নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন। দুই বছর আগে পাস হওয়া আইন অনুযায়ী কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি প্রেসিডেন্টের অনুমোদনে গঠিত হবে। আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের পদে নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি তাদের মনোনীত নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আরও ৪ জন কমিশনার নিয়ে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের আয়োজন করা এবং অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাই নির্বাচন কমিশনের মুখ্য দায়িত্ব। অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ ইত্যাদি।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই কমিশন গঠিত হয় বিধায় দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন থাকবে স্বাধীন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ‘নির্বাচন কমিশন’ স্বাধীন বিধায় এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালনের সুবিধার্থে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয়ও রয়েছে। নির্বাচনসহ অন্যান্য কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সব প্রকার সহায়তা সংবিধানের ১২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ মোতাবেক সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য। খরচের ক্ষেত্রেও কমিশনের নিজস্ব এখতিয়ার রয়েছেÑ অনুমোদিত বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য নির্ধারিত খাতে দেয়া বরাদ্দ থেকে অর্থ ব্যয়ে নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত অনুমোদন কর্তৃপক্ষ। নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়ার পর সরকার ইচ্ছে করলেই বাদ দিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারককে অপসারণ করতে হলে যে কারণ এবং পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রয়োজন হয় সেই একই কারণ এবং পদ্ধতি নির্বাচন কমিশনারের অপসারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কমিশনাররা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন সেজন্য তাদের অপসারণে জটিল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অনুসরণের শর্ত সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়েছে। অসীম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের আজ্ঞাবহ থাকার অভিযোগ ওঠে।

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত সদ্যবিদায়ী নির্বাচন কমিশনের আমলে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল বলে শোনা যায়নি, তাদের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের বাকি ৬৬৮৭টি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম আর সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে এই কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। বিদায়ী কমিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। বিদায়ী কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা অস্বীকার করেছেন, তিনি তাদের সফল কমিশন হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব ছিল, কোন অভিযোগ সুরাহা করার ব্যাপারে তার মনোযোগ ছিল বলে জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যারা নির্বাচন পরিচালনা করেছেন তাদের প্রতিবেদনকেই চূড়ান্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন, পত্র-পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যকে তিনি কোন গুরুত্বই দেননি; অবশ্য এটাই আইন সম্মত। কিন্তু মানুষ তো রোবট নয়, শুধু আইন দিয়ে কাজ সমাধা করলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না, বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগাতে হয়।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে সংঘটিত সহিংসতা সেনাবাহিনী নিয়োজিত করলে হ্রাস পেত, কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার সাফ কথা, সে দায় তাদের নয়। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার তথ্যও তিনি গ্রহণ করেননি। তবে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার ছিল না। বিএনপির আমলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বহু প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করলে এমন হবেই। নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করতে ক্ষমতাসীন দল ভোট কাস্টিং বেশি দেখাবেই, কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্বাচনকে অর্থবহ করে তুলে ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা প্রমাণে তা অপরিহার্য; কিন্তু এমন অপকর্মে নির্বাচন কমিশন কেন সহায়তা করে তা জনতা আজও বুঝতে পারেনি। শুধু যে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি বা ২০১৮ সনের নির্বাচনে এমন হয়েছে তা কিন্তু নয়, দলীয় সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই একই অবস্থা। দিনের ভোট রাতে না হলেও সিল মেরে ব্যালট পেপার দিয়ে বাক্স ভর্তি করার কারণে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরাও বিএনপির আমলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। মাগুরা নির্বাচনে দিনে দুপুরে যেভাবে বিএনপি জনসম্মুখে সিল মেরে ভোটের বাক্স ভর্তি করেছিল তা দেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ মাগুরা সার্কেট হাউস থেকে লজ্জায় পালিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিএনপি সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন বলে তিনি ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। বিরোধী দলের অনুপস্থিততে এরশাদ সাহেবের আমলে সকাল ১১টার মধ্যে সব ভোট কাস্ট হয়ে যেত। এসব অপকর্ম সব দলীয় সরকারের আমলে হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন তা বিনা প্রশ্নে জায়েজ করেছে। নির্বাচন কমিশনের এত স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ কখনো হয়নি।

