শিল্প-বিদ্যুৎ-বাণিজ্যিক খাতে বাড়লো গ্যাসের দাম

আবাসিক, সিএনজি, সার কারখানা ও চা শিল্পে দাম বাড়েনি

নতুন বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ছয় দিনের মাথায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা এলো। দুটোই হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। এ দফায় শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ক্যাপটিভসহ) ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে আবাসিকে রান্নার গ্যাস, গাড়ি চালাতে ব্যবহৃত সিএনজির দাম, সার উৎপাদন ও চা শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। গতকাল এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের বিল পরিশোধের সময় (সাধারণত মার্চে) গ্রাহককে বাড়তি টাকা গুনতে হবে।

এবার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম গড়ে প্রতি ঘনমিটারে (ইউনিট) ১৬০ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।

সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রতি ইউনিটে ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ব্যবসায়ীদের ক্যাপটিভ পাওয়ারে বেড়েছে ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতে দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় জনজীবনে সরাসরি প্রভাব না পড়লেও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়বে।

বৃহৎ শিল্প খাতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্প খাতে ছিল ১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র, কুটির ও অন্যান্য শিল্প খাতে দাম ছিল ১০ টাকা ৭৮ পয়সা।

সব ধরনের শিল্পের গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট এবার ৩০ টাকা হয়েছে।

গত বছর জুনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে ৬ টাকা ২৬ পয়াসা কমিয়েছিল এ খাতের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতদিন গণশুনানি করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমিশনই নির্ধারণ করত।

ডিসেম্বরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা (গণশুনানি ছাড়াই) সরকার নিজের হাতে নেয়। এই ক্ষমতা বলে গত ১২ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির ছয় দিনের মাথায় গতকাল গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করল সরকার। তবে বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হলেও গ্যাসের বর্ধিত মূল্য দিতে হবে ফেব্রুয়ারি থেকে।

আগে সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৫ টাকা ২ পয়সা। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী দাম বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা। ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে।

হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগে ছিল ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা।

যেসব খাতে দাম বাড়েনি

আবাসিক খাতে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়েনি। এই খাতের পোস্টপেইড গ্রাহকদের আগের মতোই দ্বিমুখী চুলায় (ডাবল বার্নার) মাসিক ১০৮০ টাকা এবং একমুখী চুলায় (সিঙ্গেল বার্নার) মাসিক ৯৯০ টাকা বিল দিতে হবে। আবাসিকে রান্নায় প্রিপেইড গ্রাহকদের গ্যাসের দামও বাড়েনি। তাদেরও আগের মতো প্রতি ঘনমিটারে ১৮ টাকা বিল দিতে হবে।

সিএনজি স্টেশনেও গ্যাসের দাম আগের মতো প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা থাকছে। বিইআরসি গতবছর জুনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময়ও সিএনজির দাম বাড়ায়নি। এবার সরকারও যানবাহনে ব্যবহৃত এই জ্বালানির দাম অপরিবর্তিত রাখল।

সার কারখানায় ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগের মতোই ১৬ টাকা এবং চা শিল্পে (চা বাগান) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৩ পয়সা থাকছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে

বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে। এ বিষয়ে পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব বিদ্যুৎ উৎপাদনে পড়বে। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়বে

এবার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম গড়ে প্রতি ঘনমিটারে (ইউনিট) ১৬০ দশমিক ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। দেশে মুদ্রাস্ফীতির এই সময় বাজারে এসব পণ্যের বিক্রয় মূল্য বেড়ে গেলে অর্থনীতি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চান ব্যবসায়ীরা

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত সোমবার জাতীয় সংসদে জানান, দেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে তাতে আর প্রায় ১১ বছর চাহিদার জোগান দেয়া যাবে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের (আমদানিসহ) মধ্যে বিদ্যুতে ব্যবহৃত হয় ৪৫.৯ শতাংশ, সারে ৫.৫ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.২ শতাংশ, শিল্পে ১৫.৭ শতাংশ, বাণিজ্যিকে ০.৭ শতাংশ সিএনজিতে ৩.৬ শতাংশ. বাসাবাড়িতে ১৩.৩ শতাংশ এবং চা বাগানে ০.১ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখন দেশে প্রতিদিন গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। গড়ে সরবরাহ করা হয় ২৬৬ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ধুঁকছে শিল্পোৎপাদন।

