মগবাজারের ওয়্যারলেসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ : ‘জঙ্গি গোষ্ঠী’ ঘিরে সন্দেহ

রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটে সেন্ট মেরিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ময়লার ড্রামের ভেতরে রেখে যাওয়া বিস্ফোরকদ্রব্য থেকে বিস্ফোরণে ৫ জন আহত হওয়ায় এর নেপথ্যে কারা রয়েছে তা তথ্যানুসন্ধান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট ও গোয়েন্দারা এ নিয়ে কাজ করছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটির শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বলিস্থলের পাশে কারা কি উদ্দেশে অভিনব কায়দায় বিস্ফোরক রেখেছিল এ নিয়ে খোঁজখবর চলছে। ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ থেকে ক্লু খোঁজা হচ্ছে। চলছে গোয়েন্দা কার্যক্রমও। এরমধ্যে ঘটনার নেপথ্যে কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর হাত রয়েছে এমন সন্দেহ থেকে তদন্ত করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

ঘটনাস্থল সংলগ্ন বহুতল ভবনের গার্লস হোস্টেল ঘিরেও রয়েছে সন্দেহ। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আশপাশে ছড়িয়ে আছে স্প্লিন্টার। সেখানে প্রায় কাছাকাছি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আছে বিদ্যুতের একটি উপকেন্দ্র। নাশকতার উদ্দেশ্যে বা আতঙ্ক ছড়াতে বর্জ্যরে ড্রামে বিস্ফোরক রাখার ঘটনা এটাই প্রথম বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল সকালে বিস্ফোরণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট ও র‌্যাব। তবে, কোন সংস্থাই নিশ্চিত করেনি, এটি কি ধরনের বিস্ফোরণ ছিল।

সিটিটিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিস্ফোরণটি ককটেল নাকি ইম্প্রুভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) থেকে ঘটেছে সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। তবে, প্রাথমিকভাবে তাদের মনে হয়ে হয়েছে ড্রামটিকে একাধিক উন্নত ধরনের ককটেল ছিল। ড্রামটিতে নাড়া লাগার পরে সেটি বিস্ফোরিত হয়। সূত্রটির দাবি, এটি আইইডি বিস্ফোরণ হলে বিস্ফোরণে আরও ভয়ঙ্কর তা-ব দেখা যেত। সেখানে কিছুটা গর্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে ককটেল বিস্ফোরণ হলেও এটি কোন জঙ্গি সংগঠনের কাজ হতে পারে। আবারও আতঙ্ক ছড়াতে অন্য কেউ সেটি ঘটাতে পারে। একটি সূত্র জানিয়েছে, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে গার্লস হোস্টেলে সর্বশেষ কারা কারা উঠেছে তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ওয়্যারলেস এলাকায়। আহত হয় প্রকৌশলীসহ ৫ জন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, ড্রামটিকে ভাঙারি দোকানে নিতে যাওয়া কর্মচারী আতিকুল ইসলাম, ঘটনাস্থলের পাশে ডিপিডিসির ক্যাবল স্থাপনে নিয়োজিত শ্রমিক তারেক, শাহিন ও আবুল কালাম। এদের মধ্যে আতিকুলের সমস্ত শরীরেই বিস্ফোরণের আঘাত লেগেছে। বিশেষ করে তার ডান পা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডান পায়ের দুটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

ভাঙারির দোকানে মালিকের বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়া জানান, বিস্ফোরণ হওয়া ফার্স্ট ফার্মা ও তাদের ভাঙারির দোকান ২০-৩০ গজ দূরত্ব। সকালে আতিকুলকে ফার্মেসির কেউ বলেছিল দোকানের সামনে থাকা ড্রামটি একেবারে নিয়ে যেতে। এজন্য সে ড্রামটি আনার জন্য গিয়েছিল। ড্রামটি ধরতেই বিস্ফোরণ ঘটে। আহত সাইফুল ইসলাম জানান, তার বাসা সবুজবাগের বাসাবোতে। মগবাজারে অগ্রণী অ্যাপার্টমেন্টের প্রকৌশলীর দায়িত্ব রয়েছেন তিনি। অফিসের উদ্দেশে সকালে বাসে করে বাসা থেকে মগবাজার ওয়্যারলেস গেটে যান। ওয়্যারলেস গেট উজ্জ্বল হোটেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। তখন তিনি রাস্তায় পড়ে যান। পরক্ষণে তার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে দেখেন। পরে পথচারীরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সেন্ট মেরিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভবনটি ৬ তলা বিশিষ্ট। নিচতলায় থেকে ৩য় তলা পর্যন্ত পরিচালিত হয় স্কুলের কার্যক্রম। এর উপরের তলাগুলোতে গার্লস হোস্টেল। নিচতলায় ফার্স্ট ফার্মা লিমিটেড নামে ফার্মেসি ও মেট্রো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নামে একটি দোকান রয়েছে। ফার্স্ট ফার্মার পাশ দিয়েই স্কুলে প্রবেশের গেট এবং গেটেই স্কুল শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বেলি করার জায়গা। অ্যাসেম্বেলি জায়গা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের ২য় ও ৩য় তলাগুলোতে থাকা ক্লাসরুমে উঠার জায়গা। এই ভবনের সঙ্গে পাশেই রমনা কিড্স কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অবস্থান। এই দুই স্কুলের বিপরীত পাশে রয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) উপকেন্দ্র। স্কুল ও উপকেন্দ্রের মাঝামাঝি সড়কের একপাশ খুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে হাই ভোল্টেজ ক্যাবল।

ফার্স্ট ফার্মা লিমিটেড নামের ফার্মেসির সামনে ফুটপাত ঘেঁষে রাখা হয়েছিল ড্রামটি। বিস্ফোরণে ফুটপাতের বেশ খানিক আস্তরণ উঠে গেছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ফার্মেসিটির থাই-গ্লাস, ঝুলে পড়েছে শাটারের একাংশও। ফার্মেসির ভেতরে থাকা টিউবলাইটগুলো ভেঙে গেছে। দোকানের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ওষুধপত্র। ভবনের ৪র্থ তলা পর্যন্ত জানালার গ্লাস ভেঙে গেছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে স্কুলটির ব্যানার। বিস্ফোরণের আশপাশে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অসংখ্য স্পিøন্টার, ছোট কাচের টুকরো এবং বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া ড্রাম ও এর ঢাকনা, টাইলস, ইটের টুকরা। এছাড়া ঘটনাস্থলে পলিথিনে থাকা কিছু আবর্জনা ও প্লাস্টিকের বোতল দেখা গেছে। ঘটনার পর থেকেই ক্রাইমসিন টেপ দিয়ে ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই বিস্ফোরণ থেকেই ভয়ানক কিছু ঘটতে পারত। ভাগ্যক্রমে সেটি ঘটেনি।

রমনা কিড্স কিন্ডার গার্টেন স্কুলের পিয়ন আবদুল আওয়াল বলেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি স্কুলের সামনে চেয়ারে বসে মোবাইল চালাচ্ছিলেন। সাড়ে ৯টার পর একটি ছোট ছেলে এসে ড্রামের ঢাকনা খোলে। তখনই সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফার্স্ট ফার্মা লিমিটেড নামে দোকানটি। আমরা ভয়ে স্কুলের ভেতরে চলে আসি। পরে কর্তৃপক্ষ দ্রুত স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়। ভবনটির নিচতলায় অবস্থিত মেট্রো ডিপার্টমেন্টার স্টোরের ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম বলেন, প্রতিদিনের মতোই সকালে দোকান খোলেন তিনি। হঠাৎ করেই বিকট শব্দ আর সাদা ধোঁয়া দেখতে পান। তখন দোকানের অন্য কর্মচারীরা ভয়ে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যায়। শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় তিনি বের হতে পারেননি।

