বর্তমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, তিনি কী করতে পারেন

রাষ্ট্রপতির অভিশংসন বা অপসারণ প্রক্রিয়া কী

সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কম থাকে। তবে একেক দেশে ক্ষমতার এই তারতম্য একেক রকম। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতির বা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর দুটি বিষয় ছাড়া রাষ্ট্রপতির সেই অর্থে কোন ক্ষমতা নেই।

ঊনিশশত একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় যাত্রা শুরু করে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। গত পাঁচ দশকে শাসন ব্যবস্থায় তিনবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে দেশ চলছে সংসদীয় পদ্ধতির বা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায়।

শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিও বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই সঙ্গে সংবিধান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কখনো বেড়েছে আবার কখনো কমেছে এই পদের ক্ষমতা।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি। তার নামেই দেশ চালায় সরকার। সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী।

পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ সরকারের পথচলা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রপতি করা হয় আবু সাঈদ চৌধুরীকে।

পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে চালু হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাহাত্তর সালে সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে নির্বাচিত হতেন। পঁচাত্তরে সংবিধান সংশোধন করে গোপান ভোট তুলে দিয়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান প্রবর্তিত হয়।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে সেনাসমর্থিত রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা চলে টানা ১৬ বছর। একানব্বইয়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা

সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নির্ধারণ করা এবং তাকে নিয়োগ করার একক এখতিয়ার সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে। তবে সংসদ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে, সেই দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হয়। তবে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, তখন কোন দলের জোট থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন, তা রাষ্ট্রপতিই নির্ধারণ করবেন। এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর। তখন রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা বোধ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, এই দুটি কাজের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির কারও পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন নেই। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোন দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা নেই।

তবে রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোন বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। এই পরোক্ষ ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে।

সংবিধান বলছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শ দিয়েছেন কি না, কিংবা পরামর্শ দিয়ে থাকলেও তা নিয়ে কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হলেও রাষ্ট্রপতি তার এ দায়িত্বটি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী পালন করে থাকেন। সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন সে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে অথবা অন্য কোন দল একক বা যৌথভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

সংবিধানে বলা হয়েছে, সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া ও অর্পিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত রাখবেন প্রধানমন্ত্রী।

কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের দেয়া যেকোন দন্ডের মার্জনা বা ক্ষমা করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্বের ব্যাপারে কোন আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন প্রকার ফৌজদারি মামলা করা যাবে না। তাকে গ্রেপ্তারের বা কারাগারে নেয়ার জন্য কোন আদালত থেকে পরোয়ানা জারি করা যাবে না।

রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে এই পদে থাকতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তার উত্তরাধিকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত তিনিই নিজের পদে বহাল থাকবেন।

প্রধানমন্ত্রী পদে একজন ব্যক্তি বারবার আসতে পারলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে এই সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী, দুই মেয়াদের বেশি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না।

সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা

জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকার গঠন করলে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হয়েছিলেন। বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়েছিল। তবে সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও জামায়াত সেই সরকারে অংশীদার ছিল না, সেটি ছিল বিএনপির সরকার।

আর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বসেছিলেন বিরোধীদলীয় নেতার আসনে।

একানব্বইয়ে ৬ আগস্ট সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ফের চালু হয়। সংশোধনীটি উত্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৩০৭-০ ভোটে সংশোধনী বিলটি পাস হয়।

এরপর সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। সীমিত হয় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা।

রাষ্ট্রপতি নিয়োগ ও অপসারণ

রাষ্ট্রপতি পদটি আলংকারিক হলেও ওই পদে কাউকে অভিশংসন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হবে।

রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সব শাখার আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (কমান্ডার ইন চিফ)। রাষ্ট্রপতির দন্ডিত ব্যক্তির দন্ডাদেশ স্থগিত, হ্রাস বা দন্ডিতকে ক্ষমা করার অধিকার রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি বড় মনে হয়।

সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার ক্ষমতাও সংসদের হাতে।

সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হয়। তাই সংসদে কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে, তাদের পছন্দের কাউকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ, অপছন্দ হলে অভিশংসন, জটিল কিছু নয় বলেই অনেকের অভিমত।

অভিশংসনের জন্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের স্বাক্ষরে অভিযোগের বিবরণ লিখে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে পেশ করতে হবে।

স্পিকারের কাছে অভিযোগসম্পর্কিত নোটিশ যেদিন পেশ করা হবে, সেদিন থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ওই বিষয়ে সংসদে কোন আলোচনা করা যাবে না। আবার ৩০ দিন পারও করা যাবে না। ফলে ১৪ দিন পর এবং ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে হবে।

