জনগণের কল্যাণ কি নিশ্চিত হচ্ছে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বিকশিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই বাংলাদেশ এক ধরনের নামমাত্র গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসনামলে সীমিত আকারে গণতান্ত্রিক অধিকারবোধের জ্ঞান পরবর্তীতে জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছিল। এ গণতান্ত্রিক চেতনা ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। গণতন্ত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো সংজ্ঞাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের এ মাত্রাগুলো সব সময় গণতন্ত্র চর্চায় ফোকাস করে না। যদিও গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তথাপি গণতন্ত্রের মূল বিষয়টি হলো জনগণের দ্বারা শাসন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চা সমস্যার সম্মুখীন হয়। কেননা তৎকালীন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকদের ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ারই ফলাফল।

স্বাধীনতার পর থেকে মূলত তিনটি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করে আসছে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় প্রায় ২৩ বছর দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি বর্তমানেও ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি চার মেয়াদে ১৪ বছরের বেশি সময় দেশ শাসন করেছে। তবে জিয়াউর রহমান দলটি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক পোশাকে প্রায় দুবছর দেশ শাসন করেছেন। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করেছে পাঁচ বছর। তবে এইচএম এরশাদ দলটি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক পোশাকে চার বছর দেশ শাসন করেছেন। দেশ শাসনকারী এ তিনটি রাজনৈতিক দলের কোনটিই দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আন্তরিক হয়নি। একটানা দীর্ঘ ১৪ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন বলেন, ‘গণতন্ত্র একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া, এটি কোন ম্যাজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন নয় যে, রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে’, তখন জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিকÑ এ প্রক্রিয়া সম্পন্নে তথা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আর কত সময় প্রয়োজন? গত ১৪ বছরে ক্ষমতাসীন দলটির কার্যক্রম গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে কতটা সহায়ক ছিল?

নব্বই পরবর্তী সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল জনগণকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা। সেজন্য তাদের দলীয় নীতি ও কর্মসূচিতে উন্নয়নমুখী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির গণতন্ত্রায়ন, জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ফ্যাক্টর প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নির্ধারণের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হচ্ছে রাজনৈতিক দল। দলগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ক্ষমতাচর্চা, ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল থাকে। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে জনগণের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মুক্ত, ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের সংবিধানেও এর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা এর থেকে যোজন যোজন দূর। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য বর্তমানে গণতন্ত্রের ধারণাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা ক্ষমতা লাভ করা। গত কয়েক দশক ধরে জনগণের ভালোমন্দের বিষয়গুলো ও নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো আরো অনেক কাজ করে থাকে। যেমন, সংসদীয় সরকারকে সচল রাখা, সরকারতন্ত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করা, গণনীতি নির্ধারণ করা, জনমত প্রচার করা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নেতৃত্ব সংগ্রহে সহায়তা করা ইত্যাদি। এসব কাজ করার জন্য প্রথমে একটি শক্ত দুর্নীতিমুক্ত এবং অদম্য রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘসময় ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তি যাদের যথাযথ শিক্ষা রয়েছে ও কোন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ নেই, শুধুমাত্র সেই প্রার্থী হতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাংলাদেশের নাগরিকদের উন্নততর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে যে দায়িত্ব, সেটা অনুধাবন করা উচিত। আর এর জন্য প্রার্থীর পেশিশক্তি ও টাকাকে বিবেচনা না করে শুধুমাত্র যোগ্য নেতাদেরই সামনের কাতারে নিয়ে আসা আবশ্যক।

প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণ সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করে না। জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করে। তাই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন অত্যাবশ্যক। আর নির্বাচন বর্তমানকালের দলপ্রথার ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিক দলগুলো নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের অনুকূলে জনসমর্থন লাভের জন্য প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। যে দলের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন, সেই দলই সরকার গঠন করে। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে বর্তমানে দলগত শাসনকেই বোঝায়। সেজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য।

শুধুমাত্র জাতীয় রাজনীতিতেই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতন্ত্র থাকা প্রয়োজন। দলগুলোকে তাদের কর্মীদের চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে এমন সুযোগ তৈরি করতে হবে যেন মাঠপর্যায় থেকেও ভালো নেতা উপরে উঠে আসতে পারে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ দলই তাদের গঠনে একটি স্বৈরাচারী ধারা অনুসরণ করে। যার ফলে মাঠপর্যায় থেকে উপরে উঠে আসার সুযোগ খুব কম থাকে। কিন্তু এ দলগুলোর সংবিধান ও গঠনতন্ত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন দলের ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চা গড়ে উঠে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য এই দলগুলোর মুক্ত, ন্যায্য এবং গ্রহণযোগ্য কাউন্সিল নিয়মিত হওয়া আবশ্যক। সব রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ।

যদি তারা নির্বাচনে জনগণের সমর্থন চায়, তবে তাদের জনগণের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি তারা জনগণের স্বার্থরক্ষায় কাজ না করে তবে জনগণ তাদের শুধুমাত্র সরকারের ক্ষমতায় আনার জন্য ভোট দেবে না। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের গণতান্ত্রিক সমালোচনা করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। শুধুমাত্র যদি তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তাই আমরা জনগণ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন তাদের দায়িত্বগুলো অনুধাবন করে এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের কল্যাণে কাজ করে সেটাই আশা করি। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠবে এটাই আমাদের বিশ্বাস।

গণতন্ত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দলপ্রথার অস্তিত্ব ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় না। আর গণতান্ত্রিক শাসন বলতে বর্তমানে দলীয় শাসনকেই বোঝায়। গণতন্ত্রে দলব্যবস্থার অপরিহার্যতা দলব্যবস্থার গুণাবলির মধ্যেই নিহিত আছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দলপ্রথার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে এবং প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছে। বর্তমানে গণতন্ত্র ও দলপ্রথা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। দলপ্রথাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই প্রাণসঞ্চার করে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৫ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

জনগণের কল্যাণ কি নিশ্চিত হচ্ছে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বিকশিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই বাংলাদেশ এক ধরনের নামমাত্র গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসনামলে সীমিত আকারে গণতান্ত্রিক অধিকারবোধের জ্ঞান পরবর্তীতে জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছিল। এ গণতান্ত্রিক চেতনা ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। গণতন্ত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো সংজ্ঞাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের এ মাত্রাগুলো সব সময় গণতন্ত্র চর্চায় ফোকাস করে না। যদিও গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তথাপি গণতন্ত্রের মূল বিষয়টি হলো জনগণের দ্বারা শাসন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চা সমস্যার সম্মুখীন হয়। কেননা তৎকালীন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকদের ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ারই ফলাফল।

স্বাধীনতার পর থেকে মূলত তিনটি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করে আসছে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় প্রায় ২৩ বছর দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি বর্তমানেও ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি চার মেয়াদে ১৪ বছরের বেশি সময় দেশ শাসন করেছে। তবে জিয়াউর রহমান দলটি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক পোশাকে প্রায় দুবছর দেশ শাসন করেছেন। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করেছে পাঁচ বছর। তবে এইচএম এরশাদ দলটি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক পোশাকে চার বছর দেশ শাসন করেছেন। দেশ শাসনকারী এ তিনটি রাজনৈতিক দলের কোনটিই দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আন্তরিক হয়নি। একটানা দীর্ঘ ১৪ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন বলেন, ‘গণতন্ত্র একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া, এটি কোন ম্যাজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন নয় যে, রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে’, তখন জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিকÑ এ প্রক্রিয়া সম্পন্নে তথা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আর কত সময় প্রয়োজন? গত ১৪ বছরে ক্ষমতাসীন দলটির কার্যক্রম গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে কতটা সহায়ক ছিল?

নব্বই পরবর্তী সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল জনগণকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা। সেজন্য তাদের দলীয় নীতি ও কর্মসূচিতে উন্নয়নমুখী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির গণতন্ত্রায়ন, জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ফ্যাক্টর প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নির্ধারণের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হচ্ছে রাজনৈতিক দল। দলগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ক্ষমতাচর্চা, ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল থাকে। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে জনগণের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মুক্ত, ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের সংবিধানেও এর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা এর থেকে যোজন যোজন দূর। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য বর্তমানে গণতন্ত্রের ধারণাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা ক্ষমতা লাভ করা। গত কয়েক দশক ধরে জনগণের ভালোমন্দের বিষয়গুলো ও নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো আরো অনেক কাজ করে থাকে। যেমন, সংসদীয় সরকারকে সচল রাখা, সরকারতন্ত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করা, গণনীতি নির্ধারণ করা, জনমত প্রচার করা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নেতৃত্ব সংগ্রহে সহায়তা করা ইত্যাদি। এসব কাজ করার জন্য প্রথমে একটি শক্ত দুর্নীতিমুক্ত এবং অদম্য রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘসময় ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তি যাদের যথাযথ শিক্ষা রয়েছে ও কোন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ নেই, শুধুমাত্র সেই প্রার্থী হতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাংলাদেশের নাগরিকদের উন্নততর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে যে দায়িত্ব, সেটা অনুধাবন করা উচিত। আর এর জন্য প্রার্থীর পেশিশক্তি ও টাকাকে বিবেচনা না করে শুধুমাত্র যোগ্য নেতাদেরই সামনের কাতারে নিয়ে আসা আবশ্যক।

প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণ সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করে না। জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করে। তাই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন অত্যাবশ্যক। আর নির্বাচন বর্তমানকালের দলপ্রথার ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিক দলগুলো নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের অনুকূলে জনসমর্থন লাভের জন্য প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। যে দলের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন, সেই দলই সরকার গঠন করে। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে বর্তমানে দলগত শাসনকেই বোঝায়। সেজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য।

শুধুমাত্র জাতীয় রাজনীতিতেই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতন্ত্র থাকা প্রয়োজন। দলগুলোকে তাদের কর্মীদের চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে এমন সুযোগ তৈরি করতে হবে যেন মাঠপর্যায় থেকেও ভালো নেতা উপরে উঠে আসতে পারে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ দলই তাদের গঠনে একটি স্বৈরাচারী ধারা অনুসরণ করে। যার ফলে মাঠপর্যায় থেকে উপরে উঠে আসার সুযোগ খুব কম থাকে। কিন্তু এ দলগুলোর সংবিধান ও গঠনতন্ত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন দলের ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চা গড়ে উঠে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য এই দলগুলোর মুক্ত, ন্যায্য এবং গ্রহণযোগ্য কাউন্সিল নিয়মিত হওয়া আবশ্যক। সব রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ।

যদি তারা নির্বাচনে জনগণের সমর্থন চায়, তবে তাদের জনগণের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি তারা জনগণের স্বার্থরক্ষায় কাজ না করে তবে জনগণ তাদের শুধুমাত্র সরকারের ক্ষমতায় আনার জন্য ভোট দেবে না। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের গণতান্ত্রিক সমালোচনা করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। শুধুমাত্র যদি তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তাই আমরা জনগণ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন তাদের দায়িত্বগুলো অনুধাবন করে এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের কল্যাণে কাজ করে সেটাই আশা করি। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠবে এটাই আমাদের বিশ্বাস।

গণতন্ত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দলপ্রথার অস্তিত্ব ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় না। আর গণতান্ত্রিক শাসন বলতে বর্তমানে দলীয় শাসনকেই বোঝায়। গণতন্ত্রে দলব্যবস্থার অপরিহার্যতা দলব্যবস্থার গুণাবলির মধ্যেই নিহিত আছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দলপ্রথার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে এবং প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছে। বর্তমানে গণতন্ত্র ও দলপ্রথা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। দলপ্রথাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই প্রাণসঞ্চার করে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]