ছবি প্রদর্শনে বাধা কেন

রেজাউল করিম খোকন

ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে বলিউডে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ফারাজ’ ছবি। ছবিটি বানিয়েছেন মুম্বাইয়ের একজন গুণী মেধাবী চিত্রনির্মাতা হংসল মেহতা। বলিউডে বাংলাদেশের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার আলোচিত ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা জানা গিয়েছিল আগেই। ইতোমধ্যে সেই বলিউডি সিনেমা ‘ফারাজ’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে সেই ছবি।

বাংলাদেশের গুণী চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ইতোমধ্যে তার নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক, ওয়েব সিনেমায় তার অসাধারণত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বাংলাদেশের সিনেমাকে নিয়ে গেছেন, অধিষ্ঠিতও করেছেন উজ্জ্বল এক অবস্থানে। তার প্রতিটি কাজেই রয়েছে ভিন্নচিন্তার অপূর্ব প্রকাশ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ঢাকার গুলশানে সংঘটিত হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত সেই নৃশংস ট্র্যাজিক ঘটনাবলী নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি। যেখানে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কয়েকজন গুণী মেধাবী অভিনয় শিল্পী।

‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের পর থেকে দেশের গুণীজন, সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী, সচেতন নাগরিক মহলের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বহুল আলোচিত হৃদয়ে নাড়া দেয়া একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দেখার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলেন। সেলুলয়েডে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় থাকা অগণিত সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিক মহল, সংস্কৃতি কর্মী আজও ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি দেখতে পারেননি।

সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে বহুল আলোচিত দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ছবিটির মুক্তি আটকে আছে গত প্রায় চার বছর ধরে। যথাসময়ে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটির সব কাজ শেষ করেছিলেন পরিচালক ফারুকী। নির্মাণ শেষে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে জমা দেয়া হয়েছিল অনুমোদনের জন্য। সেন্সর বোর্ড সদস্যরা প্রথমে ছবিটি দেখে একটি অনবদ্য চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এরকম একটি বাস্তব ঘটনানির্ভর চলচ্চিত্র অবিলম্বে দর্শকদের সামনে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করা হয়েছিল তখন।

কিন্তু হঠাৎ করে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। গত ২০১৯ সালে সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষ ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি আবার দেখে এর বিভিন্ন বিষয় ও দৃশ্য নিয়ে আপত্তি তোলেন। যার কারণে এ ছবিটি প্রদর্শনীর ব্যাপারে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে আটকে দেয়া হয়। ছবিটি মুক্তি পেলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে তেমন অজুহাত তুলে এর প্রদর্শনীর অনুমোদন দিতে আপত্তি তোলা হয়েছে। তখন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপত্তিকৃত কিছু দৃশ্য পরিবর্তন সাপেক্ষে পুনরায় সেন্সর বোর্ডে পেশ করার কথা বলা হয়। সেই মোতাবেক দৃশ্যগুলো পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন করে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি আবার জমা দেয়ার পর ইতোমধ্যে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়ে ছবিটিকে আটকে রেখেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নির্মাতা, কুলাকুশলী, অভিনয়শিল্পী, দর্শক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক মহল, সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয়েছে। সব ধরনের বাধা, আপত্তি, নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে বহুল আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত ছবিটি যাতে অবিলম্বে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়- তেমন দাবি জানানো হয়েছে।

স্বাধীনভাবে গল্প বলার সুযোগ সৃষ্টি দাবি তোলা হয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, কলাকুশলী, নাট্যকার চলচ্চিত্রকারদের পক্ষ থেকে। সেন্সর বোর্ডের বেড়াজাল থেকে শিল্প-সাহিত্য চলচ্চিত্র তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মুক্ত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে সেখান থেকে। যে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি প্রথমে দেখার পর এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ে ছবিটির চিত্রনাট্য জমা দেয়ার পর অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছিল- সেই ছবিটি পরবর্তী সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে নানাবিধি নিষেধের বেড়াজালে কেন বাক্সবন্দি হয়ে পড়লো, তার নেপথ্যের কারণ এখনও জানেন না ছবিটির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

