নাসির আহমেদের কবিতা

এই পরিহাস

আমার স্বপ্নের শস্য কেড়ে নিয়ে করো তুমি

নগরীর ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নবান্ন উৎসব!

অথচ দুঃখের বর্ষাকাল নিয়ে অর্ধাহারে

আমি চিরকাল।

আমার ক্ষেতের শস্য, পুকুরের মাছ

খাই না কখনো নিজে তোমাকে পাঠাই,

পাঠাতে বাধ্য; তবু দারিদ্র্য ঘোচে না কী যে ঋণ!

সাপ্তাহিক শোধ করে জীবন সর্বদা ওষ্ঠাগত।

তোমার বসন্তদিনে কত না উৎসব!

শীতে চলে পিঠাপুলি নবান্ন উৎসব, রিক্ত হাতে

ফিরে আসি, তোমার বাড়িতে হিং¯্র বিদেশি কুকুর!

আমার উৎসব নেই, বারো মাস আমাদের দুঃখের শ্রাবণ।

অথচ এ তুমিই তো আমার স্বজন! তবু চেনো না আমাকে!

চেনো না স্বদেশ আর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এমনকি মা’কে!

ভাগ্যের কী পরিহাস : আমার রক্ত চুষে এত যে বৈভব

তবু তুমি সুখী নও, অল্পে তুষ্ট আমি সুখী, তোমারই অভাব!

আমার পিতার মুখ

তিনি খুব মাটিবর্তী ছিলেন, বাসতেন ভালো লাঙ্গল-জোয়াল,

ফসল বণ্টন-সাম্যে এতটুকু ছাড় নয়! যার যা প্রাপ্য শোধ

করতেন সঠিক। তার চোখেমুখে জ্বলন্ত ক্রোধ প্রথম দেখেছি

একাত্তরে। মাটি ও মায়ের বড় ভক্ত সন্তান তিনি। আমার মাকেও

বড় ভালবাসতেন। এতটাই নিবেদিত- মা আমার শেষশয্যা

নিতে না নিতেই শোকে মুহ্যমান তিনিও গেলেন চলে।

আমরা কি তার মতো ভালবাসতে পেরেছি কাউকেই!

সব সময় তিনি শস্যের কথাই বলতেন। মনে রাখতেন বাংলা

মাসের হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক। কখন কী ঋতু আসে, কোন্

ঋতু কী ফলাবে ভালো, তা-ও ছিল জানা তার। বীজ তিনি

বুনতেন নিজের হাতে। আমরা কেউ তার মতো হতে পারি নাই।

আমি তার অক্ষম সন্তান- বাংলা মাসের হিসাব জানি না!

ঋতুচক্রে কীভাবে যে কোন মাস যায়, কখন কী ফসল ফলে

কিছুই জানি না। আমি ঘাস লতা-গুল্মহীন উদ্বাস্ত নাগরিক এক,

অথচ না নগরীও জানি কোনদিন দেবে না স্বীকৃতি!

শুনতে কি পাও

বন্ধ হয়েছে সব যোগাযোগ আমাদের

তবু ফুল ফোটা বন্ধ হয়নি, ফাল্গুনে সেই হুহু বেগে হাওয়া...

আমার আগুনে আমি যে পুড়েছি তুমি তা এখনো ভোলোনি!

সেই বন্ধন আজও দেখি তুমি খোলোনি।

দুঃস্বপ্নের মতো জেগে উঠি হঠাৎ মধ্যরাতে,

সেই সুখ আহা তীব্র শীতের মধ্যদুপুরে...

এখনো বুকের ভিতরে তৃষ্ণা জ্বালায় আগুন!

কেন তুমি খেলে গেলে এরকম নিষ্ঠুর প্রেম-প্রহসন-খেলা!

কাকে করি এই প্রশ্ন এখন?

তুমি তো এখন হারানো দিনের মনকাড়া গান

জীর্ণ রেকর্ড কত যে পুরনো! তবু কী সহজে বাজছো!

তুমি চেতনের অবচেতনের মধ্যবর্তী কাব্য;

ভাববো তোমার কথাই কেবল, আজীবন একা ভাববো।

শীতের শীর্ণ ধূসর পাতার নীরবে ঝরার কান্না

শুনতে কি পাও, শুনছো কি তুমি। শুনছো?

লোকগানের আসরে

খোল-করতাল বন্ধ করো, থামাও তোমার মুর্শিদী

আমার ক্ষেতের ধান লয়্যা যায় লাঠিয়াল ঐ

জোরদারে!

ঢাল-তলোয়ার কোথায় তোমার! বার করো ও বয়াতি!

আমরা ছজন ছয়খান আছে ধারালো ঈশ নাঙ্গলের,

খুন ঝরাইয়া দিমু আজকা পাকা ধানের আতাইলে!

থামাও সবে খোল করতাল! থামাও সুরের খুঞ্জুরা।

নাঙ্গল লও কান্ধে সবাই, হায়দরী হাঁক দেও মিয়া!

লিখে রাখো সেই স্বপ্ন

রাতের গভীরে টুপটাপ ঝরে মাঘের কুয়াশা গোপন দুঃখ,

শেষ বিকেলের গোধূলি-রঙিন পাতা ঝরে যায়, পাতা ঝরে যায়

এমন পোড়ানো শীতরাতে তুমি স্বপ্ন দেখেছ ফাগুন দিনের

রাশিরাশি ফুল ফুটেছে বাগানে

দখিনা বাতাসে হিজল ফুলেরা ঝরে!

স্বপ্ন দেখেছ ফসলে ভরেছে মাঠ। উচ্ছ্বাসে তুমি লাফিয়ে উঠেছ!

অথচ তীব্র শীতের কাঁপুনি, শূন্য হাঁড়িতে ভাত নেই এক মুঠো!

স্মৃতির গভীরে লিখে রাখো সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিন

আগুন ঝরানো ফাগুন আসবে থাকবে, তোমারও গোলাভরা ধান।

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৫ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

নাসির আহমেদের কবিতা

image

এই পরিহাস

আমার স্বপ্নের শস্য কেড়ে নিয়ে করো তুমি

নগরীর ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নবান্ন উৎসব!

অথচ দুঃখের বর্ষাকাল নিয়ে অর্ধাহারে

আমি চিরকাল।

আমার ক্ষেতের শস্য, পুকুরের মাছ

খাই না কখনো নিজে তোমাকে পাঠাই,

পাঠাতে বাধ্য; তবু দারিদ্র্য ঘোচে না কী যে ঋণ!

সাপ্তাহিক শোধ করে জীবন সর্বদা ওষ্ঠাগত।

তোমার বসন্তদিনে কত না উৎসব!

শীতে চলে পিঠাপুলি নবান্ন উৎসব, রিক্ত হাতে

ফিরে আসি, তোমার বাড়িতে হিং¯্র বিদেশি কুকুর!

আমার উৎসব নেই, বারো মাস আমাদের দুঃখের শ্রাবণ।

অথচ এ তুমিই তো আমার স্বজন! তবু চেনো না আমাকে!

চেনো না স্বদেশ আর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এমনকি মা’কে!

ভাগ্যের কী পরিহাস : আমার রক্ত চুষে এত যে বৈভব

তবু তুমি সুখী নও, অল্পে তুষ্ট আমি সুখী, তোমারই অভাব!

আমার পিতার মুখ

তিনি খুব মাটিবর্তী ছিলেন, বাসতেন ভালো লাঙ্গল-জোয়াল,

ফসল বণ্টন-সাম্যে এতটুকু ছাড় নয়! যার যা প্রাপ্য শোধ

করতেন সঠিক। তার চোখেমুখে জ্বলন্ত ক্রোধ প্রথম দেখেছি

একাত্তরে। মাটি ও মায়ের বড় ভক্ত সন্তান তিনি। আমার মাকেও

বড় ভালবাসতেন। এতটাই নিবেদিত- মা আমার শেষশয্যা

নিতে না নিতেই শোকে মুহ্যমান তিনিও গেলেন চলে।

আমরা কি তার মতো ভালবাসতে পেরেছি কাউকেই!

সব সময় তিনি শস্যের কথাই বলতেন। মনে রাখতেন বাংলা

মাসের হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক। কখন কী ঋতু আসে, কোন্

ঋতু কী ফলাবে ভালো, তা-ও ছিল জানা তার। বীজ তিনি

বুনতেন নিজের হাতে। আমরা কেউ তার মতো হতে পারি নাই।

আমি তার অক্ষম সন্তান- বাংলা মাসের হিসাব জানি না!

ঋতুচক্রে কীভাবে যে কোন মাস যায়, কখন কী ফসল ফলে

কিছুই জানি না। আমি ঘাস লতা-গুল্মহীন উদ্বাস্ত নাগরিক এক,

অথচ না নগরীও জানি কোনদিন দেবে না স্বীকৃতি!

শুনতে কি পাও

বন্ধ হয়েছে সব যোগাযোগ আমাদের

তবু ফুল ফোটা বন্ধ হয়নি, ফাল্গুনে সেই হুহু বেগে হাওয়া...

আমার আগুনে আমি যে পুড়েছি তুমি তা এখনো ভোলোনি!

সেই বন্ধন আজও দেখি তুমি খোলোনি।

দুঃস্বপ্নের মতো জেগে উঠি হঠাৎ মধ্যরাতে,

সেই সুখ আহা তীব্র শীতের মধ্যদুপুরে...

এখনো বুকের ভিতরে তৃষ্ণা জ্বালায় আগুন!

কেন তুমি খেলে গেলে এরকম নিষ্ঠুর প্রেম-প্রহসন-খেলা!

কাকে করি এই প্রশ্ন এখন?

তুমি তো এখন হারানো দিনের মনকাড়া গান

জীর্ণ রেকর্ড কত যে পুরনো! তবু কী সহজে বাজছো!

তুমি চেতনের অবচেতনের মধ্যবর্তী কাব্য;

ভাববো তোমার কথাই কেবল, আজীবন একা ভাববো।

শীতের শীর্ণ ধূসর পাতার নীরবে ঝরার কান্না

শুনতে কি পাও, শুনছো কি তুমি। শুনছো?

লোকগানের আসরে

খোল-করতাল বন্ধ করো, থামাও তোমার মুর্শিদী

আমার ক্ষেতের ধান লয়্যা যায় লাঠিয়াল ঐ

জোরদারে!

ঢাল-তলোয়ার কোথায় তোমার! বার করো ও বয়াতি!

আমরা ছজন ছয়খান আছে ধারালো ঈশ নাঙ্গলের,

খুন ঝরাইয়া দিমু আজকা পাকা ধানের আতাইলে!

থামাও সবে খোল করতাল! থামাও সুরের খুঞ্জুরা।

নাঙ্গল লও কান্ধে সবাই, হায়দরী হাঁক দেও মিয়া!

লিখে রাখো সেই স্বপ্ন

রাতের গভীরে টুপটাপ ঝরে মাঘের কুয়াশা গোপন দুঃখ,

শেষ বিকেলের গোধূলি-রঙিন পাতা ঝরে যায়, পাতা ঝরে যায়

এমন পোড়ানো শীতরাতে তুমি স্বপ্ন দেখেছ ফাগুন দিনের

রাশিরাশি ফুল ফুটেছে বাগানে

দখিনা বাতাসে হিজল ফুলেরা ঝরে!

স্বপ্ন দেখেছ ফসলে ভরেছে মাঠ। উচ্ছ্বাসে তুমি লাফিয়ে উঠেছ!

অথচ তীব্র শীতের কাঁপুনি, শূন্য হাঁড়িতে ভাত নেই এক মুঠো!

স্মৃতির গভীরে লিখে রাখো সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিন

আগুন ঝরানো ফাগুন আসবে থাকবে, তোমারও গোলাভরা ধান।