সারাদেশে এখনও পৌঁছেনি নতুন শিক্ষাবর্ষের সব পাঠ্যবই। সব বই ছাপা শেষ হতে পুরো ফেব্রুয়ারি গড়াতে পারে। মূলত কাগজ সংকট, দেরিতে কার্যাদেশ দেয়া, বইয়ের পাণ্ডলিপি বারবার সংশোধন ও নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের কাজ দেয়ার কারণেই পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পিছিয়ে গেছে।
বই ছাপার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে পাঠদান শুরু হয়েছে; কিন্তু তিন শ্রেণীর বই ছাপার কার্যাদেশ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেয়া হয়। ছাপাখানা মালিকরা পাণ্ডুলিপি বা ‘সিডি’ হাতে পাওয়ার পর বই সরবরাহের জন্য অন্তত দুই মাস পান।
নতুন শিক্ষাবর্ষের ২০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অথচ এখনও দেশের সব শিক্ষার্থী ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক হাতে পায়নি। মোট ৩৫ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সাড়ে তিন কোটি বই ছাপার বাকি রয়েছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের দাবি। যদিও ছাপাখানা মালিকদের দাবি, এখনও ৬-৭ কোটি বই ছাপার বাকি রয়েছে।
পুরো জানুয়ারি মাসেও এসব বই ছাপার কাজ শেষ হচ্ছে না। বাজারে কাগজ সংকটের দোহাই দিয়ে বই ছাপার কার্যক্রম শেষ করতে সরকারের কাছে সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হচ্ছে বলে কয়েকটি ছাপাখানা মালিক জানিয়ছেন।
জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের হিসেবে এখন পর্যন্ত ছয় থেকে সাত কোটি বই ছাপার বাকি রয়েছে।’
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজ সংকট, পাল্প (কাগজের কাঁচামাল) আমদানি বন্ধ রাখা, দেরিতে কার্যাদেশ দেয়া ও বইয়ের পাণ্ডুলিপি বারবার সংশোধন, ঘন ঘন লোডশেডিং, নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের বেশি কাজ দেয়ার কারণেই বই ছাপায় দেরি হচ্ছে।’
তোফায়েল খান বলেন, একদিকে কাগজ সংকটের কারণে বেশির ভাগ ছাপাখানায় কর্মীরা অলস সময় পার করছেন। অন্যদিকে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো কাজ নিয়ে ফেলে রেখেছেন। পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ রেখে তারা নোট-গাইড ছেপে বাণিজ্য করছেন। এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একটি ছাপাখানার কাছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মিলিয়ে প্রায় ৯৫ লাখ বই এখনও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি পাঠ্যবই ছাপা থামিয়ে রেখে এখন নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ছাপাচ্ছে। পাঠ্যবই ছাপায় বিলম্ব হওয়ায় দেশব্যাপী বাজারে এখন নোট-গাইড বইয়ের চাহিদা বেড়েছে।
একটি ছাপাখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের এখনও ১২ লাখের বেশি বই ছাপার বাকি রয়েছে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, তার হাতে এসব বই স্কুলে পৌঁছে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় রয়েছে। এরপর সামান্য জরিমানা দিয়ে আরও ২৮ দিন সময় পাবেন। তিনি এখন কাগজের দাম ‘কমার’ অপেক্ষায় রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, দুই বছর আগ থেকেই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ হচ্ছিল। কিন্তু শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা, দুই মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া, দরপত্র প্রক্রিয়া অনুমোদনসহ এ সংক্রান্ত অনুমোদন পেতে বিলম্ব হয়। এ কারণে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরা নতুন শিক্ষাক্রম ‘সম্পাদনের’ সময় পাননি।
নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের আগে অনেকটা তাড়াহুড়া করেই নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ছাপাতে হয়। এতে একদিকে বইয়ে নানা রকম ভুল-ত্রুটি যেমন শনাক্ত হচ্ছে, বই ছাপার কাজেও বিলম্ব হচ্ছে। বইয়ের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
তাছাড়া প্রাথমিক স্তরের বই ছাপতে ক্রয়প্রক্রিয়ার অনুমোদন পেতে গত বছর অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। বিগত বছরের তুলনায় গতবছর অন্তত একমাস বিলম্বে গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সম্মতি মেলে।
এই পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বেশি কাজ পাওয়া ছাপাখানা মালিকদের এনসিটিবিতে ডেকে বলা হয়, আপাতত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাথমিকের বই ছাপাতে। এতে মাধ্যমিকের বই ছাপার গতিও কমে যায়।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩৫ কোটি বই ছাপাতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন। বছরের শেষ দিকে বিশাল এই কাগজের চাহিদা থাকায় প্রতিবারই আগাম প্রস্তুতি নিয়ে আসছিল এনসিটিবি। তারা নিজেরাই মোট প্রাক্কলিত চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ কাগজ কিনে রাখত। কিন্তু এক শ্রেণীর ছাপাখানা মালিকের তদবিরের কারণে গত বছর এনসিটিবিকে আগাম কাগজ কেনার অনুমোদন দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর খোলাবাজারে কাগজের সংকট প্রকট রূপ নেয়। এই সুযোগ ভালো করেই কাজে লাগিয়েছে কিছু ছাপাখানা।