পরিতাপের বিষয় হলো- একই ঘটনা নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে নির্মিত ‘ফারাজ’ ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে আগামী অল্পকিছুদিনের মধ্যে। অথচ নিজ দেশেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি মুক্তি প্রদর্শনী অজ্ঞাত কারণে রহস্যজনকভাবে আটকে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমহল উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে এবং উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছে। যে ঘটনাটি দুনিয়াজুড়ে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার করেছিল, সেই হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত নৃশংস, ট্র্যাজিক ঘটনানির্ভর ছবিটি দেশের মানুষ দেখতে ভীষণভাবে আগ্রহী। জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য গোটা বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করেছে এবং আলাদা মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সেই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নৃশংসতা এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নিয়ে নির্মিত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি মুক্তি পেয়ে প্রদর্শিত হলে সব শ্রেণীর দর্শক এ বিষয়ে আরো অনেক বেশি সচেতন এবং তার বিরুদ্ধে নিজেদের সোচ্চার মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পাবে বলে মনে করি। দেশ বিদেশে এ বিষয়ে আরও জোরালো জনমতও গড়ে উঠবে।

গতানুগতিক ধারার বাইরে ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের নানা পরীক্ষা চলছে আরো অনেক আগে থেকেই। তবে অতীতে ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণে এতো সক্রিয় ছিলেন না নির্মাতারা। আজ যেভাবে নিত্যনতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভিন্নতর উপস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করছেন বিভিন্ন নির্মাতা, তখন এটা আজকের মতো এতো ব্যাপকভাবে বিস্মৃত ছিল না। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমার পর বাংলাদেশ আজকে যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা গোটা বিশ্বে দারুণ এক বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে আমরা সমৃদ্ধির চমৎকার একটি অবস্থানে অধিষ্ঠিত। স্বাধীনতা লাভের পর ৫১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অভিপ্রায়ে পথচলা শুরু করেছি। এখন আমাদের কুপম-ুক, পুরনো ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ, সংস্কার, বিধিবিধান আঁকড়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন আমাদের আধুনিক স্মার্ট ধ্যান-ধারণার অনুসারী হতে হবে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড আধুনিক স্মার্ট দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হয়ে বহুল আলোচিত ও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি প্রদর্শনীর অনুমোদন প্রদানে বাস্তব অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেবেন- এটা আজকের দৃঢ় প্রত্যাশা আমাদের সবার।

এভাবে লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, গল্পকার, উপন্যাসিক চলচ্চিত্রকারদের নিজস্ব সৃজনশীলতা প্রকাশে তার শিল্পকর্ম চলচ্চিত্র, গল্প, নাটক, সিনেমা সবার সামনে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হলে ভবিষ্যতে দেশে সৃজনশীলতার ধারা রুদ্ধ হয়ে পড়বে। মুক্ত স্বাধীন সাংস্কৃতিক বিকাশকে বাধা দেয়া হলে সামাজিক রাজনৈতিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে- এটা সবাইকে উপলদ্ধি করতে হবে সিরিয়াসভাবে।

আমাদের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এখনও ১৯১৮ ঔপনিবেশিক কাঠামো বা ভাষার বাইরে বের হতে না পারার বিষয়টি বলা যায় এ প্রসঙ্গে। এতো পালাবদলের পরও ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা সেই নিপীড়নমূলক আইনের স্পিরিট অব দ্য ল বা মূলভাবনা আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ, পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনামল থেকে নব্বই পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের যুগেও, কী ভাষায়, কী সংস্কৃতিতে- শাসক আর শাসিতের সেই পুরোনো আমরা-তোমরা বাইনারি মেজাজেই রয়ে গেছে।

শুধুমাত্র অর্থনীতিই একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নের সূচক হতে পারে না, এর পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সূচকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে স্মার্ট বা আধুনিক বলা যায় না। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, চিত্রকর, সাংবাদিক যদি বোবা হয়ে যায়, তাহলে সমাজও বোবা হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মে। তাঁবেদারি শিল্পচর্চা তাঁবেদার সমাজ তৈরি করে। দর্শনের অভাবে যেমন দিক হারায় রাজনীতি, সংস্কৃতির অভাবে তেমনি পথ হারায় সমাজ। শিল্পী বা শিল্পের কাজই হলো চোখে আঙুল তুলে সেই পথটা দেখিয়ে দেয়া। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবশ্যই স্মার্ট মানুষ, স্মার্ট পরিবার এবং স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। এজন্য যা যা প্রয়োজন তা যদি পূরণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে যথার্থ প্রক্রিয়ায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রত্যেককে যার যার নিজের অবস্থান বদলাতে হবে, পরিশুদ্ধ করতে হবে নিজেকে। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, ধারণার উন্মেষ ঘটাতে হবে সমাজে। পুরোনো জরাজীর্ণ ধ্যান-ধারণা গতানুগতিক ভাবনা ত্যাগ করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

ছবি প্রদর্শনে বাধা কেন

রেজাউল করিম খোকন

ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে বলিউডে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ফারাজ’ ছবি। ছবিটি বানিয়েছেন মুম্বাইয়ের একজন গুণী মেধাবী চিত্রনির্মাতা হংসল মেহতা। বলিউডে বাংলাদেশের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার আলোচিত ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা জানা গিয়েছিল আগেই। ইতোমধ্যে সেই বলিউডি সিনেমা ‘ফারাজ’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে সেই ছবি।

বাংলাদেশের গুণী চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ইতোমধ্যে তার নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক, ওয়েব সিনেমায় তার অসাধারণত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বাংলাদেশের সিনেমাকে নিয়ে গেছেন, অধিষ্ঠিতও করেছেন উজ্জ্বল এক অবস্থানে। তার প্রতিটি কাজেই রয়েছে ভিন্নচিন্তার অপূর্ব প্রকাশ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ঢাকার গুলশানে সংঘটিত হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত সেই নৃশংস ট্র্যাজিক ঘটনাবলী নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি। যেখানে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কয়েকজন গুণী মেধাবী অভিনয় শিল্পী।

‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের পর থেকে দেশের গুণীজন, সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী, সচেতন নাগরিক মহলের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বহুল আলোচিত হৃদয়ে নাড়া দেয়া একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দেখার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলেন। সেলুলয়েডে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় থাকা অগণিত সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিক মহল, সংস্কৃতি কর্মী আজও ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি দেখতে পারেননি।

সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে বহুল আলোচিত দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ছবিটির মুক্তি আটকে আছে গত প্রায় চার বছর ধরে। যথাসময়ে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটির সব কাজ শেষ করেছিলেন পরিচালক ফারুকী। নির্মাণ শেষে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে জমা দেয়া হয়েছিল অনুমোদনের জন্য। সেন্সর বোর্ড সদস্যরা প্রথমে ছবিটি দেখে একটি অনবদ্য চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এরকম একটি বাস্তব ঘটনানির্ভর চলচ্চিত্র অবিলম্বে দর্শকদের সামনে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করা হয়েছিল তখন।

কিন্তু হঠাৎ করে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। গত ২০১৯ সালে সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষ ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি আবার দেখে এর বিভিন্ন বিষয় ও দৃশ্য নিয়ে আপত্তি তোলেন। যার কারণে এ ছবিটি প্রদর্শনীর ব্যাপারে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে আটকে দেয়া হয়। ছবিটি মুক্তি পেলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে তেমন অজুহাত তুলে এর প্রদর্শনীর অনুমোদন দিতে আপত্তি তোলা হয়েছে। তখন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপত্তিকৃত কিছু দৃশ্য পরিবর্তন সাপেক্ষে পুনরায় সেন্সর বোর্ডে পেশ করার কথা বলা হয়। সেই মোতাবেক দৃশ্যগুলো পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন করে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি আবার জমা দেয়ার পর ইতোমধ্যে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়ে ছবিটিকে আটকে রেখেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নির্মাতা, কুলাকুশলী, অভিনয়শিল্পী, দর্শক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক মহল, সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয়েছে। সব ধরনের বাধা, আপত্তি, নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে বহুল আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত ছবিটি যাতে অবিলম্বে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়- তেমন দাবি জানানো হয়েছে।

স্বাধীনভাবে গল্প বলার সুযোগ সৃষ্টি দাবি তোলা হয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, কলাকুশলী, নাট্যকার চলচ্চিত্রকারদের পক্ষ থেকে। সেন্সর বোর্ডের বেড়াজাল থেকে শিল্প-সাহিত্য চলচ্চিত্র তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মুক্ত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে সেখান থেকে। যে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি প্রথমে দেখার পর এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ে ছবিটির চিত্রনাট্য জমা দেয়ার পর অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছিল- সেই ছবিটি পরবর্তী সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে নানাবিধি নিষেধের বেড়াজালে কেন বাক্সবন্দি হয়ে পড়লো, তার নেপথ্যের কারণ এখনও জানেন না ছবিটির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

