মতিঝিল গোল চত্বরের ঠিক পূর্ব দিকে ২০ বছর ধরে জুতা তৈরি এবং মেরামতের কাজ করেন জগদিস দাস। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করেন। এক্ষেত্রে তার ১০ থেকে ৫০ টাকার নোটই জমা হয় বেশি। সংসারের ব্যয় শেষে ঘরেই টাকা জমিয়ে রাখেন তিনি।
তবে জগদিসের নিত্যদিনের লেনদেনে এসেছে পরিববর্তন। এখন আর নগদ টাকার লেনদেন না করলেও চলে। কাজ করিয়ে বাংলা কিউআর কোডে যুক্ত হয়ে টাকা পরিশোধ করছেন ক্রেতারা। সেই টাকা সরাসরি জমা হচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। চাহিদামতো টাকা তুলে নিয়ে বাকিটা ব্যাংকেই জমা রাখা যাচ্ছে।
জগদিস বলেন, ‘মানুষ নগদ টাকা দেয়া কমিয়ে দিচ্ছে। মোবাইলেই টাকা দেয়। এইটাই সুবিধা। কারণ টাকা হাত দিয়ে ধরতে হয় না। ব্যাংকে টাকা থাকলে নিরাপদ।’
হ্যাঁ, পাল্টে গেছে লেনদেন ব্যবস্থা। ক্যাশলেস দুনিয়ায় প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। শুধু মুচিই নয়, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ লেনদেন করছে ক্যাশলেস মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সেবা দিচ্ছে মোবাইল ফাইন্যানসিয়াল কোম্পানি ও ব্যাংক। গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ ব্যাংক ও মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাতে এমন চিত্র দেখা যায়।
‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় শ্রমনির্ভর অতিক্ষুদ্র ভাসমান উদ্যোক্তা (চা বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা), বিভিন্ন প্রান্তিক পেশায় (মুচি, নাপিত, হকার) নিয়োজিত সেবা প্রদানকারীদের বিল গ্রহণ পদ্ধতিকে ডিজিটাল ও প্রাতিষ্ঠানিক করার উদ্দেশ্যে ব্যক্তির রিটেইল হিসাব খোলা হচ্ছে। এ হিসাবের মাধ্যমে যারা তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করবেন তারা মাইক্রো-মার্চেন্ট হিসেবে গণ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে গত বুধবার প্রায় ১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে মতিঝিলে এই ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা কিউআর-এ অংশগ্রহণকারী যেকোনো ব্যাংক ও এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী গ্রাহক যেকোন ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী মার্চেন্টকে পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। কিউআর কোড কেবলমাত্র একটি প্রিন্টেড ছবি হওয়ায় এই পরিশোধ ব্যবস্থায় মার্চেন্টের অংশগ্রহণের খরচ নাই, তাই এ পরিশোধ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাংলা কিউআর উদ্যোগে ১০টি ব্যাংক, ৩টি এমএফএস ও ৩টি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম অংশগ্রহণ করছে।
মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে জুতা বিক্রি করেন সবুজ মিয়া। ভ্যানের উপরে বিভিন্ন রকমের জুতার পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। জুতাগুলোর একপাশে বাক্সের ওপর রাখা মোবাইল ব্যাংকিং রকেটের কিউআর কোড। জুতা কিনে এই কিউআর কোডের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করছেন ভোক্তারা।
চা দোকানি বাবুল মিয়া। প্রায় ছয় মাস ধরে ডাচ-বাংলার রকেট অ্যাপসের মাধ্যমে কিউআর কোডে দোকানের বিল নেন তিনি। বলেন, ‘এতদিন শুধু রকেটের মাধ্যমে অনেকে চা-বিস্কুট খেয়ে টাকা পরিশোধ করত। জমা হয়ে যেত আমার ডাচ-বাংলার ব্যাংক হিসাবে। কিন্তু এখন অন্য সবাইও এ সুবিধা পাবেন।’
এটা ব্যবহারে কি উপকার হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারাদিনে কিছু কিছু জমা হয়। প্রতিদিন টাকা তোলার প্রয়োজন হয় না। ব্যাংকে টাকা জমতে থাকে। মাঝে মাঝে এক হাজার টাকার ওপরেও জমা হয়। এ টাকা জমা করার চেষ্টা করি। কখনো দরকার হলে তখন টাকা তুলি। মাসে একবারে ২০ হাজার টাকাও তুলেছি। সংসারে বিপদ, প্রয়োজনে এ টাকা খুব কাজে লাগে।’
সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে জুতা পালিস করেন বিজন সরকার। তিনি বলেন, ‘আগে রোদে কাজ করতাম। আজকে একটা বড় ছাতা দিয়ে গেছে। তার নিচে বসে কাজ করছি। ডাচ-বাংলা ব্যাংক হিসাব খুলে দিয়েছে। তিনজন জুতা ঠিক করে ৪০ টাকা করে ১২০ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। যা আয় করি জমাতে তো পারি না, এভাবে একটু একটু করে যা জমবে তাই লাভ।’
মতিঝিলে ফল কিনতে আসা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘ক্যাশলেস হলে খুব সুবিধা। নগদ টাকা বহন করা ঝুঁকি। অ্যাপের মাধ্যমেই করা যাচ্ছে লেনদেন। খুচরা টাকা নিয়েও কোন ঝামেলা নেই। বিল যেটা সেটাই পেমেন্ট হচ্ছে।’
শাপলার চত্বরের পাশেই জুতা পলিশের দোকান রয়েছে রাকেশের। তার দোকানেও এখন কিউআর কোডের মাধ্যমে মূল্য পরিশধের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। রাকেশ বলেন, ‘অনেক সময় জুতা কালি করার পরে ভাংতি নাই বলে টাকা পরে দেবো বলে কাস্টমার চলে যেত। এই টাকা আর কোনদিনই পাইতাম না। এখন মোবাইলে টাকা দেয়ার সিস্টেম হওয়াতে ভালো হইছে। আর ভাংতির ঝামেলা নাই।’
মতিঝিল এলাকার পেয়ারা বিক্রেতা মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য খুব ভালো হইছে। অনেক সময় দেখা যায় ক্রেতার সঙ্গে খুচরা ১-২ টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়। এখন এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় খুচরা টাকা নিয়ে আর ঝামেলা হবে না। তবে টাকা উঠানোর সময় ঝামালে না হলে আর সমস্যা নেই। এছাড়া মোবাইলে পেমেন্ট হলে ছেড়া টাকা নিয়ে আর কোন চিন্তা করতে হবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘এখন এক ব্যাংকের কিউআর কোড থাকলে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করা যাবে। এতদিন একটি ব্যাংকের কিউআর কোডে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারত।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ধরেন চা দোকানির ডাচ-বাংলা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। এখন আপনি চা, বিস্কুট খেয়ে বিল দেবেন। কিন্তু আপনার অ্যাকাউন্ট মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বা বিকাশে। এখন কীভাবে বিল দেবেন? এটার সমাধান দেবে সর্বজনীন বাংলা কিউআর কোড। এখান থেকে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করতে পারবেন। অর্থাৎ দোকানদারকে তার চায়ের বিল ডাচ-বাংলা কিউআর কোডে সরাসরি পরিশোধ করতে পারবেন।’
বাংলা কিউআর পরিশোধ ব্যবস্থায় ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য অর্জন এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্টসহ সব ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সাধারণ মানুষকে জানাতে পরবর্তীতে সারাদেশে এ উদ্যোগের প্রচারণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
১৯৯০ সালের পর বিশ্বে কিউআর কোডের প্রচলন শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বাংলা কিউআর স্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলা কিউআর কোড দিয়ে নির্দিষ্ট যেকোন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করা যাবে। ফলে ব্যাংকের গ্রাহকদের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের একাধিক কিউআর কোড ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ, জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা এমএফএসগুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে কার্ডে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা মার্চেন্টদের জন্য ব্যয়বহুল। ছোট মার্চেন্টের (যেমন : ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, মুচি ইত্যাদি) পক্ষে এ ব্যয় বহন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসারে পৃথিবীব্যাপী লো-কস্ট সলিউশন বা স্বল্প খরচে লেনদেন প্রচলনের তাগিদ রয়েছে। কুইক রেসপন্স (কিউআর) ডিজিটাল পেমেন্ট এমনি একটি লো-কস্ট সলিউশন। বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক ও এমএফএস-এর কিউআর কোড থাকলেও সর্বজনীন কিউআর ছিল না। ফলে শুধুমাত্র ওই ব্যাংক বা এমএফএস গ্রাহকরা পারস্পরিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কিউআর পেমেন্ট কী
কিউআর এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘কুইক রেসপন্স’। এটি একটি কন্টাক্টলেস পেমেন্ট পদ্ধতি, যেখানে কিউআর কোডটি মোবাইল অ্যাপে স্ক্যান করে দ্রুত, সহজ ও সুলভ লেনদেন করা যায়।
কীভাবে করবেন কিউআর পেমেন্ট
মোবাইলে আপনার ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপ ডাউনলোড করুন
ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপে পিন টাইপ করে লগইন করুন
দোকান বা মার্চেন্ট আউটলেট প্রদর্শিত কিউআর কোড স্ক্যান করুন
পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করার জন্য টাকার পরিমাণ লিখুন ৫. পিন/ওটিপি টাইপ করে লেনদেন সম্পন্ন করুন
লেনদেন সম্পন্ন হবে এবং পেমেন্টের কনফার্মেশন ও ডিজিটাল রিসিট পাবেন
কিউআর পেমেন্ট কেন করবেন
ক্রেতার সুবিধা
পেমেন্ট করতে নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় না।
ক্রেডিট/ডেবিট/প্রিপেইড কার্ড সঙ্গে না থাকলেও ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপের সঙ্গে আগে সংযুক্ত কার্ড ব্যবহার করে পেমেন্ট করা যায়।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা এমএফএস ওয়ালেটের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যায়।
বিক্রেতার সুবিধা
নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় না বিধায় ছেঁড়া-ফাটা বা জাল নোট গ্রহণের আশঙ্কা থাকে না
শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪
রমজান আলী
মতিঝিল গোল চত্বরের ঠিক পূর্ব দিকে ২০ বছর ধরে জুতা তৈরি এবং মেরামতের কাজ করেন জগদিস দাস। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করেন। এক্ষেত্রে তার ১০ থেকে ৫০ টাকার নোটই জমা হয় বেশি। সংসারের ব্যয় শেষে ঘরেই টাকা জমিয়ে রাখেন তিনি।
তবে জগদিসের নিত্যদিনের লেনদেনে এসেছে পরিববর্তন। এখন আর নগদ টাকার লেনদেন না করলেও চলে। কাজ করিয়ে বাংলা কিউআর কোডে যুক্ত হয়ে টাকা পরিশোধ করছেন ক্রেতারা। সেই টাকা সরাসরি জমা হচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। চাহিদামতো টাকা তুলে নিয়ে বাকিটা ব্যাংকেই জমা রাখা যাচ্ছে।
জগদিস বলেন, ‘মানুষ নগদ টাকা দেয়া কমিয়ে দিচ্ছে। মোবাইলেই টাকা দেয়। এইটাই সুবিধা। কারণ টাকা হাত দিয়ে ধরতে হয় না। ব্যাংকে টাকা থাকলে নিরাপদ।’
হ্যাঁ, পাল্টে গেছে লেনদেন ব্যবস্থা। ক্যাশলেস দুনিয়ায় প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। শুধু মুচিই নয়, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ লেনদেন করছে ক্যাশলেস মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সেবা দিচ্ছে মোবাইল ফাইন্যানসিয়াল কোম্পানি ও ব্যাংক। গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ ব্যাংক ও মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাতে এমন চিত্র দেখা যায়।
‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় শ্রমনির্ভর অতিক্ষুদ্র ভাসমান উদ্যোক্তা (চা বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা), বিভিন্ন প্রান্তিক পেশায় (মুচি, নাপিত, হকার) নিয়োজিত সেবা প্রদানকারীদের বিল গ্রহণ পদ্ধতিকে ডিজিটাল ও প্রাতিষ্ঠানিক করার উদ্দেশ্যে ব্যক্তির রিটেইল হিসাব খোলা হচ্ছে। এ হিসাবের মাধ্যমে যারা তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করবেন তারা মাইক্রো-মার্চেন্ট হিসেবে গণ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে গত বুধবার প্রায় ১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে মতিঝিলে এই ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা কিউআর-এ অংশগ্রহণকারী যেকোনো ব্যাংক ও এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী গ্রাহক যেকোন ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী মার্চেন্টকে পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। কিউআর কোড কেবলমাত্র একটি প্রিন্টেড ছবি হওয়ায় এই পরিশোধ ব্যবস্থায় মার্চেন্টের অংশগ্রহণের খরচ নাই, তাই এ পরিশোধ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাংলা কিউআর উদ্যোগে ১০টি ব্যাংক, ৩টি এমএফএস ও ৩টি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম অংশগ্রহণ করছে।
মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে জুতা বিক্রি করেন সবুজ মিয়া। ভ্যানের উপরে বিভিন্ন রকমের জুতার পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। জুতাগুলোর একপাশে বাক্সের ওপর রাখা মোবাইল ব্যাংকিং রকেটের কিউআর কোড। জুতা কিনে এই কিউআর কোডের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করছেন ভোক্তারা।
চা দোকানি বাবুল মিয়া। প্রায় ছয় মাস ধরে ডাচ-বাংলার রকেট অ্যাপসের মাধ্যমে কিউআর কোডে দোকানের বিল নেন তিনি। বলেন, ‘এতদিন শুধু রকেটের মাধ্যমে অনেকে চা-বিস্কুট খেয়ে টাকা পরিশোধ করত। জমা হয়ে যেত আমার ডাচ-বাংলার ব্যাংক হিসাবে। কিন্তু এখন অন্য সবাইও এ সুবিধা পাবেন।’
এটা ব্যবহারে কি উপকার হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারাদিনে কিছু কিছু জমা হয়। প্রতিদিন টাকা তোলার প্রয়োজন হয় না। ব্যাংকে টাকা জমতে থাকে। মাঝে মাঝে এক হাজার টাকার ওপরেও জমা হয়। এ টাকা জমা করার চেষ্টা করি। কখনো দরকার হলে তখন টাকা তুলি। মাসে একবারে ২০ হাজার টাকাও তুলেছি। সংসারে বিপদ, প্রয়োজনে এ টাকা খুব কাজে লাগে।’
সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে জুতা পালিস করেন বিজন সরকার। তিনি বলেন, ‘আগে রোদে কাজ করতাম। আজকে একটা বড় ছাতা দিয়ে গেছে। তার নিচে বসে কাজ করছি। ডাচ-বাংলা ব্যাংক হিসাব খুলে দিয়েছে। তিনজন জুতা ঠিক করে ৪০ টাকা করে ১২০ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। যা আয় করি জমাতে তো পারি না, এভাবে একটু একটু করে যা জমবে তাই লাভ।’
মতিঝিলে ফল কিনতে আসা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘ক্যাশলেস হলে খুব সুবিধা। নগদ টাকা বহন করা ঝুঁকি। অ্যাপের মাধ্যমেই করা যাচ্ছে লেনদেন। খুচরা টাকা নিয়েও কোন ঝামেলা নেই। বিল যেটা সেটাই পেমেন্ট হচ্ছে।’
শাপলার চত্বরের পাশেই জুতা পলিশের দোকান রয়েছে রাকেশের। তার দোকানেও এখন কিউআর কোডের মাধ্যমে মূল্য পরিশধের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। রাকেশ বলেন, ‘অনেক সময় জুতা কালি করার পরে ভাংতি নাই বলে টাকা পরে দেবো বলে কাস্টমার চলে যেত। এই টাকা আর কোনদিনই পাইতাম না। এখন মোবাইলে টাকা দেয়ার সিস্টেম হওয়াতে ভালো হইছে। আর ভাংতির ঝামেলা নাই।’
মতিঝিল এলাকার পেয়ারা বিক্রেতা মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য খুব ভালো হইছে। অনেক সময় দেখা যায় ক্রেতার সঙ্গে খুচরা ১-২ টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়। এখন এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় খুচরা টাকা নিয়ে আর ঝামেলা হবে না। তবে টাকা উঠানোর সময় ঝামালে না হলে আর সমস্যা নেই। এছাড়া মোবাইলে পেমেন্ট হলে ছেড়া টাকা নিয়ে আর কোন চিন্তা করতে হবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘এখন এক ব্যাংকের কিউআর কোড থাকলে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করা যাবে। এতদিন একটি ব্যাংকের কিউআর কোডে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারত।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ধরেন চা দোকানির ডাচ-বাংলা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। এখন আপনি চা, বিস্কুট খেয়ে বিল দেবেন। কিন্তু আপনার অ্যাকাউন্ট মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বা বিকাশে। এখন কীভাবে বিল দেবেন? এটার সমাধান দেবে সর্বজনীন বাংলা কিউআর কোড। এখান থেকে যেকোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করতে পারবেন। অর্থাৎ দোকানদারকে তার চায়ের বিল ডাচ-বাংলা কিউআর কোডে সরাসরি পরিশোধ করতে পারবেন।’
বাংলা কিউআর পরিশোধ ব্যবস্থায় ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য অর্জন এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্টসহ সব ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সাধারণ মানুষকে জানাতে পরবর্তীতে সারাদেশে এ উদ্যোগের প্রচারণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
১৯৯০ সালের পর বিশ্বে কিউআর কোডের প্রচলন শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বাংলা কিউআর স্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলা কিউআর কোড দিয়ে নির্দিষ্ট যেকোন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করা যাবে। ফলে ব্যাংকের গ্রাহকদের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের একাধিক কিউআর কোড ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ, জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা এমএফএসগুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে কার্ডে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা মার্চেন্টদের জন্য ব্যয়বহুল। ছোট মার্চেন্টের (যেমন : ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, মুচি ইত্যাদি) পক্ষে এ ব্যয় বহন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসারে পৃথিবীব্যাপী লো-কস্ট সলিউশন বা স্বল্প খরচে লেনদেন প্রচলনের তাগিদ রয়েছে। কুইক রেসপন্স (কিউআর) ডিজিটাল পেমেন্ট এমনি একটি লো-কস্ট সলিউশন। বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক ও এমএফএস-এর কিউআর কোড থাকলেও সর্বজনীন কিউআর ছিল না। ফলে শুধুমাত্র ওই ব্যাংক বা এমএফএস গ্রাহকরা পারস্পরিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউআর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কিউআর পেমেন্ট কী
কিউআর এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘কুইক রেসপন্স’। এটি একটি কন্টাক্টলেস পেমেন্ট পদ্ধতি, যেখানে কিউআর কোডটি মোবাইল অ্যাপে স্ক্যান করে দ্রুত, সহজ ও সুলভ লেনদেন করা যায়।
কীভাবে করবেন কিউআর পেমেন্ট
মোবাইলে আপনার ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপ ডাউনলোড করুন
ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপে পিন টাইপ করে লগইন করুন
দোকান বা মার্চেন্ট আউটলেট প্রদর্শিত কিউআর কোড স্ক্যান করুন
পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করার জন্য টাকার পরিমাণ লিখুন ৫. পিন/ওটিপি টাইপ করে লেনদেন সম্পন্ন করুন
লেনদেন সম্পন্ন হবে এবং পেমেন্টের কনফার্মেশন ও ডিজিটাল রিসিট পাবেন
কিউআর পেমেন্ট কেন করবেন
ক্রেতার সুবিধা
পেমেন্ট করতে নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় না।
ক্রেডিট/ডেবিট/প্রিপেইড কার্ড সঙ্গে না থাকলেও ব্যাংক/এমএফএস/পিএসপির অ্যাপের সঙ্গে আগে সংযুক্ত কার্ড ব্যবহার করে পেমেন্ট করা যায়।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা এমএফএস ওয়ালেটের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যায়।
বিক্রেতার সুবিধা
নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় না বিধায় ছেঁড়া-ফাটা বা জাল নোট গ্রহণের আশঙ্কা থাকে না