নতুন বছরে নতুন করে ভাবি

রহমান মৃধা

মা তার বাচ্চা শিশুটিকে বুকের দুধ মুখে ধরিয়ে দিয়ে তাকে সান্তনা দিতে চেষ্টা করছে কিন্তু শিশুটির কান্না থামছে না। আমি মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? বাচ্চাটির মুখে দুধ সত্ত্বেও কাঁদছে, নিশ্চয়ই পেট ব্যথা করছে বা অন্য কোনো সমস্যা।

মহিলাটি উত্তরে বলেছিল, বুকে দুধ নাই; থাকবে কিভাবে? আমি নিজেই দুই দিন কিছু খাইনি।

ঘটনাটি দেখে মনটি খুব খারাপ হয়ে গেল, কিছু সাহায্য করে সেখান থেকে চলে গেলাম। ইচ্ছে ছিল কিছুক্ষণ জায়গাটি ঘুরবো, ভালো কিছু দেখবো, নিজে অনুপ্রাণিত হবো, অন্যকে অনুপ্রাণিত করবো কিন্তু হলো না।

জায়গাটি ছিল ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসের পাশে, যেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাস করেন। আফ্রিকা বা বাংলাদেশে এমনটি দেখলে জানি না কেমন লাগতো তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে ঘটনাটি দেখে হৃদয়ে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।

আজ থেকে ৭০ বছর আগে ন্যাটো জোট গঠন করা হয়। যে দেশগুলো এই ন্যাটো জোট গঠনে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল তার মধ্যে আমেরিকার নাম তালিকার প্রথমে রাখলে ভুল হবে না। অন্যদিকে গঠন করা হয় ওয়ারশ চুক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জোট দুটি গঠন করা হয়। ওয়েস্ট ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ বেশ দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে। না জানি কখন কোথায় আক্রমণ করে! এমন একটি সময় আমেরিকা সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে কৃপণতা করেনি। যে সমস্ত দেশ আমেরিকার সঙ্গে দল বেঁধেছিল তারা একবারও কি ভাবেনি আমেরিকা আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পাড়ে, কেন তারা আমাদের বন্ধু হতে চায়? কারণ ছিল একটাই তা হলো সুপার পাওয়ার।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো ইউরোপ এবং এশিয়া ডমিনেট করবে তা আমেরিকা কখনও মেনে নিতে পারেনি। তাইতো উঠেপড়ে লেগেছে সব সময় পৃথিবীতে শান্তির চেয়ে অশান্তি ডেকে আনতে। আমাদের এশিয়া মহাদেশে পাকিস্তানকে অনেকবার কাজে লাগিয়ে নানা কুকর্মের ব্যবস্থা করেছে আমেরিকা। যাই হোক না কেনো পশ্চিমা ইউরোপ এবং আমেরিকা শেষপর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙেচুরে তছনছ করেছে।

প্রথমে মিখাইল গর্বাচভ, পরে বরিস নিকোলায়েভিচ এবং শেষে পুতিন। সব চলে গেলেও রাশিয়া রয়েছে এখনও। যারা সোভিয়েত ছেড়েছে তারা যোগ দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে। আবার অনেকে যোগ দিয়েছে সেনজেন দেশগুলোর সঙ্গে। ন্যাটো জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত বা বর্তমান রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করা। ভেবেছিলাম জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে ন্যাটো জোট সেলিব্রেশন আনন্দময় মুহূর্ত দিবে বিশ্বকে। এখন দেখছি আম গাছের তলে আমই পড়ে।

এখন আমরা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের খবর টেলিভিশনে দেখি, ইউক্রেনে আক্রান্ত মানুষের রিপোর্ট টেলিভিশনে আসে, ইউক্রেনে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এসব খবর আসে। মিডিয়ার এই ভূমিকা যদি সব সময় থাকতো, তাহলে ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিনিদের বর্বরতার খবর আমরা মিডিয়ায় পেতাম, আফগানিস্তানের খবর আমরা জানতাম, ইয়েমেনে সৌদি আরব যখন আক্রমণ করছে সেটা জানতাম, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মিডিয়া উল্টোটা করেছে, কারণ তাদের স্বার্থ ছিল আগ্রাসীর পক্ষে। লাখ লাখ মানুষ নিহত হলেও কোনো খবরে তা গুরুত্ব পায়নি।

