জ্বালানি তেলের দাম : প্রতিমাসেই নির্ধারণ কেন, কী হবে পদ্ধতি?

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রাখে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। বিশ্ববাজারে দর কমবেশি যাই হোক বাংলাদেশে সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় এবং পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত সারাদেশে সেই দরেই জ্বালানি তেল বিক্রি হয়। তবে এলপিজির দাম নির্ধারণ হয় প্রতিমাসেই।

অনেক সময় দীর্ঘদিন একই দামে তেল বিক্রি অব্যাহত থাকে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের ব্যাপক দরপতন হলেও এ দেশের সাধারণ ভোক্তা ওই সুবিধা পায় না। আবার বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেড়ে গেলেও সরকার ভর্তুকি বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম একই রাখে। তবে ভর্তুকির এই সুবিধা প্রকৃতপক্ষে জনগণের করের টাকা থেকেই দেয়া হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও প্রতিমাসে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করার জন্য একটি ‘ম্যাকানিজম (রূপরেখা)’ তৈরি করা হচ্ছে। শীঘ্রই এটি চূড়ান্ত করা হবে। পর্যায়ক্রমে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করা হবে।

তবে কেন প্রতিমাসে দাম নির্ধারণ করার কথা পরিকল্পনা এবং দাম নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগই আমদানি করা এই ডিজেলের বড় অংশ পরিবহন খাত এবং কৃষিতে সেচের কাজে ব্যবহার হয়। অতীতে দেখা গেছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাস, ট্রাক, লঞ্চ থেকে শুরু করে সবরকম পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ফলে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। কিন্তু যে দুই-একবার জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে, সেই অনুযায়ী পরিবহন ব্যয় কমেনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টা আমি সাপোর্ট (সমর্থন) করি। এতে ভোক্তাদের জন্যই সুবিধা। আমাদের দেশে দেখা যায় দীর্ঘদিন মূল্য সমন্বয় হয় না। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও সাধারণ মানুষ এর সুবিধা পায় না।’

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক মাসের পরিবর্তে তিন মাসে একবার মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ড. ইজাজ হোসেন। এ দেশে যেহেতু জ্বালানি তেলের দামের ওপর ভিত্তি করে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারিত হয়, সেখানেও একটি সমন্বয়ের ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘যতদূর জানি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি ভারতেও বেশিরভাগ গণপরিবহন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চলে। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ায় রাতারাতি সেখানে প্রভাব পড়ে না। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের পরিবহন খাতে বেসরকারি খাতের প্রাধান্য বেশি, ফলে তেলের দাম কমে গেলে যতটা না প্রভাব পড়বে, দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।’

এক্ষেত্রে পরিবহন খাতেও সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তেলের দাম এত থেকে এত পর্যন্ত হলে ভাড়া হবে এই... এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে তারাও তেলের দামের সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া সমন্বয় করতে পারে।’

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর চাপ রয়েছে। এ কারণে সরকার প্রতি মাসে তেলের দাম সমন্বয়ের দিকে যাচ্ছে। যাতে আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী তেল বিক্রির মধ্য দিয়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনা যায়। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, কমলে কমবে।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করে থাকে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বে প্রধানত ৩টি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড বা বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কোন কোন দেশ সর্বোচ্চ দর বা প্রাইস সিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ ফিক্সড প্রাইস বা নির্ধারিত দরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে।

ভারতে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি

প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেকদিন ধরেই ডায়ানামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড অবলম্বন করা হচ্ছে। সেখানে মাসিক হিসাবে নয়, প্রতিদিন বেন্ট ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনায় দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়।

ভারত বিশ্বের যেসব দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে, তার সঙ্গে সরকারি কর ও মুনাফা যোগ করে প্রতিদিন তেলের দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। প্রতিদিন সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়, কত দামে ডিজেল-পেট্রল বিক্রি হবে। তেল বিক্রিতে সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পদ্ধতি

আমেরিকায় প্রতি ঘণ্টায় তেলের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। আবার যুক্তরাজ্যে প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের দাম উঠানামা করে। কিন্তু সেখানে সরকারি কোন সংস্থা সেটা নির্ধারণ করে না। ক্রুড অয়েলের দাম, সরকারি কর, ভ্যাট ইত্যাদির সঙ্গে নিজেদের মুনাফা মিলিয়ে পাম্প মালিকরাই প্রতিদিন সেটা ঠিক করেন। ফলে একই দিন একেক এলাকায় তেলের দাম একেক রকমও হতে পারে।

