অমিতাভ ঘোষ

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

এবারের ঢাকা লিট ফেস্টের আমন্ত্রিত লেখকদের মধ্যেও আপন আলোয় উজ্জ্বল ছিলেন অমিতাভ ঘোষ। আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হচ্ছে- এদেশের মাটির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। এ সাহিত্য উৎসবের প্রাক্কালে তিনি বলেছেন যে, এবারের সফরের মধ্য দিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের পিতৃভূমির সাথে সম্পর্কের পুনর্নবায়ন ঘটল। এমনকি উৎসব শেষে গোপালগঞ্জের কিছু দর্শনীয় স্থানও ঘুরে আসেন। ঘুরেফিরে এদেশ তথা এ বাংলার প্রকৃতি, বিশেষ করে, সুন্দরবনের কথা তিনি বারবার স্মরণ করেন। লিট ফেস্টের একটি সেশনে যেমনটি তিনি বলেছেন, “সুন্দরবন তাঁর কল্পনার গভীরে প্রোথিত বলেই বারবার তিনি ফিরে আসেন এ ম্যানগ্রোভ বনের কাছে লেখনীর মারফত।”

ÒThe Hungry Tide: Amitav Ghosh with Sadaf SaazÓ নামক সেশনে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, “মানুষ প্রকৃতির তুলনায় দুর্বল। মানুষ যতই প্রকৃতির ক্ষতি করুক না কেন, প্রকৃতি নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করবে। সেজন্যেই মানুষের উচিত প্রকৃতির যত্ন নেয়া।” এ কমনসেন্স বা সাধারণ প্রজ্ঞাটুকু আমাদের মাঝে বারবার বিলানোর জন্যই অমিতাভ ঘোষ প্রমুখ লেখকদের জরুরিত্ব। তিনি আর যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন একই আলোচনায় তা হলো: “দিনকেদিন আমরা সংগঠিত হবার বদলে আত্মগত (individualized) হয়েছি। বই পড়ার অভিজ্ঞতাও এখন ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছে। আগে এরকমটা ছিল না। আগুনের পাশে একদল লোক বই পড়ত বা বাড়িতে বসে গল্প বলত। গল্পের এ স্বাদ এখন আর আগের মতো নেই।”

জলবায়ু সংকট, পরিবেশ সংকট, পরিবেশ বিনাশ, দুর্যোগপ্রসূত ভৌগোলিক পরিবর্তন, গ্রহীয় স্তরের ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের সরাসরি ভূমিকা, প্রতিবেশ নিয়ে মানুষের আত্মঘাতী তৎপরতা ইত্যাদি বিষয়ে যেসব লেখক নিয়মিত পরিবেশ-জেহাদ চালিয়ে যাচ্ছেন বিগত কয়েক দশক ধরে, তাঁদের মধ্যে অমিতাভ ঘোষ সামনের কাতারে। গত চল্লিশ বছর ধরে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করলেও বর্তমানে তাঁর প্রধান পরিচয় ইকো-ফিকশনিস্ট হিসেবে। ফিকশনের পাশাপাশি নন-ফিকশন রচনা করেও তিনি পরিবেশ-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০০৪ সালে প্রকাশিত The Hungry Tide দিয়ে তাঁর পরিবেশবাদী সাহিত্যের যাত্রা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন একটি বহুস্তরীয় উপন্যাস। জীবন যেখানে সার্বক্ষণিক অনিশ্চয়তায় ঘেরা, ভয়ের সাথে লড়াই যেখানে নিত্যদিনের কাজ, পরতে পরতে যেখানে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর বিভীষিকা- উপন্যাসটি তার মূর্ত রূপ। সুন্দরবনের আদি বাসিন্দা ও নব্য বসতি স্থাপনকারীদের জন্য জীবন মানে ভয়ানক বাস্তবতার সাথে রোমান্স। খামখেয়ালি জোয়ার-ভাটা, শিকারের লোভে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কিংবা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন- এ সমস্ত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যে জীবন পর্যুদস্ত, উপন্যাসটি তার বিশ্বস্ত দলিল। তিনটি ভিন্ন মেজাজ, মানসিকতা ও বলয়ের মানুষের ঘটনাচক্রে মিলিত হবার সূত্র ধরে এগুতে থাকে উপন্যাসটি। কীভাবে মানুষের হাত ধরে স্বাদু পানির রঙের ডলফিন হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, কীভাবে সুন্দরবনের বাঘ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি, কীভাবে মুনাফালোভী ক্ষমতাবান মানুষের লালায়িত জিভের সামনে বঙ্গীয় বদ্বীপের রক্ষাকবচ সুন্দরবন উজাড় হয়ে চলেছে, লেখক তা তুলে ধরেছেন দক্ষতার সাথে। পাশাপাশি, ক্ষমতাকাঠামো-নির্ধারিত সমাজব্যবস্থায় সুন্দরবনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে অসহায়, তার নিরেট চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অমিতাভ ঘোষ। মরিচঝাঁপি গণহত্যাকে উপজীব্য করে উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও নিম্নবর্গের মানুষের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের যোগসূত্র স্থাপন করে কাহিনির ঘনত্ব দিয়েছেন তিনি। মূলত, এ উপন্যাসটি দিয়ে তাঁর সাহিত্যে পরিবেশবাদী বাঁক বদল সম্পন্ন হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে বছর তিনি বইটি প্রকাশ করেন, সে বছরই একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের একটি বড় পরিমাণ কিনে নিয়ে ইকোট্যুরিজমের ব্যবসা ফেঁদে বসতে চেয়েছিল।

