চকরিয়ায় চিংড়িজোনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দখলবাজ সন্ত্রাসী

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনে প্রতিবছর উৎপাদন মৌসুমে ঘটে চিংড়িঘের জবরদখল ও মাছ লুটের ঘটনা। ভুক্তভোগী চিংড়িচাষিদের অভিযোগ, জোর যার ঘের তার নীতিতে চলছে উপজেলার চিংড়িজোন এলাকা। এতে এক ধরনের জিন্মিদশায় রয়েছেন ঘেরমালিক ও চাষীরা। আর নিত্য জবরদখল, ডাকাতি ও লুটপাটের কারণে পুঁজি বিনিয়োগ করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর উৎপাদিত চিংড়ির লভ্যাংশ ঘরে তুলতে পারছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন ঘের মালিক ও চাষীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সুন্দরবন রেঞ্জের সাড়ে ৪৫ হাজার একর জমিতে এক সময় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (প্যারাবন) ছিল চকরিয়ায়। ১৯৭৮ সাল থেকে চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ায় অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে প্যারাবনের। সেসময়কার এক সাবেক রাষ্ট্রপতির আমলে মাত্র ৩৯ ধনাঢ্য ব্যক্তির নামে এই বিশাল ভূমি ইজারা দিলে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। পরে সাবেক আরেক রাষ্ট্রপতি সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে তাদের বাদ না দিয়ে ১০, ১১ ও ৩০ একর করে ঘের সর্বসাধারণকে চিংড়ি চাষের জন্য ইজারা দেন। তবে চিংড়ি চাষের আগের জৌলুস নেই বলে দাবি ভুক্তভোগী চাষিদের।

স্থানীয় একাধিক চিংড়ি চাষি জানিয়েছেন, ঘেরে মাসে দু’বার চিংড়ি ধরা হয়। যাকে চাষিরা স্থানীয় ভাষায় ‘জোঁ’ বলে থাকেন। প্রতি জোঁতে ১০ একর ঘেরের জন্য এক হাজার, ২০ একরের জন্য দুই হাজার ও ৩০ একরের জন্য তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদা যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে মাছ লুটপাট হয়ে যায় চোখের সামনে। প্রতিবাদ করলেই বিপদ।

জানা গেছে, গত ১২ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলা পরিষদে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন খুটাখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো আবদুর রহমান। সভায় তিনি অভিযোগ করেন, খুটাখালী ও ডুলাহাজারা ইউনিয়নের বহলতলী ঘের এলাকায় প্রতিনিয়ত ডাকাত দলের তান্ডবে অসহায় হয়ে পড়েছেন চাষিরা। তবে চিরিংগা ইউপি চেয়ারম্যান জামাল হোসেন চৌধুরীর দাবি, সওদাগরঘোনাসহ তার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাজিন ফরহান বলেন, চকরিয়া উপজেলার উপকূলের খুটাখালীতে ২৫০টি চিংড়ি ঘের, ডুলাহাজারায় ৯৫, সাহারবিলে ৫০৪, চিরিংগাতে ১ হাজার ১০৫, কোনাখালীতে ৭০, বদরখালীতে ২০২, পশ্চিম বড় ভেওলায় ২০০ ও ঢেমুশিয়ায় ৪৫টি চিংড়ি ঘের রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য বিভাগের ঘেরের সংখ্যা ৫৮৭টি।

সব মিলিয়ে চকরিয়ায় মোট চিংড়ি ঘেরের পরিমাণ ১৮ হাজার ৪৮৯ হেক্টর। একরের হিসাবে জমির পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫৩০ একর। এই বিপুল পরিমাণ চিংড়িজমি থেকে প্রতি বছর ৩৬৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার চিংড়ি আহরণ করা হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন উন্নতি ঘটেনি।

অভিযোগ রয়েছে, চিংড়ি ঘের এলাকায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের কয়েক হাজার একর জমি দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দ দেয়া ৩০০ একর জমির ঘেরটিও বেহাত। জমি দখল-বেদখল নিয়ে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। এই জমিতে দখলদাররা চিংড়ি চাষ করে লাভবান হলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

চিংড়ি চাষী চকরিয়া উপজেলা বিআরডিবির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সেলিম উল্লাহ বলেন, চিংড়ি ঘের এলাকায় এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। এ কারণে অপরাধীরা বিনা বাধায় লুটপাট, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি করে পার পাচ্ছে। চিংড়ি জোন সওদাগর ঘোনা, পালাকাটা, ডুলাহাজারা ও কোরালখালীতে দুই শতাধিক দখলবাজ সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

তবে চকরিয়া-পেকুয়া (কক্সবাজার ১) আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব জাফর আলমের ভাষ্য, স্থানীয় বাসিন্দা প্রকৃত চাষিদের বাদ দিয়ে বহিরাগতদের ঘের বরাদ্দ দেয়ায় সমস্যা হচ্ছে। যাঁরা প্রকৃত চিংড়িচাষি নন, তাদের ঘের বাতিল করলে এ সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে।

চকরিয়া থানার ওসি চন্দন কুমার চক্রবর্তী বলেন, চিংড়ি ঘের এলাকার অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নিয়মিত টহল দেয়া অনেকটা দুরূহ ব্যাপার। তবে খবর পেয়ে পুলিশ যাওয়ার আগেই নৌপথে পালিয়ে যায় এসব অস্ত্রধারী অপরাধীরা।

রবিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৭ মাঘ ১৪২৯, ২৭ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