গ্যাস-সংকট নিয়ে গত কয়েক মাস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, উৎপাদনের খরচ বাড়লেও শিল্প বাঁচাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হন ব্যবসায়ীরা।

তবে তারা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। তারা বলেন, দাম বাড়িয়ে গ্যাস না দিলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও সমন্বয় করতে হবে।

দাম বৃদ্ধির কারণ

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে চলমান গ্যাস-সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে গিয়ে পেট্রোবাংলা আর্থিক সংকটে রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।

ঋণ ছাড়ের আগে আইএমএফ বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছিল- বিভিন্ন মহল এমন কথা বললেও সরকার বলছে, তারা আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল (আইএমএফ) থেকে এমন কোন শর্তে ঋণ নিচ্ছে না। তবে নিজস্ব তাগিদে ভর্তুকির বোঝা কামিয়ে আনতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা স্বীকার করছে সরকার।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ব্যাখ্যা

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতের ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং আগামীতে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে গ্যাসের এই মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে আরও বল হয়, ‘বর্তমান বৈশ্বিক বিশেষ জ্বালানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সকল প্রকার জ্বালানির মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এছাড়া জ্বালানি সংশ্লিষ্ট বীমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্যও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে গেছে। এতে জ্বালানি খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি প্রদান করতে হচ্ছিল। সে কারণে জুলাই ২০২২ থেকে স্পট মার্কেট হতে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে।’

‘এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান উৎপাদন/সরবরাহ সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্পসহ সব খাতে গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে।’

‘চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রপ্তানিমুখী বিভিন্ন কল-কারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে করণীয় সম্পর্কে সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়। যেহেতু স্পট মার্কেট হতে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানিপূর্বক উক্ত বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে, সে কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’

সর্বশেষ গত বছরের ৫ জুন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছিল গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ১ জুলাই বেড়েছিল গ্যাসের দাম। বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে ১৭৪ শতাংশের বেশি। এ সময় পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা।

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৫ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

শিল্প-বিদ্যুৎ-বাণিজ্যিক খাতে বাড়লো গ্যাসের দাম

আবাসিক, সিএনজি, সার কারখানা ও চা শিল্পে দাম বাড়েনি

ফয়েজ আহমেদ তুষার

নতুন বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ছয় দিনের মাথায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা এলো। দুটোই হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। এ দফায় শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ক্যাপটিভসহ) ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে আবাসিকে রান্নার গ্যাস, গাড়ি চালাতে ব্যবহৃত সিএনজির দাম, সার উৎপাদন ও চা শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। গতকাল এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের বিল পরিশোধের সময় (সাধারণত মার্চে) গ্রাহককে বাড়তি টাকা গুনতে হবে।

এবার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম গড়ে প্রতি ঘনমিটারে (ইউনিট) ১৬০ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।

সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রতি ইউনিটে ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ব্যবসায়ীদের ক্যাপটিভ পাওয়ারে বেড়েছে ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতে দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় জনজীবনে সরাসরি প্রভাব না পড়লেও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়বে।

বৃহৎ শিল্প খাতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্প খাতে ছিল ১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র, কুটির ও অন্যান্য শিল্প খাতে দাম ছিল ১০ টাকা ৭৮ পয়সা।

সব ধরনের শিল্পের গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট এবার ৩০ টাকা হয়েছে।

গত বছর জুনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে ৬ টাকা ২৬ পয়াসা কমিয়েছিল এ খাতের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতদিন গণশুনানি করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমিশনই নির্ধারণ করত।

ডিসেম্বরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা (গণশুনানি ছাড়াই) সরকার নিজের হাতে নেয়। এই ক্ষমতা বলে গত ১২ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির ছয় দিনের মাথায় গতকাল গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করল সরকার। তবে বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হলেও গ্যাসের বর্ধিত মূল্য দিতে হবে ফেব্রুয়ারি থেকে।

আগে সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৫ টাকা ২ পয়সা। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী দাম বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা। ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে।

হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগে ছিল ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা।

