শেষ থেকে শুরু

ঝুমকি বসু

একতলা বাড়িটির বাইরের দেওয়ালে শেষ কবে রঙ করা হয়েছে তা বলা যায় না, চুন-সুরকি খসে পড়া বাড়িটির জীর্ণ দশা ঠিক এই বাড়িতে বসবাসরত ষাট পেরোনো দম্পতির মতো। বাড়ির সামনে দাবার কোর্টের মতো চার কোনা উঠোন। এক পাশে বেড়াহীন রান্নাঘর, মাটির চুলার পাশে কাঠের পিঁড়ির ওপর বসে মাজেদা বেগম অপলক তাকিয়ে আছেন উঠানের এক পাশে প্রসূতি আতা গাছের দিকে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডব থেকে কোনো রকম প্রাণে বেঁচে গিয়েছে গাছটি। মূল অর্ধেক মাটিতে লেগে আছে। বাকি অর্ধেক মাটির বাইরে। তবু প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে আতা গাছটি এবং বছর বছর নতুন নতুন সন্তান জন্ম দিচ্ছে। ঝড়ের পরে জাফর হোসেন গাছটা কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাঁচবে না এটা। অযথা রেখে লাভ নেই। কিন্তু মাজেদার বড্ড মায়া হলো। বিয়ের পর থেকেই গাছটা দেখে এসেছেন তিনি, বললেন থাকুক না যতদিন বাঁচে। গাছে এই বছর ফল ধরেছে প্রচুর, আতাগুলো পাকতেও শুরু করেছে। ডালে বসে একটা শালিক পাকা ফলে অনবরত ঠোকর দিচ্ছে। উড়ে উড়ে এই ডাল থেকে ওই ডালে গিয়ে বসছে এবং নতুন নতুন ফল ঠুকরে ভেতরের কিছুটা অংশ খেয়ে নিচ্ছে। বোঁটা আলগা হয়ে যাওয়া দুই-একটা আতা পাখির ঠোকর লেগে টুপ করে মাটিতে ঝরে পড়ছে। অন্য সময় হলে মাজেদা ঢিল ছুড়ে পাখি তাড়াতেন। কিন্তু এখন পাখিটাকে দেখেও তার দাওয়া থেকে উঠতে মন চাচ্ছে না। তাড়িয়ে লাভ তো নেই। এই গাছ এখন কাগজে-কলমে অন্যের, এখন শুধু হস্তান্তরের অপেক্ষা।

আগামীকাল ঈদ। কিন্তু এবারের ঈদে ‘মাজেদা মঞ্জিল’ কেমন যেন মলিন, আড়ম্বরহীন। প্রতি বছর বিশ রোজা পার হলেই বাড়ির মালকীন মাজেদা বেগম ঈদের তোড়জোড় শুরু করে দেন। ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনি ঢাকা থেকে ঈদ পালন করতে গ্রামে আসে, তাদের যতœআত্তির কোনো ত্রুটি রাখেন না তিনি। কিন্তু এবার মাজেদা বেগমের মন ভালো নেই। তাই ঈদের খুশি ছুঁয়ে যায়নি মাজেদা মঞ্জিলের কোনায় কোনায়।

জাফর হোসেনের সঙ্গে মাজেদার সংসারের বয়স সাতচল্লিশ বছর তিন মাস ছয় দিন। বিয়ের পর থেকেই জাফর হোসেনের এক স্বভাব আস্তে আস্তে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে- ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে স্ত্রীর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প তার করতেই হবে। সারাদিন যত ধকল থাকুক না কেন মনের কথা সব উগরে ফেলে এই এক ঘণ্টাতেই যেন গোটা জীবনের অক্সিজেন পেয়ে যান তিনি।

এবারের ঈদেও ছেলেমেয়েরা সবাই এসেছে, নাতি-নাতনির কলরবে মুখর হয়ে আছে ঘর। রাতে ঘুমাতে এসে গলার ভেতর মাছের কাঁটা আটকানোর মতো অনুভূতিতে কথা আটকে আসে মাজেদার।

-তুমি এট্টু বেশিই ভাবতিছ রনির মা।

জাফর হোসেনের এই কথায় গলার মধ্যে আটকে থাকা কষ্টের পিন্ডটা পেটের ভেতর ঢুকে পড়ে, আঁচলের খোটে চোখ মুছে কথা বলতে শুরু করেন মাজেদা।

-রনির আব্বা, আবারো কচ্চি আপ্নে এট্টা মস্ত ভুল কইরে ফেলাইলেন।

-বয়েস এহন আমার পয়ষট্টির গরে পইড়ে গেইছে, এহন ছুয়াল-মাইয়ে ঢাহা গেলি আমার যদি কিচু অয়, তুমি এল্লা এই বাড়ি থাকতি পাইরবে রনির মা?

-কিন্তুক সমস্ত সম্পত্তি এই ভাবি বেচি দিয়া আপ্নের উচিত অলো না।

-তুমি বারবার এই কতা কচ্চ। আমি মরলিও তো এইগুলান পোলা মাইয়ারাই পাতো। এহন দিয়ে দিতি তো সমস্যা দেখতিছি না। তুমার হক যা পাবা তাও আমি ঢাহা যাইয়ে তুমার নামে ব্যাঙ্কে রাহি দিবানে। আমি মরলি রনি-বনি এই গিরামে থাকতি আইসবেনানে। ছুয়াল শহরে ফিলাট কিনিছে। এহন আমাগো বয়েস হইয়ে গেইছে, এট্টু ছুয়াল-মাইয়ে, নাতি-নাত্নি নিইয়ে আরাম-আল্লাদ কইরবো। রনি চাতিছে আমরা তাগো ফিলাটে থাহি। আমরা দুইজনি ছুয়ালির বাসায় ঠ্যাংয়ের উপরি ঠ্যাং তুইলে গপসপ কইরবো।

-ক্যান্ন জানি আমার ভিতরডা পতম থেহেই সায় দিতিছে না।

-নিজির পেটেরতে যাগো জন্ম দেছো, তাগো বিশ্বাস করতি পারতিছ না মাজেদা।

-বিশ্বাস না করার কতা তো কইনি।

-তালি আর ভাবতি অবে না, আরামে গুমাও। বিয়ান হলি ঈদ। ঈদের পরের দিন সাহাব আলীর কাছে সব কিচু বুঝাইয়ে দিইয়ে চইলে যাতি অবে। ম্যালা ঝামেলা রইছে, কত কিছু গুছাতি অবে। সাহাবের কাছি টাহা পয়সা আর কিছু তো পাবনানে, তয় ওর সব অরে বুঝায়া দিতি পারলি আমার শান্তি অবেনে। এহন গুমাও দিহি। চুলি বিলি কাইটে দেবো?