এ সময়ে সংসদ অধিবেশন না থাকলে স্পিকার অবিলম্বে অধিবেশন আহ্বান করবেন। ভোটের আগে আলোচনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের একমত হতে হবে যে, রাষ্ট্রপতি আইন ভেঙেছেন।

অভিযোগ তদন্তের জন্য সংসদ কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দিতে পারে। অভিযোগ বিবেচনা করার সময় রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকার বা প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার থাকবে।

অভিযোগ বিবেচনার পর সংসদে সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপি অভিশংসনের উদ্যোগ নিলে তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন।

বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল না দিতে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রপতিত্ব হারিয়েছেন।

তবে অনেকের অভিমত সেই সময় বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অভিশংসন বা অপসারণের যথেষ্ট আইনি ভিত্তি সেই সময়কার ক্ষমতাসীনদের ছিল না।

সংবিধান অনুযায়ী শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারণ করা যাবে। সে জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে পেশ করতে হবে।

সংসদ অধিবেশন না থাকলে নোটিশ পাওয়ামাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করবেন এবং একটি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করবেন।

সংসদের স্পিকার সদস্যদের নোটিশ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দ্রুত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে ১০ দিনের মধ্যে চিকিৎসক বোর্ডের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার অনুরোধ জানাবেন।

অর্থাৎ শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্য প্রমাণ না করতে পারলে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে কাউকে অপসারণ সাংবিধানিকভাবে সম্ভব নয় বলেই অনেকের অভিমত।

image
আরও খবর
রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন
দুই বই প্রত্যাহারে সরকারের ক্ষতি ৩৫ কোটি টাকা
ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভ্রমণ আজও স্মৃতিতে অম্লান : মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন
আ-মরি বাংলা ভাষা
একুশে পদক পাচ্ছেন ২১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান
মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে শ্বাসরোধে হত্যা
তাপমাত্রা কমে বাড়তে পারে শীত
নিহত ৩৩ হাজার ছাড়ালো
দৃশ্যদূষণ : ঢাকার ২৪ শতাংশ মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছে, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা
রাষ্ট্রপতির বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধা
মৃত্যু ৩৬ হাজার ছাড়ালো
আ-মরি বাংলা ভাষা
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজ ভিড়তে পারবে না বাংলাদেশে
মরিয়ম মান্নানদের শাস্তির সুপারিশ পিবিআইয়ের
তুরস্ক ও সিরিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত
ফুলের বাজার সরগরম : চাষিদের মুনাফার হাতছানি

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ , ০১ ফাল্গুন ১৪২৯, ২২ রজব ১৪৪৪

বর্তমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, তিনি কী করতে পারেন

রাষ্ট্রপতির অভিশংসন বা অপসারণ প্রক্রিয়া কী

ফয়েজ আহমেদ তুষার

image

সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কম থাকে। তবে একেক দেশে ক্ষমতার এই তারতম্য একেক রকম। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতির বা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর দুটি বিষয় ছাড়া রাষ্ট্রপতির সেই অর্থে কোন ক্ষমতা নেই।

ঊনিশশত একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় যাত্রা শুরু করে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। গত পাঁচ দশকে শাসন ব্যবস্থায় তিনবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে দেশ চলছে সংসদীয় পদ্ধতির বা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায়।

শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিও বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই সঙ্গে সংবিধান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কখনো বেড়েছে আবার কখনো কমেছে এই পদের ক্ষমতা।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি। তার নামেই দেশ চালায় সরকার। সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী।

পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ সরকারের পথচলা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রপতি করা হয় আবু সাঈদ চৌধুরীকে।

পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে চালু হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাহাত্তর সালে সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে নির্বাচিত হতেন। পঁচাত্তরে সংবিধান সংশোধন করে গোপান ভোট তুলে দিয়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান প্রবর্তিত হয়।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে সেনাসমর্থিত রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা চলে টানা ১৬ বছর। একানব্বইয়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা

সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নির্ধারণ করা এবং তাকে নিয়োগ করার একক এখতিয়ার সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে। তবে সংসদ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে, সেই দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হয়। তবে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, তখন কোন দলের জোট থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন, তা রাষ্ট্রপতিই নির্ধারণ করবেন। এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর। তখন রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা বোধ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, এই দুটি কাজের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির কারও পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন নেই। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোন দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা নেই।

তবে রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোন বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। এই পরোক্ষ ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে।

সংবিধান বলছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শ দিয়েছেন কি না, কিংবা পরামর্শ দিয়ে থাকলেও তা নিয়ে কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হলেও রাষ্ট্রপতি তার এ দায়িত্বটি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী পালন করে থাকেন। সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন সে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে অথবা অন্য কোন দল একক বা যৌথভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

সংবিধানে বলা হয়েছে, সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া ও অর্পিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত রাখবেন প্রধানমন্ত্রী।

কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের দেয়া যেকোন দন্ডের মার্জনা বা ক্ষমা করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্বের ব্যাপারে কোন আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন প্রকার ফৌজদারি মামলা করা যাবে না। তাকে গ্রেপ্তারের বা কারাগারে নেয়ার জন্য কোন আদালত থেকে পরোয়ানা জারি করা যাবে না।

রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে এই পদে থাকতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তার উত্তরাধিকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত তিনিই নিজের পদে বহাল থাকবেন।

প্রধানমন্ত্রী পদে একজন ব্যক্তি বারবার আসতে পারলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে এই সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী, দুই মেয়াদের বেশি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না।

সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা

জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকার গঠন করলে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হয়েছিলেন। বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়েছিল। তবে সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও জামায়াত সেই সরকারে অংশীদার ছিল না, সেটি ছিল বিএনপির সরকার।

আর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বসেছিলেন বিরোধীদলীয় নেতার আসনে।

একানব্বইয়ে ৬ আগস্ট সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ফের চালু হয়। সংশোধনীটি উত্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৩০৭-০ ভোটে সংশোধনী বিলটি পাস হয়।

এরপর সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। সীমিত হয় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা।

রাষ্ট্রপতি নিয়োগ ও অপসারণ

রাষ্ট্রপতি পদটি আলংকারিক হলেও ওই পদে কাউকে অভিশংসন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হবে।

রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সব শাখার আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (কমান্ডার ইন চিফ)। রাষ্ট্রপতির দন্ডিত ব্যক্তির দন্ডাদেশ স্থগিত, হ্রাস বা দন্ডিতকে ক্ষমা করার অধিকার রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি বড় মনে হয়।

সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার ক্ষমতাও সংসদের হাতে।

সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হয়। তাই সংসদে কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে, তাদের পছন্দের কাউকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ, অপছন্দ হলে অভিশংসন, জটিল কিছু নয় বলেই অনেকের অভিমত।

অভিশংসনের জন্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের স্বাক্ষরে অভিযোগের বিবরণ লিখে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে পেশ করতে হবে।

স্পিকারের কাছে অভিযোগসম্পর্কিত নোটিশ যেদিন পেশ করা হবে, সেদিন থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ওই বিষয়ে সংসদে কোন আলোচনা করা যাবে না। আবার ৩০ দিন পারও করা যাবে না। ফলে ১৪ দিন পর এবং ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে হবে।

এ সময়ে সংসদ অধিবেশন না থাকলে স্পিকার অবিলম্বে অধিবেশন আহ্বান করবেন। ভোটের আগে আলোচনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের একমত হতে হবে যে, রাষ্ট্রপতি আইন ভেঙেছেন।

অভিযোগ তদন্তের জন্য সংসদ কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দিতে পারে। অভিযোগ বিবেচনা করার সময় রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকার বা প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার থাকবে।

অভিযোগ বিবেচনার পর সংসদে সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপি অভিশংসনের উদ্যোগ নিলে তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন।

বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল না দিতে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রপতিত্ব হারিয়েছেন।

তবে অনেকের অভিমত সেই সময় বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অভিশংসন বা অপসারণের যথেষ্ট আইনি ভিত্তি সেই সময়কার ক্ষমতাসীনদের ছিল না।

সংবিধান অনুযায়ী শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারণ করা যাবে। সে জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে পেশ করতে হবে।

সংসদ অধিবেশন না থাকলে নোটিশ পাওয়ামাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করবেন এবং একটি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করবেন।

সংসদের স্পিকার সদস্যদের নোটিশ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দ্রুত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে ১০ দিনের মধ্যে চিকিৎসক বোর্ডের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার অনুরোধ জানাবেন।

অর্থাৎ শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্য প্রমাণ না করতে পারলে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে কাউকে অপসারণ সাংবিধানিকভাবে সম্ভব নয় বলেই অনেকের অভিমত।