কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ও সময় ফের বাড়ছে

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের খরচ বাড়ছে ৩১৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পের সময়ও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। এর আগেও একবার ব্যয় ও দুইবার সময় বাড়ানো হয়েছিল প্রকল্পটির। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঠিকাদারের বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন আমদানি খাতে খরচ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধনের জন্য উঠলে গতকাল তাতে অনুমোদন দেয়া হয়। সব মিলিয়ে এখন এই প্রকল্পে খরচ হবে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি শেষ করার জন্য এর আগে সময় দেয়া হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘এবার মূলত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই প্রকল্পের ব্যয় ৩ শতাংশ বাড়ছে। ডলারের দাম না বাড়লে এই সংশোধনের প্রয়োজন হতো না। ২০১৫ সালে এই প্রকল্প গ্রহণের সময় টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ১ ডলারে ৮২ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর তা এক বছরে এই হার ১০৫ টাকার ওপরে চলে গেছে। প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট বিদেশি জনবল এবং পণ্য আমদানিসহ বেশিরভাগ ব্যয় মেটানো হয় ডলারে। সুতরাং ডলারের দাম বাড়লে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।’

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি এখন প্রায় শেষের দিকে। শীঘ্রই এই টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা আছে। গত নভেম্বর মাসে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল সেতু কর্তৃপক্ষ।

গত কয়েক মাসে ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০৬ টাকা হয়েছে। সে কারণে এই প্রকল্পের খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া আসবাব কেনা, শুল্ক-কর বৃদ্ধির কারণেও খরচ বাড়ছে বলে জানা যাচ্ছে।

২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর একনেক সভায় চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ কাজ করছে চীনা কোম্পানি- চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (সিসিসি)।

তখন ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। পরে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বরের একনেক সভায় প্রায় ১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ব্যয় এবং বাস্তবায়ন সময় এক বছর ৬ মাস বাড়িয়ে প্রথমবার প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

তখন প্রকল্পটি ২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার লক্ষ্য ধরা হলেও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকার বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক বছর বাড়ানোর সুযোগ দেয়। সে হিসাবে প্রকল্পটি গত ডিসেম্বর মাসে শেষ করার কথা ছিল।

গত ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের একটি টিউব উদ্বোধন করেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ১৫ জানুয়ারির পরে পুরো প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। কর্মকর্তারা জানান, নদীর তলদেশে টানেলের দুটি টিউবের নির্মাণকাজ শেষ, ভেতরে অবকাঠামোগত কাজ চলছে।

প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দিতে পারব।’

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অন্য টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুইটি করে মোট চারটি লেন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে বের হবে।

৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।

বুধবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৪ মাঘ ১৪২৯, ২৫ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ও সময় ফের বাড়ছে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের খরচ বাড়ছে ৩১৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পের সময়ও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। এর আগেও একবার ব্যয় ও দুইবার সময় বাড়ানো হয়েছিল প্রকল্পটির। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঠিকাদারের বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন আমদানি খাতে খরচ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধনের জন্য উঠলে গতকাল তাতে অনুমোদন দেয়া হয়। সব মিলিয়ে এখন এই প্রকল্পে খরচ হবে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি শেষ করার জন্য এর আগে সময় দেয়া হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘এবার মূলত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই প্রকল্পের ব্যয় ৩ শতাংশ বাড়ছে। ডলারের দাম না বাড়লে এই সংশোধনের প্রয়োজন হতো না। ২০১৫ সালে এই প্রকল্প গ্রহণের সময় টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ১ ডলারে ৮২ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর তা এক বছরে এই হার ১০৫ টাকার ওপরে চলে গেছে। প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট বিদেশি জনবল এবং পণ্য আমদানিসহ বেশিরভাগ ব্যয় মেটানো হয় ডলারে। সুতরাং ডলারের দাম বাড়লে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।’

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি এখন প্রায় শেষের দিকে। শীঘ্রই এই টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা আছে। গত নভেম্বর মাসে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল সেতু কর্তৃপক্ষ।

গত কয়েক মাসে ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০৬ টাকা হয়েছে। সে কারণে এই প্রকল্পের খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া আসবাব কেনা, শুল্ক-কর বৃদ্ধির কারণেও খরচ বাড়ছে বলে জানা যাচ্ছে।

২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর একনেক সভায় চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ কাজ করছে চীনা কোম্পানি- চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (সিসিসি)।

তখন ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। পরে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বরের একনেক সভায় প্রায় ১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ব্যয় এবং বাস্তবায়ন সময় এক বছর ৬ মাস বাড়িয়ে প্রথমবার প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

তখন প্রকল্পটি ২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার লক্ষ্য ধরা হলেও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকার বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক বছর বাড়ানোর সুযোগ দেয়। সে হিসাবে প্রকল্পটি গত ডিসেম্বর মাসে শেষ করার কথা ছিল।

গত ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের একটি টিউব উদ্বোধন করেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ১৫ জানুয়ারির পরে পুরো প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। কর্মকর্তারা জানান, নদীর তলদেশে টানেলের দুটি টিউবের নির্মাণকাজ শেষ, ভেতরে অবকাঠামোগত কাজ চলছে।

প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দিতে পারব।’

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অন্য টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুইটি করে মোট চারটি লেন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে বের হবে।

৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।