যাহোক, ২০১৬ সালে প্রকাশিত The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable বইটি আমাদের বিবেক নাড়া দেয়ার মতো একটি প্রবন্ধ সংকলন। তিনটি ভাগে বিভক্ত বইটি আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable বা মাথাখারাপ ধারাকে খোলাসা করেন। পাশাপাশি পারিবেশিক বিপর্যয়কে কল্পনা করা বা ধারণ করার মতো যোগ্যতা আধুনিক সাহিত্যের এখনো হয়ে ওঠেনি বলে তিনি মনে করেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, জলবায়ু সংকট আদতে আমাদের কল্পনার সংকট বলেও তিনি রায় দিয়েছেন। বিশিষ্ট সমালোচক আলেক্সান্দ্রেলসকানিচ বইটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ প্রশংসনীয় বইটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ভৌতিকতা বিষয়ে মানবচিন্তার সীমাবদ্ধতাকে পরীক্ষা ও প্রকাশ করে।’ সাহিত্য, ইতিহাস ও রাজনীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে জলবায়ু সংকটের কারণ ও নিদান তিনি বাতলে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন অমিতাভ ঘোষ।

২০১৯ সালে Gun Island উপন্যাসের মাধ্যমে তাঁর সুন্দরবনকেন্দ্রিক চিন্তাজগতের নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছেন। অনেকটা প্রথমোক্ত উপন্যাসের সিলসিলায় লেখা হলেও উপন্যাসটিতে আছে নবতর দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যাপ্তিতে এটি আরও বেশি বৈশ্বিক, আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ। বঙ্গীয় মনসা পুরাণের সৃষ্টিশীল ব্যবহারের মাধ্যমে লেখক কাহিনিকে ঘনবদ্ধ করেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন, মানবপাচার, জলবায়ু শরণার্থী সংকট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, সুন্দরবনের লাগামহীন ধ্বংসযজ্ঞ, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণির বিলুপ্তি, উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রমগ্ন হওয়া, লবণায়ন, নদীভাঙন, দাবানল, অসম্ভবপর স্থানে বিভিন্ন পাকামাকড়ের উপস্থিতি, জাতিবিদ্বেষ- কতসব বিষয় এসে একাট্টা হয়েছে এ আকর গ্রন্থের চৌহদ্দিতে। আর এ সমস্ত অপ্রীতিকর বিষয় মূলত আমাদের ক্ষমতা কাঠামোর সৃষ্টি বলে লেখক ইঙ্গিত করেছেন। উপনিবেশবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা, ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা পরিবেশ সংকটের কনট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর- উপন্যাসটি পড়ে সে বোধটিই জাগ্রত হয়েছে। আবার নাটমেগস কার্স উপন্যাসেও অমিতাভ রীতিমতো সপাটে প্রহার করেছেন উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের মতো অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আমাদের পরিবেশ সংকটের উৎস যে কয়েক শত বছরের ভূরাজনৈতিক খেলার ফল, এ সত্যটি উচ্চারণ করতে তিনি পিছপা হননি। মানুষ ও ভূমির ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার নোংরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ইউরোপীয়দের ভোগলিপ্সার ধারাবাহিকতায় আজ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংকটের অমানিশা।

