‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই’

‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই/ পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরি টিপ/জাগি বাতায়নে জ¦ালি আঁখি প্রদীপ/ মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই’- এটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত গজল। গজলের ইতিহাসে দেখা যায়, নজরুলই প্রথম গীতিকবি যিনি গজলকে জেনারালাইজেশন বা সাধারণীকরণ করেছেন। নজরুলের পূর্বে গজল ছিল মূলত ড্রয়িংরুম কেন্দ্রিক। আড্ডা হবে সাথে সুরাপানসহ গজল। নজরুল এই ধারাটি ভেঙ্গে ফেলেন। তিনি কৃষক, কামার, কুমার, মাঝি, মল্লার, জেলে, পথচারীসহ সকল মানুষের জন্য গজল রচনা করেছেন।

‘ভৈরবী’ রাগে ও কাহারবা তালে রচিত এটি নজরুলের একটি বিখ্যাত গজল। প্রাকৃতিক উপাদানে প্রেয়সীর অঙ্গসজ্জার নানাবিধ বর্ণনা রয়েছে গজলটিতে। প্রিয় মানুষটিকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা, প্রিয়তমের আসার আকাক্সক্ষায়- ‘চাপা রঙের শাড়ি পরা, কপালে খয়েরি টিপ আর বাতায়নে বসে জেগে আছে চাঁদের তৃষ্ণার ব্যাকুলতা। কখন প্রেমাস্পদের সাথে দেখা হবে তার জন্য এক অস্থিরতা। প্রেমে পড়ার পর দেহ ও মনের যে চঞ্চলতা তার রূপও গজলটিতে গভীরভাবে প্রকাশ হয়েছে। নজরুলের এই গজলটির যে বৈশিষ্ট্য তা থেকে দেখা যায় যে, আমাদের খুব চেনা বাস্তবের প্রেমকেই তিনি সংগীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রেমাসক্ত নর-নারীর স্বাভাবিক চঞ্চলতা, নজরুল প্রকৃতি ও জীবন থেকে বিভিন্ন উপাদান নিযে- ‘ভৈরবী’ রাগের মাধুর্যে গজলটি রচনা করেছেন। নরনারীর প্রেমকে সংগীতে এঁকেছেন সাধারণ অথচ চিরন্তন দৃষ্টি দিয়ে। তাঁর আরও একটি গজল, ‘আধো আধো বোল্ লাজে-বাধো-বাধো বোল’-এ প্রেমের প্রকাশ হিসেবে প্রেমিকার আনমনা ভাব, লাজনত চোখে পেমকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এবং শেষ পর্যন্ত না বলা কথাও জানাজানি হয়ে যাওয়া- ইত্যাদি পার্থিব জীবনের বিশেষ মুহূর্তের রূপকল্পের মধ্যে দিয়ে প্রেমের অনুভব ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার না বলা কথাও বেশভুষার ছলে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার চিত্রকল্প ফুটে ওঠে এই গজলে। তাঁর গজলে প্রেমের রূপ এত বৈচিত্র্যময় যা বাক্য দিয়ে প্রকাশ প্রায় অসম্ভব। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এ ক্ষেত্রেও তিনি সুরের নিরীক্ষণও করেছেন। গানের বাণীর ভাবকে প্রকাশের জন্য একই গানে একাধিক রাগ-রাগিনীর মিশ্রণ ঘটিয়েছেন এবং বলা যায় রাগ-রাগিনীর এরূপ ব্যবহারই নজরুলের গজলকে স্বাতন্ত্র্যধর্মী করেছে। ড. স্বপ্না ব্যানার্জি তাঁর গজল প্রসঙ্গে বলেছেন-

“নজরুলের গজলে কথা ও সুর দুটি পৃথক শিল্প একত্রে একটি সার্থক শিল্পরূপ পরিগ্রহ করেছে। কথাকেও তার ভাবৈশ্বর্যের জগৎ থেকে আলঙ্কারিক পোশাক ছাড়তে হয়েছে কিছুটা, সুরকে ও তার গুরুগম্ভীর অঙ্গন থেকে সহজ সরল চলন পদ্ধতি নিয়ে আসতে হয়েছে প্রাত্যহিকের আঙ্গিনায়। খাম্বাজের সঙ্গে মিলেছে পিলু, বারোয়াঁর করুণ্যের সঙ্গে পিলুর লঘু চাপল্য, ভীমপলশ্রীর মাধুর্যের সঙ্গে কাফির মেজাজ- এখানেই নজরুলের কৃতিত্ব।”