চকরিয়ায় চিংড়িজোনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দখলবাজ সন্ত্রাসী

এম জিয়াবুল হক, চকরিয়া

image

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনে প্রতিবছর উৎপাদন মৌসুমে ঘটে চিংড়িঘের জবরদখল ও মাছ লুটের ঘটনা। ভুক্তভোগী চিংড়িচাষিদের অভিযোগ, জোর যার ঘের তার নীতিতে চলছে উপজেলার চিংড়িজোন এলাকা। এতে এক ধরনের জিন্মিদশায় রয়েছেন ঘেরমালিক ও চাষীরা। আর নিত্য জবরদখল, ডাকাতি ও লুটপাটের কারণে পুঁজি বিনিয়োগ করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর উৎপাদিত চিংড়ির লভ্যাংশ ঘরে তুলতে পারছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন ঘের মালিক ও চাষীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সুন্দরবন রেঞ্জের সাড়ে ৪৫ হাজার একর জমিতে এক সময় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (প্যারাবন) ছিল চকরিয়ায়। ১৯৭৮ সাল থেকে চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ায় অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে প্যারাবনের। সেসময়কার এক সাবেক রাষ্ট্রপতির আমলে মাত্র ৩৯ ধনাঢ্য ব্যক্তির নামে এই বিশাল ভূমি ইজারা দিলে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। পরে সাবেক আরেক রাষ্ট্রপতি সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে তাদের বাদ না দিয়ে ১০, ১১ ও ৩০ একর করে ঘের সর্বসাধারণকে চিংড়ি চাষের জন্য ইজারা দেন। তবে চিংড়ি চাষের আগের জৌলুস নেই বলে দাবি ভুক্তভোগী চাষিদের।

স্থানীয় একাধিক চিংড়ি চাষি জানিয়েছেন, ঘেরে মাসে দু’বার চিংড়ি ধরা হয়। যাকে চাষিরা স্থানীয় ভাষায় ‘জোঁ’ বলে থাকেন। প্রতি জোঁতে ১০ একর ঘেরের জন্য এক হাজার, ২০ একরের জন্য দুই হাজার ও ৩০ একরের জন্য তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদা যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে মাছ লুটপাট হয়ে যায় চোখের সামনে। প্রতিবাদ করলেই বিপদ।

জানা গেছে, গত ১২ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলা পরিষদে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন খুটাখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো আবদুর রহমান। সভায় তিনি অভিযোগ করেন, খুটাখালী ও ডুলাহাজারা ইউনিয়নের বহলতলী ঘের এলাকায় প্রতিনিয়ত ডাকাত দলের তান্ডবে অসহায় হয়ে পড়েছেন চাষিরা। তবে চিরিংগা ইউপি চেয়ারম্যান জামাল হোসেন চৌধুরীর দাবি, সওদাগরঘোনাসহ তার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাজিন ফরহান বলেন, চকরিয়া উপজেলার উপকূলের খুটাখালীতে ২৫০টি চিংড়ি ঘের, ডুলাহাজারায় ৯৫, সাহারবিলে ৫০৪, চিরিংগাতে ১ হাজার ১০৫, কোনাখালীতে ৭০, বদরখালীতে ২০২, পশ্চিম বড় ভেওলায় ২০০ ও ঢেমুশিয়ায় ৪৫টি চিংড়ি ঘের রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য বিভাগের ঘেরের সংখ্যা ৫৮৭টি।

সব মিলিয়ে চকরিয়ায় মোট চিংড়ি ঘেরের পরিমাণ ১৮ হাজার ৪৮৯ হেক্টর। একরের হিসাবে জমির পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫৩০ একর। এই বিপুল পরিমাণ চিংড়িজমি থেকে প্রতি বছর ৩৬৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার চিংড়ি আহরণ করা হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন উন্নতি ঘটেনি।

অভিযোগ রয়েছে, চিংড়ি ঘের এলাকায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের কয়েক হাজার একর জমি দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দ দেয়া ৩০০ একর জমির ঘেরটিও বেহাত। জমি দখল-বেদখল নিয়ে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। এই জমিতে দখলদাররা চিংড়ি চাষ করে লাভবান হলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

চিংড়ি চাষী চকরিয়া উপজেলা বিআরডিবির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সেলিম উল্লাহ বলেন, চিংড়ি ঘের এলাকায় এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। এ কারণে অপরাধীরা বিনা বাধায় লুটপাট, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি করে পার পাচ্ছে। চিংড়ি জোন সওদাগর ঘোনা, পালাকাটা, ডুলাহাজারা ও কোরালখালীতে দুই শতাধিক দখলবাজ সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

তবে চকরিয়া-পেকুয়া (কক্সবাজার ১) আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব জাফর আলমের ভাষ্য, স্থানীয় বাসিন্দা প্রকৃত চাষিদের বাদ দিয়ে বহিরাগতদের ঘের বরাদ্দ দেয়ায় সমস্যা হচ্ছে। যাঁরা প্রকৃত চিংড়িচাষি নন, তাদের ঘের বাতিল করলে এ সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে।

চকরিয়া থানার ওসি চন্দন কুমার চক্রবর্তী বলেন, চিংড়ি ঘের এলাকার অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নিয়মিত টহল দেয়া অনেকটা দুরূহ ব্যাপার। তবে খবর পেয়ে পুলিশ যাওয়ার আগেই নৌপথে পালিয়ে যায় এসব অস্ত্রধারী অপরাধীরা।