বাংলাদেশে এলপিজির দাম নির্ধারণ পদ্ধতি

২০২১ সালের এপ্রিল থেকে রান্নায় বহুল ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের মূল্য প্রতি মাসেই সমন্বয় করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্র্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এ সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে প্রতি মাসেই এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি।

মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুরুতেই গণশুনানি করে আমদানিকারককের খরচ, পরিবহন ব্যয় ও কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন তার সঙ্গে প্রতিমাসে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি গ্যাসের দামের উঠা-নামা যোগ করে দেশের বাজারে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের পদ্ধতি কী হবে

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে যে নিয়মে এলপিজির মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে, সেই ফর্মুলা বিবেচনায় নিয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের কথা ভাবছে সরকার।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রথমে প্রতি তিন মাস পর পর তেলের দাম নির্ধারণের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের দর সমন্বয়ের পরিকল্পানা নিয়ে খসড়া একটি রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। নতুন কৌশলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মাসের শুরুর দিকে যে দাম থাকবে, তার সঙ্গে পরিবহন খরচ, ডিলারদের কমিশন ইত্যাদি যোগ করে দেশের বাজারে তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে।

ফলে যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে, দেশের বাজারেও সেটা বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেলে দেশের বাজারেও দাম সেই হারে কমবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশকে সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত ছিল জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। সংস্থাটি বলেছে, জ্বালানির মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি সংস্কার করে তা বিশ্ববাজারের ওপরেও ছেড়ে দিলে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

সম্প্রতি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি না দেয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়। সেইসঙ্গে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রি বেসরকারি খাতের জন্য খুলে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

গত ১ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’ জারি হয়। এ অধ?্যাদেশ অনুযায়ী বিশেষ ক্ষেত্রে বিইআরসির পরিবর্তে ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ ও সমন্বয় করতে পারবে সরকার।

এদিকে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।

বুধবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৩ , ২৭ পৌষ ১৪২৯, ১৭ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

জ্বালানি তেলের দাম : প্রতিমাসেই নির্ধারণ কেন, কী হবে পদ্ধতি?

ফয়েজ আহমেদ তুষার

image

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রাখে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। বিশ্ববাজারে দর কমবেশি যাই হোক বাংলাদেশে সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় এবং পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত সারাদেশে সেই দরেই জ্বালানি তেল বিক্রি হয়। তবে এলপিজির দাম নির্ধারণ হয় প্রতিমাসেই।

অনেক সময় দীর্ঘদিন একই দামে তেল বিক্রি অব্যাহত থাকে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের ব্যাপক দরপতন হলেও এ দেশের সাধারণ ভোক্তা ওই সুবিধা পায় না। আবার বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেড়ে গেলেও সরকার ভর্তুকি বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম একই রাখে। তবে ভর্তুকির এই সুবিধা প্রকৃতপক্ষে জনগণের করের টাকা থেকেই দেয়া হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও প্রতিমাসে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করার জন্য একটি ‘ম্যাকানিজম (রূপরেখা)’ তৈরি করা হচ্ছে। শীঘ্রই এটি চূড়ান্ত করা হবে। পর্যায়ক্রমে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করা হবে।

তবে কেন প্রতিমাসে দাম নির্ধারণ করার কথা পরিকল্পনা এবং দাম নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগই আমদানি করা এই ডিজেলের বড় অংশ পরিবহন খাত এবং কৃষিতে সেচের কাজে ব্যবহার হয়। অতীতে দেখা গেছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাস, ট্রাক, লঞ্চ থেকে শুরু করে সবরকম পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ফলে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। কিন্তু যে দুই-একবার জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে, সেই অনুযায়ী পরিবহন ব্যয় কমেনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টা আমি সাপোর্ট (সমর্থন) করি। এতে ভোক্তাদের জন্যই সুবিধা। আমাদের দেশে দেখা যায় দীর্ঘদিন মূল্য সমন্বয় হয় না। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও সাধারণ মানুষ এর সুবিধা পায় না।’