শুধু উপনিবেশবাদীরাই নয়, এককালীন ঔপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর একটি শ্রেণিও যে সীমাহীন লোভের ফাঁদে পড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করছে এবং পরিবেশ বিনাশের বাধভাঙা ¯্রােতে শামিল হচ্ছে। এর ফলে এমন বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে যার সমাধান কারো কাছেই নেই। নাতা উপনিবেশবাদবাদীদের কাছে, না ঔপনিবেশিতদের কাছে। এ থিমকে উপজীব্য করে অমিতাভ লিখেছেন The Living Mountain.উপমহাদেশতা বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সংস্কৃতির কাছে পাহাড়-পর্বত একটি পবিত্র সত্তা,দবতুল্য স্থান। শুধু পাহাড় নয়, নানাবিধ প্রাকৃতিক স্থান ও স্থাপনা অনেক সংস্কৃতির কাছে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সমীহ পেয়ে এসেছে। সভ্যতাগর্বী ইউরোপীয়দের সান্নিধ্যে এসে অনেকক্ষত্রেই সে শ্রদ্ধাবোধ কুসংস্কার হিসেবে বাতিলের খাতায় চলে গেছে। ফলে ইউরোপীয়দের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের প্রজাগণও পরিবেশ ধ্বংসের হোলিতে মেতেছে। যার অনিবার্য ফল আমরা ও আমাদের আগামী প্রজন্ম ভোগ করব। অমিতাভ ঘোষের ক্ষুরধার কলম রেহাই দেয়নি কাউকেই।

কেবল ফিকশন ও নন-ফিকশন নয়, বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতায় অমিতাভ আমাদের সচেতন করার প্রয়াস পাচ্ছেন। তাঁর উপন্যাসে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা বাস্তবে প্রায় হুবহু ঘটেছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতটাই চিন্তার প্রগাঢ়তা ও ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি তিনি ধারণ করেন। প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ কতটা নিবিড়ভাবে আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে, তা বলিষ্ঠভাবে তিনি তুলে ধরেন তাঁর কথায় ও লেখায়।

কাজেই যে পঠনপ্রক্রিয়া আমাদের বোধের জাগরণ ঘটাবে তার প্রতি অমিতাভ ঘোষের পূর্ণ সমর্থন। আজকের পৃথিবীকে সুনিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন মননের উদ্বোধন এবং বৈশ্বিক অ্যাকশান। প্রয়োজন চিন্তার নিবিড় অনুশীলন। আর সে চিন্তা উস্কে দিতে পারে সাহিত্য। সেই সাহিত্যকে হাতিয়ার বানিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অমিতাভ ঘোষ। একটি জলবায়ু পরিবর্তনহেতু সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের উচিত অমিতাভ ঘোষের চিন্তাবিপ্লবের সাথে শামিল হওয়া। তা হতে পারে পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে, শিল্পসাহিত্য চর্চার বদৌলতে এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের মারফতে। আমাদের পেছন ফেরার অবকাশ নেই।

ঢাকা লিট ফেস্টের এ সফরে অমিতাভ ঘোষ যে আমাদের কতটা কাছের ও আত্মার আত্মীয় তা প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাঁর বাবা-মায়ের পিতৃভূমির জন্য নয়, একজন ইকো-ফিকশনিস্ট হিসেবে তিনি নিরন্তর কাজ করে চলেছেন এই ভূখণ্ডের মানুষের পরিবেশ ও তার বিপর্যয় নিয়ে। সারা বিশে^র কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন সুন্দরবনের মতো বিশে^র সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ভূমির সাম্প্রতিক ঝুঁকির কথা। একারণে,এ ভূখণ্ডের মানুষ তাঁকে গ্রহণ করেছে যে, লাইন ধরে তাঁর বই কেনার ভিতর দিয়ে দৃশ্যটি পূর্ণতা পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৩ , ২৮ পৌষ ১৪২৯, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