‘মোর ঘুমঘরে এলে মনোহর’- এটিও খুব সাদামাটাভাবে নজরুল রচনা করেছেন। এটি শুনলে মনে হয়- ভারতীয় সুমহান ঐতিহ্যের কথা, যেখানে প্রেমাস্পদ হয়ে যায় দেবতা অথবা দেবতা হয়ে যায় প্রেমাস্পদ। অর্থাৎ ভারতীয় দর্শনের ভক্তিভাবও এ গানটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ‘তোমার বুকের ফুলদানিতে ফুল হব বঁধু আমি’- নজরুল ভাবনায় কতটা রোমান্টিক এ গানের বাণী ও সুর তারই ইঙ্গিত প্রদান করে। ‘অঙ্গে তোমার রূপ হবো, ধূপ হবো মিলন রাতে- ‘ভৈরবী’র সুর স্পষ্ট অন্তরায় এসে। সাধারণের বিশ্বাসে পরিণত হয়- প্রেম ভিখারী পুরুষ যেন ¯স্নিগ্ধ একটি সকালে একা একা প্রেমিকার চরণতলে সমর্পিত হয়ে কথাগুলো বলছেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় নজরুলের প্রেমে যেমন আছে দৈহিক মিলন, আকাক্সক্ষা, তেমনি ভারতীয় দর্শনের ভক্তিভাবের সমর্পণের চিত্র। তাঁর গজলে জীবনের চরম বাস্তবতা যে মৃত্যু তার রূপেরও চিত্রকল্প এঁকেছেন তিনি এ গানটিতে- ‘মুসাফির। মোছ্ রে আঁখি-জল/ফিরে চল্ আপনারে নিয়া’-।‘বারোয়াঁ’ রাগে রচিত মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার প্রতীক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এই গান। আঁখি-জল নিয়েই অনন্ত পথের যাত্রী হতে হয় মানুষকে। বরষায় যে ফুল ফুটলো না পৌষ মাসে কি আর সেই ফুল ফুটবে? আসলেই একাকী জীবন পার করতে হয় মানুষকে। এই চির সত্যকেই নজরুল তাঁর গানে নানা আলঙ্কারিক শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেছেন বা চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।

ফরাসি গজলের অনুসরণে বাংলা গজল রচনা করেন তিনি। বাংলা শব্দ ব্যবহারে গজলে এক অপূর্ব লালিত্য এলো- ‘ঐ জল্কে চলে লো কার ঝিয়ারি/রূপ চাপে না তার নীল শাড়ি’

অথবা

‘কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া / প্রাতে কোকিল কাঁদে নিশাথে পাপিয়া’

নজরুলের অনেক গজল পারস্য গজল থেকে অনূদিত হলেও এর বাণী ও সুরে স্বকীয়তা স্পষ্ট। আবার গজলের বাণীতে পারস্য দর্শন শিল্প-সংস্কৃতির প্রভাব থাকলেও সুর রচনা একান্তই নজরুলের নিজস্ব। বলা যায়, গজলে সুরের ভিত্তি ও কাঠামোর খানিকটা পারস্য সুর প্রভাবিত হলেও মুনশিয়ানার সাথে ভারতীয় সংগীতের ধারা এবং বাংলা গানের যে ঐতিহ্যবাহী কাঠামো তার সাথে সুন্দরভাবে সংমিশ্রণ করতে পেরেছেন। গজলে তিনি যে নতুনত্ব আনেন তা হচ্ছে ভাবের নতুনত্ব, সুর-তাল ও লয়ের নতুনত্ব। গজলে ‘শেয়র’ তার অনবদ্য সংযোজন। তালহীন সুরের ওপর অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে টেনে টেনে ভাব ও রসকে পল্লবিত করার যে বৈচিত্র্য তা তিনি বাংলা গানের সুর সম্ভারে জমা করেছেন।

নজরুলের প্রায় সকল গজলই বাণী ও সুরে অনবদ্য। তাঁর গজলের ধারণাটাই এমন, শ্রোতা শোনামাত্র এর