সেন্ট মেরিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কেয়াটেকার পলাশ বলেন, কেজি থেকে ও লেভেল পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুলটিতে পড়াশোনা করেন। শুক্র ও শনিবার স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। শীতকালীন ছুটি শেষে গত ৫ জানুয়ারি থেকে স্কুল খোলা হয়। ১০টা থেকে সব শিক্ষার্থীর ক্লাস শুরু হয়। ক্লাসে যাওয়ার আগে পৌনে ১০টায় অ্যাসেম্বেলি হয়। এ সময় ভবনের নিচতলায় অবস্থান করে সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। ভবনের সামনে অভিভাবকরা অবস্থান নেয়। গত ৫ জানুয়ারি স্কুল খোলার পর আর অ্যাসেম্বলি করানো হয়নি। তবে পৌনে ১০টার দিকেই সব শিক্ষার্থী প্রবেশ করত।

এক প্রশ্নের জবাবে কেয়ারটেকার পলাশ আরও বলেন, ড্রামটি স্কুলের নয়। ৯ মাস আগে ফার্মেসিটির কাজ চলার সময় ড্রামটিতে পানি রাখা হতো। ফার্মেসি চালু হওয়ার পর স্কুলের প্রবেশমুখের গেটের পাশে রাখা হতো। সেটি খালি অবস্থাতেই পড়ে ছিল সেখানে। এজন্য জায়গাটা পরিষ্কার করার জন্য গতকাল সকাল ৯টার দিকে বাইরে নিয়ে রাখেন। ঢাকনা লাগানো থাকলেও তখন ড্রামটি খালি ছিল বলে মনে হয়েছে। এরপর ড্রাম থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে দেখে অবাক হয়েছি। ৫ম তলার গার্লস হোস্টেলে থাকা দুই শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পৌনে ১০টার দিকে ব্যাপক শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ পান। কেপে ওঠে ভবনও। পরে আতঙ্কে তারা নিচে নেমে এসে দেখেন ভবনের সামনেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) হারুন-অর রশীদ বলেন, বিস্ফোরক দ্রব্যটি ময়লা একটি প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে ছিল। ভেতর থেকে ময়লা বের করার সময় বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল থেকে স্পিøন্টারও পাওয়া গেছে। কী উদ্দেশ্যে ওই বিস্ফোরক এখানে রাখা হয়েছিল আমরা সেটা বের করার জন্য কাজ করছি।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) আসাদুজ্জামান জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, আগে থেকেই ড্রামের ভেতরে যে কেউ বিস্ফোরকটি রেখে দিয়েছিল। অসাবধানতাবশত ফেলে দেয়ার কারণে বিস্ফোরণটি ঘটে। বিস্ফোরকটিকে রেখেছিল বা কীভাবে এখানে এসেছে সেটা উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করছি। এই বিস্ফোরণের সঙ্গে কোন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কি না জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এমন কোন বিষয়ে সন্দেহ করছি না। তবে প্রাথমিকভাবে সব বিষয়কে সামনে রেখে আমরা কাজ করছি।

ডিএমপির রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) বায়েজীদুর রহমান বলেন, সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটের দিকে একটি প্লাস্টিকের ড্রাম থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ড্রামটি স্কুলের কেয়ারটেকার পলাশ ফার্মেসির সামনে রেখেছিলেন। তখন ফার্মেসির লোকজন সেখান থেকে সরিয়ে রাখতে বললে ফুটপাতের সঙ্গে মিশিয়ে রাখে। এক প্রশ্নের জবাবে এসি বলেন, ড্রামটিতে স্কুলের বিভিন্ন ড্রাই ময়লা (চিপসের খোসা, পুরনো কলম ও মার্কার, পরিত্যক্ত কাগজ) ফেলা হতো। ভাঙারি দোকানের একটি ছেলে ময়লাগুলো দেখতে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে। এটি বেশ শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে বিস্ফোরক কারা কি উদ্দেশ্যে রেখে গেলো, সেটি জানতে কিছুটা সময় লাগবে।

image

মগবাজারের ওয়্যারলেসে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্প্লিন্টার -সংবাদ

আরও খবর
সীমান্তে হত্যা বন্ধে দুই দেশই আন্তরিক : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা আজ
বিএনপির আন্দোলন দলটির নেতাদের মধ্যেই সীমিত
ভোলার গ্যাস আসবে ফেব্রুয়ারিতে
পাঠ্যবইয়ে ভুল ইচ্ছাকৃত কি না, খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি : শিক্ষামন্ত্রী
পানির স্তর নেমেছে ৩৫ ফুট, যশোরে শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই পানির জন্য হাহাকার
পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করছে সরকার : বিএনপি
গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে নীতিমালা প্রণয়ন ঢাবির
ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজায় নিয়ে আসার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট
নওগাঁর রক্তদহ বিলে ব্রিজের জন্য ভোগান্তি

বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩ , ১০ মাঘ ১৪২৯, ৩০ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

মগবাজারের ওয়্যারলেসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ : ‘জঙ্গি গোষ্ঠী’ ঘিরে সন্দেহ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

মগবাজারের ওয়্যারলেসে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্প্লিন্টার -সংবাদ

রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটে সেন্ট মেরিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ময়লার ড্রামের ভেতরে রেখে যাওয়া বিস্ফোরকদ্রব্য থেকে বিস্ফোরণে ৫ জন আহত হওয়ায় এর নেপথ্যে কারা রয়েছে তা তথ্যানুসন্ধান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট ও গোয়েন্দারা এ নিয়ে কাজ করছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটির শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বলিস্থলের পাশে কারা কি উদ্দেশে অভিনব কায়দায় বিস্ফোরক রেখেছিল এ নিয়ে খোঁজখবর চলছে। ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ থেকে ক্লু খোঁজা হচ্ছে। চলছে গোয়েন্দা কার্যক্রমও। এরমধ্যে ঘটনার নেপথ্যে কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর হাত রয়েছে এমন সন্দেহ থেকে তদন্ত করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

ঘটনাস্থল সংলগ্ন বহুতল ভবনের গার্লস হোস্টেল ঘিরেও রয়েছে সন্দেহ। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আশপাশে ছড়িয়ে আছে স্প্লিন্টার। সেখানে প্রায় কাছাকাছি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আছে বিদ্যুতের একটি উপকেন্দ্র। নাশকতার উদ্দেশ্যে বা আতঙ্ক ছড়াতে বর্জ্যরে ড্রামে বিস্ফোরক রাখার ঘটনা এটাই প্রথম বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল সকালে বিস্ফোরণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট ও র‌্যাব। তবে, কোন সংস্থাই নিশ্চিত করেনি, এটি কি ধরনের বিস্ফোরণ ছিল।

সিটিটিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিস্ফোরণটি ককটেল নাকি ইম্প্রুভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) থেকে ঘটেছে সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। তবে, প্রাথমিকভাবে তাদের মনে হয়ে হয়েছে ড্রামটিকে একাধিক উন্নত ধরনের ককটেল ছিল। ড্রামটিতে নাড়া লাগার পরে সেটি বিস্ফোরিত হয়। সূত্রটির দাবি, এটি আইইডি বিস্ফোরণ হলে বিস্ফোরণে আরও ভয়ঙ্কর তা-ব দেখা যেত। সেখানে কিছুটা গর্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে ককটেল বিস্ফোরণ হলেও এটি কোন জঙ্গি সংগঠনের কাজ হতে পারে। আবারও আতঙ্ক ছড়াতে অন্য কেউ সেটি ঘটাতে পারে। একটি সূত্র জানিয়েছে, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে গার্লস হোস্টেলে সর্বশেষ কারা কারা উঠেছে তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ওয়্যারলেস এলাকায়। আহত হয় প্রকৌশলীসহ ৫ জন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, ড্রামটিকে ভাঙারি দোকানে নিতে যাওয়া কর্মচারী আতিকুল ইসলাম, ঘটনাস্থলের পাশে ডিপিডিসির ক্যাবল স্থাপনে নিয়োজিত শ্রমিক তারেক, শাহিন ও আবুল কালাম। এদের মধ্যে আতিকুলের সমস্ত শরীরেই বিস্ফোরণের আঘাত লেগেছে। বিশেষ করে তার ডান পা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডান পায়ের দুটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