শিক্ষা প্রশাসন গত ১ জানুয়ারি ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ উদ্যাপন করেছে। এর আগেই পাঠ্যবই ছাপার করার কথা ছিল। কিন্তু নানা সংকটে এবার নির্ধারিত সময়ে এ কাজ শেষ হয়নি।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের প্রায় আড়াই কোটি এবং প্রাথমিক স্তরের এক কোটির বেশি বই ছাপার বাকি রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় নাগাদ এসব বইয়ের ছাপা শেষ হতে পারে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক (স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি) স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য মোট ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪৫ কপি বই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে ২২ কোটির বেশি বই স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাকি বই এখন ছাপার অপেক্ষায় রয়েছে।
চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৩৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণ করা হচ্ছে।
এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ৬৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৪টি ‘আমার বই’ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর মোট দুই লাখ ১২ হাজার ১৭৭টি পুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক সাইদুর রহমান প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক ছাপার কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। তার তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকের ১০ শতাংশের মতো বই এখন ছাপার বাকি রয়েছে। সাইদুর রহমান দুদিন আগে সংবাদকে জানান, ১০ শতাংশ কিছুদিনের মধ্যেই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
এনসিটিবির গতকালের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের উৎপাদন ও বিতরণসহ মোট আট কোটি ৮০ লাখ বই ছাপা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর দুই কোটি ২০ লাখ, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৯ লাখ ১৫ হাজার এবং প্রি-প্রাইমারির ৬২ লাখ বই ছাপা শেষে স্কুল পর্যায়ে দেয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে জানান, ১৫ দিনের মধ্যে (জানুয়ারির মাঝামাঝি) দেশের সব শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে পাবে। যদিও পাঠ্যপুস্তক উৎসবের দিন (১ জানুয়ারি) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন একমাসের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে বই দেয়ার কথা জানান।
এনসিটিবি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই ছাপা শেষে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। কিন্তু দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, কাগজ সংকট ও দাম বেড়ে যাওয়া এবং কিছুটা দেরিতে দরপত্র আহ্বানের কারণে এবার পাঠ্যপুস্তক ছাপায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সরকার ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট চার কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ শিক্ষার্থী ধরে নিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপছে।
শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪
রাকিব উদ্দিন
সারাদেশে এখনও পৌঁছেনি নতুন শিক্ষাবর্ষের সব পাঠ্যবই। সব বই ছাপা শেষ হতে পুরো ফেব্রুয়ারি গড়াতে পারে। মূলত কাগজ সংকট, দেরিতে কার্যাদেশ দেয়া, বইয়ের পাণ্ডলিপি বারবার সংশোধন ও নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের কাজ দেয়ার কারণেই পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পিছিয়ে গেছে।
বই ছাপার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে পাঠদান শুরু হয়েছে; কিন্তু তিন শ্রেণীর বই ছাপার কার্যাদেশ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেয়া হয়। ছাপাখানা মালিকরা পাণ্ডুলিপি বা ‘সিডি’ হাতে পাওয়ার পর বই সরবরাহের জন্য অন্তত দুই মাস পান।
নতুন শিক্ষাবর্ষের ২০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অথচ এখনও দেশের সব শিক্ষার্থী ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক হাতে পায়নি। মোট ৩৫ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সাড়ে তিন কোটি বই ছাপার বাকি রয়েছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের দাবি। যদিও ছাপাখানা মালিকদের দাবি, এখনও ৬-৭ কোটি বই ছাপার বাকি রয়েছে।
পুরো জানুয়ারি মাসেও এসব বই ছাপার কাজ শেষ হচ্ছে না। বাজারে কাগজ সংকটের দোহাই দিয়ে বই ছাপার কার্যক্রম শেষ করতে সরকারের কাছে সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হচ্ছে বলে কয়েকটি ছাপাখানা মালিক জানিয়ছেন।
জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের হিসেবে এখন পর্যন্ত ছয় থেকে সাত কোটি বই ছাপার বাকি রয়েছে।’
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজ সংকট, পাল্প (কাগজের কাঁচামাল) আমদানি বন্ধ রাখা, দেরিতে কার্যাদেশ দেয়া ও বইয়ের পাণ্ডুলিপি বারবার সংশোধন, ঘন ঘন লোডশেডিং, নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের বেশি কাজ দেয়ার কারণেই বই ছাপায় দেরি হচ্ছে।’
তোফায়েল খান বলেন, একদিকে কাগজ সংকটের কারণে বেশির ভাগ ছাপাখানায় কর্মীরা অলস সময় পার করছেন। অন্যদিকে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো কাজ নিয়ে ফেলে রেখেছেন। পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ রেখে তারা নোট-গাইড ছেপে বাণিজ্য করছেন। এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একটি ছাপাখানার কাছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মিলিয়ে প্রায় ৯৫ লাখ বই এখনও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি পাঠ্যবই ছাপা থামিয়ে রেখে এখন নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ছাপাচ্ছে। পাঠ্যবই ছাপায় বিলম্ব হওয়ায় দেশব্যাপী বাজারে এখন নোট-গাইড বইয়ের চাহিদা বেড়েছে।