ভাব-আবেদন-মূর্ছনা ইত্যাদির সাথে সহজেই একাত্ম হয়ে পড়েন। মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হলেও ইহলৌকিক ব্যাথা-বেদনা-যন্ত্রণা থেকে দূরে সরে গিয়ে এক ধরনের অলৌকিক আনন্দ পায়। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, কিছু গজলের বাণী এতই স্পর্শকাতর যা শোনামাত্রই মানব মনে দার্শনিক ভাবনা জন্ম নেয়। তাঁর ‘আগে মন করলে চুরি/মর্মে শেষে হানলে ছুরি/এত শঠতা এত যে ব্যথা/তবু যেন তা মধুতে মাখা’- এমন চরণ মুহুর্মুহু ব্যবহারের কারণে আমরা বলতে পারি প্রেমে যতই শঠতা থাকুক, নজরুল তা মধুর মতো করে তাঁর স্বচৈতন্যে ধারণ করেছেন এবং প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

গজলের উৎপত্তি প্রাচীন আরবি সাহিত্য থেকে এবং বিকশিত হয়েছিল পারস্যে। গজলকে বলা হয়ে থাকে দর্শননির্ভর হৃদয়কে নাড়া দেওয়ার মতো সংক্ষিপ্ত এক কাব্য। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গজল রচিত হলেও গজলের মূল উপজীব্য প্রেম আর প্রেমের বিরহ অর্থাৎ প্রেমাস্পদকে না পাওয়ার বেদনা গজলে চির উজ্জল। প্রেম ছাড়াও প্রকৃতি, সৃষ্টিতত্ত্ব ও ¯্রষ্টার গুনগান, ঋতুবৈচিত্র্য কিংবা সুরা ও সাকি বিষয়ক সংক্ষিপ্ত কাব্যই গজল। বলা হয়ে থাকে, পারস্য সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে গজল। পারস্য অঞ্চলের রুদাকি, ফেরদৌসি, আসাদি তুশি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী, জালালউদ্দিন রুমী কিংবা হাফিজ সিরাজির মতো কবি ও সুফি সাধকের হাত ধরে গজল সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে গজল জনপ্রিয় হতে থাকে আমির খসরুর কালজয়ী সৃষ্টির কারণে। পরবর্তীতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় অনেক গজল লিখলেও তার পরবর্তী সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের ভেতরে এই প্রবণতা তেমন খেয়াল করা যায়নি।

“পারস্য গজল দ্বিঅর্থাবাচক”। শারাব শব্দটি জ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞান তথা নিগূঢ় সত্য হিসেবে গজলে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আর সাকি হচ্ছে গুরু বা মুর্শিদ সেই দুর্লভ জ্ঞানদাতা-অপরূপকে রূপ আনার দিশারি তবে গজলের সমস্ত অর্থই বদলে যায় সাধারণ অর্থের কাছে। সুফি সাধনার মাতাল হওয়া বা বেহুঁশ হওয়া অর্থ হলো ‘ফানা’ অর্থ বিলীন হওয়া-আল্লাহর সাথে বিলীন হওয়া। উদাহারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় নজরুলের ‘এ কোন্ মধুর শারাব দিলে আল আরাবি সাকি/নেশায় হলাম দিওয়ানা যে রঙিন হল আঁখি।/... আল-কোরানের গাইলে গজল শবে কদর রাতে’-এখানে সাকি অর্থ গুরু আর শরাব মনে তত্ত্বজ্ঞান। ফলে গানটির ভাবমর্যাদা সাধারণের দৃষ্টিতে মর্যাদা সৃষ্টিতে বিশেষ সাহায্য করে, বলা যায় দারুণ এক মুগ্ধতাও তৈরি করে। তাঁর বিখ্যাত গজল-‘আধো আধো বোল্ লাজে বাধো বাধো বোল’, ‘আমি যেদিন রইব না গো লইব চিরবিদায়’, ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’, ‘এ আঁখি জল মোছ প্রিয়া’, ‘মুসাফির মোছরে আঁখি জল ফিরে চল’-এগুলো তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় গজল। নিতান্তই সহজ-সরল ভাষায় রচিত গজল শোনামাত্রই মানুষের ইন্দ্রিয় জগতে এক ধরনের প্রেমভাবনা জাগ্রত হয়। (ক্রমশ...)