মিডিয়া কোনটাকে ফোকাস করবে, কোন দেশকে সামনে আনবে, কোন দেশের অর্থনীতিকে তারা সংকটগ্রস্ত বলবে, কোন দেশের অর্থনীতি বিকাশমান বলবে- এসবের সঙ্গে আসলে বহুজাতিক পুঁজির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটা সম্পর্ক থাকে। এসব হলো খুবই সংগঠিত ব্যাপার। এসব কোনো মিডিয়ার সাংবাদিকের ব্যক্তিগত বিষয় নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের লাইনের বাইরে গেলে বড় বড় সাংবাদিকের চাকরিও চলে যায়।

বর্তমানে সুইডেনে যা কিছু ঘটছে তার সঙ্গে বৈশ্বিক জোট-সম্পর্কিত। এ দেশে যা কিছু ঘটে তার সুবিধাভোগী যেমন দেশের মধ্যে, তেমনি দেশের বাইরেও আছে। বৈশ্বিক জোটের প্রতিনিধি হিসেবে যারা কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জেপি মর্গান বা গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতো ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠান, যারা মূলত বহুজাতিক পুঁজির ব্যবস্থাপনা, তাদের স্বার্থ দেখার জন্য বিভিন্ন স্থানে কাজ করে। নীতি প্রভাবিত করা তো বটেই, তথ্য বিকৃতিও তারা করে থাকে।

বৈশ্বিক পুঁজিবাদের বর্তমান পরিস্থিতি খেয়াল করলে বোঝা যায়, বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক এবং মিডিয়া, একটার সঙ্গে অন্যটা যুক্ত। মিডিয়ায় কোনটা ফোকাস হবে, কোনটাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, সেগুলো আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় এসব বহুজাতিক কোম্পানি এবং সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ও অ্যাজেন্ডা থেকে। সুতরাং সিএনএন, বিবিসি, এএফপি, রয়টার্সের রিপোর্ট- সবই এই ছাঁকনির ওপর নির্ভর করে।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জো বাইডেনের প্রথম বক্তব্য ছিল এরূপ ‘আমি দেশ সার্ভ করতে এসেছি ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াতে নয়। যদি ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর ইচ্ছা থাকতো তবে ব্যবসায়ী হতাম, রাজনীতিবিদ নয়। রাজনীতি হলো বিলিয়ে দেয়ার জায়গা, বিলিয়নিয়ার হবার নয়। ব্যবসায় মুনাফা থাকে। রাজনীতিতে থাকে শুধু সেবা। এই সেবাই হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মুনাফা।’ এই কথার সঙ্গে বর্তমান কাজের কি তেমন মিল দেখা যাচ্ছে? হয়তো অনেকেই বলবে জো বাইডেন দুর্নীতি করে অন্যান্যদের মতো গাড়ি বাড়ি করছে না। আমার মনে হয় সেটা করলেও অগত্যা গোটা বিশ্বের এতবড় ক্ষতি হতো না। যদিও যে কথা তিনি বলেছিলেন সেটা রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে হবার কথা।

ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিমুক্ত হলে কর্তৃপক্ষ দক্ষতার সঙ্গে দেশের সেবা করতে সক্ষম হয়। রাজনীতিবিদদের মাসিক বেতন বা অন্য কোনো ভাতার ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা হয়তোবা দুর্নীতিগ্রস্ত; কিন্তু সিভিল প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের মাসিক বেতনসহ সবাই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন তারা দুর্নীতি করে?

আবার যারা বিভিন্ন প্রশাসনের দায়িত্বে নিযুক্ত তাদের ক্ষেত্রেও একই বার্তা, সেটা হলো সেবা দেয়া। এই সেবা দেয়ার মনোভাব যেসব দেশ থেকে বিলীন হতে চলছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কিছু পেতে কিছু দিতে হবে কথাটি সত্য। যারা চাকরি করে তাদের কাজ সেবা দেয়া। বিনিময়ে তাদের বেতন থেকে শুরু করে সবাই সুবিধা দেয়া হয়। তারপরও কেন সেবা পেতে আলাদা মুনাফা? ঘটনাটি কি ভাববার বিষয় না?

একজন রিকশাচালক আমাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নিয়ে গেল। বিনিময়ে তাকে তার কায়িক পরিশ্রমের জন্য সঠিক মজুরি দিতে আমার সমস্যা হবার কথা নয়; কিন্তু যদি একজন পুলিশ, ব্যাংকার, ডাক্তার, এসি ল্যান্ড, ইঞ্জিনিয়ার আরও শত শত কর্মরত বেতনভুক্ত কর্মীও যদি রিকশাচালকের মতো মজুরির ডিমান্ড করে তবে দেয়া নেয়ার ভারসাম্য কেমন হয়ে গেল না? সরকারি সুযোগ সুবিধা যারা ভোগ করে তারা তো জনগণের থেকে নতুন করে সেবার বিনিময়ে মজুরি নিতে পারে না!

যদি সবাই রিকশাচালকের মতো ব্যক্তি মালিকানা হয় সেক্ষেত্রে বুঝলাম সেবার বিনিময়ে মুজরি দিতে হবে। এই সহজ কাজগুলো যাতে সমাজে সঠিকভাবে পালিত হয় তার জন্য কর্তৃপক্ষ রয়েছে এবং তাদেরও কাজের বিনিময়ে সরকার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। তারা যাতে সে দায়িত্ব পালন করে, সে বিষয়ে নজর রাখার জন্য রয়েছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি যেমন উপরের বর্ণনায় জো বাইডেনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন যদি জো বাইডেন তার কথা মতো সেই সঠিক কাজ না করে এবং আলাদা মুনাফা নিতে শুরু করে তবে আমেরিকার জনগণ কি সেটা মেনে নেবে? নিশ্চয়ই না। তাহলে বাংলাদেশের জনগণও গণতন্ত্রের সংজ্ঞানুযায়ী সেটা মেনে নিতে পারে না। অথচ মেনে নেওয়া হচ্ছে যার ফলে অরাজকতা দেশের সর্বত্রই ভরপুর। এর থেকে রেহাই পেতে হলে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন হতে হবে সবাইকে।

বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিনটি দল দেশ পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। যদি ধরি পুনরায় বিএনপি ক্ষমতায় এলো তাহলে কী হবে? পার্টির পরিবর্তন হবে, মুষ্টিমেয় প্রশাসনের কিছু রদবদল হবে বা চাকরি যাবে, তবে কারও স্বভাবের পরিবর্তন হবে না।

বর্তমান সরকারের সময় যে জিনিসটা বেশি লক্ষণীয় সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারো নাম শোনা যায় না; যা কিছু করতে হবে প্রধানমন্ত্রী, সমস্ত প্রশংসা প্রধানমন্ত্রীর, দেশ রসাতালে যাচ্ছে, দুর্নীতিতে ভরপুর, দোষ প্রধানমন্ত্রীর। বিষয়টি মেলাতে পারছি না, এ কী করে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী কেন সবকিছুর জন্য দায়ী হবেন বা সব ভালো কাজের জন্য প্রশংসা পাবেন?

ইদানীং প্রশাসনের কর্মকর্তারাই বলছে প্রধানমন্ত্রী জেগে আছেন যার ফলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদি এমনটি হয় হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছেন তাহলে কী হবে এই অভাগা দেশটির, ভেবেছেন কি একবার? ভাবলে একজন মানুষের উপর ১৭ কোটি মানুষের দায়ভার চাপিয়ে দিব্যি সবাই লুটপাট করতো না।

আমি বিশ্বাস করি দেশে অনেক ভালো লোক রয়েছে যারা সত্যি দেশের জন্য কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে ভালো লোকগুলোকে চিহ্নিত করে তাদেরকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবর্তমানে কে কী করবে সেটা বুঝিয়ে দেয়া।

পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যেখানে একনায়কতন্ত্রের শাসন চলছে। উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া তার মধ্যে অন্যতম। তারা তাদের দেশকে গণতন্ত্রের দেশ বলে দাবি করে না। যেহেতু বাংলাদেশ গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূল স্তম্ভ এবং গণতন্ত্রই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, তাই দেশে গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিস হওয়া উচিত।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

নতুন বছরে নতুন করে ভাবি

রহমান মৃধা

মা তার বাচ্চা শিশুটিকে বুকের দুধ মুখে ধরিয়ে দিয়ে তাকে সান্তনা দিতে চেষ্টা করছে কিন্তু শিশুটির কান্না থামছে না। আমি মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? বাচ্চাটির মুখে দুধ সত্ত্বেও কাঁদছে, নিশ্চয়ই পেট ব্যথা করছে বা অন্য কোনো সমস্যা।

মহিলাটি উত্তরে বলেছিল, বুকে দুধ নাই; থাকবে কিভাবে? আমি নিজেই দুই দিন কিছু খাইনি।

ঘটনাটি দেখে মনটি খুব খারাপ হয়ে গেল, কিছু সাহায্য করে সেখান থেকে চলে গেলাম। ইচ্ছে ছিল কিছুক্ষণ জায়গাটি ঘুরবো, ভালো কিছু দেখবো, নিজে অনুপ্রাণিত হবো, অন্যকে অনুপ্রাণিত করবো কিন্তু হলো না।

জায়গাটি ছিল ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসের পাশে, যেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাস করেন। আফ্রিকা বা বাংলাদেশে এমনটি দেখলে জানি না কেমন লাগতো তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে ঘটনাটি দেখে হৃদয়ে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।

আজ থেকে ৭০ বছর আগে ন্যাটো জোট গঠন করা হয়। যে দেশগুলো এই ন্যাটো জোট গঠনে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল তার মধ্যে আমেরিকার নাম তালিকার প্রথমে রাখলে ভুল হবে না। অন্যদিকে গঠন করা হয় ওয়ারশ চুক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জোট দুটি গঠন করা হয়। ওয়েস্ট ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ বেশ দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে। না জানি কখন কোথায় আক্রমণ করে! এমন একটি সময় আমেরিকা সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে কৃপণতা করেনি। যে সমস্ত দেশ আমেরিকার সঙ্গে দল বেঁধেছিল তারা একবারও কি ভাবেনি আমেরিকা আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পাড়ে, কেন তারা আমাদের বন্ধু হতে চায়? কারণ ছিল একটাই তা হলো সুপার পাওয়ার।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো ইউরোপ এবং এশিয়া ডমিনেট করবে তা আমেরিকা কখনও মেনে নিতে পারেনি। তাইতো উঠেপড়ে লেগেছে সব সময় পৃথিবীতে শান্তির চেয়ে অশান্তি ডেকে আনতে। আমাদের এশিয়া মহাদেশে পাকিস্তানকে অনেকবার কাজে লাগিয়ে নানা কুকর্মের ব্যবস্থা করেছে আমেরিকা। যাই হোক না কেনো পশ্চিমা ইউরোপ এবং আমেরিকা শেষপর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙেচুরে তছনছ করেছে।

প্রথমে মিখাইল গর্বাচভ, পরে বরিস নিকোলায়েভিচ এবং শেষে পুতিন। সব চলে গেলেও রাশিয়া রয়েছে এখনও। যারা সোভিয়েত ছেড়েছে তারা যোগ দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে। আবার অনেকে যোগ দিয়েছে সেনজেন দেশগুলোর সঙ্গে। ন্যাটো জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত বা বর্তমান রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করা। ভেবেছিলাম জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে ন্যাটো জোট সেলিব্রেশন আনন্দময় মুহূর্ত দিবে বিশ্বকে। এখন দেখছি আম গাছের তলে আমই পড়ে।

এখন আমরা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের খবর টেলিভিশনে দেখি, ইউক্রেনে আক্রান্ত মানুষের রিপোর্ট টেলিভিশনে আসে, ইউক্রেনে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এসব খবর আসে। মিডিয়ার এই ভূমিকা যদি সব সময় থাকতো, তাহলে ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিনিদের বর্বরতার খবর আমরা মিডিয়ায় পেতাম, আফগানিস্তানের খবর আমরা জানতাম, ইয়েমেনে সৌদি আরব যখন আক্রমণ করছে সেটা জানতাম, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মিডিয়া উল্টোটা করেছে, কারণ তাদের স্বার্থ ছিল আগ্রাসীর পক্ষে। লাখ লাখ মানুষ নিহত হলেও কোনো খবরে তা গুরুত্ব পায়নি।

মিডিয়া কোনটাকে ফোকাস করবে, কোন দেশকে সামনে আনবে, কোন দেশের অর্থনীতিকে তারা সংকটগ্রস্ত বলবে, কোন দেশের অর্থনীতি বিকাশমান বলবে- এসবের সঙ্গে আসলে বহুজাতিক পুঁজির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটা সম্পর্ক থাকে। এসব হলো খুবই সংগঠিত ব্যাপার। এসব কোনো মিডিয়ার সাংবাদিকের ব্যক্তিগত বিষয় নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের লাইনের বাইরে গেলে বড় বড় সাংবাদিকের চাকরিও চলে যায়।

বর্তমানে সুইডেনে যা কিছু ঘটছে তার সঙ্গে বৈশ্বিক জোট-সম্পর্কিত। এ দেশে যা কিছু ঘটে তার সুবিধাভোগী যেমন দেশের মধ্যে, তেমনি দেশের বাইরেও আছে। বৈশ্বিক জোটের প্রতিনিধি হিসেবে যারা কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জেপি মর্গান বা গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতো ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠান, যারা মূলত বহুজাতিক পুঁজির ব্যবস্থাপনা, তাদের স্বার্থ দেখার জন্য বিভিন্ন স্থানে কাজ করে। নীতি প্রভাবিত করা তো বটেই, তথ্য বিকৃতিও তারা করে থাকে।

বৈশ্বিক পুঁজিবাদের বর্তমান পরিস্থিতি খেয়াল করলে বোঝা যায়, বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক এবং মিডিয়া, একটার সঙ্গে অন্যটা যুক্ত। মিডিয়ায় কোনটা ফোকাস হবে, কোনটাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, সেগুলো আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় এসব বহুজাতিক কোম্পানি এবং সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ও অ্যাজেন্ডা থেকে। সুতরাং সিএনএন, বিবিসি, এএফপি, রয়টার্সের রিপোর্ট- সবই এই ছাঁকনির ওপর নির্ভর করে।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জো বাইডেনের প্রথম বক্তব্য ছিল এরূপ ‘আমি দেশ সার্ভ করতে এসেছি ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াতে নয়। যদি ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর ইচ্ছা থাকতো তবে ব্যবসায়ী হতাম, রাজনীতিবিদ নয়। রাজনীতি হলো বিলিয়ে দেয়ার জায়গা, বিলিয়নিয়ার হবার নয়। ব্যবসায় মুনাফা থাকে। রাজনীতিতে থাকে শুধু সেবা। এই সেবাই হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মুনাফা।’ এই কথার সঙ্গে বর্তমান কাজের কি তেমন মিল দেখা যাচ্ছে? হয়তো অনেকেই বলবে জো বাইডেন দুর্নীতি করে অন্যান্যদের মতো গাড়ি বাড়ি করছে না। আমার মনে হয় সেটা করলেও অগত্যা গোটা বিশ্বের এতবড় ক্ষতি হতো না। যদিও যে কথা তিনি বলেছিলেন সেটা রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে হবার কথা।

ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিমুক্ত হলে কর্তৃপক্ষ দক্ষতার সঙ্গে দেশের সেবা করতে সক্ষম হয়। রাজনীতিবিদদের মাসিক বেতন বা অন্য কোনো ভাতার ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা হয়তোবা দুর্নীতিগ্রস্ত; কিন্তু সিভিল প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের মাসিক বেতনসহ সবাই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন তারা দুর্নীতি করে?

আবার যারা বিভিন্ন প্রশাসনের দায়িত্বে নিযুক্ত তাদের ক্ষেত্রেও একই বার্তা, সেটা হলো সেবা দেয়া। এই সেবা দেয়ার মনোভাব যেসব দেশ থেকে বিলীন হতে চলছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কিছু পেতে কিছু দিতে হবে কথাটি সত্য। যারা চাকরি করে তাদের কাজ সেবা দেয়া। বিনিময়ে তাদের বেতন থেকে শুরু করে সবাই সুবিধা দেয়া হয়। তারপরও কেন সেবা পেতে আলাদা মুনাফা? ঘটনাটি কি ভাববার বিষয় না?

একজন রিকশাচালক আমাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নিয়ে গেল। বিনিময়ে তাকে তার কায়িক পরিশ্রমের জন্য সঠিক মজুরি দিতে আমার সমস্যা হবার কথা নয়; কিন্তু যদি একজন পুলিশ, ব্যাংকার, ডাক্তার, এসি ল্যান্ড, ইঞ্জিনিয়ার আরও শত শত কর্মরত বেতনভুক্ত কর্মীও যদি রিকশাচালকের মতো মজুরির ডিমান্ড করে তবে দেয়া নেয়ার ভারসাম্য কেমন হয়ে গেল না? সরকারি সুযোগ সুবিধা যারা ভোগ করে তারা তো জনগণের থেকে নতুন করে সেবার বিনিময়ে মজুরি নিতে পারে না!

যদি সবাই রিকশাচালকের মতো ব্যক্তি মালিকানা হয় সেক্ষেত্রে বুঝলাম সেবার বিনিময়ে মুজরি দিতে হবে। এই সহজ কাজগুলো যাতে সমাজে সঠিকভাবে পালিত হয় তার জন্য কর্তৃপক্ষ রয়েছে এবং তাদেরও কাজের বিনিময়ে সরকার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। তারা যাতে সে দায়িত্ব পালন করে, সে বিষয়ে নজর রাখার জন্য রয়েছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি যেমন উপরের বর্ণনায় জো বাইডেনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন যদি জো বাইডেন তার কথা মতো সেই সঠিক কাজ না করে এবং আলাদা মুনাফা নিতে শুরু করে তবে আমেরিকার জনগণ কি সেটা মেনে নেবে? নিশ্চয়ই না। তাহলে বাংলাদেশের জনগণও গণতন্ত্রের সংজ্ঞানুযায়ী সেটা মেনে নিতে পারে না। অথচ মেনে নেওয়া হচ্ছে যার ফলে অরাজকতা দেশের সর্বত্রই ভরপুর। এর থেকে রেহাই পেতে হলে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন হতে হবে সবাইকে।

বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিনটি দল দেশ পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। যদি ধরি পুনরায় বিএনপি ক্ষমতায় এলো তাহলে কী হবে? পার্টির পরিবর্তন হবে, মুষ্টিমেয় প্রশাসনের কিছু রদবদল হবে বা চাকরি যাবে, তবে কারও স্বভাবের পরিবর্তন হবে না।

বর্তমান সরকারের সময় যে জিনিসটা বেশি লক্ষণীয় সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারো নাম শোনা যায় না; যা কিছু করতে হবে প্রধানমন্ত্রী, সমস্ত প্রশংসা প্রধানমন্ত্রীর, দেশ রসাতালে যাচ্ছে, দুর্নীতিতে ভরপুর, দোষ প্রধানমন্ত্রীর। বিষয়টি মেলাতে পারছি না, এ কী করে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী কেন সবকিছুর জন্য দায়ী হবেন বা সব ভালো কাজের জন্য প্রশংসা পাবেন?

ইদানীং প্রশাসনের কর্মকর্তারাই বলছে প্রধানমন্ত্রী জেগে আছেন যার ফলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদি এমনটি হয় হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছেন তাহলে কী হবে এই অভাগা দেশটির, ভেবেছেন কি একবার? ভাবলে একজন মানুষের উপর ১৭ কোটি মানুষের দায়ভার চাপিয়ে দিব্যি সবাই লুটপাট করতো না।

আমি বিশ্বাস করি দেশে অনেক ভালো লোক রয়েছে যারা সত্যি দেশের জন্য কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে ভালো লোকগুলোকে চিহ্নিত করে তাদেরকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবর্তমানে কে কী করবে সেটা বুঝিয়ে দেয়া।

পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যেখানে একনায়কতন্ত্রের শাসন চলছে। উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া তার মধ্যে অন্যতম। তারা তাদের দেশকে গণতন্ত্রের দেশ বলে দাবি করে না। যেহেতু বাংলাদেশ গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূল স্তম্ভ এবং গণতন্ত্রই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, তাই দেশে গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিস হওয়া উচিত।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]