মাজেদার উত্তরের অপেক্ষা করেন না জাফর হোসেন, হাতের পাঁচটি আঙুল খেলা করতে থাকে মাজেদার সাদা চুলের অলিগলি। বিয়ের পর থেকেই মাজেদার চুলে এভাবে বিলি করে দেন জাফর হোসেন। প্রতিদিনের মতো জাফর হোসেনের বুকের ভেতর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন মাজেদা বেগম। রাতের নিস্তব্ধতায় মাজেদার নিশ^াসের ওঠাপড়া টের পেতে পেতে ঘুমিয়ে যান জাফর হোসেন।

সিলভারের হাঁড়ি-পাতিলে হাতা খুন্তির ঠোকাঠুকির শব্দে মাজেদা মঞ্জিলের শেষ ঈদের উৎসব শুরু হয়। জাফর হোসেন ছেলে রনি, জামাই সাদিক এবং নাতি সিয়ামকে নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে ফেরেন। ছেলের বউ আফসানা এবং মেয়ে বনিকে নিয়ে রান্নাঘরে পোলাও-কোর্মা রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করেন মাজেদা। প্রতিবেশী সাহাব আলী সদর দরজায় এসে হাঁকডাক শুরু করেন।

-মাজেদা ভাবি, সিমাই নিইয়ে আসেন তাত্তারি।

-আরে, সাহাব ভাই আইছো, মাজেদা দেহে যাও কিডা আইছে, সিমাই নিইয়ে আইসে পড়ো।

জাফর হোসেনের গলা পেয়ে মাজেদা মেলামাইনের বাটিতে সেমাই নিয়ে বারান্দায় আসেন। মাজেদাকে দেখে আবার গলা ছাড়েন সাহাব আলী।

-ভাবি, ভাই কচ্চিল আপ্নে নাহি সারা রাইত কান্দেন। শোনেন ভাবি, আপ্নে মনে কইরবেন এই বাড়ি আপ্নের বাই কিনিছে, আপ্নের যহন ইচ্চা চইলে আইসবেন, যদ্দিন মন চায় আইসে থাইকবেন। আমি বুজি ভাবি সবই মায়া, এদ্দিনের সংসার।

মাজেদা ঘোমটার আড়ালে চোখের পানি লুকান। নাক টানতে টানতে ভেতরের ঘরে চলে যান।

ঈদের দিনের সূর্য আস্তে আস্তে অস্ত যেতে থাকে। রাত নামে মাজেদা মঞ্জিলে। থেমে যায় সব কোলাহল। সকাল হলেই রনির মাইক্রোবাসে উঠে পড়বে মাজেদার সংসার, ইতি ঘটবে সাতচল্লিশ বছরের এই সাংসারিক দিনযাপনের। সারা দিনের ধকলে ক্লান্ত মাজেদা ঘরে ঢুকে লাগেজগুলো শেষবার চেক করে নেয়, বাকি থাকা টুকটাক জিনিস ঢুকাতে থাকে।

-মাজেদা, বিয়ানবেলা উঠতি অবে, আর রাইত জাইগো না।

-বুঝতিছি, আমারে ছাড়া ঘুমাতি পারতিছেন না, তাই না?

-বুঝতিই তো পারো, সাতচল্লিশ বছরির অব্যেস, আইসে পড়ো, তোমার সাতি শুইয়ে শুইয়ে কতা না কলি আমার ঘুম আসতি চায় না।

মাজেদা কথা বাড়ান না। লাগেজের চেইন টেনে বন্ধ করেন। প্রতিদিনের মতো স্বামীর বুকের কাছে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। অপেক্ষা করেন নতুন ভোরের, যে অনিশ্চিত ভোর তাদের নিয়ে এক অজানা গন্তব্যে ছুটে চলার অপেক্ষায় রয়েছে।

অতঃপর ভোরের আলো জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে জাফর-মাজেদার ঘরে। বাড়ির লালঝুটি মোরগটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ডেকে ডেকে আজ আর তাদের ঘুম ভাঙায় না। বাড়ির মালিকেরাই থাকবে না যখন, মোরগ রেখে আরও বড় করে কোনো লাভ নেই। তাই গতকাল সেই মোরগের মাংস ছিল সবার খাবারের তালিকায়। জাফর হোসেনের নোকিয়া বাটন ফোনের এলার্মে ঘুম ভাঙে দুজনের। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নানা কাজে। কিছুক্ষণ পরেই চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে হবে এই বাড়িঘর।

সকাল দশটা বাজতেই ড্রাইভার আনিস গাড়ি নিয়ে রেডি হয়। রনি বাবা-মাকে তাড়া দিতে থাকে। বাড়ির অন্য সদস্যরা নিজেদের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। মালপত্র সব গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ঘর থেকে বের হলেন জাফর হোসেন। টলটল চোখে পেছন পেছন গাড়ির কাছে আসতে গিয়ে আতা গাছটার কাছে এসে থেমে যান মাজেদা। সবাইকে অবাক করে গাছটা ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। হয়তো গাছের কাছ থেকে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার, ভেঙে না পড়ার মন্ত্র শিখে নেন তিনি। ছেলে রনি এসে মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসায়। সাতচল্লিশ বছর পেছনে ফেলে গাড়ি চলতে শুরু করে নিজ গন্তব্যে।

গাড়িতে তেমন কোনো কথা বলেন না মাজেদা বেগম। পাশে বসে তার হাত শক্ত করে ধরে আছেন জাফর হোসেন। পেছনের সিটে নাতি-নাতনি গানের লড়াই খেলায় ব্যস্ত। আফসানা এবং বনি টিভির কোন সিরিয়ালে কি ঘটেছে, কোন পার্লারে ফেসিয়ালের খরচ কত, ইলেকট্রিক ওভেনে চিকেন গ্রিল কীভাবে করে এসব আলাপে মেতে ওঠে। ছেলে রনি জামাই সাদিকের সঙ্গে রাজনীতি-অর্থিনীতির আলাপে জড়ায়। বাজারে কোন জিনিসের দাম কমেছে অথবা বেড়েছে, পদ্মা সেতুর টোল কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, মেট্রো রেলের টিকিটের ভাড়াসহ বিভিন্ন আলাপ চলে তাদের। ভিটেমাটি বিক্রি করে চলে আসার আবেগ কারো মধ্যেই ছিটে ফোঁটা কাজ করছে না। শুধু গাড়ির দুটো মানুষের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো খেলা করে চলেছে পুরোনো সময়।

জাফর-মাজেদার ছেলে রনি নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। কিছুদিন আগে ধানমন্ডি লেকের পাশে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে। স্ত্রী আফসানা ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। বলা চলে, সময় কাটাতেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে সে। একমাত্র সন্তান সিয়াম ক্লাস নাইনে পড়ছে। ছেলের বিত্ত-বৈভবের তুলনায় জামাই-মেয়ে একটু পিছিয়েই আছে। মেয়ে বনি থাকে যাত্রাবাড়ি, একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করছে সে। জামাই সাদিক আছে এনজিওতে। মাঝে মাঝেই ঢাকার বাইরে ট্যুর থাকে তার। একমাত্র সন্তান লিসা ক্লাস ফাইভে পড়ছে। বাসায় কাজের সহকারী রোকেয়ার তত্ত্বাবধানে থাকে সে।

পদ্মা সেতু হওয়ায় বাগেরহাট থেকে ঢাকা আসতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। গাড়ি এসে থামে যাত্রাবাড়ি, বনির পরিবারকে এখানে নামিয়ে গাড়ি যাবে ধানমন্ডি।

-আম্মা, তুমিও নামো।

রনির কথায় নিজের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ টের পান মাজেদা।

-ক্যান্ন, তোর আম্মারে নামতি কচ্চিস ক্যান্ন? তুই না কইছিস তোর বাসায় আমাগো যাতি।

-আব্বা, তোমাকে নামতে বলছি না তো। তুমি আমার বাসাতেই যাচ্ছো, বনি বলছিল সাদিক আগামীকাল ট্যুরে যাবে। মেয়েটা একা থাকবে। আম্মা থাকলে ও খুশি হবে। এক মাস পরেই সাদিক ফিরলে আম্মা চলে আসবে। তাছাড়া মাঝে মাঝে তুমিও যেও ওর বাসায়। ড্রাইভার নিয়ে যাবে।

-সাদিক আগেও কত ট্যুর করিছে, কই তহন তো আমরা কেউ থাহিনি।

-আব্বা, শোনো তোমরা তখন ছিলে না তাই থাকোনি, এখন কাছে আসছো, তোমরা বাসায় থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।

বনির কথায় গলা ভারি হয়ে যায় জাফর হোসেনের।

-সাতচল্লিশ বছরির সংসারে আমরা কেউ কাউরে ছাড়া থাহিনি।

-নাতি-নাতনিদের মুখের দিকে তাকাও! ওরা তোমাদের চায়। সাদিক বছরে অন্তত পাঁচবার ট্যুরে যায়, আমি ওকে ছাড়া সব সময় থাকি। আর এই বয়সে তুমি এমন কথা বলছো আব্বা!