অমিতাভ ঘোষ

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

image

এবারের ঢাকা লিট ফেস্টের আমন্ত্রিত লেখকদের মধ্যেও আপন আলোয় উজ্জ্বল ছিলেন অমিতাভ ঘোষ। আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হচ্ছে- এদেশের মাটির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। এ সাহিত্য উৎসবের প্রাক্কালে তিনি বলেছেন যে, এবারের সফরের মধ্য দিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের পিতৃভূমির সাথে সম্পর্কের পুনর্নবায়ন ঘটল। এমনকি উৎসব শেষে গোপালগঞ্জের কিছু দর্শনীয় স্থানও ঘুরে আসেন। ঘুরেফিরে এদেশ তথা এ বাংলার প্রকৃতি, বিশেষ করে, সুন্দরবনের কথা তিনি বারবার স্মরণ করেন। লিট ফেস্টের একটি সেশনে যেমনটি তিনি বলেছেন, “সুন্দরবন তাঁর কল্পনার গভীরে প্রোথিত বলেই বারবার তিনি ফিরে আসেন এ ম্যানগ্রোভ বনের কাছে লেখনীর মারফত।”

ÒThe Hungry Tide: Amitav Ghosh with Sadaf SaazÓ নামক সেশনে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, “মানুষ প্রকৃতির তুলনায় দুর্বল। মানুষ যতই প্রকৃতির ক্ষতি করুক না কেন, প্রকৃতি নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করবে। সেজন্যেই মানুষের উচিত প্রকৃতির যত্ন নেয়া।” এ কমনসেন্স বা সাধারণ প্রজ্ঞাটুকু আমাদের মাঝে বারবার বিলানোর জন্যই অমিতাভ ঘোষ প্রমুখ লেখকদের জরুরিত্ব। তিনি আর যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন একই আলোচনায় তা হলো: “দিনকেদিন আমরা সংগঠিত হবার বদলে আত্মগত (individualized) হয়েছি। বই পড়ার অভিজ্ঞতাও এখন ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছে। আগে এরকমটা ছিল না। আগুনের পাশে একদল লোক বই পড়ত বা বাড়িতে বসে গল্প বলত। গল্পের এ স্বাদ এখন আর আগের মতো নেই।”

জলবায়ু সংকট, পরিবেশ সংকট, পরিবেশ বিনাশ, দুর্যোগপ্রসূত ভৌগোলিক পরিবর্তন, গ্রহীয় স্তরের ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের সরাসরি ভূমিকা, প্রতিবেশ নিয়ে মানুষের আত্মঘাতী তৎপরতা ইত্যাদি বিষয়ে যেসব লেখক নিয়মিত পরিবেশ-জেহাদ চালিয়ে যাচ্ছেন বিগত কয়েক দশক ধরে, তাঁদের মধ্যে অমিতাভ ঘোষ সামনের কাতারে। গত চল্লিশ বছর ধরে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করলেও বর্তমানে তাঁর প্রধান পরিচয় ইকো-ফিকশনিস্ট হিসেবে। ফিকশনের পাশাপাশি নন-ফিকশন রচনা করেও তিনি পরিবেশ-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০০৪ সালে প্রকাশিত The Hungry Tide দিয়ে তাঁর পরিবেশবাদী সাহিত্যের যাত্রা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন একটি বহুস্তরীয় উপন্যাস। জীবন যেখানে সার্বক্ষণিক অনিশ্চয়তায় ঘেরা, ভয়ের সাথে লড়াই যেখানে নিত্যদিনের কাজ, পরতে পরতে যেখানে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর বিভীষিকা- উপন্যাসটি তার মূর্ত রূপ। সুন্দরবনের আদি বাসিন্দা ও নব্য বসতি স্থাপনকারীদের জন্য জীবন মানে ভয়ানক বাস্তবতার সাথে রোমান্স। খামখেয়ালি জোয়ার-ভাটা, শিকারের লোভে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কিংবা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন- এ সমস্ত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যে জীবন পর্যুদস্ত, উপন্যাসটি তার বিশ্বস্ত দলিল। তিনটি ভিন্ন মেজাজ, মানসিকতা ও বলয়ের মানুষের ঘটনাচক্রে মিলিত হবার সূত্র ধরে এগুতে থাকে উপন্যাসটি। কীভাবে মানুষের হাত ধরে স্বাদু পানির রঙের ডলফিন হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, কীভাবে সুন্দরবনের বাঘ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি, কীভাবে মুনাফালোভী ক্ষমতাবান মানুষের লালায়িত জিভের সামনে বঙ্গীয় বদ্বীপের রক্ষাকবচ সুন্দরবন উজাড় হয়ে চলেছে, লেখক তা তুলে ধরেছেন দক্ষতার সাথে। পাশাপাশি, ক্ষমতাকাঠামো-নির্ধারিত সমাজব্যবস্থায় সুন্দরবনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে অসহায়, তার নিরেট চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অমিতাভ ঘোষ। মরিচঝাঁপি গণহত্যাকে উপজীব্য করে উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও নিম্নবর্গের মানুষের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের যোগসূত্র স্থাপন করে কাহিনির ঘনত্ব দিয়েছেন তিনি। মূলত, এ উপন্যাসটি দিয়ে তাঁর সাহিত্যে পরিবেশবাদী বাঁক বদল সম্পন্ন হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে বছর তিনি বইটি প্রকাশ করেন, সে বছরই একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের একটি বড় পরিমাণ কিনে নিয়ে ইকোট্যুরিজমের ব্যবসা ফেঁদে বসতে চেয়েছিল।