ভাঙারির দোকানে মালিকের বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়া জানান, বিস্ফোরণ হওয়া ফার্স্ট ফার্মা ও তাদের ভাঙারির দোকান ২০-৩০ গজ দূরত্ব। সকালে আতিকুলকে ফার্মেসির কেউ বলেছিল দোকানের সামনে থাকা ড্রামটি একেবারে নিয়ে যেতে। এজন্য সে ড্রামটি আনার জন্য গিয়েছিল। ড্রামটি ধরতেই বিস্ফোরণ ঘটে। আহত সাইফুল ইসলাম জানান, তার বাসা সবুজবাগের বাসাবোতে। মগবাজারে অগ্রণী অ্যাপার্টমেন্টের প্রকৌশলীর দায়িত্ব রয়েছেন তিনি। অফিসের উদ্দেশে সকালে বাসে করে বাসা থেকে মগবাজার ওয়্যারলেস গেটে যান। ওয়্যারলেস গেট উজ্জ্বল হোটেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। তখন তিনি রাস্তায় পড়ে যান। পরক্ষণে তার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে দেখেন। পরে পথচারীরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সেন্ট মেরিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভবনটি ৬ তলা বিশিষ্ট। নিচতলায় থেকে ৩য় তলা পর্যন্ত পরিচালিত হয় স্কুলের কার্যক্রম। এর উপরের তলাগুলোতে গার্লস হোস্টেল। নিচতলায় ফার্স্ট ফার্মা লিমিটেড নামে ফার্মেসি ও মেট্রো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নামে একটি দোকান রয়েছে। ফার্স্ট ফার্মার পাশ দিয়েই স্কুলে প্রবেশের গেট এবং গেটেই স্কুল শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বেলি করার জায়গা। অ্যাসেম্বেলি জায়গা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের ২য় ও ৩য় তলাগুলোতে থাকা ক্লাসরুমে উঠার জায়গা। এই ভবনের সঙ্গে পাশেই রমনা কিড্স কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অবস্থান। এই দুই স্কুলের বিপরীত পাশে রয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) উপকেন্দ্র। স্কুল ও উপকেন্দ্রের মাঝামাঝি সড়কের একপাশ খুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে হাই ভোল্টেজ ক্যাবল।

ফার্স্ট ফার্মা লিমিটেড নামের ফার্মেসির সামনে ফুটপাত ঘেঁষে রাখা হয়েছিল ড্রামটি। বিস্ফোরণে ফুটপাতের বেশ খানিক আস্তরণ উঠে গেছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ফার্মেসিটির থাই-গ্লাস, ঝুলে পড়েছে শাটারের একাংশও। ফার্মেসির ভেতরে থাকা টিউবলাইটগুলো ভেঙে গেছে। দোকানের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ওষুধপত্র। ভবনের ৪র্থ তলা পর্যন্ত জানালার গ্লাস ভেঙে গেছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে স্কুলটির ব্যানার। বিস্ফোরণের আশপাশে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অসংখ্য স্পিøন্টার, ছোট কাচের টুকরো এবং বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া ড্রাম ও এর ঢাকনা, টাইলস, ইটের টুকরা। এছাড়া ঘটনাস্থলে পলিথিনে থাকা কিছু আবর্জনা ও প্লাস্টিকের বোতল দেখা গেছে। ঘটনার পর থেকেই ক্রাইমসিন টেপ দিয়ে ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই বিস্ফোরণ থেকেই ভয়ানক কিছু ঘটতে পারত। ভাগ্যক্রমে সেটি ঘটেনি।

রমনা কিড্স কিন্ডার গার্টেন স্কুলের পিয়ন আবদুল আওয়াল বলেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি স্কুলের সামনে চেয়ারে বসে মোবাইল চালাচ্ছিলেন। সাড়ে ৯টার পর একটি ছোট ছেলে এসে ড্রামের ঢাকনা খোলে। তখনই সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফার্স্ট ফার্মা লিমিটেড নামে দোকানটি। আমরা ভয়ে স্কুলের ভেতরে চলে আসি। পরে কর্তৃপক্ষ দ্রুত স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়। ভবনটির নিচতলায় অবস্থিত মেট্রো ডিপার্টমেন্টার স্টোরের ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম বলেন, প্রতিদিনের মতোই সকালে দোকান খোলেন তিনি। হঠাৎ করেই বিকট শব্দ আর সাদা ধোঁয়া দেখতে পান। তখন দোকানের অন্য কর্মচারীরা ভয়ে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যায়। শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় তিনি বের হতে পারেননি।