পেছনে বসে মুখ টিপে টিপে হাসছে আফসানা। এই বয়সে স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকতে পারবে না এমন অদ্ভুত কথা সে কোনোদিন শোনেনি।

চোখের পানি মুছে মাজেদা কথা বলে ওঠেন:

-আমাগো দুইজনির কাপড়চোপড় তো এক সাথিই আনিছি।

-তুমি লাগেজ খুলে আব্বার দুই-তিনটা কাপড় বের করে দাও, আমি পরশু ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেবো, বাকি ড্রেসগুলো তখন দিয়ে দিও।

ছেলের কথায় লাগেজ খোলা হয়। কয়েকটা কাপড় বের করে দিয়ে বনির বাসায় নেমে পড়েন মাজেদা।

এই প্রথম স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি তার। লোকটা তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। বিয়ের পর বাবার বাড়ি গিয়েও তার জন্য রাত কাটানো হয়নি মাজেদার, থাকার প্রয়োজন পড়লে জাফর হোসেন নিজেই সঙ্গে যেতেন। আর আজ সন্তানেরা আলাদা করে দিল তাদের। মাজেদার এসব ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন বনি এসে তার ফোনটা হাতে ধরিয়ে দেয়।

-আব্বার ফোন।

-তুমার সাতি কতা না বললি ঘুম ধরে না মাজেদা।

লিসার সামনে চোখের পানি লুকান মাজেদা। ওর সঙ্গে এক ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার। কিন্তু লিসা ব্যস্ত নিজের হোমওয়ার্ক, ভিডিও গেম, কার্টুন চ্যানেল নিয়ে, মাজেদা আসায় তার মনে আলাদা কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। পাশের ঘর থেকে মেয়ে-জামাইয়ের কথা কানে আসে

-আব্বার বুড়ো বয়সে ভীমরতি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পার হয়েছে তাও এত রাতে ফোন করে কথা বলতে হচ্ছে।

সকালেই সাদিক ট্যুরে চলে যায়। বনিও যায় অফিসে। ঈদের ছুটি শেষ হয়নি তাই লিসার স্কুল এখনো খোলেনি। তবে বাসায় সে তার নিজের জগতেই ব্যস্ত। এছাড়া কোচিং, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, আঁকা শেখা একটার পর একটা চলতে থাকে তার, বাসার বাইরেই সময় কাটে বেশি। কাজের মেয়ে রোকেয়া এসব ক্লাসে নিয়ে যায় লিসাকে। বাকিটা সময় রোকেয়া ঘরের কাজ অথবা অবসর পেলে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখায় ব্যস্ত থাকে। রাতে বনি ফিরেও মেয়ের হোমওয়ার্ক, বাসার এটা-সেটা কাজ, টিভি সিরিয়াল, মোবাইল ফোন নিয়ে পার করে দেয় সময়। মায়ের সঙ্গে গল্প করার ফুরসত মেলে না বনির।

মাজেদার সময় কাটে না, কথা বলার একটা লোক নেই, দম বন্ধ হয়ে আসে তার। এভাবেই পার হয়ে যায় একটার পর একটা দিন। রাতে বিছানায় ছটফট করেন মাজেদা, ঘুম আসে না তার।

বেশ রাতে ঘুমে টলতে টলতে মায়ের ঘরে ঢোকে বনি

-বয়স হয়ে আব্বার মাথাটা গেছে, এই রাতে কেউ ফোন করে! নাও, কথা বলো।

সারা দিনের ছটফটানি কমে মাজেদার, মেয়ের কথা গায়ে মাখেন না তিনি, ঘুমের ঘোরে আছে হয়তো। স্বামীর সঙ্গে আলাপ জমে তার। সারাদিনের মন খারাপ ঝেড়ে ফেলে মনের সব কথা গড়গড় বলতে থাকেন মাজেদা।

পাখির পালকের মতো পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে ধানমন্ডি লেকের পাশ ঘেঁষে থাকা দুই হাজার আটশ স্কয়ারফিটের চোখ ধাঁধানো ফ্লাটের সবুজ বারান্দায়। এক কাপ চা হাতে সাজানো-গোছানো ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন জাফর হোসেন। এত বড় বাসায় কেউ নেই কথা বলার, যার যার কাজে ব্যস্ত সবাই। জাফর হোসেন এই বাসায় আসায় কারো কাজের কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। বাসার প্রত্যেকেই ঘরে থাকার চেয়ে বাইরে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। অনেক রাত অব্দি জেগে থাকা এবং দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে ওঠা প্রত্যেকের অভ্যেস। রাত জাগাটা এই কদিনে খানিক রপ্ত করলেও দেরি করে ওঠা হয় না তার। ঘুম থেকে ওঠার পর বাসার বাঁধা কাজের মেয়েটি চা-নাস্তা ঘরে এনে দেয়। একা একাই খেয়ে নেন তিনি। তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে আলাদা ঘর। ছেলের সংসারে নিজেকে কেমন যেন অতিথির মতো লাগে তার। সময় কাটাতে ব্যালকনিতে বসে বসে মানুষ দেখছেন তিনি। কেউ জোরে জোরে কদম ফেলছে। কেউ-বা প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। দেখলেই বোঝা যায় হতভাগ্য মানুষগুলোর শরীরে বাসা বেঁধেছে উচ্চরক্তচাপ আর মধুমেয়। কিছু তরুণী অবশ্য শরীর লিকলিকে রাখার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেও ক্রমাগত ছুটে চলেছে। সন্ধ্যের এমন আবছা আলোয় আরো নজর কাড়ে কিছু কপোত-কপোতী। কলেজ পড়ুয়া কোনো সদ্য যুবতী প্রেমিকের স্পর্শসুখ পেতে এসে বসেছে আলো-আঁধারি ঘাসের বুকে। মোবাইল ফোনে বনির কল আসায় লেকের পাড় থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন জাফর হোসেন।

-আব্বা, তোমার মাথাটা একদম গেছে, বয়স হলে কেউ এমন করে জানতাম না।

-ক্যান্ন, কী করিছি?

-কাল এত রাতে যে তুমি আম্মাকে ফোন করেছো তাও মানা যায়। কিন্তু সারা রাত ফোনে কথা বলেছো।

-সারা রাইত না, দুই-তিন ঘণ্টা হতি পারে।

-আব্বা, আমার মেয়েটা তোমাদের এসব আলাপে পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি। রাতে আর আম্মাকে ফোন দিও না আব্বা।

-তালি কেমুন কইরে কতা কবো, তুই তো দিনির বেলা অফিসি থাহিস।

-রাতে কথা বলা লাগবে না। শুক্রবার কথা বলবে।

-আইচ্চা তাই কবো। তয় আইজ রাইতে এট্টু পাঁচডা মিনিটির জন্যি ফোনডা আম্মারে ধরতি দিস, আইজের পর আর রাইতের বেলা করবোনানে।

-ঠিক আছে।

মানুষ দেখতে আর ভালো লাগে না জাফর হোসেনের। ছেলেমেয়ে দুটোকে খুব অচেনা লাগে তার। বনির বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর, প্রায় রাতেই মেয়েটার পায়ে ব্যথা করতো। ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদতো মেয়ে। জাফর হোসেন এবং মাজেদা বেগম পালা করে গোটা রাত মেয়ের পা টিপে দিতেন, যাতে মেয়েটা একটু ঘুমাতে পারে। জ্বর হলে আব্বা ছাড়া কিছুই বুঝতো না এই মেয়ে। তিনি মেয়ের মাথায় পানি ঢালতেন, বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন, জ্বরের উত্তাপে অস্বস্তি লাগতো তার, তবু তিনি মেয়েকে বুক থেকে সরাতেন না। আর এখন মেয়েটা কীভাবে যেন কথা বলে! ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারেননি দাম্পত্য জীবন কেমন হয়- এ হয়তো তাদের দুজনের ব্যর্থতা।

মাজেদাকে ছাড়া জীবন চালাতে হবে, এ কথা কোনোদিন মনেও আসেনি জাফর হোসেনের। এই বয়সে এসে পাওয়া কষ্টগুলো নাড়াচাড়া করতে করতেই রাত বেড়ে চলে। বনির ফোনে ফোন করেন তিনি।

-আব্বা, পাঁচ মিনিট কিন্তু।

মাজেদার হাতে ফোন দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় বনি।

-মাজেদা, যা কবো শুদু হ অতবা না কবা। আমার সইঙ্গে পলায় যাবা?

-হ।

-তালি কাইলকে যহন বাসায় কেউ থাকপেনানে তহন গরেরতে বাইর হইয়ে আইসে পইড়বে যেহেনে সিদিন গাড়ির থেহে নাইমচিলে সেহেনে, মাইনে গলির মাতাডায়, দুকানের পাইশে আমি সহাল থেহে দাঁড়াইয়ে থাকপানে। যহনি সুযোগ পাবা বাইর হইয়ে পইড়বা।

-আইচ্চা।

রাতে ঘুম আসে না জাফর হোসেনের। সারাদিনের কোলাহলমুখর লেক এখন নিস্তব্ধতার অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছে, সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে ধেয়ে আসছে বেওয়ারিশ কুকুরের করুণ কান্না। জানালার পর্দা উঠিয়ে জাফর হোসেন কুকুরটাকে দেখতে চেষ্টা করেন, নেশার ঘোরে কেউ হয়তো কুকুরটার গায়ে কিছু ছুড়ে মেরেছে, মায়া হয় খুব। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল বের করে ঢকঢক করে গলায় ঢালেন তিনি, তবু তার ভেতরটা শীতল হয় না। যে সন্তানদের কাছে বুড়ো বয়সে আরাম-আয়েসে থাকতে চেয়েছিলেন; সেই সন্তানদের থেকে কখন পালাবেন, কখন মুক্তি মিলবে এই আশায় ঘড়ির কাটার সেকেন্ড-মিনিটের দিকে নজর রাখছেন তিনি।

সকালে নাস্তা করেই বের হয়ে যান জাফর হোসেন। তার ঘরে কেউ উঁকি দিয়েও দেখবে না তিনি বাসায় আছেন নাকি নেই। আজ আকাশটা খুব সুন্দর, আকাশে ধুপের ধোঁয়ার মতো ভেসে যাচ্ছে হালকা হালকা মেঘ। বনির বাসার গলির মুখের একটা দোকানের পাশে তিনি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তাকে দেখা না যায়। দোকানটি চালাচ্ছেন একজন বছর ত্রিশের মহিলা, কোলে তার দুধের সন্তান। খুব বিরক্ত করছে ছেলেটি, মা মাঝে মাঝেই হিসেবে ভুল করছেন তবু হাসিমুখে সামলে যাচ্ছেন সন্তানের আবদার। ঠিক এই জায়গাটায় দশ দিন আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল জাফর-মাজেদার গড়া একটি স্বপ্নের, আজ আবার সেই জায়গা থেকেই শুরু হচ্ছে তাদের একটি নতুন স্বপ্ন।

বনির অফিস নয়টায়, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে জাফর হোসেন আসার আগেই চলে গেছে সে। বাসায় শুধু কাজের মেয়ে রোকেয়া এবং মাজেদা। দোকানের মহিলাটির কাছে এই নিয়ে তিন কাপ চায়ের অর্ডার করেছেন তিনি। আসলে চায়ের তেষ্টা তার একবারের জন্যও পায়নি, এটা সময় কাটানোর একটা উছিলা মাত্র। তিন ঘণ্টা আটাশ মিনিট চুয়াল্লিশ সেকেন্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন জাফর হোসেন, ঘড়িতে সময় দেখেন তিনি। বনির বাসা থেকে বের হচ্ছে রোকেয়া, স্কুল থেকে লিসাকে আনতে যাচ্ছে বোধহয়। পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পর বাসা থেকে বের হলেন মাজেদা বেগম। এগিয়ে গিয়ে হাতের লাগেজটি তুলে নিলেন জাফর হোসেন।

মোবাইল ফোনের লাল বোতামে চাপ দিয়ে ফোনটি বন্ধ করে দেন জাফর হোসেন। দিনের বাকিটা সময় স্ত্রীকে নিয়ে এখানে-ওখানে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করেন, রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের টিকিট কাটেন। ওয়েটিং রুমে বসে থাকেন দুজনে, দশ দিনের জমে যাওয়া আলাপে সময় কেটে যেতে থাকে দ্রুত। তুর্ণা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে আসে, স্লিপিং বাথে উঠে পড়েন দম্পতি। গন্তব্য চট্টগ্রাম।

-আচ্চা, চট্টগিরামে যাতিছ কেন? বাগেরহাডে গেলিই ভালো অতো।

-বাগেরহাড গেলি সব্বাই রনি-বনিরে খারাপ কতো। বাপ-মায়েরে রাখতি পারেনি কইয়ে সমালুচনা কইরতো। আমরা তো ছুয়াল-মাইয়ের খারাপ চাতি পারি না।

-চট্টগিরামে যাইয়ে কিরাম কইরে থাকপানে? টাহা-পয়সা লাগবেনানে?

-টাহা-পয়সা সব জাগাতিই লাইগবে মাজেদা। তুমার জন্যি যে টাহা রাহিলাম তুমার হক হিসাবি, ওইডা ঢাহা আইসে তো আর ব্যাঙ্কি রাখতি পারিনি এহোনো। চট্টগিরামে তুমার নাইমে ওইডা ব্যাঙ্কি রাখপানে, ওইডা দিয়িই আমাগো চইলে যাবেনে। ছোড দেহে এট্টা বাসা ভাড়া নিবানে।

-অইহান থেইয়ে নাহি সমুদুরি যায়া যায় শুনিছি।

-হ, তুমারে কক্সবাজার নিয়ে যাবানে। চট্টগিরামেও পতেঙ্গা নামে নাহি এট্টা আচে। ছোয়াল-মাইয়া কইরে কইরে তো জীবনে কিচুই দেখতি পারিনি, ইবার সব ঘুরবানে। বুঝিছো, রনি-বনি তো আমাগো খুইজতি পারে, থানা-পুলিশও করতি পারে। পুলিশ যদি নিতি চায় অতবা ছুয়াল-মাইয়ে আমাগো নিতি চাইয়ে যত কতাই কোক, যতই কান্দুক মন কিন্তুক গলাবা না কইলাম। আবার নাও খুজতি পারে, তবু তুমারে কয়ে রাখতিছি।

-আমি তো বাগেরহাড থেহেই আসতি চাতিল্লাম না, আপনিই বুইঝলেন না।

-হ, ইবার কানলিও আর ফিরি আসপোনানে।

পঁয়ষট্টি বছরের বুকে জড়ায় ষাট বছরের যাপিত জীবন। অনেকগুলো নির্ঘুম রাতের পর শান্তির ঘুম নেমে আসে দুই জোড়া চোখে। নিজের শক্তি জানান দিয়ে ছুটে চলতে থাকে তুর্ণা এক্সপ্রেস।

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৫ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

শেষ থেকে শুরু

ঝুমকি বসু

image

একতলা বাড়িটির বাইরের দেওয়ালে শেষ কবে রঙ করা হয়েছে তা বলা যায় না, চুন-সুরকি খসে পড়া বাড়িটির জীর্ণ দশা ঠিক এই বাড়িতে বসবাসরত ষাট পেরোনো দম্পতির মতো। বাড়ির সামনে দাবার কোর্টের মতো চার কোনা উঠোন। এক পাশে বেড়াহীন রান্নাঘর, মাটির চুলার পাশে কাঠের পিঁড়ির ওপর বসে মাজেদা বেগম অপলক তাকিয়ে আছেন উঠানের এক পাশে প্রসূতি আতা গাছের দিকে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডব থেকে কোনো রকম প্রাণে বেঁচে গিয়েছে গাছটি। মূল অর্ধেক মাটিতে লেগে আছে। বাকি অর্ধেক মাটির বাইরে। তবু প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে আতা গাছটি এবং বছর বছর নতুন নতুন সন্তান জন্ম দিচ্ছে। ঝড়ের পরে জাফর হোসেন গাছটা কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাঁচবে না এটা। অযথা রেখে লাভ নেই। কিন্তু মাজেদার বড্ড মায়া হলো। বিয়ের পর থেকেই গাছটা দেখে এসেছেন তিনি, বললেন থাকুক না যতদিন বাঁচে। গাছে এই বছর ফল ধরেছে প্রচুর, আতাগুলো পাকতেও শুরু করেছে। ডালে বসে একটা শালিক পাকা ফলে অনবরত ঠোকর দিচ্ছে। উড়ে উড়ে এই ডাল থেকে ওই ডালে গিয়ে বসছে এবং নতুন নতুন ফল ঠুকরে ভেতরের কিছুটা অংশ খেয়ে নিচ্ছে। বোঁটা আলগা হয়ে যাওয়া দুই-একটা আতা পাখির ঠোকর লেগে টুপ করে মাটিতে ঝরে পড়ছে। অন্য সময় হলে মাজেদা ঢিল ছুড়ে পাখি তাড়াতেন। কিন্তু এখন পাখিটাকে দেখেও তার দাওয়া থেকে উঠতে মন চাচ্ছে না। তাড়িয়ে লাভ তো নেই। এই গাছ এখন কাগজে-কলমে অন্যের, এখন শুধু হস্তান্তরের অপেক্ষা।

আগামীকাল ঈদ। কিন্তু এবারের ঈদে ‘মাজেদা মঞ্জিল’ কেমন যেন মলিন, আড়ম্বরহীন। প্রতি বছর বিশ রোজা পার হলেই বাড়ির মালকীন মাজেদা বেগম ঈদের তোড়জোড় শুরু করে দেন। ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনি ঢাকা থেকে ঈদ পালন করতে গ্রামে আসে, তাদের যতœআত্তির কোনো ত্রুটি রাখেন না তিনি। কিন্তু এবার মাজেদা বেগমের মন ভালো নেই। তাই ঈদের খুশি ছুঁয়ে যায়নি মাজেদা মঞ্জিলের কোনায় কোনায়।

জাফর হোসেনের সঙ্গে মাজেদার সংসারের বয়স সাতচল্লিশ বছর তিন মাস ছয় দিন। বিয়ের পর থেকেই জাফর হোসেনের এক স্বভাব আস্তে আস্তে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে- ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে স্ত্রীর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প তার করতেই হবে। সারাদিন যত ধকল থাকুক না কেন মনের কথা সব উগরে ফেলে এই এক ঘণ্টাতেই যেন গোটা জীবনের অক্সিজেন পেয়ে যান তিনি।

এবারের ঈদেও ছেলেমেয়েরা সবাই এসেছে, নাতি-নাতনির কলরবে মুখর হয়ে আছে ঘর। রাতে ঘুমাতে এসে গলার ভেতর মাছের কাঁটা আটকানোর মতো অনুভূতিতে কথা আটকে আসে মাজেদার।

-তুমি এট্টু বেশিই ভাবতিছ রনির মা।

জাফর হোসেনের এই কথায় গলার মধ্যে আটকে থাকা কষ্টের পিন্ডটা পেটের ভেতর ঢুকে পড়ে, আঁচলের খোটে চোখ মুছে কথা বলতে শুরু করেন মাজেদা।

-রনির আব্বা, আবারো কচ্চি আপ্নে এট্টা মস্ত ভুল কইরে ফেলাইলেন।

-বয়েস এহন আমার পয়ষট্টির গরে পইড়ে গেইছে, এহন ছুয়াল-মাইয়ে ঢাহা গেলি আমার যদি কিচু অয়, তুমি এল্লা এই বাড়ি থাকতি পাইরবে রনির মা?

-কিন্তুক সমস্ত সম্পত্তি এই ভাবি বেচি দিয়া আপ্নের উচিত অলো না।

-তুমি বারবার এই কতা কচ্চ। আমি মরলিও তো এইগুলান পোলা মাইয়ারাই পাতো। এহন দিয়ে দিতি তো সমস্যা দেখতিছি না। তুমার হক যা পাবা তাও আমি ঢাহা যাইয়ে তুমার নামে ব্যাঙ্কে রাহি দিবানে। আমি মরলি রনি-বনি এই গিরামে থাকতি আইসবেনানে। ছুয়াল শহরে ফিলাট কিনিছে। এহন আমাগো বয়েস হইয়ে গেইছে, এট্টু ছুয়াল-মাইয়ে, নাতি-নাত্নি নিইয়ে আরাম-আল্লাদ কইরবো। রনি চাতিছে আমরা তাগো ফিলাটে থাহি। আমরা দুইজনি ছুয়ালির বাসায় ঠ্যাংয়ের উপরি ঠ্যাং তুইলে গপসপ কইরবো।

-ক্যান্ন জানি আমার ভিতরডা পতম থেহেই সায় দিতিছে না।

-নিজির পেটেরতে যাগো জন্ম দেছো, তাগো বিশ্বাস করতি পারতিছ না মাজেদা।

-বিশ্বাস না করার কতা তো কইনি।

-তালি আর ভাবতি অবে না, আরামে গুমাও। বিয়ান হলি ঈদ। ঈদের পরের দিন সাহাব আলীর কাছে সব কিচু বুঝাইয়ে দিইয়ে চইলে যাতি অবে। ম্যালা ঝামেলা রইছে, কত কিছু গুছাতি অবে। সাহাবের কাছি টাহা পয়সা আর কিছু তো পাবনানে, তয় ওর সব অরে বুঝায়া দিতি পারলি আমার শান্তি অবেনে। এহন গুমাও দিহি। চুলি বিলি কাইটে দেবো?

মাজেদার উত্তরের অপেক্ষা করেন না জাফর হোসেন, হাতের পাঁচটি আঙুল খেলা করতে থাকে মাজেদার সাদা চুলের অলিগলি। বিয়ের পর থেকেই মাজেদার চুলে এভাবে বিলি করে দেন জাফর হোসেন। প্রতিদিনের মতো জাফর হোসেনের বুকের ভেতর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন মাজেদা বেগম। রাতের নিস্তব্ধতায় মাজেদার নিশ^াসের ওঠাপড়া টের পেতে পেতে ঘুমিয়ে যান জাফর হোসেন।

সিলভারের হাঁড়ি-পাতিলে হাতা খুন্তির ঠোকাঠুকির শব্দে মাজেদা মঞ্জিলের শেষ ঈদের উৎসব শুরু হয়। জাফর হোসেন ছেলে রনি, জামাই সাদিক এবং নাতি সিয়ামকে নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে ফেরেন। ছেলের বউ আফসানা এবং মেয়ে বনিকে নিয়ে রান্নাঘরে পোলাও-কোর্মা রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করেন মাজেদা। প্রতিবেশী সাহাব আলী সদর দরজায় এসে হাঁকডাক শুরু করেন।

-মাজেদা ভাবি, সিমাই নিইয়ে আসেন তাত্তারি।

-আরে, সাহাব ভাই আইছো, মাজেদা দেহে যাও কিডা আইছে, সিমাই নিইয়ে আইসে পড়ো।

জাফর হোসেনের গলা পেয়ে মাজেদা মেলামাইনের বাটিতে সেমাই নিয়ে বারান্দায় আসেন। মাজেদাকে দেখে আবার গলা ছাড়েন সাহাব আলী।

-ভাবি, ভাই কচ্চিল আপ্নে নাহি সারা রাইত কান্দেন। শোনেন ভাবি, আপ্নে মনে কইরবেন এই বাড়ি আপ্নের বাই কিনিছে, আপ্নের যহন ইচ্চা চইলে আইসবেন, যদ্দিন মন চায় আইসে থাইকবেন। আমি বুজি ভাবি সবই মায়া, এদ্দিনের সংসার।

মাজেদা ঘোমটার আড়ালে চোখের পানি লুকান। নাক টানতে টানতে ভেতরের ঘরে চলে যান।

ঈদের দিনের সূর্য আস্তে আস্তে অস্ত যেতে থাকে। রাত নামে মাজেদা মঞ্জিলে। থেমে যায় সব কোলাহল। সকাল হলেই রনির মাইক্রোবাসে উঠে পড়বে মাজেদার সংসার, ইতি ঘটবে সাতচল্লিশ বছরের এই সাংসারিক দিনযাপনের। সারা দিনের ধকলে ক্লান্ত মাজেদা ঘরে ঢুকে লাগেজগুলো শেষবার চেক করে নেয়, বাকি থাকা টুকটাক জিনিস ঢুকাতে থাকে।

-মাজেদা, বিয়ানবেলা উঠতি অবে, আর রাইত জাইগো না।

-বুঝতিছি, আমারে ছাড়া ঘুমাতি পারতিছেন না, তাই না?

-বুঝতিই তো পারো, সাতচল্লিশ বছরির অব্যেস, আইসে পড়ো, তোমার সাতি শুইয়ে শুইয়ে কতা না কলি আমার ঘুম আসতি চায় না।

মাজেদা কথা বাড়ান না। লাগেজের চেইন টেনে বন্ধ করেন। প্রতিদিনের মতো স্বামীর বুকের কাছে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। অপেক্ষা করেন নতুন ভোরের, যে অনিশ্চিত ভোর তাদের নিয়ে এক অজানা গন্তব্যে ছুটে চলার অপেক্ষায় রয়েছে।

অতঃপর ভোরের আলো জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে জাফর-মাজেদার ঘরে। বাড়ির লালঝুটি মোরগটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ডেকে ডেকে আজ আর তাদের ঘুম ভাঙায় না। বাড়ির মালিকেরাই থাকবে না যখন, মোরগ রেখে আরও বড় করে কোনো লাভ নেই। তাই গতকাল সেই মোরগের মাংস ছিল সবার খাবারের তালিকায়। জাফর হোসেনের নোকিয়া বাটন ফোনের এলার্মে ঘুম ভাঙে দুজনের। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নানা কাজে। কিছুক্ষণ পরেই চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে হবে এই বাড়িঘর।

সকাল দশটা বাজতেই ড্রাইভার আনিস গাড়ি নিয়ে রেডি হয়। রনি বাবা-মাকে তাড়া দিতে থাকে। বাড়ির অন্য সদস্যরা নিজেদের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। মালপত্র সব গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ঘর থেকে বের হলেন জাফর হোসেন। টলটল চোখে পেছন পেছন গাড়ির কাছে আসতে গিয়ে আতা গাছটার কাছে এসে থেমে যান মাজেদা। সবাইকে অবাক করে গাছটা ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। হয়তো গাছের কাছ থেকে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার, ভেঙে না পড়ার মন্ত্র শিখে নেন তিনি। ছেলে রনি এসে মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসায়। সাতচল্লিশ বছর পেছনে ফেলে গাড়ি চলতে শুরু করে নিজ গন্তব্যে।

গাড়িতে তেমন কোনো কথা বলেন না মাজেদা বেগম। পাশে বসে তার হাত শক্ত করে ধরে আছেন জাফর হোসেন। পেছনের সিটে নাতি-নাতনি গানের লড়াই খেলায় ব্যস্ত। আফসানা এবং বনি টিভির কোন সিরিয়ালে কি ঘটেছে, কোন পার্লারে ফেসিয়ালের খরচ কত, ইলেকট্রিক ওভেনে চিকেন গ্রিল কীভাবে করে এসব আলাপে মেতে ওঠে। ছেলে রনি জামাই সাদিকের সঙ্গে রাজনীতি-অর্থিনীতির আলাপে জড়ায়। বাজারে কোন জিনিসের দাম কমেছে অথবা বেড়েছে, পদ্মা সেতুর টোল কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, মেট্রো রেলের টিকিটের ভাড়াসহ বিভিন্ন আলাপ চলে তাদের। ভিটেমাটি বিক্রি করে চলে আসার আবেগ কারো মধ্যেই ছিটে ফোঁটা কাজ করছে না। শুধু গাড়ির দুটো মানুষের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো খেলা করে চলেছে পুরোনো সময়।

জাফর-মাজেদার ছেলে রনি নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। কিছুদিন আগে ধানমন্ডি লেকের পাশে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে। স্ত্রী আফসানা ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। বলা চলে, সময় কাটাতেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে সে। একমাত্র সন্তান সিয়াম ক্লাস নাইনে পড়ছে। ছেলের বিত্ত-বৈভবের তুলনায় জামাই-মেয়ে একটু পিছিয়েই আছে। মেয়ে বনি থাকে যাত্রাবাড়ি, একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করছে সে। জামাই সাদিক আছে এনজিওতে। মাঝে মাঝেই ঢাকার বাইরে ট্যুর থাকে তার। একমাত্র সন্তান লিসা ক্লাস ফাইভে পড়ছে। বাসায় কাজের সহকারী রোকেয়ার তত্ত্বাবধানে থাকে সে।

পদ্মা সেতু হওয়ায় বাগেরহাট থেকে ঢাকা আসতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। গাড়ি এসে থামে যাত্রাবাড়ি, বনির পরিবারকে এখানে নামিয়ে গাড়ি যাবে ধানমন্ডি।

-আম্মা, তুমিও নামো।

রনির কথায় নিজের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ টের পান মাজেদা।

-ক্যান্ন, তোর আম্মারে নামতি কচ্চিস ক্যান্ন? তুই না কইছিস তোর বাসায় আমাগো যাতি।

-আব্বা, তোমাকে নামতে বলছি না তো। তুমি আমার বাসাতেই যাচ্ছো, বনি বলছিল সাদিক আগামীকাল ট্যুরে যাবে। মেয়েটা একা থাকবে। আম্মা থাকলে ও খুশি হবে। এক মাস পরেই সাদিক ফিরলে আম্মা চলে আসবে। তাছাড়া মাঝে মাঝে তুমিও যেও ওর বাসায়। ড্রাইভার নিয়ে যাবে।

-সাদিক আগেও কত ট্যুর করিছে, কই তহন তো আমরা কেউ থাহিনি।

-আব্বা, শোনো তোমরা তখন ছিলে না তাই থাকোনি, এখন কাছে আসছো, তোমরা বাসায় থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।

বনির কথায় গলা ভারি হয়ে যায় জাফর হোসেনের।

-সাতচল্লিশ বছরির সংসারে আমরা কেউ কাউরে ছাড়া থাহিনি।

-নাতি-নাতনিদের মুখের দিকে তাকাও! ওরা তোমাদের চায়। সাদিক বছরে অন্তত পাঁচবার ট্যুরে যায়, আমি ওকে ছাড়া সব সময় থাকি। আর এই বয়সে তুমি এমন কথা বলছো আব্বা!

পেছনে বসে মুখ টিপে টিপে হাসছে আফসানা। এই বয়সে স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকতে পারবে না এমন অদ্ভুত কথা সে কোনোদিন শোনেনি।

চোখের পানি মুছে মাজেদা কথা বলে ওঠেন:

-আমাগো দুইজনির কাপড়চোপড় তো এক সাথিই আনিছি।

-তুমি লাগেজ খুলে আব্বার দুই-তিনটা কাপড় বের করে দাও, আমি পরশু ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেবো, বাকি ড্রেসগুলো তখন দিয়ে দিও।

ছেলের কথায় লাগেজ খোলা হয়। কয়েকটা কাপড় বের করে দিয়ে বনির বাসায় নেমে পড়েন মাজেদা।

এই প্রথম স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি তার। লোকটা তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। বিয়ের পর বাবার বাড়ি গিয়েও তার জন্য রাত কাটানো হয়নি মাজেদার, থাকার প্রয়োজন পড়লে জাফর হোসেন নিজেই সঙ্গে যেতেন। আর আজ সন্তানেরা আলাদা করে দিল তাদের। মাজেদার এসব ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন বনি এসে তার ফোনটা হাতে ধরিয়ে দেয়।

-আব্বার ফোন।

-তুমার সাতি কতা না বললি ঘুম ধরে না মাজেদা।

লিসার সামনে চোখের পানি লুকান মাজেদা। ওর সঙ্গে এক ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার। কিন্তু লিসা ব্যস্ত নিজের হোমওয়ার্ক, ভিডিও গেম, কার্টুন চ্যানেল নিয়ে, মাজেদা আসায় তার মনে আলাদা কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। পাশের ঘর থেকে মেয়ে-জামাইয়ের কথা কানে আসে

-আব্বার বুড়ো বয়সে ভীমরতি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পার হয়েছে তাও এত রাতে ফোন করে কথা বলতে হচ্ছে।

সকালেই সাদিক ট্যুরে চলে যায়। বনিও যায় অফিসে। ঈদের ছুটি শেষ হয়নি তাই লিসার স্কুল এখনো খোলেনি। তবে বাসায় সে তার নিজের জগতেই ব্যস্ত। এছাড়া কোচিং, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, আঁকা শেখা একটার পর একটা চলতে থাকে তার, বাসার বাইরেই সময় কাটে বেশি। কাজের মেয়ে রোকেয়া এসব ক্লাসে নিয়ে যায় লিসাকে। বাকিটা সময় রোকেয়া ঘরের কাজ অথবা অবসর পেলে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখায় ব্যস্ত থাকে। রাতে বনি ফিরেও মেয়ের হোমওয়ার্ক, বাসার এটা-সেটা কাজ, টিভি সিরিয়াল, মোবাইল ফোন নিয়ে পার করে দেয় সময়। মায়ের সঙ্গে গল্প করার ফুরসত মেলে না বনির।

মাজেদার সময় কাটে না, কথা বলার একটা লোক নেই, দম বন্ধ হয়ে আসে তার। এভাবেই পার হয়ে যায় একটার পর একটা দিন। রাতে বিছানায় ছটফট করেন মাজেদা, ঘুম আসে না তার।

বেশ রাতে ঘুমে টলতে টলতে মায়ের ঘরে ঢোকে বনি

-বয়স হয়ে আব্বার মাথাটা গেছে, এই রাতে কেউ ফোন করে! নাও, কথা বলো।

সারা দিনের ছটফটানি কমে মাজেদার, মেয়ের কথা গায়ে মাখেন না তিনি, ঘুমের ঘোরে আছে হয়তো। স্বামীর সঙ্গে আলাপ জমে তার। সারাদিনের মন খারাপ ঝেড়ে ফেলে মনের সব কথা গড়গড় বলতে থাকেন মাজেদা।

পাখির পালকের মতো পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে ধানমন্ডি লেকের পাশ ঘেঁষে থাকা দুই হাজার আটশ স্কয়ারফিটের চোখ ধাঁধানো ফ্লাটের সবুজ বারান্দায়। এক কাপ চা হাতে সাজানো-গোছানো ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন জাফর হোসেন। এত বড় বাসায় কেউ নেই কথা বলার, যার যার কাজে ব্যস্ত সবাই। জাফর হোসেন এই বাসায় আসায় কারো কাজের কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। বাসার প্রত্যেকেই ঘরে থাকার চেয়ে বাইরে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। অনেক রাত অব্দি জেগে থাকা এবং দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে ওঠা প্রত্যেকের অভ্যেস। রাত জাগাটা এই কদিনে খানিক রপ্ত করলেও দেরি করে ওঠা হয় না তার। ঘুম থেকে ওঠার পর বাসার বাঁধা কাজের মেয়েটি চা-নাস্তা ঘরে এনে দেয়। একা একাই খেয়ে নেন তিনি। তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে আলাদা ঘর। ছেলের সংসারে নিজেকে কেমন যেন অতিথির মতো লাগে তার। সময় কাটাতে ব্যালকনিতে বসে বসে মানুষ দেখছেন তিনি। কেউ জোরে জোরে কদম ফেলছে। কেউ-বা প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। দেখলেই বোঝা যায় হতভাগ্য মানুষগুলোর শরীরে বাসা বেঁধেছে উচ্চরক্তচাপ আর মধুমেয়। কিছু তরুণী অবশ্য শরীর লিকলিকে রাখার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেও ক্রমাগত ছুটে চলেছে। সন্ধ্যের এমন আবছা আলোয় আরো নজর কাড়ে কিছু কপোত-কপোতী। কলেজ পড়ুয়া কোনো সদ্য যুবতী প্রেমিকের স্পর্শসুখ পেতে এসে বসেছে আলো-আঁধারি ঘাসের বুকে। মোবাইল ফোনে বনির কল আসায় লেকের পাড় থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন জাফর হোসেন।

-আব্বা, তোমার মাথাটা একদম গেছে, বয়স হলে কেউ এমন করে জানতাম না।

-ক্যান্ন, কী করিছি?

-কাল এত রাতে যে তুমি আম্মাকে ফোন করেছো তাও মানা যায়। কিন্তু সারা রাত ফোনে কথা বলেছো।

-সারা রাইত না, দুই-তিন ঘণ্টা হতি পারে।

-আব্বা, আমার মেয়েটা তোমাদের এসব আলাপে পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি। রাতে আর আম্মাকে ফোন দিও না আব্বা।

-তালি কেমুন কইরে কতা কবো, তুই তো দিনির বেলা অফিসি থাহিস।

-রাতে কথা বলা লাগবে না। শুক্রবার কথা বলবে।

-আইচ্চা তাই কবো। তয় আইজ রাইতে এট্টু পাঁচডা মিনিটির জন্যি ফোনডা আম্মারে ধরতি দিস, আইজের পর আর রাইতের বেলা করবোনানে।

-ঠিক আছে।

মানুষ দেখতে আর ভালো লাগে না জাফর হোসেনের। ছেলেমেয়ে দুটোকে খুব অচেনা লাগে তার। বনির বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর, প্রায় রাতেই মেয়েটার পায়ে ব্যথা করতো। ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদতো মেয়ে। জাফর হোসেন এবং মাজেদা বেগম পালা করে গোটা রাত মেয়ের পা টিপে দিতেন, যাতে মেয়েটা একটু ঘুমাতে পারে। জ্বর হলে আব্বা ছাড়া কিছুই বুঝতো না এই মেয়ে। তিনি মেয়ের মাথায় পানি ঢালতেন, বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন, জ্বরের উত্তাপে অস্বস্তি লাগতো তার, তবু তিনি মেয়েকে বুক থেকে সরাতেন না। আর এখন মেয়েটা কীভাবে যেন কথা বলে! ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারেননি দাম্পত্য জীবন কেমন হয়- এ হয়তো তাদের দুজনের ব্যর্থতা।

মাজেদাকে ছাড়া জীবন চালাতে হবে, এ কথা কোনোদিন মনেও আসেনি জাফর হোসেনের। এই বয়সে এসে পাওয়া কষ্টগুলো নাড়াচাড়া করতে করতেই রাত বেড়ে চলে। বনির ফোনে ফোন করেন তিনি।

-আব্বা, পাঁচ মিনিট কিন্তু।

মাজেদার হাতে ফোন দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় বনি।

-মাজেদা, যা কবো শুদু হ অতবা না কবা। আমার সইঙ্গে পলায় যাবা?

