স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমরা উগ্রতা পছন্দ করি না। এদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে পছন্দ করে না, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। আর সেজন্যই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আমরা যখনই ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিলাম তখনই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি উজ্জ্বীবিত করেছে। এই সংগঠনটি মনের আগুন জ্বালিয়েছে। আমরা মনে করি যেভাবে সংগঠনটি এগোচ্ছে, এদেশের মানুষের আমাদের সবাইকে একত্রিত করে অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে দেবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা পঁচাত্তরে হারিয়েছি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমরা পঁচাত্তরে হঠাৎ হোঁচট খেয়েছিলাম। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিমটি কেটে দেখেছি আসলেই বেঁচে আছি কি না, স্বপ্ন দেখছি কি না! এরপর তো এই দেশেই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখাও সহ্য করতে হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ বন্ধ করতেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশে ফিরে আসার পর মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আপন করে নিলেন। মানুষ বলেছে, শেখের বেটি আসছে আর কোন দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দাবায়া রাখতে পারবা না। সেই দৃশ্যটাই আমরা দেখলাম। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেন। প্রচলিত আইনেই।’
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এগিয়ে চলছি, আমরা এগিয়ে যাবো। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখতেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ আমরা সেই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে মুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই থাকবে। আমরা সেভাবেই চলছি। সবার জন্য বাসস্থান, শিক্ষা স্বাস্থ্য চিকিৎসা সেবা সবাই পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক চর্চা যদি থাকে তাহলে সে কখনো তার ইতিহাসকে ভুলে যেতে পারে না উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের লোকসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, লালনগীতি, উত্তরের ওকি গাড়িয়াল ভাই গান আমাদের সম্পদ। ‘উগ্র মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক’- এই সেøাগানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমিতে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্র শিল্পী ওয়েরা সেথের।
দিনব্যাপী আয়োজনে কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, খ্যাতিমান বাংলাদেশি অভিনেতা মঞ্চ নির্দেশক নির্মাতা রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশি মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক মুনতাসীর মামুন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভিন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নির্মূল কমিটির আইটি সেল-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।
এর আগে সকাল ১০টায় নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের। এরপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভার প্রারম্ভে লালনগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গান পরিবেশন করেন নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের শিল্পীরা।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বহু বাধাবিঘœ, জেল-জুলুম-হত্যা মোকাবেলা করে গত তিন দশকে নির্মূল কমিটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের বৃহত্তম নাগরিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং বিস্তার লাভ করেছে পাঁচটি মহাদেশে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আমরা নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডকে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে চাই, যাতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রসারে এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।’
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে আমরা যাত্রাপালা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। আমার একটি প্রস্তাব থাকবেÑ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চকে যাত্রামঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।’ নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের বলেন, ‘এই বাঙালি সঙ্গীত ও সংস্কৃতি যদি না থাকতো, এই সাংস্কৃতিক চেতনা যদি মনের গভীরে না থাকতো- তবে এই বাংলাদেশ হতো না। এই দেশের ভাষা আমি জানতাম না। শুধু সুর জানতাম। আমি জানি এই সুর হৃদয় থেকে আসে। যেখান থেকে আপনাদের জন্ম হয়েছে সেই হৃদয়ের সুর আপনারা হারিয়ে ফেলবেন না।’
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট-এর সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমাদের বাঙালির আত্মাটা আছে লোকসংস্কৃতির মধ্যে- এটা আমরা ভুলে যাই। আমরা অবকাঠামোগতভাবে অনেক উন্নতি করেছি, কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। আমরা এই সরকারকে সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বলি, কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বরাদ্দ তলানীতে পড়ে আছে আজও। আমরা করি বাঙালি সংস্কৃতি সংরক্ষণে জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড কাজ করে যাবে।’
নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বিভিন্নক্ষেত্রে উন্নতি করেছি কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এখনও অন্ধকার বিরাজমান। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। এছাড়া আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন।’ বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি চলচ্চিত্রনির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ছিল যেখানে শাহরিয়ার কবিরের লেখা ‘রূপান্তরের গান’ ভারতের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো যা মুক্তিযোদ্ধাদের দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭১ সালে নির্মূল কমিটির বর্তমান সভাপতি সেই সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের একজন সভ্য ছিলেন এবং আজও বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে নির্মূল কমিটির নেতৃত্বেই গঠিত হয়ে নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করা ‘জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড’-এরও নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন- যা খুবই আশাব্যাঞ্জক।
১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সংস্কৃতি মানুষকে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতির ভূমিকা অনেক। বর্তমান সময়ে সরকার ওয়াজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্য তেমন ব্যয় করে না। ধর্মের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। সারাদেশে ৬৪টি জেলায় যেভাবে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে সেভাবে ৬৪টি জেলায় মডেল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেন নির্মাণ করা হয়- সরকারের কাছে আমাদের এই প্রস্তাব থাকবে।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ নানা দিক থেকে সমৃদ্ধি অর্জন করলেও মনোযোগতে উন্নতির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এর থেকে উত্তরণের জন্য নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াড গঠিত হয়েছে যা অন্ধকারের মাঝে আলোর সঞ্চার করবে।’ তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিল যে কোন সময়ে নির্বিঘেœ চললেও যাত্রাপালা চলতে পারে না এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিও পায় না।’ফরিদা ফাউন্ডেশনের সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আশা করি, আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য সাংস্কৃতিক স্কোয়াড কাজ করে যাবে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ফিরে পেলে আমরা আমাদের শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে পারব।’
শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমরা উগ্রতা পছন্দ করি না। এদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে পছন্দ করে না, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। আর সেজন্যই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আমরা যখনই ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিলাম তখনই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি উজ্জ্বীবিত করেছে। এই সংগঠনটি মনের আগুন জ্বালিয়েছে। আমরা মনে করি যেভাবে সংগঠনটি এগোচ্ছে, এদেশের মানুষের আমাদের সবাইকে একত্রিত করে অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে দেবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা পঁচাত্তরে হারিয়েছি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমরা পঁচাত্তরে হঠাৎ হোঁচট খেয়েছিলাম। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিমটি কেটে দেখেছি আসলেই বেঁচে আছি কি না, স্বপ্ন দেখছি কি না! এরপর তো এই দেশেই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখাও সহ্য করতে হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ বন্ধ করতেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশে ফিরে আসার পর মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আপন করে নিলেন। মানুষ বলেছে, শেখের বেটি আসছে আর কোন দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দাবায়া রাখতে পারবা না। সেই দৃশ্যটাই আমরা দেখলাম। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেন। প্রচলিত আইনেই।’
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এগিয়ে চলছি, আমরা এগিয়ে যাবো। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখতেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ আমরা সেই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে মুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই থাকবে। আমরা সেভাবেই চলছি। সবার জন্য বাসস্থান, শিক্ষা স্বাস্থ্য চিকিৎসা সেবা সবাই পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক চর্চা যদি থাকে তাহলে সে কখনো তার ইতিহাসকে ভুলে যেতে পারে না উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের লোকসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, লালনগীতি, উত্তরের ওকি গাড়িয়াল ভাই গান আমাদের সম্পদ। ‘উগ্র মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক’- এই সেøাগানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমিতে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্র শিল্পী ওয়েরা সেথের।
দিনব্যাপী আয়োজনে কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, খ্যাতিমান বাংলাদেশি অভিনেতা মঞ্চ নির্দেশক নির্মাতা রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশি মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক মুনতাসীর মামুন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভিন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নির্মূল কমিটির আইটি সেল-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।
এর আগে সকাল ১০টায় নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের। এরপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভার প্রারম্ভে লালনগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গান পরিবেশন করেন নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের শিল্পীরা।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বহু বাধাবিঘœ, জেল-জুলুম-হত্যা মোকাবেলা করে গত তিন দশকে নির্মূল কমিটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের বৃহত্তম নাগরিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং বিস্তার লাভ করেছে পাঁচটি মহাদেশে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আমরা নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডকে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে চাই, যাতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রসারে এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।’
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে আমরা যাত্রাপালা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। আমার একটি প্রস্তাব থাকবেÑ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চকে যাত্রামঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।’ নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের বলেন, ‘এই বাঙালি সঙ্গীত ও সংস্কৃতি যদি না থাকতো, এই সাংস্কৃতিক চেতনা যদি মনের গভীরে না থাকতো- তবে এই বাংলাদেশ হতো না। এই দেশের ভাষা আমি জানতাম না। শুধু সুর জানতাম। আমি জানি এই সুর হৃদয় থেকে আসে। যেখান থেকে আপনাদের জন্ম হয়েছে সেই হৃদয়ের সুর আপনারা হারিয়ে ফেলবেন না।’
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট-এর সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমাদের বাঙালির আত্মাটা আছে লোকসংস্কৃতির মধ্যে- এটা আমরা ভুলে যাই। আমরা অবকাঠামোগতভাবে অনেক উন্নতি করেছি, কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। আমরা এই সরকারকে সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বলি, কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বরাদ্দ তলানীতে পড়ে আছে আজও। আমরা করি বাঙালি সংস্কৃতি সংরক্ষণে জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড কাজ করে যাবে।’
নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বিভিন্নক্ষেত্রে উন্নতি করেছি কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এখনও অন্ধকার বিরাজমান। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। এছাড়া আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন।’ বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি চলচ্চিত্রনির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ছিল যেখানে শাহরিয়ার কবিরের লেখা ‘রূপান্তরের গান’ ভারতের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো যা মুক্তিযোদ্ধাদের দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭১ সালে নির্মূল কমিটির বর্তমান সভাপতি সেই সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের একজন সভ্য ছিলেন এবং আজও বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে নির্মূল কমিটির নেতৃত্বেই গঠিত হয়ে নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করা ‘জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড’-এরও নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন- যা খুবই আশাব্যাঞ্জক।
১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সংস্কৃতি মানুষকে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতির ভূমিকা অনেক। বর্তমান সময়ে সরকার ওয়াজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্য তেমন ব্যয় করে না। ধর্মের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। সারাদেশে ৬৪টি জেলায় যেভাবে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে সেভাবে ৬৪টি জেলায় মডেল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেন নির্মাণ করা হয়- সরকারের কাছে আমাদের এই প্রস্তাব থাকবে।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ নানা দিক থেকে সমৃদ্ধি অর্জন করলেও মনোযোগতে উন্নতির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এর থেকে উত্তরণের জন্য নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াড গঠিত হয়েছে যা অন্ধকারের মাঝে আলোর সঞ্চার করবে।’ তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিল যে কোন সময়ে নির্বিঘেœ চললেও যাত্রাপালা চলতে পারে না এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিও পায় না।’ফরিদা ফাউন্ডেশনের সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আশা করি, আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য সাংস্কৃতিক স্কোয়াড কাজ করে যাবে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ফিরে পেলে আমরা আমাদের শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে পারব।’