সেন্ট মেরিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কেয়াটেকার পলাশ বলেন, কেজি থেকে ও লেভেল পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুলটিতে পড়াশোনা করেন। শুক্র ও শনিবার স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। শীতকালীন ছুটি শেষে গত ৫ জানুয়ারি থেকে স্কুল খোলা হয়। ১০টা থেকে সব শিক্ষার্থীর ক্লাস শুরু হয়। ক্লাসে যাওয়ার আগে পৌনে ১০টায় অ্যাসেম্বেলি হয়। এ সময় ভবনের নিচতলায় অবস্থান করে সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। ভবনের সামনে অভিভাবকরা অবস্থান নেয়। গত ৫ জানুয়ারি স্কুল খোলার পর আর অ্যাসেম্বলি করানো হয়নি। তবে পৌনে ১০টার দিকেই সব শিক্ষার্থী প্রবেশ করত।

এক প্রশ্নের জবাবে কেয়ারটেকার পলাশ আরও বলেন, ড্রামটি স্কুলের নয়। ৯ মাস আগে ফার্মেসিটির কাজ চলার সময় ড্রামটিতে পানি রাখা হতো। ফার্মেসি চালু হওয়ার পর স্কুলের প্রবেশমুখের গেটের পাশে রাখা হতো। সেটি খালি অবস্থাতেই পড়ে ছিল সেখানে। এজন্য জায়গাটা পরিষ্কার করার জন্য গতকাল সকাল ৯টার দিকে বাইরে নিয়ে রাখেন। ঢাকনা লাগানো থাকলেও তখন ড্রামটি খালি ছিল বলে মনে হয়েছে। এরপর ড্রাম থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে দেখে অবাক হয়েছি। ৫ম তলার গার্লস হোস্টেলে থাকা দুই শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পৌনে ১০টার দিকে ব্যাপক শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ পান। কেপে ওঠে ভবনও। পরে আতঙ্কে তারা নিচে নেমে এসে দেখেন ভবনের সামনেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) হারুন-অর রশীদ বলেন, বিস্ফোরক দ্রব্যটি ময়লা একটি প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে ছিল। ভেতর থেকে ময়লা বের করার সময় বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল থেকে স্পিøন্টারও পাওয়া গেছে। কী উদ্দেশ্যে ওই বিস্ফোরক এখানে রাখা হয়েছিল আমরা সেটা বের করার জন্য কাজ করছি।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) আসাদুজ্জামান জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, আগে থেকেই ড্রামের ভেতরে যে কেউ বিস্ফোরকটি রেখে দিয়েছিল। অসাবধানতাবশত ফেলে দেয়ার কারণে বিস্ফোরণটি ঘটে। বিস্ফোরকটিকে রেখেছিল বা কীভাবে এখানে এসেছে সেটা উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করছি। এই বিস্ফোরণের সঙ্গে কোন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কি না জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এমন কোন বিষয়ে সন্দেহ করছি না। তবে প্রাথমিকভাবে সব বিষয়কে সামনে রেখে আমরা কাজ করছি।

ডিএমপির রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) বায়েজীদুর রহমান বলেন, সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটের দিকে একটি প্লাস্টিকের ড্রাম থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ড্রামটি স্কুলের কেয়ারটেকার পলাশ ফার্মেসির সামনে রেখেছিলেন। তখন ফার্মেসির লোকজন সেখান থেকে সরিয়ে রাখতে বললে ফুটপাতের সঙ্গে মিশিয়ে রাখে। এক প্রশ্নের জবাবে এসি বলেন, ড্রামটিতে স্কুলের বিভিন্ন ড্রাই ময়লা (চিপসের খোসা, পুরনো কলম ও মার্কার, পরিত্যক্ত কাগজ) ফেলা হতো। ভাঙারি দোকানের একটি ছেলে ময়লাগুলো দেখতে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে। এটি বেশ শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে বিস্ফোরক কারা কি উদ্দেশ্যে রেখে গেলো, সেটি জানতে কিছুটা সময় লাগবে।