ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্য ও সুকুক

জিল্লুর রহমান

সুকুক বা ইসলামী বন্ড শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্যে ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আধুনিক ইসলামী বন্ড বা সুকুকের ব্যবহার সাম্প্রতিক কয়েক দশকে বেশ জনপ্রিয় হলেও এর ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো। সপ্তম শতাব্দীতে সিরিয়ার দামেস্ক নগরীতে সুকুকের প্রথম প্রচলন হয়। তবে এটি প্রচলিত সাধারণ বা ট্রেজারি বন্ড নয়। এটি এমন একটি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বন্ড যেটি বিশ্বব্যাপী চালু আছে এবং এ ধরনের বন্ড ‘সুকুক’ নামে সারাবিশ্বে পরিচিত।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ‘সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামক প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য সর্বপ্রথম সুকুক বন্ড (ইজারা সুকুক) ইস্যু করা হয়, যেখানে মূল উদ্যোক্তা হলো বাংলাদেশ সরকার এবং মধ্যস্থতাকারী হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সরকারের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং প্রথম দফায় আট হাজার কোটি টাকার এই ইসলামী বন্ড চালু করা হয়। এটাই সরকারের উদ্যোগে চালু হওয়া প্রথম ইসলামী বন্ড। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা করে দুই দফায় বিনিয়োগকারীদের কাছে সুকুকের সার্টিফিকেট ইস্যু করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের বাজারে সুকুক বন্ড একটি নতুন ধারণা হলেও এটিকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে সরকারি উদ্যোগে যথাযথ পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এগিয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সুকুক প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুদারাবা (মুনাফায় অংশীদারি) সুকুক, মুশারাকা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগি) সুকুক, মুরাবাহা (লাভে বিক্রি) সুকুক, ইস্তিÍসনা (পণ্য তৈরি) সুকুক, সালাম (অগ্রিম ক্রয়) সুকুক, ইজারা (ভাড়া) সুকুক, মুযারা’আ সুকুক, মুসাকাত সুকুক, প্রাইভেট সুকুক, মানবকল্যাণ সুকুক, করজ হাসানা (উত্তম ঋণ) সুকুক। আবার ইস্তিসনা, মুরাবাহা ও ইজারার সমন্বয়ে হাইব্রিড ধরনের কিছু সুকুকের ব্যবহারও বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। যেকোন প্রতিষ্ঠানের তারল্য বাড়ানো, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্প সম্প্রসারণ বা কোন বৃহৎ প্রকল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুশারাকা, মুদারাবা, ইস্তিসনা, সালাম ও ইজারা সুকুকের ব্যবহার বেশি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ইজারা সুকুকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে সুকুক চালুর কার্যক্রমে জোর পায় প্রায় এক যুগ আগে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে পুঁজিবাজারে সুকুক ব্যবহারে নীতিমালা তৈরি করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ২০১৯ সালের ২২ মে সরকার ওই নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করে। নীতিমালা জারির পরপরই ১০০ কোটি টাকার সুকুক ছাড়তে বিএসইসিতে আবেদন জানিয়েছিল শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল; কিন্তু সুকুকের নীতিবিরুদ্ধ উপাদান থাকায় সে আবেদন বিএসইসি অনুমোদন দেয়নি। তবে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সর্বপ্রথম বেক্সিমকো লিমিটেড গ্রিন সুকুক বন্ড ছেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহ করে। এই বন্ড থেকে সংগ্রহ করা অর্থ কোম্পানির সাব-সিডিয়ারি দুটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিস্তা সোলার লিমিটেড এবং করতোয়া সোলার লিমিটেড নির্মাণ কাজে ব্যয় করে। এছাড়া এ অর্থ বেক্সিমকোর বস্ত্র খাতের ব্যবসা সম্প্রসারণে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়।

সুকুক ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) সুকুক ছেড়েছে। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া সুকুক ব্যবহার করে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। দেশ দুটির বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখছে এ ইসলামিক বন্ড। তাছাড়া অন্তত এক ডজন মুসলিম প্রধান দেশের পুঁজিবাজারের পাশাপাশি মুদ্রাবাজারেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুকুক। মুসলিম বিশ্বের গ-ি পেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকার অমুসলিম দেশে সুকুক ছড়িয়ে পড়েছে। চালু হয়েছে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও। অন্যদিকে বাংলাদেশ এ বন্ডের ব্যবহারে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে সম্ভাবনাময় এ খাতটির ব্যবহার সম্প্রসারিত হচ্ছে না অথচ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক বৃহৎ অর্থনীতির দেশে সুকুক চালু হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসির মতো বহুজাতিক ব্যাংকও সুকুকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

এটা সত্য ইসলামী বন্ড সুকুক চালু হলে সরকারের অর্থ সংগ্রহের নতুন একটি উৎস তৈরি হবে। সাধারণত বাজেটের খরচ মেটাতে প্রতি বছর রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও ব্যাংক ঋণের ওপর ভরসা করে আসছিল। সাধারণত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংস্থানের উৎস হিসেবে সুকুক ইস্যু করা হয়। যেমন ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। প্রকল্প মালিক কিংবা কোন সংস্থা এ প্রকল্পে অর্থ সংস্থানের জন্য সমপরিমাণ অর্থের সুকুক ইস্যু করতে পারে। বিনিয়োগে আগ্রহী যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের সুকুক কিনে প্রকল্পের ঘোষিত অংশ বা অংশবিশেষের মালিক হতে পারে। প্রকল্পটির আয় থেকে সুকুক হোল্ডাররা তাদের মালিকানার আনুপাতিক হারে মুনাফা পাবে।

সুকুক চালুর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত বেশি, যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজ করতে যে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হয়, সরকার এখন পর্যন্ত তা করে আসছে প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা থেকে। এর ফলে ব্যক্তিগত খাতের বিনিয়োগ সংকুচিত হয় এবং অর্থনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত এর সমালোচনা করে থাকে অথচ এ প্রক্রিয়ায় ইসলামী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা সহজেই সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিতে পারে।

দেশে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারত্ব প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোন উপকরণ নেই। ফলে একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর নিরাপদ এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে, অন্যদিকে সরকার তার ঘাটতি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। একই সঙ্গে দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থ ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা ও পরিধি বাড়লেও এ খাতের সেবায় বৈচিত্র্যতা আসছে না। অনেক অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস মুদ্রাবাজারে সুকুকের কার্যক্রম শুরু হলে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এবং তাদের অতিরিক্ত তারল্যের সুষম বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। ইসলামী ব্যাংকগুলো এসএলআর সংরক্ষণের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকা অতিরিক্ত অর্থ থেকে ২ শতাংশের বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। আবার সরকারি বিল-বন্ডের সুদহার সুনির্দিষ্ট হওয়ায় এ খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই। ফলে অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মতে সুকুক পুঁজিবাজারের পাশাপাশি মুদ্রাবাজারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বহু আগে থেকেই সুকুক প্রবর্তনের দাবি জানানো হচ্ছে। এটি কার্যকর হলে ব্যাংক, গ্রাহক ও সরকার সবাই উপকৃত হবে। সুকুক প্রবর্তন হলে সরকার চাইলেই তারা মেগা প্রকল্পের জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ নিতে পারবে। তবে অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী শরিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে এমন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদি বাংলাদেশ সরকার ইসলামী বিনিয়োগ বন্ডের (ইসলামী বন্ড) ব্যবহার করে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি তারল্য সংকট ও ব্যবস্থাপনার জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা দরকার।

[লেখক : ব্যাংকার]

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৫ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্য ও সুকুক

জিল্লুর রহমান

সুকুক বা ইসলামী বন্ড শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্যে ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আধুনিক ইসলামী বন্ড বা সুকুকের ব্যবহার সাম্প্রতিক কয়েক দশকে বেশ জনপ্রিয় হলেও এর ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো। সপ্তম শতাব্দীতে সিরিয়ার দামেস্ক নগরীতে সুকুকের প্রথম প্রচলন হয়। তবে এটি প্রচলিত সাধারণ বা ট্রেজারি বন্ড নয়। এটি এমন একটি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বন্ড যেটি বিশ্বব্যাপী চালু আছে এবং এ ধরনের বন্ড ‘সুকুক’ নামে সারাবিশ্বে পরিচিত।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ‘সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামক প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য সর্বপ্রথম সুকুক বন্ড (ইজারা সুকুক) ইস্যু করা হয়, যেখানে মূল উদ্যোক্তা হলো বাংলাদেশ সরকার এবং মধ্যস্থতাকারী হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সরকারের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং প্রথম দফায় আট হাজার কোটি টাকার এই ইসলামী বন্ড চালু করা হয়। এটাই সরকারের উদ্যোগে চালু হওয়া প্রথম ইসলামী বন্ড। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা করে দুই দফায় বিনিয়োগকারীদের কাছে সুকুকের সার্টিফিকেট ইস্যু করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের বাজারে সুকুক বন্ড একটি নতুন ধারণা হলেও এটিকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে সরকারি উদ্যোগে যথাযথ পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এগিয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সুকুক প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুদারাবা (মুনাফায় অংশীদারি) সুকুক, মুশারাকা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগি) সুকুক, মুরাবাহা (লাভে বিক্রি) সুকুক, ইস্তিÍসনা (পণ্য তৈরি) সুকুক, সালাম (অগ্রিম ক্রয়) সুকুক, ইজারা (ভাড়া) সুকুক, মুযারা’আ সুকুক, মুসাকাত সুকুক, প্রাইভেট সুকুক, মানবকল্যাণ সুকুক, করজ হাসানা (উত্তম ঋণ) সুকুক। আবার ইস্তিসনা, মুরাবাহা ও ইজারার সমন্বয়ে হাইব্রিড ধরনের কিছু সুকুকের ব্যবহারও বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। যেকোন প্রতিষ্ঠানের তারল্য বাড়ানো, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্প সম্প্রসারণ বা কোন বৃহৎ প্রকল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুশারাকা, মুদারাবা, ইস্তিসনা, সালাম ও ইজারা সুকুকের ব্যবহার বেশি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ইজারা সুকুকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে সুকুক চালুর কার্যক্রমে জোর পায় প্রায় এক যুগ আগে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে পুঁজিবাজারে সুকুক ব্যবহারে নীতিমালা তৈরি করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ২০১৯ সালের ২২ মে সরকার ওই নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করে। নীতিমালা জারির পরপরই ১০০ কোটি টাকার সুকুক ছাড়তে বিএসইসিতে আবেদন জানিয়েছিল শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল; কিন্তু সুকুকের নীতিবিরুদ্ধ উপাদান থাকায় সে আবেদন বিএসইসি অনুমোদন দেয়নি। তবে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সর্বপ্রথম বেক্সিমকো লিমিটেড গ্রিন সুকুক বন্ড ছেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহ করে। এই বন্ড থেকে সংগ্রহ করা অর্থ কোম্পানির সাব-সিডিয়ারি দুটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিস্তা সোলার লিমিটেড এবং করতোয়া সোলার লিমিটেড নির্মাণ কাজে ব্যয় করে। এছাড়া এ অর্থ বেক্সিমকোর বস্ত্র খাতের ব্যবসা সম্প্রসারণে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়।

সুকুক ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) সুকুক ছেড়েছে। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া সুকুক ব্যবহার করে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। দেশ দুটির বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখছে এ ইসলামিক বন্ড। তাছাড়া অন্তত এক ডজন মুসলিম প্রধান দেশের পুঁজিবাজারের পাশাপাশি মুদ্রাবাজারেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুকুক। মুসলিম বিশ্বের গ-ি পেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকার অমুসলিম দেশে সুকুক ছড়িয়ে পড়েছে। চালু হয়েছে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও। অন্যদিকে বাংলাদেশ এ বন্ডের ব্যবহারে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে সম্ভাবনাময় এ খাতটির ব্যবহার সম্প্রসারিত হচ্ছে না অথচ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক বৃহৎ অর্থনীতির দেশে সুকুক চালু হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসির মতো বহুজাতিক ব্যাংকও সুকুকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

এটা সত্য ইসলামী বন্ড সুকুক চালু হলে সরকারের অর্থ সংগ্রহের নতুন একটি উৎস তৈরি হবে। সাধারণত বাজেটের খরচ মেটাতে প্রতি বছর রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও ব্যাংক ঋণের ওপর ভরসা করে আসছিল। সাধারণত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংস্থানের উৎস হিসেবে সুকুক ইস্যু করা হয়। যেমন ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। প্রকল্প মালিক কিংবা কোন সংস্থা এ প্রকল্পে অর্থ সংস্থানের জন্য সমপরিমাণ অর্থের সুকুক ইস্যু করতে পারে। বিনিয়োগে আগ্রহী যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের সুকুক কিনে প্রকল্পের ঘোষিত অংশ বা অংশবিশেষের মালিক হতে পারে। প্রকল্পটির আয় থেকে সুকুক হোল্ডাররা তাদের মালিকানার আনুপাতিক হারে মুনাফা পাবে।

সুকুক চালুর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত বেশি, যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজ করতে যে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হয়, সরকার এখন পর্যন্ত তা করে আসছে প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা থেকে। এর ফলে ব্যক্তিগত খাতের বিনিয়োগ সংকুচিত হয় এবং অর্থনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত এর সমালোচনা করে থাকে অথচ এ প্রক্রিয়ায় ইসলামী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা সহজেই সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিতে পারে।

দেশে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারত্ব প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোন উপকরণ নেই। ফলে একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর নিরাপদ এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে, অন্যদিকে সরকার তার ঘাটতি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। একই সঙ্গে দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থ ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা ও পরিধি বাড়লেও এ খাতের সেবায় বৈচিত্র্যতা আসছে না। অনেক অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস মুদ্রাবাজারে সুকুকের কার্যক্রম শুরু হলে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এবং তাদের অতিরিক্ত তারল্যের সুষম বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। ইসলামী ব্যাংকগুলো এসএলআর সংরক্ষণের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা থাকা অতিরিক্ত অর্থ থেকে ২ শতাংশের বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। আবার সরকারি বিল-বন্ডের সুদহার সুনির্দিষ্ট হওয়ায় এ খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই। ফলে অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মতে সুকুক পুঁজিবাজারের পাশাপাশি মুদ্রাবাজারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বহু আগে থেকেই সুকুক প্রবর্তনের দাবি জানানো হচ্ছে। এটি কার্যকর হলে ব্যাংক, গ্রাহক ও সরকার সবাই উপকৃত হবে। সুকুক প্রবর্তন হলে সরকার চাইলেই তারা মেগা প্রকল্পের জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ নিতে পারবে। তবে অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী শরিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে এমন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদি বাংলাদেশ সরকার ইসলামী বিনিয়োগ বন্ডের (ইসলামী বন্ড) ব্যবহার করে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি তারল্য সংকট ও ব্যবস্থাপনার জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা দরকার।

[লেখক : ব্যাংকার]