পরিতাপের বিষয় হলো- একই ঘটনা নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে নির্মিত ‘ফারাজ’ ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে আগামী অল্পকিছুদিনের মধ্যে। অথচ নিজ দেশেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি মুক্তি প্রদর্শনী অজ্ঞাত কারণে রহস্যজনকভাবে আটকে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমহল উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে এবং উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছে। যে ঘটনাটি দুনিয়াজুড়ে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার করেছিল, সেই হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত নৃশংস, ট্র্যাজিক ঘটনানির্ভর ছবিটি দেশের মানুষ দেখতে ভীষণভাবে আগ্রহী। জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য গোটা বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করেছে এবং আলাদা মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সেই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নৃশংসতা এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নিয়ে নির্মিত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি মুক্তি পেয়ে প্রদর্শিত হলে সব শ্রেণীর দর্শক এ বিষয়ে আরো অনেক বেশি সচেতন এবং তার বিরুদ্ধে নিজেদের সোচ্চার মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পাবে বলে মনে করি। দেশ বিদেশে এ বিষয়ে আরও জোরালো জনমতও গড়ে উঠবে।

গতানুগতিক ধারার বাইরে ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের নানা পরীক্ষা চলছে আরো অনেক আগে থেকেই। তবে অতীতে ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণে এতো সক্রিয় ছিলেন না নির্মাতারা। আজ যেভাবে নিত্যনতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভিন্নতর উপস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করছেন বিভিন্ন নির্মাতা, তখন এটা আজকের মতো এতো ব্যাপকভাবে বিস্মৃত ছিল না। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমার পর বাংলাদেশ আজকে যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা গোটা বিশ্বে দারুণ এক বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে আমরা সমৃদ্ধির চমৎকার একটি অবস্থানে অধিষ্ঠিত। স্বাধীনতা লাভের পর ৫১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অভিপ্রায়ে পথচলা শুরু করেছি। এখন আমাদের কুপম-ুক, পুরনো ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ, সংস্কার, বিধিবিধান আঁকড়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন আমাদের আধুনিক স্মার্ট ধ্যান-ধারণার অনুসারী হতে হবে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড আধুনিক স্মার্ট দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হয়ে বহুল আলোচিত ও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি প্রদর্শনীর অনুমোদন প্রদানে বাস্তব অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেবেন- এটা আজকের দৃঢ় প্রত্যাশা আমাদের সবার।

এভাবে লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, গল্পকার, উপন্যাসিক চলচ্চিত্রকারদের নিজস্ব সৃজনশীলতা প্রকাশে তার শিল্পকর্ম চলচ্চিত্র, গল্প, নাটক, সিনেমা সবার সামনে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হলে ভবিষ্যতে দেশে সৃজনশীলতার ধারা রুদ্ধ হয়ে পড়বে। মুক্ত স্বাধীন সাংস্কৃতিক বিকাশকে বাধা দেয়া হলে সামাজিক রাজনৈতিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে- এটা সবাইকে উপলদ্ধি করতে হবে সিরিয়াসভাবে।

আমাদের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এখনও ১৯১৮ ঔপনিবেশিক কাঠামো বা ভাষার বাইরে বের হতে না পারার বিষয়টি বলা যায় এ প্রসঙ্গে। এতো পালাবদলের পরও ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা সেই নিপীড়নমূলক আইনের স্পিরিট অব দ্য ল বা মূলভাবনা আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ, পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনামল থেকে নব্বই পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের যুগেও, কী ভাষায়, কী সংস্কৃতিতে- শাসক আর শাসিতের সেই পুরোনো আমরা-তোমরা বাইনারি মেজাজেই রয়ে গেছে।

শুধুমাত্র অর্থনীতিই একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নের সূচক হতে পারে না, এর পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সূচকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে স্মার্ট বা আধুনিক বলা যায় না। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, চিত্রকর, সাংবাদিক যদি বোবা হয়ে যায়, তাহলে সমাজও বোবা হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মে। তাঁবেদারি শিল্পচর্চা তাঁবেদার সমাজ তৈরি করে। দর্শনের অভাবে যেমন দিক হারায় রাজনীতি, সংস্কৃতির অভাবে তেমনি পথ হারায় সমাজ। শিল্পী বা শিল্পের কাজই হলো চোখে আঙুল তুলে সেই পথটা দেখিয়ে দেয়া। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবশ্যই স্মার্ট মানুষ, স্মার্ট পরিবার এবং স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। এজন্য যা যা প্রয়োজন তা যদি পূরণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে যথার্থ প্রক্রিয়ায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রত্যেককে যার যার নিজের অবস্থান বদলাতে হবে, পরিশুদ্ধ করতে হবে নিজেকে। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, ধারণার উন্মেষ ঘটাতে হবে সমাজে। পুরোনো জরাজীর্ণ ধ্যান-ধারণা গতানুগতিক ভাবনা ত্যাগ করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]