হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

অরূপ পালিত

আর যদি দেখো পাশ দিয়ে যেতে

জুম থেকে ফেরা আদিবাসী কোনো সাধারণ নারী

বলো, সন্তান আমি তোমারি গর্ভে জন্ম আমার

কী করে ভুলিতে পারি...

সবুজ পাহাড়ের উঁচুনিচু সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা দেখতে কার না ভালো লাগে। পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে যদি পেয়ে যান নীলচে কালো মেঘ আর বৃষ্টি-মনটা তখন উড়তে শুরু করে অজানার উদ্দেশে। পেছন থেকে এসে সাদা মেঘের ভেলা উড়ে এসে যেন বলবে, তুমি চোখ বন্ধ করো। মনের মানুষটির মতো জড়িয়ে নিয়ে বলবে, অনেক হয়েছে প্রিয়। এবার আমার সাথে উড়ে চলো। সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় যদি সেই মানুষটির সাথে হাত ধরে চলার কোন সুখের স্মৃতি,না পাওয়ার বেদনারা হাহাকার তুলে নেমে আসবে হৃদয়জুড়ে। এমন সময় হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি আসে আকাশজুড়ে, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকতে হবে গহীন অরণ্যের মাঝ থেকে নেমে আসা অপরূপ ঝর্ণাধারার দিকে। মনে হয় সাদা মেঘের ভেলা ওই সবুজের স্নিগ্ধতায় পাহাড়কে ভালোবেসে কীভাবে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।এর মধ্য দিয়ে হৃদয়ে লেখা হয় না পাওয়ার গল্প এবং কবিতা।

আমার চোখে পাহাড়পুত্র কবি হাফিজ রশিদ খান-এর কবিতা নিয়ে কিছু লেখা মানেই আসলে দুঃসাহস দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। হাফিজ রশিদ খান-এর জন্ম চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একুশে সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত তিনি। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘আদিবাসী কাব্য’ তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

পাহাড়ের টানে তিনি ঘর ছেড়েছেন। পাহাড় ও আদিবাসী জনপদকে ভালোবেসে ওখানেই দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন। এক শ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোলুপতার দিকে ইংগিত করে তাঁর উচ্চারণ:

তারা উচ্ছল, সধবা রমণীর দিকে

পাহাড়ের চূড়া আর সমুদ্রের অবাধ বিস্তারে

অরণ্যভূমি ও ফসলি জমির বুকে

হনন-উদ্যত হায়েনার মতো চেয়ে থাকে...

লেখালেখির শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্র সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন। আশির দশকে সম্পাদনা করেছেন ‘রেনেসাঁস,’ধানের শীষে গান’, ’বৃষ্টি’,’চারণ’ ইত্যাদি পত্রিকা। ১৯৯১ সাল থেকে ‘সমুজ্জ¦ল সুবাতাস’ এবং ’পুষ্পকরথ’ সম্পাদনা করছেন। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রস্থ ’জোসনা কেমন ফুটেছে’, ১৯৮৩, সালে ‘সুন্দরের দূর্গ’ কাব্য প্রকাশিত হয়। একই বছর চৈতন্যের মগ্নতার স্বাক্ষরবাহী ‘চোরাগুপ্তা ডুবোপাহাড়’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি ‘বিধ্বস্ত ক্যম্পাস’ নামে প্রেমের কবিতার ভাঁজপত্র এবং এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী ’ফুলবাড়িয়ার নিহত পলাশগুলো’ প্রকাশিত হলে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রাতিস্বিকতা সুধীমহলে দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশ করেন দীর্ঘ কবিতা সংকলন ‘শোণিত প্রপাত’।

প্রিয় কবি পাহাড়ি পুত্র হিসেবেই পরিচিত। তাঁর আদিবাসী নিয়ে কাব্যচর্চা ও কাব্যযাত্রার সূত্রপাত আশির দশক থেকে। শুধু আদিবাসী জীবনের উপর ভিত্তি করে এখন পর্যন্ত তাঁর ছয়টি কাব্য ও গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

চলতি বছর (২০২২) ‘নির্বাচিত কবিতা : আদিবাসীপর্ব’ নামে হাফিজ রশিদ খান-এর আদিবাসীকেন্দ্রিক কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছে প্রকাশনাসংস্থা চন্দ্রবিন্দু। এখানে ‘পাহাড়ি কুসুম’ ‘যুবতীর জন্যে পদ্য’ ‘বৃক্ষবিশারদ’ শিরোনামে আদিবাসীদের জীবনধারার হাল-হকিকত তথা অস্তিত্বের টানাপোড়েন, নিজস্ব মধুর প্রেম এসব নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য সব কবিতা। ‘কাটে কামাচ্ছন্ন তবু লাবণ্যে তাহার / আমি প্রেমিক বৃক্ষের বিশারদ...’