যাহোক, ২০১৬ সালে প্রকাশিত The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable বইটি আমাদের বিবেক নাড়া দেয়ার মতো একটি প্রবন্ধ সংকলন। তিনটি ভাগে বিভক্ত বইটি আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable বা মাথাখারাপ ধারাকে খোলাসা করেন। পাশাপাশি পারিবেশিক বিপর্যয়কে কল্পনা করা বা ধারণ করার মতো যোগ্যতা আধুনিক সাহিত্যের এখনো হয়ে ওঠেনি বলে তিনি মনে করেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, জলবায়ু সংকট আদতে আমাদের কল্পনার সংকট বলেও তিনি রায় দিয়েছেন। বিশিষ্ট সমালোচক আলেক্সান্দ্রেলসকানিচ বইটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ প্রশংসনীয় বইটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ভৌতিকতা বিষয়ে মানবচিন্তার সীমাবদ্ধতাকে পরীক্ষা ও প্রকাশ করে।’ সাহিত্য, ইতিহাস ও রাজনীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে জলবায়ু সংকটের কারণ ও নিদান তিনি বাতলে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন অমিতাভ ঘোষ।

২০১৯ সালে Gun Island উপন্যাসের মাধ্যমে তাঁর সুন্দরবনকেন্দ্রিক চিন্তাজগতের নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছেন। অনেকটা প্রথমোক্ত উপন্যাসের সিলসিলায় লেখা হলেও উপন্যাসটিতে আছে নবতর দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যাপ্তিতে এটি আরও বেশি বৈশ্বিক, আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ। বঙ্গীয় মনসা পুরাণের সৃষ্টিশীল ব্যবহারের মাধ্যমে লেখক কাহিনিকে ঘনবদ্ধ করেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন, মানবপাচার, জলবায়ু শরণার্থী সংকট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, সুন্দরবনের লাগামহীন ধ্বংসযজ্ঞ, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণির বিলুপ্তি, উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রমগ্ন হওয়া, লবণায়ন, নদীভাঙন, দাবানল, অসম্ভবপর স্থানে বিভিন্ন পাকামাকড়ের উপস্থিতি, জাতিবিদ্বেষ- কতসব বিষয় এসে একাট্টা হয়েছে এ আকর গ্রন্থের চৌহদ্দিতে। আর এ সমস্ত অপ্রীতিকর বিষয় মূলত আমাদের ক্ষমতা কাঠামোর সৃষ্টি বলে লেখক ইঙ্গিত করেছেন। উপনিবেশবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা, ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা পরিবেশ সংকটের কনট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর- উপন্যাসটি পড়ে সে বোধটিই জাগ্রত হয়েছে। আবার নাটমেগস কার্স উপন্যাসেও অমিতাভ রীতিমতো সপাটে প্রহার করেছেন উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের মতো অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আমাদের পরিবেশ সংকটের উৎস যে কয়েক শত বছরের ভূরাজনৈতিক খেলার ফল, এ সত্যটি উচ্চারণ করতে তিনি পিছপা হননি। মানুষ ও ভূমির ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার নোংরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ইউরোপীয়দের ভোগলিপ্সার ধারাবাহিকতায় আজ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংকটের অমানিশা।

