজে ব্যবহার করা যায়। অধিকতর তদন্তের ভিত্তিতে দেশে দায়ের করা মামলায় অনুকূল রায় পাওয়া গেলেও বিদেশি ব্যাংক থেকে সহজে অবৈধ টাকা ফেরত আনা যায় না, বিদেশে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে মামলা করে পুনরায় জিততে হয়। শুধু তাই নয়, আরও প্রক্রিয়া রয়েছেÑ অর্থ ফেরত আনতে শুধু আদালতের অনুকূল রায়ই যথেষ্ট নয়, সংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে অবৈধ অর্থ প্রত্যাবর্তনের সমঝোতা চুক্তি থাকাও অপরিহার্য।

পি কে হালদার বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করেছে, পাচার করা অর্থ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগও করেছে, কিন্তু উদ্ধার করা যাচ্ছে না। ভারত সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তার সম্পদের হিসাবনিকাশ করছে। বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজরা অবৈধ টাকা হাতে এলেই ইংল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আবুধাবি প্রভৃতি দেশে পাচার করে দেয়। অর্থ পাচার করার আগে সন্তান বা স্ত্রীকে পাচার করা হয়। পাচার করা সন্তান বা স্ত্রীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত হলেই বাড়ি কেনা হয়। বাড়ি কেনার জন্য সহজ শর্তে প্রচুর ঋণ পাওয়া যায় ওই সব দেশে। বৈধ ঋণের সঙ্গে পাচার করা অবৈধ টাকা মিশে যায়। আমাদের দেশের ধনী লোকদের সবার নাকি বিদেশে রাজপ্রাসাদ তুল্য বাড়ি আছে, ওই সব বাড়িতে তাদের সন্তান বা স্ত্রী বসবাস করে, অথবা ভাড়া দেয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে প্রচুর খালি জায়গা পড়ে রয়েছে, থাকার মানুষ নেই। এ সব দেশে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। দুর্নীতিবাজরা এই সুযোগ গ্রহণ করছে এবং দেশগুলোও তাদের সাদরে বরণ করেও নিচ্ছে। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈধ-অবৈধ যাচাই করার কোন গরজ নেই। অবৈধ অর্থ দিয়ে বিদেশিদের ‘সেকেন্ড হোম’ তৈরি করার অবাধ নিশ্চিত সুযোগ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া।

বিশ্বের ১১টি দেশের ৬০০ সাংবাদিক যে ১ কোটি ২০ লাখ গোপন নথি ফাঁস করেছে তা থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ক্ষমতাধর কিছু লোক অবৈধভাবে অর্জিত প্রচুর ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার করে তা লুকিয়ে রেখেছে এবং এদের মধ্যে ৯০টি দেশের ৩০০ জনেরও বেশি রাজনীতিক রয়েছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদও রয়েছেন। ফাঁস করা গোপন নথি মোতাবেক পাকিস্তান এবং ভারত থেকে পাচার করা অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেবিরোধী দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই সব বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় যায় তখন তারাই আবার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে থাকে।

ইন্দিরা গান্ধীর সময় তেল কেলেঙ্কারি, রাজীব গান্ধীর শাসনামলে বোফর্স কেলেঙ্কারি সারা ভারতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে আলোড়ন তুলেছিল কয়লা কেলেঙ্কারি, চপার কেলেঙ্কারি, টাটা ট্রাক কেলেঙ্কারি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি রাহুল গান্ধী প্রায়শই বলে থাকেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। ১৯৯৬ সনে বেনজির ভুট্টোকে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শুধু বরখাস্ত করা হয়নি, তার স্বামীর সঙ্গে তাকে পাঁচ বছরের কারাদ-ও দেয়া হয়েছিল। ২০১৬ সনে পানামা পেপারস প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দুর্নীতি ফাঁস করলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হন, নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করেন। নওয়াজ শরীফের পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন শহীদ খাকান আব্বাসি, তাকেও দুর্নীতির দায়ে পরে ২০১৯ সনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ইমরান খান ক্ষমতায় আসার আগে পাকিস্তানে দুর্নীতির অবসান ঘটানোর জোরালো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমরান খানের আমলে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি ধারণা সূচকে পাকিস্তানের চার পয়েন্ট অবনতি ঘটে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে পার্লামেন্টের সদস্য পদে ইমরান খানকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়ার পেছনে বিগত ২০ বছর যাবত রাজাপাকসে পরিবারের লুটপাটকে দায়ী করা হয়ে থাকে।

খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ স্বীকার করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস ২০০৯ সালে ঘুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সিমেন্সের অ্যাকাউন্টগুলোর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মামলা দায়ের করে। পরবর্তীকালে কোকোর সিঙ্গাপুর একাউন্ট থেকে দুই মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সহযোগী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘুষ ও মানি লন্ডারিং কার্যক্রমের তদন্ত করেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে যে সব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বা বিদেশে গ্রহণ করা হয়েছে সেই সব অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এফবিআইকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুরোধ করেছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগ তারেক রহমানকে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে সাত বছরের কারাদ- প্রদান করে। এই মামলায় এফবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা সাক্ষী দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়াও দুর্নীতির অভিযোগে সাজা ভোগ করছেন।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়, কোন মন্ত্রী বা আমলা ঘুষ-দুর্নীতির জন্য বিচারের সম্মুখীন হয়ে শাস্তি ভোগ করেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার হুমকি দিচ্ছে বিএনপি, মামলা হলে কিছু দুর্নীতিবাজ শাস্তি ভোগ করবে। আমাদের দেশের জনগণের চরিত্র অদ্ভুত, সবাই দুর্নীতির বিচার চায়, কিন্তু নিজ দলের নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বাস করে না। তাই বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও আওয়ামী লীগ থেকে বলা হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এমন বক্তব্য আওয়ামী লীগ কর্মী এবং সমর্থকরা বিশ্বাসও করবেন। এখন একই আচরণ করছে বিএনপি। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিএনপির নেতাদের শাস্তি হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি বলছে, ‘এইসব আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’। বিচারের রায়কেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি এবং বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করলে, সব দলের জন্য গ্রহণযোগ্য রায় পাওয়ার উপায় কী?

বিচারের রায় যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখন বিচার করে দুর্নীতি দূর করা প্রায় অসম্ভব। তাই দুর্নীতি কমার কোন লক্ষণ নেই। প্রতিটি অফিসের কর্মকা- সম্পাদনে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দুর্নীতির কারণ নিয়ে আরেকটি কলাম লিখার ইচ্ছে থাকায় এখানে তাই বিশদ বর্ণনা দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। তবে দুর্নীতি কমানো গেলে অর্থের পাচারও কমবে, অর্থের পাচার কমানো গেলে দুর্নীতিও কমবে। দুর্নীতির প্রধান কারণ সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব। দুর্নীতির অঢেল অর্থ দেশের অভ্যন্তরে রাখার বৈধ পথ খুঁজে না পেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকগুলো বিদেশে পাচার করে। আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সৎ ও সতর্ক হলে এই পাচার কিছুটা কমানো সম্ভব। এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে মনিটরিং জোরদার করেছে; এই মনিটরিং ফলপ্রসূ হলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে যাবে। অর্থ পাচারের আরেকটি মুখ্য মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডি রোধ করা কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে মর্মে ঘোষণা দিয়েছে। এ সব ঘোষণা অর্থহীন। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে ৬-৭ টাকা বেশি বিধায় হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে গেছে। অবশ্য সম্প্রতি কয়েকজন হুন্ডি ব্যবসায়ীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, পুলিশি তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। আমাদের বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সক্রিয় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থাও নেয়া যায়। মনে রাখতে হবে, অর্থ একবার পাচার হয়ে গেলে তা উদ্ধার করা প্রায়ই অসম্ভব।

সমাজে দুর্নীতিবাজদের অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো আমাদের নেতা, আমলা, ব্যবসায়ীরা যখন দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি করে, তখন এই দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]