একটি ছাপাখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের এখনও ১২ লাখের বেশি বই ছাপার বাকি রয়েছে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, তার হাতে এসব বই স্কুলে পৌঁছে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় রয়েছে। এরপর সামান্য জরিমানা দিয়ে আরও ২৮ দিন সময় পাবেন। তিনি এখন কাগজের দাম ‘কমার’ অপেক্ষায় রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, দুই বছর আগ থেকেই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ হচ্ছিল। কিন্তু শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা, দুই মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া, দরপত্র প্রক্রিয়া অনুমোদনসহ এ সংক্রান্ত অনুমোদন পেতে বিলম্ব হয়। এ কারণে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরা নতুন শিক্ষাক্রম ‘সম্পাদনের’ সময় পাননি।
নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের আগে অনেকটা তাড়াহুড়া করেই নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ছাপাতে হয়। এতে একদিকে বইয়ে নানা রকম ভুল-ত্রুটি যেমন শনাক্ত হচ্ছে, বই ছাপার কাজেও বিলম্ব হচ্ছে। বইয়ের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
তাছাড়া প্রাথমিক স্তরের বই ছাপতে ক্রয়প্রক্রিয়ার অনুমোদন পেতে গত বছর অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। বিগত বছরের তুলনায় গতবছর অন্তত একমাস বিলম্বে গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সম্মতি মেলে।
এই পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বেশি কাজ পাওয়া ছাপাখানা মালিকদের এনসিটিবিতে ডেকে বলা হয়, আপাতত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাথমিকের বই ছাপাতে। এতে মাধ্যমিকের বই ছাপার গতিও কমে যায়।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩৫ কোটি বই ছাপাতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন। বছরের শেষ দিকে বিশাল এই কাগজের চাহিদা থাকায় প্রতিবারই আগাম প্রস্তুতি নিয়ে আসছিল এনসিটিবি। তারা নিজেরাই মোট প্রাক্কলিত চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ কাগজ কিনে রাখত। কিন্তু এক শ্রেণীর ছাপাখানা মালিকের তদবিরের কারণে গত বছর এনসিটিবিকে আগাম কাগজ কেনার অনুমোদন দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর খোলাবাজারে কাগজের সংকট প্রকট রূপ নেয়। এই সুযোগ ভালো করেই কাজে লাগিয়েছে কিছু ছাপাখানা।
শিক্ষা প্রশাসন গত ১ জানুয়ারি ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ উদ্যাপন করেছে। এর আগেই পাঠ্যবই ছাপার করার কথা ছিল। কিন্তু নানা সংকটে এবার নির্ধারিত সময়ে এ কাজ শেষ হয়নি।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের প্রায় আড়াই কোটি এবং প্রাথমিক স্তরের এক কোটির বেশি বই ছাপার বাকি রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় নাগাদ এসব বইয়ের ছাপা শেষ হতে পারে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক (স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি) স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য মোট ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪৫ কপি বই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে ২২ কোটির বেশি বই স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাকি বই এখন ছাপার অপেক্ষায় রয়েছে।
চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৩৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণ করা হচ্ছে।
এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ৬৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৪টি ‘আমার বই’ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর মোট দুই লাখ ১২ হাজার ১৭৭টি পুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক সাইদুর রহমান প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক ছাপার কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। তার তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকের ১০ শতাংশের মতো বই এখন ছাপার বাকি রয়েছে। সাইদুর রহমান দুদিন আগে সংবাদকে জানান, ১০ শতাংশ কিছুদিনের মধ্যেই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
এনসিটিবির গতকালের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের উৎপাদন ও বিতরণসহ মোট আট কোটি ৮০ লাখ বই ছাপা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর দুই কোটি ২০ লাখ, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৯ লাখ ১৫ হাজার এবং প্রি-প্রাইমারির ৬২ লাখ বই ছাপা শেষে স্কুল পর্যায়ে দেয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে জানান, ১৫ দিনের মধ্যে (জানুয়ারির মাঝামাঝি) দেশের সব শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে পাবে। যদিও পাঠ্যপুস্তক উৎসবের দিন (১ জানুয়ারি) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন একমাসের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে বই দেয়ার কথা জানান।
এনসিটিবি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই ছাপা শেষে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। কিন্তু দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, কাগজ সংকট ও দাম বেড়ে যাওয়া এবং কিছুটা দেরিতে দরপত্র আহ্বানের কারণে এবার পাঠ্যপুস্তক ছাপায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সরকার ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট চার কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ শিক্ষার্থী ধরে নিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপছে।