‘মায়ানমারে স্থায়ী মানবাধিকার সংকট সৃষ্টি করেছে জান্তা সরকার’

২০২১ সালে সামরিক বাহিনী মায়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর থেকে ‘স্থায়ী মানবাধিকার সংকট’ সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে জান্তা এই সংকট সৃষ্টি করেছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।

প্রতিবদেনটি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মায়ানমারের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জান্তার নির্দেশে ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মায়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন প্রদেশে নির্বিচারে বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ ও গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে সেনা সদস্যরা। জান্তার এই ঘন ঘন হামলায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষ ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং চরম মানবেতর অবস্থায় এখন দিন কাটছে তাদের।

এছাড়া দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে জান্তাবিরোধী যত সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় আছে, তাদের মূলোৎপাটন করতে গোয়েন্দা তৎপরতা, খাদ্য ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার মতো কর্মকান্ডও জারি রেখেছে ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনী।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকের তুর্ক এক বিবৃতিতে মায়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘ধারাবাহিক ও চূড়ান্ত দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে মায়ানমারে যা খুশি তাই করছে জান্তা।’

আন্তর্জাতিক কোন নীতি কিংবা বাধ্যবাধকতাকে পাত্তা দেয়ার কোন প্রয়োজন তারা বোধ করছে না।’

‘যদি জরুরি ভিত্তিতে দৃঢ় কোন পদক্ষেপ না নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে নিকট ভবিষ্যতে অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে মায়ানমার।’ জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে টেলিফোন ও ইমেইলের মাধ্যমে জান্তা মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স, কিন্তু তারা কেউই সাড়া দেননি।

মুখপাত্ররা অবশ্য অতীতে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, মায়ানমারের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুণœ রাখা সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব এবং সামরিক বাহিনী কোন নৃশংসতা বা সহিংসতা করছে না। তাদের দাবি, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসীদের দমন করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনসঙ্গত অভিযান চালাচ্ছেন পুলিশ ও সেনাসদস্যরা।

সরকারের অধীন নয় এমন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সেনাবাহিনী এই কৌশল নিয়েছে, যাতে এই গোষ্ঠীগুলো খাবার, তহবিল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য কোন কিছুই না পায় এবং কাউকে দলেও না ভেড়াতে পারে।

এত সবকিছুর পরও বরাবরই পার পেয়ে যাওয়া মায়ানমারের সেনাবাহিনী অনবরতই আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা এবং নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। “ঘনীভূত হতে থাকা এই বিপর্যয় রোধে জরুরি এবং বাস্তব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন” বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

মায়ানমার জান্তা সরকার এর আগে বলেছিল, দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা তাদের দায়িত্ব। দেশে কোনরকম নৃশংসতা চলার কথা অস্বীকার করে তারা বলেছিল, কেবল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালানো হচ্ছে।

কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের মায়ানমার টিমের প্রধান জেমস রোডহেভার বলেছেন, দেশটির প্রায় ৭৭ শতাংশ জুড়ে শসস্ত্র সংঘাত চলছে। জেনিভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “মায়ানমারে সংকট গোটা দেশজুড়ে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়ে যাওয়ার মতো এমন পরিস্থিতি এবং এরকম সময় আগে কখনও আসেনি।”

জাতিসংঘ প্রতিবেদনে মায়ানমার কর্তৃপক্ষকে বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন এবং সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, “সংকট অবসানে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সামরিক অভিযান অবশ্যই বন্ধ হতে হবে।”

মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই একের পর এক বিক্ষোভ-সহিংসতায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। যার কারণে শাসনকাজ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে জান্তা সরকার। জান্তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে ছায়া সরকার। এই সরকারের সঙ্গে হাত মেলানো মিলিশিয়া ও জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে সামরিক শাসকরা। এই গোষ্ঠীগুলোকে জান্তা সরকার “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়েছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম, সাহায্য সংস্থা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, চিন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে এরই মধ্যে তান্ডব চালিয়েছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। থান্টলাং শহরে বহু বাড়ি-ঘর, চার্চ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ধ্বংস করা হছে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’র কার্যালয়ও।

তবে চিন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে জান্তা সরকার কোনও মন্তব্য করেনি। ওই অঞ্চলে হামলার খবরগুলোও নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করতে পারেনি বার্তা সংস্থা রয়টার্স। সেখানে ইন্টারনেট এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

স্থানীয় পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ বিষয়ক সংস্থা বুধবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, চিন রাজ্যসহ আশেপাশের মাগওয়ে এবং সাগাইং অঞ্চলে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের লড়াই জোরদার হয়েছে।

রবিবার, ০৫ মার্চ ২০২৩ , ২০ ফাল্গুন ১৪২৯, ১২ শবান ১৪৪৪

‘মায়ানমারে স্থায়ী মানবাধিকার সংকট সৃষ্টি করেছে জান্তা সরকার’

২০২১ সালে সামরিক বাহিনী মায়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর থেকে ‘স্থায়ী মানবাধিকার সংকট’ সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে জান্তা এই সংকট সৃষ্টি করেছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।

প্রতিবদেনটি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মায়ানমারের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জান্তার নির্দেশে ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মায়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন প্রদেশে নির্বিচারে বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ ও গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে সেনা সদস্যরা। জান্তার এই ঘন ঘন হামলায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষ ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং চরম মানবেতর অবস্থায় এখন দিন কাটছে তাদের।

এছাড়া দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে জান্তাবিরোধী যত সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় আছে, তাদের মূলোৎপাটন করতে গোয়েন্দা তৎপরতা, খাদ্য ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার মতো কর্মকান্ডও জারি রেখেছে ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনী।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকের তুর্ক এক বিবৃতিতে মায়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘ধারাবাহিক ও চূড়ান্ত দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে মায়ানমারে যা খুশি তাই করছে জান্তা।’

আন্তর্জাতিক কোন নীতি কিংবা বাধ্যবাধকতাকে পাত্তা দেয়ার কোন প্রয়োজন তারা বোধ করছে না।’

‘যদি জরুরি ভিত্তিতে দৃঢ় কোন পদক্ষেপ না নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে নিকট ভবিষ্যতে অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে মায়ানমার।’ জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে টেলিফোন ও ইমেইলের মাধ্যমে জান্তা মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স, কিন্তু তারা কেউই সাড়া দেননি।

মুখপাত্ররা অবশ্য অতীতে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, মায়ানমারের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুণœ রাখা সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব এবং সামরিক বাহিনী কোন নৃশংসতা বা সহিংসতা করছে না। তাদের দাবি, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসীদের দমন করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনসঙ্গত অভিযান চালাচ্ছেন পুলিশ ও সেনাসদস্যরা।

সরকারের অধীন নয় এমন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সেনাবাহিনী এই কৌশল নিয়েছে, যাতে এই গোষ্ঠীগুলো খাবার, তহবিল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য কোন কিছুই না পায় এবং কাউকে দলেও না ভেড়াতে পারে।

এত সবকিছুর পরও বরাবরই পার পেয়ে যাওয়া মায়ানমারের সেনাবাহিনী অনবরতই আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা এবং নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। “ঘনীভূত হতে থাকা এই বিপর্যয় রোধে জরুরি এবং বাস্তব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন” বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

মায়ানমার জান্তা সরকার এর আগে বলেছিল, দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা তাদের দায়িত্ব। দেশে কোনরকম নৃশংসতা চলার কথা অস্বীকার করে তারা বলেছিল, কেবল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালানো হচ্ছে।

কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের মায়ানমার টিমের প্রধান জেমস রোডহেভার বলেছেন, দেশটির প্রায় ৭৭ শতাংশ জুড়ে শসস্ত্র সংঘাত চলছে। জেনিভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “মায়ানমারে সংকট গোটা দেশজুড়ে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়ে যাওয়ার মতো এমন পরিস্থিতি এবং এরকম সময় আগে কখনও আসেনি।”

জাতিসংঘ প্রতিবেদনে মায়ানমার কর্তৃপক্ষকে বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন এবং সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, “সংকট অবসানে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সামরিক অভিযান অবশ্যই বন্ধ হতে হবে।”

মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই একের পর এক বিক্ষোভ-সহিংসতায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। যার কারণে শাসনকাজ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে জান্তা সরকার। জান্তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে ছায়া সরকার। এই সরকারের সঙ্গে হাত মেলানো মিলিশিয়া ও জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে সামরিক শাসকরা। এই গোষ্ঠীগুলোকে জান্তা সরকার “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়েছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম, সাহায্য সংস্থা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, চিন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে এরই মধ্যে তান্ডব চালিয়েছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। থান্টলাং শহরে বহু বাড়ি-ঘর, চার্চ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ধ্বংস করা হছে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’র কার্যালয়ও।

তবে চিন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে জান্তা সরকার কোনও মন্তব্য করেনি। ওই অঞ্চলে হামলার খবরগুলোও নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করতে পারেনি বার্তা সংস্থা রয়টার্স। সেখানে ইন্টারনেট এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

স্থানীয় পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ বিষয়ক সংস্থা বুধবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, চিন রাজ্যসহ আশেপাশের মাগওয়ে এবং সাগাইং অঞ্চলে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের লড়াই জোরদার হয়েছে।