শুধু উপনিবেশবাদীরাই নয়, এককালীন ঔপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর একটি শ্রেণিও যে সীমাহীন লোভের ফাঁদে পড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করছে এবং পরিবেশ বিনাশের বাধভাঙা ¯্রােতে শামিল হচ্ছে। এর ফলে এমন বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে যার সমাধান কারো কাছেই নেই। নাতা উপনিবেশবাদবাদীদের কাছে, না ঔপনিবেশিতদের কাছে। এ থিমকে উপজীব্য করে অমিতাভ লিখেছেন The Living Mountain.উপমহাদেশতা বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সংস্কৃতির কাছে পাহাড়-পর্বত একটি পবিত্র সত্তা,দবতুল্য স্থান। শুধু পাহাড় নয়, নানাবিধ প্রাকৃতিক স্থান ও স্থাপনা অনেক সংস্কৃতির কাছে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সমীহ পেয়ে এসেছে। সভ্যতাগর্বী ইউরোপীয়দের সান্নিধ্যে এসে অনেকক্ষত্রেই সে শ্রদ্ধাবোধ কুসংস্কার হিসেবে বাতিলের খাতায় চলে গেছে। ফলে ইউরোপীয়দের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের প্রজাগণও পরিবেশ ধ্বংসের হোলিতে মেতেছে। যার অনিবার্য ফল আমরা ও আমাদের আগামী প্রজন্ম ভোগ করব। অমিতাভ ঘোষের ক্ষুরধার কলম রেহাই দেয়নি কাউকেই।

কেবল ফিকশন ও নন-ফিকশন নয়, বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতায় অমিতাভ আমাদের সচেতন করার প্রয়াস পাচ্ছেন। তাঁর উপন্যাসে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা বাস্তবে প্রায় হুবহু ঘটেছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতটাই চিন্তার প্রগাঢ়তা ও ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি তিনি ধারণ করেন। প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ কতটা নিবিড়ভাবে আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে, তা বলিষ্ঠভাবে তিনি তুলে ধরেন তাঁর কথায় ও লেখায়।

কাজেই যে পঠনপ্রক্রিয়া আমাদের বোধের জাগরণ ঘটাবে তার প্রতি অমিতাভ ঘোষের পূর্ণ সমর্থন। আজকের পৃথিবীকে সুনিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন মননের উদ্বোধন এবং বৈশ্বিক অ্যাকশান। প্রয়োজন চিন্তার নিবিড় অনুশীলন। আর সে চিন্তা উস্কে দিতে পারে সাহিত্য। সেই সাহিত্যকে হাতিয়ার বানিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অমিতাভ ঘোষ। একটি জলবায়ু পরিবর্তনহেতু সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের উচিত অমিতাভ ঘোষের চিন্তাবিপ্লবের সাথে শামিল হওয়া। তা হতে পারে পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে, শিল্পসাহিত্য চর্চার বদৌলতে এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের মারফতে। আমাদের পেছন ফেরার অবকাশ নেই।

ঢাকা লিট ফেস্টের এ সফরে অমিতাভ ঘোষ যে আমাদের কতটা কাছের ও আত্মার আত্মীয় তা প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাঁর বাবা-মায়ের পিতৃভূমির জন্য নয়, একজন ইকো-ফিকশনিস্ট হিসেবে তিনি নিরন্তর কাজ করে চলেছেন এই ভূখণ্ডের মানুষের পরিবেশ ও তার বিপর্যয় নিয়ে। সারা বিশে^র কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন সুন্দরবনের মতো বিশে^র সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ভূমির সাম্প্রতিক ঝুঁকির কথা। একারণে,এ ভূখণ্ডের মানুষ তাঁকে গ্রহণ করেছে যে, লাইন ধরে তাঁর বই কেনার ভিতর দিয়ে দৃশ্যটি পূর্ণতা পেয়েছে।