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৩ , ২৮ পৌষ ১৪২৯, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ০৮

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই’

‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই/ পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরি টিপ/জাগি বাতায়নে জ¦ালি আঁখি প্রদীপ/ মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই’- এটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত গজল। গজলের ইতিহাসে দেখা যায়, নজরুলই প্রথম গীতিকবি যিনি গজলকে জেনারালাইজেশন বা সাধারণীকরণ করেছেন। নজরুলের পূর্বে গজল ছিল মূলত ড্রয়িংরুম কেন্দ্রিক। আড্ডা হবে সাথে সুরাপানসহ গজল। নজরুল এই ধারাটি ভেঙ্গে ফেলেন। তিনি কৃষক, কামার, কুমার, মাঝি, মল্লার, জেলে, পথচারীসহ সকল মানুষের জন্য গজল রচনা করেছেন।

‘ভৈরবী’ রাগে ও কাহারবা তালে রচিত এটি নজরুলের একটি বিখ্যাত গজল। প্রাকৃতিক উপাদানে প্রেয়সীর অঙ্গসজ্জার নানাবিধ বর্ণনা রয়েছে গজলটিতে। প্রিয় মানুষটিকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা, প্রিয়তমের আসার আকাক্সক্ষায়- ‘চাপা রঙের শাড়ি পরা, কপালে খয়েরি টিপ আর বাতায়নে বসে জেগে আছে চাঁদের তৃষ্ণার ব্যাকুলতা। কখন প্রেমাস্পদের সাথে দেখা হবে তার জন্য এক অস্থিরতা। প্রেমে পড়ার পর দেহ ও মনের যে চঞ্চলতা তার রূপও গজলটিতে গভীরভাবে প্রকাশ হয়েছে। নজরুলের এই গজলটির যে বৈশিষ্ট্য তা থেকে দেখা যায় যে, আমাদের খুব চেনা বাস্তবের প্রেমকেই তিনি সংগীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রেমাসক্ত নর-নারীর স্বাভাবিক চঞ্চলতা, নজরুল প্রকৃতি ও জীবন থেকে বিভিন্ন উপাদান নিযে- ‘ভৈরবী’ রাগের মাধুর্যে গজলটি রচনা করেছেন। নরনারীর প্রেমকে সংগীতে এঁকেছেন সাধারণ অথচ চিরন্তন দৃষ্টি দিয়ে। তাঁর আরও একটি গজল, ‘আধো আধো বোল্ লাজে-বাধো-বাধো বোল’-এ প্রেমের প্রকাশ হিসেবে প্রেমিকার আনমনা ভাব, লাজনত চোখে পেমকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এবং শেষ পর্যন্ত না বলা কথাও জানাজানি হয়ে যাওয়া- ইত্যাদি পার্থিব জীবনের বিশেষ মুহূর্তের রূপকল্পের মধ্যে দিয়ে প্রেমের অনুভব ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার না বলা কথাও বেশভুষার ছলে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার চিত্রকল্প ফুটে ওঠে এই গজলে। তাঁর গজলে প্রেমের রূপ এত বৈচিত্র্যময় যা বাক্য দিয়ে প্রকাশ প্রায় অসম্ভব। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এ ক্ষেত্রেও তিনি সুরের নিরীক্ষণও করেছেন। গানের বাণীর ভাবকে প্রকাশের জন্য একই গানে একাধিক রাগ-রাগিনীর মিশ্রণ ঘটিয়েছেন এবং বলা যায় রাগ-রাগিনীর এরূপ ব্যবহারই নজরুলের গজলকে স্বাতন্ত্র্যধর্মী করেছে। ড. স্বপ্না ব্যানার্জি তাঁর গজল প্রসঙ্গে বলেছেন-

“নজরুলের গজলে কথা ও সুর দুটি পৃথক শিল্প একত্রে একটি সার্থক শিল্পরূপ পরিগ্রহ করেছে। কথাকেও তার ভাবৈশ্বর্যের জগৎ থেকে আলঙ্কারিক পোশাক ছাড়তে হয়েছে কিছুটা, সুরকে ও তার গুরুগম্ভীর অঙ্গন থেকে সহজ সরল চলন পদ্ধতি নিয়ে আসতে হয়েছে প্রাত্যহিকের আঙ্গিনায়। খাম্বাজের সঙ্গে মিলেছে পিলু, বারোয়াঁর করুণ্যের সঙ্গে পিলুর লঘু চাপল্য, ভীমপলশ্রীর মাধুর্যের সঙ্গে কাফির মেজাজ- এখানেই নজরুলের কৃতিত্ব।”