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক মাসের পরিবর্তে তিন মাসে একবার মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ড. ইজাজ হোসেন। এ দেশে যেহেতু জ্বালানি তেলের দামের ওপর ভিত্তি করে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারিত হয়, সেখানেও একটি সমন্বয়ের ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘যতদূর জানি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি ভারতেও বেশিরভাগ গণপরিবহন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চলে। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ায় রাতারাতি সেখানে প্রভাব পড়ে না। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের পরিবহন খাতে বেসরকারি খাতের প্রাধান্য বেশি, ফলে তেলের দাম কমে গেলে যতটা না প্রভাব পড়বে, দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।’

এক্ষেত্রে পরিবহন খাতেও সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তেলের দাম এত থেকে এত পর্যন্ত হলে ভাড়া হবে এই... এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে তারাও তেলের দামের সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া সমন্বয় করতে পারে।’

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর চাপ রয়েছে। এ কারণে সরকার প্রতি মাসে তেলের দাম সমন্বয়ের দিকে যাচ্ছে। যাতে আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী তেল বিক্রির মধ্য দিয়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনা যায়। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, কমলে কমবে।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করে থাকে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বে প্রধানত ৩টি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড বা বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কোন কোন দেশ সর্বোচ্চ দর বা প্রাইস সিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ ফিক্সড প্রাইস বা নির্ধারিত দরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে।

ভারতে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি

প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেকদিন ধরেই ডায়ানামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড অবলম্বন করা হচ্ছে। সেখানে মাসিক হিসাবে নয়, প্রতিদিন বেন্ট ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনায় দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়।

ভারত বিশ্বের যেসব দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে, তার সঙ্গে সরকারি কর ও মুনাফা যোগ করে প্রতিদিন তেলের দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। প্রতিদিন সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়, কত দামে ডিজেল-পেট্রল বিক্রি হবে। তেল বিক্রিতে সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পদ্ধতি

আমেরিকায় প্রতি ঘণ্টায় তেলের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। আবার যুক্তরাজ্যে প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের দাম উঠানামা করে। কিন্তু সেখানে সরকারি কোন সংস্থা সেটা নির্ধারণ করে না। ক্রুড অয়েলের দাম, সরকারি কর, ভ্যাট ইত্যাদির সঙ্গে নিজেদের মুনাফা মিলিয়ে পাম্প মালিকরাই প্রতিদিন সেটা ঠিক করেন। ফলে একই দিন একেক এলাকায় তেলের দাম একেক রকমও হতে পারে।

বাংলাদেশে এলপিজির দাম নির্ধারণ পদ্ধতি

২০২১ সালের এপ্রিল থেকে রান্নায় বহুল ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের মূল্য প্রতি মাসেই সমন্বয় করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্র্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এ সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে প্রতি মাসেই এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি।

মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুরুতেই গণশুনানি করে আমদানিকারককের খরচ, পরিবহন ব্যয় ও কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন তার সঙ্গে প্রতিমাসে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি গ্যাসের দামের উঠা-নামা যোগ করে দেশের বাজারে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের পদ্ধতি কী হবে

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে যে নিয়মে এলপিজির মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে, সেই ফর্মুলা বিবেচনায় নিয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের কথা ভাবছে সরকার।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রথমে প্রতি তিন মাস পর পর তেলের দাম নির্ধারণের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের দর সমন্বয়ের পরিকল্পানা নিয়ে খসড়া একটি রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। নতুন কৌশলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মাসের শুরুর দিকে যে দাম থাকবে, তার সঙ্গে পরিবহন খরচ, ডিলারদের কমিশন ইত্যাদি যোগ করে দেশের বাজারে তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে।

ফলে যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে, দেশের বাজারেও সেটা বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেলে দেশের বাজারেও দাম সেই হারে কমবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশকে সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত ছিল জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। সংস্থাটি বলেছে, জ্বালানির মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি সংস্কার করে তা বিশ্ববাজারের ওপরেও ছেড়ে দিলে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

সম্প্রতি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি না দেয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়। সেইসঙ্গে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রি বেসরকারি খাতের জন্য খুলে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

গত ১ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’ জারি হয়। এ অধ?্যাদেশ অনুযায়ী বিশেষ ক্ষেত্রে বিইআরসির পরিবর্তে ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ ও সমন্বয় করতে পারবে সরকার।

এদিকে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।