’আদিবাসী কাব্য’ (১৯৯৭)-এর অন্তর্গত ‘কার্পাসমহল’ কবিতাগুচ্ছ থেকে ১-সংখ্যক কবিতাটি পড়া যাক:

জন্মেছি বুদ্ধের ঘরে আর কোনো করুণার কারণ চিনি না

ছোটো-ছোটো ঢেউয়ের পাঁজরে

দুধ-আলতা শরীর ডুবিয়ে,

চারপাশ কার্পাসের স্বপ্ন বুনি।

নানা রকমের কুচকাওয়াজের ঝিঁঝিট

প্রাণের কাঁপন তোলা

সন্ধ্যার সান্নিধ্য আসে

স্তনের চুড়োয় রাত্রি এলে উষ্ণতর

দুনিয়ার নাগরিকদের ডেকে বলি।

খুইমা আরো খাঙ লুমা আম্যো খাঙ

সেই ভালো কুকুরের অনেক লালসা তুমি

আমি অস্থি মারমা সুতনুকার...

(কার্পাসমহল: মোগল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম। ‘খুইমা আরো খাঙ লুমা আম্যো খাঙ...: মারমা প্রবাদ: ‘কুকুরের টান হাড্ডির প্রতি, মানুষের টান স্বজনের প্রতি’)

কবিতাগুলোর চরণে মাঝেমধ্যে আদিবাসী শব্দ প্রয়োগ করে সেই জীবনের নিবিড়তা ও গভীরতার খোঁজ নিয়েছেন। যেমন, রাখাইন ভাষার ‘রে ফ্রি সা মু’ মানে ‘চিরুণিপিঠা’ আছে ‘চিরুণিপিঠা’ নিবি। এ নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ব্যঞ্জনাধর্মী আদিবাসীদের শ্রমময় জীবনের গন্ধমাখা কবিতা। যার শিরোনাম ‘রে ফ্রি সা মু’।

কবিতাটি পড়ি।

সোনালি তলপেট মুক্ত করেছে শীতের সকাল

দুচোখে ঘুম নেই রাত্রি সরেছে সে অনেক কাল

সুদূর ও-পাড়ার রেগেখাঙ তীরে ছোট্ট মাচাঙঘর

ভয়াল শীতরাতে প্রতারক ওম ঘিরে গ্রীষ্মে কেটেছে জ্বর

কুয়াশা বুকে গেঁথে থুরঙের চাপে-ভারে অবংগ্রি ওই যায়

দেখে না দুই চোখে স্পষ্ট আকাওে তবু হাঁকে রাস্তায়:

রে ফি সা মু রে ফ্রি সা মু

চিরুনি পিঠা নিবি চিরুনি পিঠা কেউ...

(রে ফি সা মু: রাখাইন শব্দ: [রে ফ্রি : চিরুনি, মু : পিঠা= চিরুনি পিঠা]। রেগেখাঙ : মারমা শব্দ: শঙ্খনদী। থুরঙ: মারমা শব্দ: পিঠে ভারী বোঝা বইবার পক্ষে উপযোগী ঝুড়িবিশেষ। অবংগ্রি: মারমা শব্দ: সকলে যে-বয়োজ্যেষ্ঠকে

আদর করে দাদি বা নানি বলে ডাকে)। কবি আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার সপক্ষে বলেছেন এভাবে।

রাতজাগা মোনঘরে

রবিশস্যর পাহারাদার

আমার হৃদয়...

আদিবাসীদের সংগ্রাম, স্বজনহীন হতদরিদ্র জীবনের ভারে নুয়ে পড়া বয়োবৃদ্ধরা, আত্মপ্রত্যায়ী নারীর বেঁচে থাকার প্রত্যয় এসব অনুষঙ্গ এসেছে তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রে সাবলীলভাবে। পাহ আদিবাসী মানুষের দুমুঠো অন্নসংস্থানের জন্যে ধুঁকে ধুঁকে পথচলার ছবি অতি বিশ্বস্তভাবে একেছের কবি। তবে তা ভিক্ষাবৃত্তি নয়। বরং তা আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয়বাহী বলেই কবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

কবি হাফিজ রশিদ খান-এর ’নির্বাচিত কবিতা: আদিবাসীপর্ব’ পাহাড়ের জীবনধারা, প্রকৃতি ও প্রকৃতির উদরতা, প্রতিবেশকে ধারণ করেছে নব্যকালের পরিবেশবাদী দৃষ্টিকোণে।

নির্বাচিত কবিতা: আদিবাসীপর্ব। হাফিজ রশিদ খান। প্রকাশকাল: ফ্রেব্রুয়ারী ২০২২। প্রচ্ছদ: সাজ্জাদ তপু। মূল্য: ৩০০ টাকা।

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৩ , ২৮ পৌষ ১৪২৯, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

অরূপ পালিত

image

আর যদি দেখো পাশ দিয়ে যেতে

জুম থেকে ফেরা আদিবাসী কোনো সাধারণ নারী

বলো, সন্তান আমি তোমারি গর্ভে জন্ম আমার

কী করে ভুলিতে পারি...

সবুজ পাহাড়ের উঁচুনিচু সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা দেখতে কার না ভালো লাগে। পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে যদি পেয়ে যান নীলচে কালো মেঘ আর বৃষ্টি-মনটা তখন উড়তে শুরু করে অজানার উদ্দেশে। পেছন থেকে এসে সাদা মেঘের ভেলা উড়ে এসে যেন বলবে, তুমি চোখ বন্ধ করো। মনের মানুষটির মতো জড়িয়ে নিয়ে বলবে, অনেক হয়েছে প্রিয়। এবার আমার সাথে উড়ে চলো। সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় যদি সেই মানুষটির সাথে হাত ধরে চলার কোন সুখের স্মৃতি,না পাওয়ার বেদনারা হাহাকার তুলে নেমে আসবে হৃদয়জুড়ে। এমন সময় হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি আসে আকাশজুড়ে, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকতে হবে গহীন অরণ্যের মাঝ থেকে নেমে আসা অপরূপ ঝর্ণাধারার দিকে। মনে হয় সাদা মেঘের ভেলা ওই সবুজের স্নিগ্ধতায় পাহাড়কে ভালোবেসে কীভাবে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।এর মধ্য দিয়ে হৃদয়ে লেখা হয় না পাওয়ার গল্প এবং কবিতা।

আমার চোখে পাহাড়পুত্র কবি হাফিজ রশিদ খান-এর কবিতা নিয়ে কিছু লেখা মানেই আসলে দুঃসাহস দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। হাফিজ রশিদ খান-এর জন্ম চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একুশে সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত তিনি। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘আদিবাসী কাব্য’ তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

পাহাড়ের টানে তিনি ঘর ছেড়েছেন। পাহাড় ও আদিবাসী জনপদকে ভালোবেসে ওখানেই দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন। এক শ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোলুপতার দিকে ইংগিত করে তাঁর উচ্চারণ:

তারা উচ্ছল, সধবা রমণীর দিকে

পাহাড়ের চূড়া আর সমুদ্রের অবাধ বিস্তারে

অরণ্যভূমি ও ফসলি জমির বুকে

হনন-উদ্যত হায়েনার মতো চেয়ে থাকে...

লেখালেখির শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্র সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন। আশির দশকে সম্পাদনা করেছেন ‘রেনেসাঁস,’ধানের শীষে গান’, ’বৃষ্টি’,’চারণ’ ইত্যাদি পত্রিকা। ১৯৯১ সাল থেকে ‘সমুজ্জ¦ল সুবাতাস’ এবং ’পুষ্পকরথ’ সম্পাদনা করছেন। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রস্থ ’জোসনা কেমন ফুটেছে’, ১৯৮৩, সালে ‘সুন্দরের দূর্গ’ কাব্য প্রকাশিত হয়। একই বছর চৈতন্যের মগ্নতার স্বাক্ষরবাহী ‘চোরাগুপ্তা ডুবোপাহাড়’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি ‘বিধ্বস্ত ক্যম্পাস’ নামে প্রেমের কবিতার ভাঁজপত্র এবং এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী ’ফুলবাড়িয়ার নিহত পলাশগুলো’ প্রকাশিত হলে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রাতিস্বিকতা সুধীমহলে দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশ করেন দীর্ঘ কবিতা সংকলন ‘শোণিত প্রপাত’।

প্রিয় কবি পাহাড়ি পুত্র হিসেবেই পরিচিত। তাঁর আদিবাসী নিয়ে কাব্যচর্চা ও কাব্যযাত্রার সূত্রপাত আশির দশক থেকে। শুধু আদিবাসী জীবনের উপর ভিত্তি করে এখন পর্যন্ত তাঁর ছয়টি কাব্য ও গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

চলতি বছর (২০২২) ‘নির্বাচিত কবিতা : আদিবাসীপর্ব’ নামে হাফিজ রশিদ খান-এর আদিবাসীকেন্দ্রিক কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছে প্রকাশনাসংস্থা চন্দ্রবিন্দু। এখানে ‘পাহাড়ি কুসুম’ ‘যুবতীর জন্যে পদ্য’ ‘বৃক্ষবিশারদ’ শিরোনামে আদিবাসীদের জীবনধারার হাল-হকিকত তথা অস্তিত্বের টানাপোড়েন, নিজস্ব মধুর প্রেম এসব নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য সব কবিতা। ‘কাটে কামাচ্ছন্ন তবু লাবণ্যে তাহার / আমি প্রেমিক বৃক্ষের বিশারদ...’

’আদিবাসী কাব্য’ (১৯৯৭)-এর অন্তর্গত ‘কার্পাসমহল’ কবিতাগুচ্ছ থেকে ১-সংখ্যক কবিতাটি পড়া যাক:

জন্মেছি বুদ্ধের ঘরে আর কোনো করুণার কারণ চিনি না

ছোটো-ছোটো ঢেউয়ের পাঁজরে

দুধ-আলতা শরীর ডুবিয়ে,

চারপাশ কার্পাসের স্বপ্ন বুনি।

নানা রকমের কুচকাওয়াজের ঝিঁঝিট

প্রাণের কাঁপন তোলা

সন্ধ্যার সান্নিধ্য আসে

স্তনের চুড়োয় রাত্রি এলে উষ্ণতর

দুনিয়ার নাগরিকদের ডেকে বলি।

খুইমা আরো খাঙ লুমা আম্যো খাঙ

সেই ভালো কুকুরের অনেক লালসা তুমি

আমি অস্থি মারমা সুতনুকার...

(কার্পাসমহল: মোগল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম। ‘খুইমা আরো খাঙ লুমা আম্যো খাঙ...: মারমা প্রবাদ: ‘কুকুরের টান হাড্ডির প্রতি, মানুষের টান স্বজনের প্রতি’)

কবিতাগুলোর চরণে মাঝেমধ্যে আদিবাসী শব্দ প্রয়োগ করে সেই জীবনের নিবিড়তা ও গভীরতার খোঁজ নিয়েছেন। যেমন, রাখাইন ভাষার ‘রে ফ্রি সা মু’ মানে ‘চিরুণিপিঠা’ আছে ‘চিরুণিপিঠা’ নিবি। এ নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ব্যঞ্জনাধর্মী আদিবাসীদের শ্রমময় জীবনের গন্ধমাখা কবিতা। যার শিরোনাম ‘রে ফ্রি সা মু’।

কবিতাটি পড়ি।

সোনালি তলপেট মুক্ত করেছে শীতের সকাল

দুচোখে ঘুম নেই রাত্রি সরেছে সে অনেক কাল

সুদূর ও-পাড়ার রেগেখাঙ তীরে ছোট্ট মাচাঙঘর

ভয়াল শীতরাতে প্রতারক ওম ঘিরে গ্রীষ্মে কেটেছে জ্বর

কুয়াশা বুকে গেঁথে থুরঙের চাপে-ভারে অবংগ্রি ওই যায়

দেখে না দুই চোখে স্পষ্ট আকাওে তবু হাঁকে রাস্তায়:

রে ফি সা মু রে ফ্রি সা মু

চিরুনি পিঠা নিবি চিরুনি পিঠা কেউ...

(রে ফি সা মু: রাখাইন শব্দ: [রে ফ্রি : চিরুনি, মু : পিঠা= চিরুনি পিঠা]। রেগেখাঙ : মারমা শব্দ: শঙ্খনদী। থুরঙ: মারমা শব্দ: পিঠে ভারী বোঝা বইবার পক্ষে উপযোগী ঝুড়িবিশেষ। অবংগ্রি: মারমা শব্দ: সকলে যে-বয়োজ্যেষ্ঠকে

আদর করে দাদি বা নানি বলে ডাকে)। কবি আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার সপক্ষে বলেছেন এভাবে।

রাতজাগা মোনঘরে

রবিশস্যর পাহারাদার

আমার হৃদয়...

আদিবাসীদের সংগ্রাম, স্বজনহীন হতদরিদ্র জীবনের ভারে নুয়ে পড়া বয়োবৃদ্ধরা, আত্মপ্রত্যায়ী নারীর বেঁচে থাকার প্রত্যয় এসব অনুষঙ্গ এসেছে তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রে সাবলীলভাবে। পাহ আদিবাসী মানুষের দুমুঠো অন্নসংস্থানের জন্যে ধুঁকে ধুঁকে পথচলার ছবি অতি বিশ্বস্তভাবে একেছের কবি। তবে তা ভিক্ষাবৃত্তি নয়। বরং তা আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয়বাহী বলেই কবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

কবি হাফিজ রশিদ খান-এর ’নির্বাচিত কবিতা: আদিবাসীপর্ব’ পাহাড়ের জীবনধারা, প্রকৃতি ও প্রকৃতির উদরতা, প্রতিবেশকে ধারণ করেছে নব্যকালের পরিবেশবাদী দৃষ্টিকোণে।

নির্বাচিত কবিতা: আদিবাসীপর্ব। হাফিজ রশিদ খান। প্রকাশকাল: ফ্রেব্রুয়ারী ২০২২। প্রচ্ছদ: সাজ্জাদ তপু। মূল্য: ৩০০ টাকা।