‘মোর ঘুমঘরে এলে মনোহর’- এটিও খুব সাদামাটাভাবে নজরুল রচনা করেছেন। এটি শুনলে মনে হয়- ভারতীয় সুমহান ঐতিহ্যের কথা, যেখানে প্রেমাস্পদ হয়ে যায় দেবতা অথবা দেবতা হয়ে যায় প্রেমাস্পদ। অর্থাৎ ভারতীয় দর্শনের ভক্তিভাবও এ গানটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ‘তোমার বুকের ফুলদানিতে ফুল হব বঁধু আমি’- নজরুল ভাবনায় কতটা রোমান্টিক এ গানের বাণী ও সুর তারই ইঙ্গিত প্রদান করে। ‘অঙ্গে তোমার রূপ হবো, ধূপ হবো মিলন রাতে- ‘ভৈরবী’র সুর স্পষ্ট অন্তরায় এসে। সাধারণের বিশ্বাসে পরিণত হয়- প্রেম ভিখারী পুরুষ যেন ¯স্নিগ্ধ একটি সকালে একা একা প্রেমিকার চরণতলে সমর্পিত হয়ে কথাগুলো বলছেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় নজরুলের প্রেমে যেমন আছে দৈহিক মিলন, আকাক্সক্ষা, তেমনি ভারতীয় দর্শনের ভক্তিভাবের সমর্পণের চিত্র। তাঁর গজলে জীবনের চরম বাস্তবতা যে মৃত্যু তার রূপেরও চিত্রকল্প এঁকেছেন তিনি এ গানটিতে- ‘মুসাফির। মোছ্ রে আঁখি-জল/ফিরে চল্ আপনারে নিয়া’-।‘বারোয়াঁ’ রাগে রচিত মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার প্রতীক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এই গান। আঁখি-জল নিয়েই অনন্ত পথের যাত্রী হতে হয় মানুষকে। বরষায় যে ফুল ফুটলো না পৌষ মাসে কি আর সেই ফুল ফুটবে? আসলেই একাকী জীবন পার করতে হয় মানুষকে। এই চির সত্যকেই নজরুল তাঁর গানে নানা আলঙ্কারিক শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেছেন বা চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।

ফরাসি গজলের অনুসরণে বাংলা গজল রচনা করেন তিনি। বাংলা শব্দ ব্যবহারে গজলে এক অপূর্ব লালিত্য এলো- ‘ঐ জল্কে চলে লো কার ঝিয়ারি/রূপ চাপে না তার নীল শাড়ি’

অথবা

‘কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া / প্রাতে কোকিল কাঁদে নিশাথে পাপিয়া’

নজরুলের অনেক গজল পারস্য গজল থেকে অনূদিত হলেও এর বাণী ও সুরে স্বকীয়তা স্পষ্ট। আবার গজলের বাণীতে পারস্য দর্শন শিল্প-সংস্কৃতির প্রভাব থাকলেও সুর রচনা একান্তই নজরুলের নিজস্ব। বলা যায়, গজলে সুরের ভিত্তি ও কাঠামোর খানিকটা পারস্য সুর প্রভাবিত হলেও মুনশিয়ানার সাথে ভারতীয় সংগীতের ধারা এবং বাংলা গানের যে ঐতিহ্যবাহী কাঠামো তার সাথে সুন্দরভাবে সংমিশ্রণ করতে পেরেছেন। গজলে তিনি যে নতুনত্ব আনেন তা হচ্ছে ভাবের নতুনত্ব, সুর-তাল ও লয়ের নতুনত্ব। গজলে ‘শেয়র’ তার অনবদ্য সংযোজন। তালহীন সুরের ওপর অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে টেনে টেনে ভাব ও রসকে পল্লবিত করার যে বৈচিত্র্য তা তিনি বাংলা গানের সুর সম্ভারে জমা করেছেন।

নজরুলের প্রায় সকল গজলই বাণী ও সুরে অনবদ্য। তাঁর গজলের ধারণাটাই এমন, শ্রোতা শোনামাত্র এর