বিরোধী দল বিএনপি নবগঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে খুব বেশি উদগ্রীব মনে হচ্ছে না, কারণ তারা চায় দল নিরপেক্ষ সরকার। বিএনপি মনে করে, সরকার নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে সমর্থ হবে না; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন দল নিরপেক্ষ সরকার। অবশ্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে বিএনপির কর্মকা-ও ভালো ছিল না। নির্বাচনে সুবিধা লাভের আশায় ২০০৫ সনে বিএনপি কারো সঙ্গে কোন আলাপ আলোচনা না করেই আপিল বিভাগের বিচারপতি এমএ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছিলেন না, বিচারপতির পদে থাকা অবস্থায় তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করায় পরবর্তীকালে উচ্চ আদালত এই নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে। আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়ার বিধান অবশ্য তখন ছিল না। এই নির্বাচন কমিশনার পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর পর কোন বাকবিত-া ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সরে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য হলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার কলাকৌশল আবিষ্কারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলেন। নির্বাচনী মাঠে শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীদের ঘর ছাড়া করা হয়েছিল, ফলে নির্বাচনে যা হবার তাই হয়েছে, বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এমন পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে নির্বাচনী মাঠ বিএনপির দখলে চলে যায়, ফলে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি, নির্বাচন কমিশন ছিল সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়ার আগে বিএনপি বিচারপতিদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে দেয় যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তাদের আজ্ঞাবহ হয়। প্রধান উপদেষ্টাকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করার ব্যাপারে বিএনপির পরিকল্পনা বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনে ভ-ুল হয়ে গেলে তারা অন্য পরিকল্পনায় তাদের দলীয় প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকেই তাৎপর্যহীন করে তোলে। এই অবস্থায় ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার। এই সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুব বেশি অনুভূত হয়নি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দল সেনা সমর্থিত সরকারের যাঁতাকলে পড়েছিল; তবে বিএনপি থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করায় বিএনপির প্রতি ফখরউদ্দিন সরকারের আক্রোশ ছিল অধিক। ফলে লতিফুর রহমানের সময় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে অবস্থা হয়েছিল, বিএনপির একই অবস্থা হয়েছিল ফখরউদ্দিন সরকারের আমলে। এই সময়ের নির্বাচন কমিশন নিয়েও কেউ উচ্চবাচ্য করেনি।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, নির্বাচনের সময় দলীয় সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো দায়িত্ব পালন করে, জাতীয় ইস্যু নিয়ে নীতিনির্ধারণমূলক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না, কারণ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মুহাম্মদ ইদ্রিসও নির্বাচনের মাঠকে ভয়ভীতি মুক্ত রাখতে পারেননি। তারপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি নূরুল ইসলাম এবং বিচারপতি এ টি এম মাসুদ ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের আজ্ঞাবহ। পরবর্তীকালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, বিচারপতি আবদুর রউফ, বিচারপতি সাদেক, মোহাম্মদ আবু হেনা, এম এ সাঈদ, বিচারপতি এম এ আজিজ, এ টি এম শামসুল হুদা, কে এম নুরুল হুদা কেউই বিরোধীদল এবং নির্বাচনে পরাজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। কারণ এরা কেউই ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশনের মতো বলতে পারেননি যে, নির্বাচনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত ও আজ্ঞাবহ ছিল। কোন দলের প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাগ আচরণে নির্বাচন কমিশন বাধা দেয়নি, বলেনি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতমূলক অযাচিত হস্তক্ষেপে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপ রুখে দিয়ে জনগণের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার কোন সুযোগ নেই। সংসদে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করার সুযোগ থাকলেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার কোন বিকল্প নেই।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৭ মাঘ ১৪২৯, ২৭ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন। দুই বছর আগে পাস হওয়া আইন অনুযায়ী কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি প্রেসিডেন্টের অনুমোদনে গঠিত হবে। আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের পদে নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি তাদের মনোনীত নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আরও ৪ জন কমিশনার নিয়ে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের আয়োজন করা এবং অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাই নির্বাচন কমিশনের মুখ্য দায়িত্ব। অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ ইত্যাদি।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই কমিশন গঠিত হয় বিধায় দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন থাকবে স্বাধীন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ‘নির্বাচন কমিশন’ স্বাধীন বিধায় এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালনের সুবিধার্থে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয়ও রয়েছে। নির্বাচনসহ অন্যান্য কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সব প্রকার সহায়তা সংবিধানের ১২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ মোতাবেক সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য। খরচের ক্ষেত্রেও কমিশনের নিজস্ব এখতিয়ার রয়েছেÑ অনুমোদিত বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য নির্ধারিত খাতে দেয়া বরাদ্দ থেকে অর্থ ব্যয়ে নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত অনুমোদন কর্তৃপক্ষ। নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়ার পর সরকার ইচ্ছে করলেই বাদ দিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারককে অপসারণ করতে হলে যে কারণ এবং পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রয়োজন হয় সেই একই কারণ এবং পদ্ধতি নির্বাচন কমিশনারের অপসারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কমিশনাররা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন সেজন্য তাদের অপসারণে জটিল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অনুসরণের শর্ত সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়েছে। অসীম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের আজ্ঞাবহ থাকার অভিযোগ ওঠে।

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত সদ্যবিদায়ী নির্বাচন কমিশনের আমলে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল বলে শোনা যায়নি, তাদের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের বাকি ৬৬৮৭টি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম আর সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে এই কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। বিদায়ী কমিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। বিদায়ী কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা অস্বীকার করেছেন, তিনি তাদের সফল কমিশন হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব ছিল, কোন অভিযোগ সুরাহা করার ব্যাপারে তার মনোযোগ ছিল বলে জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যারা নির্বাচন পরিচালনা করেছেন তাদের প্রতিবেদনকেই চূড়ান্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন, পত্র-পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যকে তিনি কোন গুরুত্বই দেননি; অবশ্য এটাই আইন সম্মত। কিন্তু মানুষ তো রোবট নয়, শুধু আইন দিয়ে কাজ সমাধা করলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না, বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগাতে হয়।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে সংঘটিত সহিংসতা সেনাবাহিনী নিয়োজিত করলে হ্রাস পেত, কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার সাফ কথা, সে দায় তাদের নয়। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার তথ্যও তিনি গ্রহণ করেননি। তবে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার ছিল না। বিএনপির আমলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বহু প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করলে এমন হবেই। নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করতে ক্ষমতাসীন দল ভোট কাস্টিং বেশি দেখাবেই, কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্বাচনকে অর্থবহ করে তুলে ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা প্রমাণে তা অপরিহার্য; কিন্তু এমন অপকর্মে নির্বাচন কমিশন কেন সহায়তা করে তা জনতা আজও বুঝতে পারেনি। শুধু যে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি বা ২০১৮ সনের নির্বাচনে এমন হয়েছে তা কিন্তু নয়, দলীয় সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই একই অবস্থা। দিনের ভোট রাতে না হলেও সিল মেরে ব্যালট পেপার দিয়ে বাক্স ভর্তি করার কারণে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরাও বিএনপির আমলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। মাগুরা নির্বাচনে দিনে দুপুরে যেভাবে বিএনপি জনসম্মুখে সিল মেরে ভোটের বাক্স ভর্তি করেছিল তা দেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ মাগুরা সার্কেট হাউস থেকে লজ্জায় পালিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিএনপি সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন বলে তিনি ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। বিরোধী দলের অনুপস্থিততে এরশাদ সাহেবের আমলে সকাল ১১টার মধ্যে সব ভোট কাস্ট হয়ে যেত। এসব অপকর্ম সব দলীয় সরকারের আমলে হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন তা বিনা প্রশ্নে জায়েজ করেছে। নির্বাচন কমিশনের এত স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ কখনো হয়নি।

বিরোধী দল বিএনপি নবগঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে খুব বেশি উদগ্রীব মনে হচ্ছে না, কারণ তারা চায় দল নিরপেক্ষ সরকার। বিএনপি মনে করে, সরকার নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে সমর্থ হবে না; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন দল নিরপেক্ষ সরকার। অবশ্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে বিএনপির কর্মকা-ও ভালো ছিল না। নির্বাচনে সুবিধা লাভের আশায় ২০০৫ সনে বিএনপি কারো সঙ্গে কোন আলাপ আলোচনা না করেই আপিল বিভাগের বিচারপতি এমএ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছিলেন না, বিচারপতির পদে থাকা অবস্থায় তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করায় পরবর্তীকালে উচ্চ আদালত এই নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে। আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়ার বিধান অবশ্য তখন ছিল না। এই নির্বাচন কমিশনার পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর পর কোন বাকবিত-া ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সরে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য হলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার কলাকৌশল আবিষ্কারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলেন। নির্বাচনী মাঠে শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীদের ঘর ছাড়া করা হয়েছিল, ফলে নির্বাচনে যা হবার তাই হয়েছে, বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এমন পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে নির্বাচনী মাঠ বিএনপির দখলে চলে যায়, ফলে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি, নির্বাচন কমিশন ছিল সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়ার আগে বিএনপি বিচারপতিদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে দেয় যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তাদের আজ্ঞাবহ হয়। প্রধান উপদেষ্টাকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করার ব্যাপারে বিএনপির পরিকল্পনা বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনে ভ-ুল হয়ে গেলে তারা অন্য পরিকল্পনায় তাদের দলীয় প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকেই তাৎপর্যহীন করে তোলে। এই অবস্থায় ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার। এই সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুব বেশি অনুভূত হয়নি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দল সেনা সমর্থিত সরকারের যাঁতাকলে পড়েছিল; তবে বিএনপি থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করায় বিএনপির প্রতি ফখরউদ্দিন সরকারের আক্রোশ ছিল অধিক। ফলে লতিফুর রহমানের সময় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে অবস্থা হয়েছিল, বিএনপির একই অবস্থা হয়েছিল ফখরউদ্দিন সরকারের আমলে। এই সময়ের নির্বাচন কমিশন নিয়েও কেউ উচ্চবাচ্য করেনি।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, নির্বাচনের সময় দলীয় সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো দায়িত্ব পালন করে, জাতীয় ইস্যু নিয়ে নীতিনির্ধারণমূলক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না, কারণ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মুহাম্মদ ইদ্রিসও নির্বাচনের মাঠকে ভয়ভীতি মুক্ত রাখতে পারেননি। তারপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি নূরুল ইসলাম এবং বিচারপতি এ টি এম মাসুদ ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের আজ্ঞাবহ। পরবর্তীকালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, বিচারপতি আবদুর রউফ, বিচারপতি সাদেক, মোহাম্মদ আবু হেনা, এম এ সাঈদ, বিচারপতি এম এ আজিজ, এ টি এম শামসুল হুদা, কে এম নুরুল হুদা কেউই বিরোধীদল এবং নির্বাচনে পরাজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। কারণ এরা কেউই ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশনের মতো বলতে পারেননি যে, নির্বাচনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত ও আজ্ঞাবহ ছিল। কোন দলের প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাগ আচরণে নির্বাচন কমিশন বাধা দেয়নি, বলেনি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতমূলক অযাচিত হস্তক্ষেপে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপ রুখে দিয়ে জনগণের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার কোন সুযোগ নেই। সংসদে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের নিয়ে সরকার গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করার সুযোগ থাকলেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার কোন বিকল্প নেই।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]