কেমন আছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়

মিথুশিলাক মুরমু

১.

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দের বড়দিনের দিনে রাজশাহীর উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রালে সকালে গির্জার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই এক ব্যক্তি কুরআন শরিফ গির্জা ঘরে রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। গির্জায় দুই-একজন থাকায় একপ্রকার জোরপূর্বক কুরআন শরিফ রেখে চলে আসলে খ্রিস্টভক্তরা দেরি না করেই স্থানীয় কাশিয়াডাঙ্গা থানাকে অবহিত করা হলে শীঘ্রই পুলিশ উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে উঠে, সংগ্রহ করে ভিডিও ফুটেজ এবং দুপুর ১২টা নাগাদই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হন। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি নিজেকে ঈসা নবী হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন। এতে অনুমিত হয় যে, রাজশাহীতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্যে একশ্রেণীর ধর্মান্ধরা বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন অত্র এলাকায় থেকেছি, দেখেছি খ্রিস্টান সম্প্রদায় কিছু জায়গা-জমি ক্রয় করে গড়ে তুলেছেন হাইস্কুল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, রোগীদের নিরাময় কেন্দ্র, এতিম ছেলেমেয়েদের জন্য হোমসহ অসংখ্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। ক্যাথিড্রালের আশপাশে খ্রিস্টবিশ্ববাসীদের পুনর্বাসন করা হয়েছে, গড়ে ওঠেছে আরো কতকগুলো গ্রাম। বাগানপাড়া, আলীগঞ্জ, পূর্ব টালিপাড়া, পশ্চিম টালিপাড়াগুলোতে আনুমানিক সহস্রখানিক পরিবার বসবাস করেছে; মোটকথা এলাকাটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত। খ্রিস্টান জনঅধ্যুষিত হলেও তাদের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে শঙ্কা ও পারস্পারিক অবিশ্বাস। তাহলে কেন এরূপ জায়গাটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল?

রাজশাহীর ক্যাথিড্রালটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নাটোর মহাসড়কের পার্শ্বে অবস্থিত। ক্যাথিড্রলটিতে ‘কুরআন শরিফ’ বির্তক সত্যিকার অর্থে রূপায়িত সম্ভব হলে লঙ্কাকা- সহজেই সম্ভবপর ছিলো।

রাজশাহীকে বেছে নেওয়ার সুবিধাদি হলো এটি বিভাগীয় নগর ও শিক্ষানগরী। রাজশাহী শহরের সাথে নরওয়ের খ্রিস্টান সেনসিটির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। শহরের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর দুর্ঘটনা হলে সহজেই বিশ্বব্যাপী নিউজ কাভার ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া যেত।

২৫ জানুয়ারি ২০২১ সালে রাজশাহী মহানগরীর ১৭নং ওয়ার্ডের আওতাধীন বড়বনগ্রাম কুচপাড়ায় হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এছাড়াও সিটি করপোরেশন এলাকায় ‘মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী’ রয়েছে। ধর্মান্ধরা মনে করতে পারেন, রাজশাহী সিটি মেয়র ও অন্যান্যরা খ্রিস্টানদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সুবিধাদি প্রদান করছেন।

২.

বড়দিনের পরের দিন অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর পাবনার চাটমোহর জগতলা গ্রামের উৎসবের আমেজেই বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মূলত বড়দিনকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, এ সময় দূরে-নিকটের আত্মীয়-স্বজনরা কর্মক্ষেত্র থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে থাকেন। গ্রামের মৃত সুবল গমেজের ছেলে সনি গমেজের বিয়েতে সেদিন রাতে গ্রামের ও আত্মীয়-স্বজনরা আনন্দে নাচগানে মেতে উঠেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামের ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মেয়েদের সাথে নাচতে উদ্যত হলে অনেকেই আপত্তি তোলেন ও নিষেধ করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সনি গমেজের চাচা সুব্রত গমেজের গায়ে হাত তোলে, মুহূর্তেই আনন্দঘন পরিবেশ বিষাদে পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতার পরিচয় দিতে কার্পণ্যবোধ করেনি।

পরের দিন ২৭ ডিসেম্বর সকালে দলবল নিয়ে দ্বিতীয় দফা হামলা চালায়; এতে পরিবারের লোকজন ও নিকটজনেরা গুরুতর আহত হন। অবশেষে পুলিশি প্রহরায় বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ ক্ষমতাসীন নেতাদের চুল পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। তবে অসহায় উপজেলা যুবলীগ কর্মকর্তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে দল থেকে বহিষ্কার করেছে যুবলীগ নেতাকে। স্থানীয় চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসামিদের বাঁচাতে কৌশল অবলম্বন করেছেন, আয়োজন করলেন সম্প্রীতি সমাবেশ। ২ জানুয়ারি উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী পুলিশ সুপার, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটি, উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও খ্রিস্টান পল্লীর বাসিন্দাদের উপস্থিতিতে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বক্তারা অনেক সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দিয়েছেন- সম্প্রীতিতে সহাবস্থানের বিষয়ে উজ্জীবিত করেছেন, একে-অন্যের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সজাগ থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন।

সম্প্রীতি সভায় একটিবারের জন্য হলেও উচ্চারিত হলো না, অপরাধী যেই হোক না কেন; তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধ করলে শাস্তি অনিবার্য। বিচারের কোনো নিশ্চয়তার বাক্য, আশ^স্ত কিংবা প্রতিশ্রুতি শোনা যায়নি; এভাবেই খ্রিস্টান-হিন্দু-ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে সম্প্রীতি সভার সমাপ্তি হয়েছে। চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের জগতলা শিশু নিকেতন স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সম্প্রীতি সভা খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের শারীরিক ও মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের সাময়িক উপশম দিয়েছে কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত কী সেরেছে!

৩.

২৯ সেপ্টেম্বর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী নেতার ওপর বিরোধীপক্ষের চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। এতে প্রাক্তন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুব্রত সাংমা চিকিৎসাধীন অবস্থায় নয় দিন জীবন-মরণের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অক্টোবর ৮ তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন। তথ্যানুযায়ী, নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার সীমান্ত ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই কুল্লাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও তার লোকজন খ্রিস্টান আদিবাসীদের ওপর প্রায়শই শারীরিক নির্যাতন-অত্যাচার চালিয়েছেন। এরূপ ঘটনায় সুব্রত সাংমার বোন কেয়া তজু বাদী হয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। ১৫ জনের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক এবং আরো অজ্ঞাত ১৫-১৬ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার ধার্য দিন ৪ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট-২ এর আদালতে উপস্থিত হলে ১২ আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন পাওয়া আসামিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেন এবং মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিতে থাকেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ইউপি চেয়ারম্যান সদস্য সচিব দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতার সাথে বিজয়পুর এলাকার বিজিবির এক সোর্সের মধ্যে বির্তক শুরু হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে দুইপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরবর্তীতে এ নিয়ে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী নেতা কুল্লাগড়া ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সুব্রত সাংমা এগিয়ে এলে থেকে ওতপেতে থাকা চিহ্নিতরা তার ওপর হামলা চালায় এবং মারাত্মকভাবে জঘম করেন। উপজেলা হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো সম্ভবপর হয়নি।

ঘটনাটি রাজনৈতিক না সামাজিক এটি অবশ্যই বিবেচ্য, কোনো কোনো বিশ্লেষকরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে যাওয়া স্টিমরোলারগুলোকে রং দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। নিহত সুব্রত সাংমা জাতিতে গারো হলেও ধর্মে খ্রিস্টান। শেরপুর-ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সীমান্তে বসবাসরত খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা শতাব্দীকাল থেকেই উচ্ছেদ ও হত্যার মতো ঘটনার শিকার হয়ে আসছে। সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখার অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে; কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জিম্মি করে স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। খ্রিস্ট বিশ্বাসী গারো আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খ্রিস্টানুসারী সুব্রত সাংমার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আয়োজন আমাদের আইনের শাসনকেই মজবুত করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।

৪.

ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নে দর্জিপাড়া গ্রামে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে। ইসলাম ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার প্রায় ১৫ বছর পূর্বে। বর্তমানে তারা ‘ইভানজেলিক্যাল হলিনেস চার্চ’-এর সদস্য। ধর্ম গ্রহণের পর থেকে অ্যাডওয়ার্ড মজনুর বাড়িতেই সাপ্তাহিক উপাসনা ও ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো পালন করে আসছেন। দীর্ঘদিন এভাবে পরিবারে উপাসনা পরিচালনার পর গির্জা ঘরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সেই লক্ষ্যে ৮ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। বিপত্তি ঘটেছে নির্মাণ করতে গিয়ে, অত্র এলাকার লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আখতার হোসেনের নেতৃত্বে সদলবলে নির্মাণ কাজে বাধা প্রদান করেন। চার্চ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় থানাকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেছেন- ‘ধর্মান্তর করা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের ক্ষোভ রয়েছে। তারা উপাসনালয় নির্মাণের ব্যাপারে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও কোনো অনুমতি নেননি। এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে তাদের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’

অপরদিকে দাইন্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি এখনও দায়িত্ব পাইনি। তাছাড়া বাধা দিতেও বলিনি। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আমি প্রশাসনের কাছে যেতে বলেছি।’

দর্জিপাড়ার খ্রিস্টবিশ্বাসী মার্ক মকরম জানান, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এর আগেও তারা এলাকায় উপাসনালয় নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু ভূমি জটিলতা ও স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতায় করতে পারেননি। এবার কোনো ধরনের ঝামেলা নেই এমন জমি কিনেছেন তারা। কিন্তু উপাসনালয়ের নির্মাণ কাজ শুরুর পর এখন স্থানীয় কিছু লোক বাধা দিচ্ছেন। ইভানজেলিক্যাল হলিনেস চার্চের প্রধান কর্মকর্তা ক্ষোভের সাথেই বলেছেন- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সবারই যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে; কিন্তু এখানে উপাসনালয় নির্মাণ কাজ বন্ধ করার মধ্য দিয়ে তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’

ডিসি, পুলিশ সুপার, স্থানীয় চেয়ারম্যান বিষয়টিতে বিব্রতবোধ করেছেন। অনুরূপভাবে আরো দুই-একটি জায়গায় গির্জাঘর নির্মাণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অসহযোগিতা চরমভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কারভাবে বলে চলেছেন- ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। আমাদের সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৮ ধারাতে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বর্ণিত রয়েছে। সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সরকার দায়ভার এড়াতে পারেন না।

[লেখক : কলামিস্ট]

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৬ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

কেমন আছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়

মিথুশিলাক মুরমু

১.

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দের বড়দিনের দিনে রাজশাহীর উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রালে সকালে গির্জার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই এক ব্যক্তি কুরআন শরিফ গির্জা ঘরে রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। গির্জায় দুই-একজন থাকায় একপ্রকার জোরপূর্বক কুরআন শরিফ রেখে চলে আসলে খ্রিস্টভক্তরা দেরি না করেই স্থানীয় কাশিয়াডাঙ্গা থানাকে অবহিত করা হলে শীঘ্রই পুলিশ উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে উঠে, সংগ্রহ করে ভিডিও ফুটেজ এবং দুপুর ১২টা নাগাদই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হন। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি নিজেকে ঈসা নবী হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন। এতে অনুমিত হয় যে, রাজশাহীতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্যে একশ্রেণীর ধর্মান্ধরা বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন অত্র এলাকায় থেকেছি, দেখেছি খ্রিস্টান সম্প্রদায় কিছু জায়গা-জমি ক্রয় করে গড়ে তুলেছেন হাইস্কুল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, রোগীদের নিরাময় কেন্দ্র, এতিম ছেলেমেয়েদের জন্য হোমসহ অসংখ্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। ক্যাথিড্রালের আশপাশে খ্রিস্টবিশ্ববাসীদের পুনর্বাসন করা হয়েছে, গড়ে ওঠেছে আরো কতকগুলো গ্রাম। বাগানপাড়া, আলীগঞ্জ, পূর্ব টালিপাড়া, পশ্চিম টালিপাড়াগুলোতে আনুমানিক সহস্রখানিক পরিবার বসবাস করেছে; মোটকথা এলাকাটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত। খ্রিস্টান জনঅধ্যুষিত হলেও তাদের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে শঙ্কা ও পারস্পারিক অবিশ্বাস। তাহলে কেন এরূপ জায়গাটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল?

রাজশাহীর ক্যাথিড্রালটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নাটোর মহাসড়কের পার্শ্বে অবস্থিত। ক্যাথিড্রলটিতে ‘কুরআন শরিফ’ বির্তক সত্যিকার অর্থে রূপায়িত সম্ভব হলে লঙ্কাকা- সহজেই সম্ভবপর ছিলো।

রাজশাহীকে বেছে নেওয়ার সুবিধাদি হলো এটি বিভাগীয় নগর ও শিক্ষানগরী। রাজশাহী শহরের সাথে নরওয়ের খ্রিস্টান সেনসিটির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। শহরের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর দুর্ঘটনা হলে সহজেই বিশ্বব্যাপী নিউজ কাভার ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া যেত।

২৫ জানুয়ারি ২০২১ সালে রাজশাহী মহানগরীর ১৭নং ওয়ার্ডের আওতাধীন বড়বনগ্রাম কুচপাড়ায় হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এছাড়াও সিটি করপোরেশন এলাকায় ‘মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী’ রয়েছে। ধর্মান্ধরা মনে করতে পারেন, রাজশাহী সিটি মেয়র ও অন্যান্যরা খ্রিস্টানদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সুবিধাদি প্রদান করছেন।

২.

বড়দিনের পরের দিন অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর পাবনার চাটমোহর জগতলা গ্রামের উৎসবের আমেজেই বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মূলত বড়দিনকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, এ সময় দূরে-নিকটের আত্মীয়-স্বজনরা কর্মক্ষেত্র থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে থাকেন। গ্রামের মৃত সুবল গমেজের ছেলে সনি গমেজের বিয়েতে সেদিন রাতে গ্রামের ও আত্মীয়-স্বজনরা আনন্দে নাচগানে মেতে উঠেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামের ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মেয়েদের সাথে নাচতে উদ্যত হলে অনেকেই আপত্তি তোলেন ও নিষেধ করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সনি গমেজের চাচা সুব্রত গমেজের গায়ে হাত তোলে, মুহূর্তেই আনন্দঘন পরিবেশ বিষাদে পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতার পরিচয় দিতে কার্পণ্যবোধ করেনি।

পরের দিন ২৭ ডিসেম্বর সকালে দলবল নিয়ে দ্বিতীয় দফা হামলা চালায়; এতে পরিবারের লোকজন ও নিকটজনেরা গুরুতর আহত হন। অবশেষে পুলিশি প্রহরায় বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ ক্ষমতাসীন নেতাদের চুল পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। তবে অসহায় উপজেলা যুবলীগ কর্মকর্তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে দল থেকে বহিষ্কার করেছে যুবলীগ নেতাকে। স্থানীয় চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসামিদের বাঁচাতে কৌশল অবলম্বন করেছেন, আয়োজন করলেন সম্প্রীতি সমাবেশ। ২ জানুয়ারি উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী পুলিশ সুপার, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটি, উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও খ্রিস্টান পল্লীর বাসিন্দাদের উপস্থিতিতে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বক্তারা অনেক সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দিয়েছেন- সম্প্রীতিতে সহাবস্থানের বিষয়ে উজ্জীবিত করেছেন, একে-অন্যের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সজাগ থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন।

সম্প্রীতি সভায় একটিবারের জন্য হলেও উচ্চারিত হলো না, অপরাধী যেই হোক না কেন; তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধ করলে শাস্তি অনিবার্য। বিচারের কোনো নিশ্চয়তার বাক্য, আশ^স্ত কিংবা প্রতিশ্রুতি শোনা যায়নি; এভাবেই খ্রিস্টান-হিন্দু-ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে সম্প্রীতি সভার সমাপ্তি হয়েছে। চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের জগতলা শিশু নিকেতন স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সম্প্রীতি সভা খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের শারীরিক ও মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের সাময়িক উপশম দিয়েছে কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত কী সেরেছে!

৩.

২৯ সেপ্টেম্বর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী নেতার ওপর বিরোধীপক্ষের চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। এতে প্রাক্তন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুব্রত সাংমা চিকিৎসাধীন অবস্থায় নয় দিন জীবন-মরণের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অক্টোবর ৮ তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন। তথ্যানুযায়ী, নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার সীমান্ত ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই কুল্লাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও তার লোকজন খ্রিস্টান আদিবাসীদের ওপর প্রায়শই শারীরিক নির্যাতন-অত্যাচার চালিয়েছেন। এরূপ ঘটনায় সুব্রত সাংমার বোন কেয়া তজু বাদী হয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। ১৫ জনের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক এবং আরো অজ্ঞাত ১৫-১৬ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার ধার্য দিন ৪ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট-২ এর আদালতে উপস্থিত হলে ১২ আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন পাওয়া আসামিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেন এবং মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিতে থাকেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ইউপি চেয়ারম্যান সদস্য সচিব দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতার সাথে বিজয়পুর এলাকার বিজিবির এক সোর্সের মধ্যে বির্তক শুরু হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে দুইপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরবর্তীতে এ নিয়ে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী নেতা কুল্লাগড়া ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সুব্রত সাংমা এগিয়ে এলে থেকে ওতপেতে থাকা চিহ্নিতরা তার ওপর হামলা চালায় এবং মারাত্মকভাবে জঘম করেন। উপজেলা হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো সম্ভবপর হয়নি।

ঘটনাটি রাজনৈতিক না সামাজিক এটি অবশ্যই বিবেচ্য, কোনো কোনো বিশ্লেষকরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে যাওয়া স্টিমরোলারগুলোকে রং দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। নিহত সুব্রত সাংমা জাতিতে গারো হলেও ধর্মে খ্রিস্টান। শেরপুর-ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সীমান্তে বসবাসরত খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা শতাব্দীকাল থেকেই উচ্ছেদ ও হত্যার মতো ঘটনার শিকার হয়ে আসছে। সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখার অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে; কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জিম্মি করে স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। খ্রিস্ট বিশ্বাসী গারো আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খ্রিস্টানুসারী সুব্রত সাংমার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আয়োজন আমাদের আইনের শাসনকেই মজবুত করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।

৪.

ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নে দর্জিপাড়া গ্রামে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে। ইসলাম ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার প্রায় ১৫ বছর পূর্বে। বর্তমানে তারা ‘ইভানজেলিক্যাল হলিনেস চার্চ’-এর সদস্য। ধর্ম গ্রহণের পর থেকে অ্যাডওয়ার্ড মজনুর বাড়িতেই সাপ্তাহিক উপাসনা ও ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো পালন করে আসছেন। দীর্ঘদিন এভাবে পরিবারে উপাসনা পরিচালনার পর গির্জা ঘরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সেই লক্ষ্যে ৮ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। বিপত্তি ঘটেছে নির্মাণ করতে গিয়ে, অত্র এলাকার লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আখতার হোসেনের নেতৃত্বে সদলবলে নির্মাণ কাজে বাধা প্রদান করেন। চার্চ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় থানাকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেছেন- ‘ধর্মান্তর করা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের ক্ষোভ রয়েছে। তারা উপাসনালয় নির্মাণের ব্যাপারে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও কোনো অনুমতি নেননি। এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে তাদের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’

অপরদিকে দাইন্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি এখনও দায়িত্ব পাইনি। তাছাড়া বাধা দিতেও বলিনি। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আমি প্রশাসনের কাছে যেতে বলেছি।’

দর্জিপাড়ার খ্রিস্টবিশ্বাসী মার্ক মকরম জানান, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এর আগেও তারা এলাকায় উপাসনালয় নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু ভূমি জটিলতা ও স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতায় করতে পারেননি। এবার কোনো ধরনের ঝামেলা নেই এমন জমি কিনেছেন তারা। কিন্তু উপাসনালয়ের নির্মাণ কাজ শুরুর পর এখন স্থানীয় কিছু লোক বাধা দিচ্ছেন। ইভানজেলিক্যাল হলিনেস চার্চের প্রধান কর্মকর্তা ক্ষোভের সাথেই বলেছেন- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সবারই যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে; কিন্তু এখানে উপাসনালয় নির্মাণ কাজ বন্ধ করার মধ্য দিয়ে তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’

ডিসি, পুলিশ সুপার, স্থানীয় চেয়ারম্যান বিষয়টিতে বিব্রতবোধ করেছেন। অনুরূপভাবে আরো দুই-একটি জায়গায় গির্জাঘর নির্মাণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অসহযোগিতা চরমভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কারভাবে বলে চলেছেন- ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। আমাদের সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৮ ধারাতে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বর্ণিত রয়েছে। সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সরকার দায়ভার এড়াতে পারেন না।

[লেখক : কলামিস্ট]