ভাব-আবেদন-মূর্ছনা ইত্যাদির সাথে সহজেই একাত্ম হয়ে পড়েন। মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হলেও ইহলৌকিক ব্যাথা-বেদনা-যন্ত্রণা থেকে দূরে সরে গিয়ে এক ধরনের অলৌকিক আনন্দ পায়। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, কিছু গজলের বাণী এতই স্পর্শকাতর যা শোনামাত্রই মানব মনে দার্শনিক ভাবনা জন্ম নেয়। তাঁর ‘আগে মন করলে চুরি/মর্মে শেষে হানলে ছুরি/এত শঠতা এত যে ব্যথা/তবু যেন তা মধুতে মাখা’- এমন চরণ মুহুর্মুহু ব্যবহারের কারণে আমরা বলতে পারি প্রেমে যতই শঠতা থাকুক, নজরুল তা মধুর মতো করে তাঁর স্বচৈতন্যে ধারণ করেছেন এবং প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

গজলের উৎপত্তি প্রাচীন আরবি সাহিত্য থেকে এবং বিকশিত হয়েছিল পারস্যে। গজলকে বলা হয়ে থাকে দর্শননির্ভর হৃদয়কে নাড়া দেওয়ার মতো সংক্ষিপ্ত এক কাব্য। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গজল রচিত হলেও গজলের মূল উপজীব্য প্রেম আর প্রেমের বিরহ অর্থাৎ প্রেমাস্পদকে না পাওয়ার বেদনা গজলে চির উজ্জল। প্রেম ছাড়াও প্রকৃতি, সৃষ্টিতত্ত্ব ও ¯্রষ্টার গুনগান, ঋতুবৈচিত্র্য কিংবা সুরা ও সাকি বিষয়ক সংক্ষিপ্ত কাব্যই গজল। বলা হয়ে থাকে, পারস্য সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে গজল। পারস্য অঞ্চলের রুদাকি, ফেরদৌসি, আসাদি তুশি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী, জালালউদ্দিন রুমী কিংবা হাফিজ সিরাজির মতো কবি ও সুফি সাধকের হাত ধরে গজল সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে গজল জনপ্রিয় হতে থাকে আমির খসরুর কালজয়ী সৃষ্টির কারণে। পরবর্তীতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় অনেক গজল লিখলেও তার পরবর্তী সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের ভেতরে এই প্রবণতা তেমন খেয়াল করা যায়নি।

“পারস্য গজল দ্বিঅর্থাবাচক”। শারাব শব্দটি জ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞান তথা নিগূঢ় সত্য হিসেবে গজলে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আর সাকি হচ্ছে গুরু বা মুর্শিদ সেই দুর্লভ জ্ঞানদাতা-অপরূপকে রূপ আনার দিশারি তবে গজলের সমস্ত অর্থই বদলে যায় সাধারণ অর্থের কাছে। সুফি সাধনার মাতাল হওয়া বা বেহুঁশ হওয়া অর্থ হলো ‘ফানা’ অর্থ বিলীন হওয়া-আল্লাহর সাথে বিলীন হওয়া। উদাহারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় নজরুলের ‘এ কোন্ মধুর শারাব দিলে আল আরাবি সাকি/নেশায় হলাম দিওয়ানা যে রঙিন হল আঁখি।/... আল-কোরানের গাইলে গজল শবে কদর রাতে’-এখানে সাকি অর্থ গুরু আর শরাব মনে তত্ত্বজ্ঞান। ফলে গানটির ভাবমর্যাদা সাধারণের দৃষ্টিতে মর্যাদা সৃষ্টিতে বিশেষ সাহায্য করে, বলা যায় দারুণ এক মুগ্ধতাও তৈরি করে। তাঁর বিখ্যাত গজল-‘আধো আধো বোল্ লাজে বাধো বাধো বোল’, ‘আমি যেদিন রইব না গো লইব চিরবিদায়’, ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’, ‘এ আঁখি জল মোছ প্রিয়া’, ‘মুসাফির মোছরে আঁখি জল ফিরে চল’-এগুলো তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় গজল। নিতান্তই সহজ-সরল ভাষায় রচিত গজল শোনামাত্রই মানুষের ইন্দ্রিয় জগতে এক ধরনের প্রেমভাবনা জাগ্রত হয়। (ক্রমশ...)