-হ।

-তালি কাইলকে যহন বাসায় কেউ থাকপেনানে তহন গরেরতে বাইর হইয়ে আইসে পইড়বে যেহেনে সিদিন গাড়ির থেহে নাইমচিলে সেহেনে, মাইনে গলির মাতাডায়, দুকানের পাইশে আমি সহাল থেহে দাঁড়াইয়ে থাকপানে। যহনি সুযোগ পাবা বাইর হইয়ে পইড়বা।

-আইচ্চা।

রাতে ঘুম আসে না জাফর হোসেনের। সারাদিনের কোলাহলমুখর লেক এখন নিস্তব্ধতার অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছে, সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে ধেয়ে আসছে বেওয়ারিশ কুকুরের করুণ কান্না। জানালার পর্দা উঠিয়ে জাফর হোসেন কুকুরটাকে দেখতে চেষ্টা করেন, নেশার ঘোরে কেউ হয়তো কুকুরটার গায়ে কিছু ছুড়ে মেরেছে, মায়া হয় খুব। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল বের করে ঢকঢক করে গলায় ঢালেন তিনি, তবু তার ভেতরটা শীতল হয় না। যে সন্তানদের কাছে বুড়ো বয়সে আরাম-আয়েসে থাকতে চেয়েছিলেন; সেই সন্তানদের থেকে কখন পালাবেন, কখন মুক্তি মিলবে এই আশায় ঘড়ির কাটার সেকেন্ড-মিনিটের দিকে নজর রাখছেন তিনি।

সকালে নাস্তা করেই বের হয়ে যান জাফর হোসেন। তার ঘরে কেউ উঁকি দিয়েও দেখবে না তিনি বাসায় আছেন নাকি নেই। আজ আকাশটা খুব সুন্দর, আকাশে ধুপের ধোঁয়ার মতো ভেসে যাচ্ছে হালকা হালকা মেঘ। বনির বাসার গলির মুখের একটা দোকানের পাশে তিনি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তাকে দেখা না যায়। দোকানটি চালাচ্ছেন একজন বছর ত্রিশের মহিলা, কোলে তার দুধের সন্তান। খুব বিরক্ত করছে ছেলেটি, মা মাঝে মাঝেই হিসেবে ভুল করছেন তবু হাসিমুখে সামলে যাচ্ছেন সন্তানের আবদার। ঠিক এই জায়গাটায় দশ দিন আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল জাফর-মাজেদার গড়া একটি স্বপ্নের, আজ আবার সেই জায়গা থেকেই শুরু হচ্ছে তাদের একটি নতুন স্বপ্ন।

বনির অফিস নয়টায়, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে জাফর হোসেন আসার আগেই চলে গেছে সে। বাসায় শুধু কাজের মেয়ে রোকেয়া এবং মাজেদা। দোকানের মহিলাটির কাছে এই নিয়ে তিন কাপ চায়ের অর্ডার করেছেন তিনি। আসলে চায়ের তেষ্টা তার একবারের জন্যও পায়নি, এটা সময় কাটানোর একটা উছিলা মাত্র। তিন ঘণ্টা আটাশ মিনিট চুয়াল্লিশ সেকেন্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন জাফর হোসেন, ঘড়িতে সময় দেখেন তিনি। বনির বাসা থেকে বের হচ্ছে রোকেয়া, স্কুল থেকে লিসাকে আনতে যাচ্ছে বোধহয়। পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পর বাসা থেকে বের হলেন মাজেদা বেগম। এগিয়ে গিয়ে হাতের লাগেজটি তুলে নিলেন জাফর হোসেন।

মোবাইল ফোনের লাল বোতামে চাপ দিয়ে ফোনটি বন্ধ করে দেন জাফর হোসেন। দিনের বাকিটা সময় স্ত্রীকে নিয়ে এখানে-ওখানে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করেন, রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের টিকিট কাটেন। ওয়েটিং রুমে বসে থাকেন দুজনে, দশ দিনের জমে যাওয়া আলাপে সময় কেটে যেতে থাকে দ্রুত। তুর্ণা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে আসে, স্লিপিং বাথে উঠে পড়েন দম্পতি। গন্তব্য চট্টগ্রাম।

-আচ্চা, চট্টগিরামে যাতিছ কেন? বাগেরহাডে গেলিই ভালো অতো।

-বাগেরহাড গেলি সব্বাই রনি-বনিরে খারাপ কতো। বাপ-মায়েরে রাখতি পারেনি কইয়ে সমালুচনা কইরতো। আমরা তো ছুয়াল-মাইয়ের খারাপ চাতি পারি না।

-চট্টগিরামে যাইয়ে কিরাম কইরে থাকপানে? টাহা-পয়সা লাগবেনানে?

-টাহা-পয়সা সব জাগাতিই লাইগবে মাজেদা। তুমার জন্যি যে টাহা রাহিলাম তুমার হক হিসাবি, ওইডা ঢাহা আইসে তো আর ব্যাঙ্কি রাখতি পারিনি এহোনো। চট্টগিরামে তুমার নাইমে ওইডা ব্যাঙ্কি রাখপানে, ওইডা দিয়িই আমাগো চইলে যাবেনে। ছোড দেহে এট্টা বাসা ভাড়া নিবানে।

-অইহান থেইয়ে নাহি সমুদুরি যায়া যায় শুনিছি।

-হ, তুমারে কক্সবাজার নিয়ে যাবানে। চট্টগিরামেও পতেঙ্গা নামে নাহি এট্টা আচে। ছোয়াল-মাইয়া কইরে কইরে তো জীবনে কিচুই দেখতি পারিনি, ইবার সব ঘুরবানে। বুঝিছো, রনি-বনি তো আমাগো খুইজতি পারে, থানা-পুলিশও করতি পারে। পুলিশ যদি নিতি চায় অতবা ছুয়াল-মাইয়ে আমাগো নিতি চাইয়ে যত কতাই কোক, যতই কান্দুক মন কিন্তুক গলাবা না কইলাম। আবার নাও খুজতি পারে, তবু তুমারে কয়ে রাখতিছি।

-আমি তো বাগেরহাড থেহেই আসতি চাতিল্লাম না, আপনিই বুইঝলেন না।

-হ, ইবার কানলিও আর ফিরি আসপোনানে।

পঁয়ষট্টি বছরের বুকে জড়ায় ষাট বছরের যাপিত জীবন। অনেকগুলো নির্ঘুম রাতের পর শান্তির ঘুম নেমে আসে দুই জোড়া চোখে। নিজের শক্তি জানান দিয়ে ছুটে চলতে থাকে তুর্ণা এক্সপ্রেস।