যেসব খাতে দাম বাড়েনি

আবাসিক খাতে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়েনি। এই খাতের পোস্টপেইড গ্রাহকদের আগের মতোই দ্বিমুখী চুলায় (ডাবল বার্নার) মাসিক ১০৮০ টাকা এবং একমুখী চুলায় (সিঙ্গেল বার্নার) মাসিক ৯৯০ টাকা বিল দিতে হবে। আবাসিকে রান্নায় প্রিপেইড গ্রাহকদের গ্যাসের দামও বাড়েনি। তাদেরও আগের মতো প্রতি ঘনমিটারে ১৮ টাকা বিল দিতে হবে।

সিএনজি স্টেশনেও গ্যাসের দাম আগের মতো প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা থাকছে। বিইআরসি গতবছর জুনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময়ও সিএনজির দাম বাড়ায়নি। এবার সরকারও যানবাহনে ব্যবহৃত এই জ্বালানির দাম অপরিবর্তিত রাখল।

সার কারখানায় ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম আগের মতোই ১৬ টাকা এবং চা শিল্পে (চা বাগান) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৩ পয়সা থাকছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে

বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে। এ বিষয়ে পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব বিদ্যুৎ উৎপাদনে পড়বে। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়বে

এবার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম গড়ে প্রতি ঘনমিটারে (ইউনিট) ১৬০ দশমিক ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। দেশে মুদ্রাস্ফীতির এই সময় বাজারে এসব পণ্যের বিক্রয় মূল্য বেড়ে গেলে অর্থনীতি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চান ব্যবসায়ীরা

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত সোমবার জাতীয় সংসদে জানান, দেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে তাতে আর প্রায় ১১ বছর চাহিদার জোগান দেয়া যাবে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের (আমদানিসহ) মধ্যে বিদ্যুতে ব্যবহৃত হয় ৪৫.৯ শতাংশ, সারে ৫.৫ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.২ শতাংশ, শিল্পে ১৫.৭ শতাংশ, বাণিজ্যিকে ০.৭ শতাংশ সিএনজিতে ৩.৬ শতাংশ. বাসাবাড়িতে ১৩.৩ শতাংশ এবং চা বাগানে ০.১ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখন দেশে প্রতিদিন গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। গড়ে সরবরাহ করা হয় ২৬৬ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ধুঁকছে শিল্পোৎপাদন।

গ্যাস-সংকট নিয়ে গত কয়েক মাস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, উৎপাদনের খরচ বাড়লেও শিল্প বাঁচাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হন ব্যবসায়ীরা।

তবে তারা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। তারা বলেন, দাম বাড়িয়ে গ্যাস না দিলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও সমন্বয় করতে হবে।

দাম বৃদ্ধির কারণ

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে চলমান গ্যাস-সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে গিয়ে পেট্রোবাংলা আর্থিক সংকটে রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।

ঋণ ছাড়ের আগে আইএমএফ বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছিল- বিভিন্ন মহল এমন কথা বললেও সরকার বলছে, তারা আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল (আইএমএফ) থেকে এমন কোন শর্তে ঋণ নিচ্ছে না। তবে নিজস্ব তাগিদে ভর্তুকির বোঝা কামিয়ে আনতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা স্বীকার করছে সরকার।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ব্যাখ্যা

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতের ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং আগামীতে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে গ্যাসের এই মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে আরও বল হয়, ‘বর্তমান বৈশ্বিক বিশেষ জ্বালানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সকল প্রকার জ্বালানির মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এছাড়া জ্বালানি সংশ্লিষ্ট বীমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্যও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে গেছে। এতে জ্বালানি খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি প্রদান করতে হচ্ছিল। সে কারণে জুলাই ২০২২ থেকে স্পট মার্কেট হতে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে।’

‘এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান উৎপাদন/সরবরাহ সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্পসহ সব খাতে গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে।’

‘চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রপ্তানিমুখী বিভিন্ন কল-কারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে করণীয় সম্পর্কে সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়। যেহেতু স্পট মার্কেট হতে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানিপূর্বক উক্ত বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে, সে কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’

সর্বশেষ গত বছরের ৫ জুন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছিল গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ১ জুলাই বেড়েছিল গ্যাসের দাম। বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে ১৭৪ শতাংশের বেশি। এ সময় পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা।