২০১৮ সালে রঙে সিসার ব্যবহারের সর্বোচ্চ ৯০ পিপিএম পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। কিন্তু এখনও দেশের বিভিন্ন রঙ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উচ্চ মাত্রায় সিসার ব্যবহার করছে। ডাব্লিওএইচও এর মতে, অতিরিক্ত মাত্রায় সিসার সংস্পর্শে আসলে কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। রক্তে সিসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ‘লেড ইন পেইন্টস : অ্যা সিগনিফিক্যান্ট পাথওয়ে অব লেড এক্সপোসার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়। গতকাল এই গবেষণার ফলাফল এসডো কার্যালয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে রঙে সিসার ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে এবং ডেকোরেটিভ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙে পূর্বের এবং বর্তমানের সিসার মাত্রার ফলাফল তুলনা করার জন্য এসডো এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। এজন্য লাল, হলুদ এবং সোনালী হলুদ রঙের ৩৯টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসহ মোট ৬৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকৃত নমুনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
পরীক্ষাকৃত নমুনাগুলোর মধ্যে ৩০ দশমিক ৮ ভাগ ডেকোরেটিভ পেইন্টে ৯০ থেকে ২৫০ পিপিএম পর্যন্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাকি ৬৯ দশমিক ২ ভাগ ডেকোরেটিভ পেইন্টে সিসার মাত্রা ছিল ৯০ পিপিএম-এর কম। তবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙে ভয়াবহ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। মোট নমুনার ৫০ ভাগে এই উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কমলা রঙে সর্বোচ্চ ৯৭ হাজার পিপিএম পর্যন্ত সিসার মাত্রা শনাক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, ডেকোরেটিভ রঙের জন্য বাংলাদেশে ন্যূনতম সিসার মাত্রা ৯০ পিপিএম পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রং কোম্পানিগুলোর বিএসটিআই থেকে সার্টিফিবকট মার্কস (সিএম) লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির জন্য রঙের পাত্রে অবশ্যই ‘লেড সেভ পেইন্ট’ লেভেল থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ৮৮টি দেশে গ্লোবাল হেলথ অবজারভেটরি অন লিগ্যালি বাইন্ডিং কন্ট্রোলস অন লেলড পেইন্ট অনুযায়ী সিসাযুক্ত রং নিষিদ্ধকরণের বিধি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ডেকোরেটিভন ও ইন্ড্রাট্রিয়াল উভয় রঙের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সিসার মাত্রা ৯০ পিপিএম পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এ সময় এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজার ও বিএসটিআইয়ের কেমিক্যাল বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল হাসেম বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে সিসাযুক্ত রঙের সংস্পর্শে আসার কারণে শিশুরা আজীবন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। রঙে সিসার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ৩৫.৫ মিলিয়ন শিশু সিসাদূষণের শিকার। রক্তে সিসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই। মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর সিসার ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর বিষক্রিয়া কমাতে আরও গুরুত্বসহকারে সিসার উৎস খুঁজে বের করতে হবে।’
এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহৃত সিসাযুক্ত রঙের বিষক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শিশুদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। শিশুদের স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশ প্রদান এবং নারীর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে রঙে সিসার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘একমাত্র’ দেশ হিসেবে রঙে সিসার নির্দিষ্ট মাত্রা নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করলেও গবেষণার যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা ‘অত্যন্ত’ উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে বিএসটিআই-এর পরিচালক (সিএম) মো. নূরুল আমিন সংবাদকে জানান, রিপোর্টটি না দেখে বলতে পারবো না। আপনি উপপরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
দেশে রঙের অর্ধেক বাজার দখন করা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রূপালী চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের সব রঙই লেড ফ্রি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি আমাদের রঙে কোন সিসা নেই।’
‘বহু বছর আগেই আমরা লেড থেকে বের হয়ে এসেছি’ বলেও জানান তিনি।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে লিড পয়জনিং : রিসার্চ এভিডেন্স ফর আর্জেন্ট অ্যাকশনবিষয়ক সাতটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৪ জেলায় ১৮ বছরের কম বয়সী সাড়ে তিন কোটি শিশুর রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৬৫ শতাংশের রক্তে সিসার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি।
সেখানে, সিসার বিষক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে অনেক বেশি। এর ক্ষতি অপরিবর্তনীয়। শৈশবে সিসা বিষাক্ততায় আক্রান্ত হওয়ায় শিশুর স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং পরবর্তী জীবনে হিংসাত্মক আচরণের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
২০১৮ সালে রঙে সিসার ব্যবহারের সর্বোচ্চ ৯০ পিপিএম পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। কিন্তু এখনও দেশের বিভিন্ন রঙ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উচ্চ মাত্রায় সিসার ব্যবহার করছে। ডাব্লিওএইচও এর মতে, অতিরিক্ত মাত্রায় সিসার সংস্পর্শে আসলে কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। রক্তে সিসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ‘লেড ইন পেইন্টস : অ্যা সিগনিফিক্যান্ট পাথওয়ে অব লেড এক্সপোসার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়। গতকাল এই গবেষণার ফলাফল এসডো কার্যালয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে রঙে সিসার ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে এবং ডেকোরেটিভ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙে পূর্বের এবং বর্তমানের সিসার মাত্রার ফলাফল তুলনা করার জন্য এসডো এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। এজন্য লাল, হলুদ এবং সোনালী হলুদ রঙের ৩৯টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসহ মোট ৬৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকৃত নমুনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
পরীক্ষাকৃত নমুনাগুলোর মধ্যে ৩০ দশমিক ৮ ভাগ ডেকোরেটিভ পেইন্টে ৯০ থেকে ২৫০ পিপিএম পর্যন্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাকি ৬৯ দশমিক ২ ভাগ ডেকোরেটিভ পেইন্টে সিসার মাত্রা ছিল ৯০ পিপিএম-এর কম। তবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙে ভয়াবহ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। মোট নমুনার ৫০ ভাগে এই উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কমলা রঙে সর্বোচ্চ ৯৭ হাজার পিপিএম পর্যন্ত সিসার মাত্রা শনাক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, ডেকোরেটিভ রঙের জন্য বাংলাদেশে ন্যূনতম সিসার মাত্রা ৯০ পিপিএম পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রং কোম্পানিগুলোর বিএসটিআই থেকে সার্টিফিবকট মার্কস (সিএম) লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির জন্য রঙের পাত্রে অবশ্যই ‘লেড সেভ পেইন্ট’ লেভেল থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ৮৮টি দেশে গ্লোবাল হেলথ অবজারভেটরি অন লিগ্যালি বাইন্ডিং কন্ট্রোলস অন লেলড পেইন্ট অনুযায়ী সিসাযুক্ত রং নিষিদ্ধকরণের বিধি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ডেকোরেটিভন ও ইন্ড্রাট্রিয়াল উভয় রঙের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সিসার মাত্রা ৯০ পিপিএম পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এ সময় এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজার ও বিএসটিআইয়ের কেমিক্যাল বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল হাসেম বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে সিসাযুক্ত রঙের সংস্পর্শে আসার কারণে শিশুরা আজীবন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। রঙে সিসার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ৩৫.৫ মিলিয়ন শিশু সিসাদূষণের শিকার। রক্তে সিসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই। মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর সিসার ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর বিষক্রিয়া কমাতে আরও গুরুত্বসহকারে সিসার উৎস খুঁজে বের করতে হবে।’
এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহৃত সিসাযুক্ত রঙের বিষক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শিশুদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। শিশুদের স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশ প্রদান এবং নারীর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে রঙে সিসার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘একমাত্র’ দেশ হিসেবে রঙে সিসার নির্দিষ্ট মাত্রা নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করলেও গবেষণার যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা ‘অত্যন্ত’ উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে বিএসটিআই-এর পরিচালক (সিএম) মো. নূরুল আমিন সংবাদকে জানান, রিপোর্টটি না দেখে বলতে পারবো না। আপনি উপপরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
দেশে রঙের অর্ধেক বাজার দখন করা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রূপালী চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের সব রঙই লেড ফ্রি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি আমাদের রঙে কোন সিসা নেই।’
‘বহু বছর আগেই আমরা লেড থেকে বের হয়ে এসেছি’ বলেও জানান তিনি।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে লিড পয়জনিং : রিসার্চ এভিডেন্স ফর আর্জেন্ট অ্যাকশনবিষয়ক সাতটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৪ জেলায় ১৮ বছরের কম বয়সী সাড়ে তিন কোটি শিশুর রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৬৫ শতাংশের রক্তে সিসার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি।
সেখানে, সিসার বিষক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে অনেক বেশি। এর ক্ষতি অপরিবর্তনীয়। শৈশবে সিসা বিষাক্ততায় আক্রান্ত হওয়ায় শিশুর স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং পরবর্তী জীবনে হিংসাত্মক আচরণের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।