পূর্ণিমার গ্রহণ

সাদ কামালী

আবুল ফজল নিশ্চিত আগুনই তার স্ত্রী, আগুনের মমতাময় স্পর্শে তার দৃষ্টি ঠান্ডা এবং হৃদয় হয় উষ্ণ। শরীরে বোধ করে বিলাস বৈভব। আগুনের ছোঁয়ায় কর্নিয়া আরও বড় বৃত্ত হলে চতুর্পাশে রং টলটল করে, দৃষ্টি হয় প্রখর। সকল ইন্দ্রিয় সে-সময় দৃষ্টির ¯স্নায়ুতে অতিরিক্ত শক্তি ও ক্ষমতার যোগান দেয়। ফলে আগুনের উজ্জ্বল আয়তক্ষেত্রের মধ্যে সে দর্শন পায় সেই রূপের বিমূর্ত-মূর্ত, স্থির-অস্থির, তরল বায়বীয় রূপ। আবুল ফজলের অপলক চোখের তারায় সে-রূপের প্রতিবিম্ব জাগে। ঠোঁট চিবুক কপালও আকুল মগ্নতায় আগুনের ওপর নিবদ্ধ করে রাখে। তখন তাকে আগুনপূজারি অথবা যজ্ঞের ঋষি মনে হতে পারে। মুখমন্ডলের ঘামে আগুনের ছায়া চকচক করে উঠলে ঋজু প্রতিজ্ঞ সন্ন্যাসী মনে হতে পারে, কিন্তু আবুল ফজলের অদূরে বিস্ময় কৌতূহল আর মজার দৃশ্য দেখার আনন্দে অপেক্ষমাণ প্রতিবেশীদের কাছে ঋষি সন্ন্যাসী কিছুই মনে হয় না। তারা কেউ তাকে পাগল বলে, বলে পাগলা ফজল, কেউ দেবদাস। তরুণ দু-একজন আরও বিদ্রুপ করে বলে দেবুদা।

যখন অগ্নিসংযোগ করে আবুল ফজল ধ্যানে তন্ময় থাকে না, যখন তাকে সামাজিক জীবন অতিবাহিত করতে হয়, তখন সে অপমানবোধ করে, ক্ষুব্ধ হয়, এবং যতদূর সম্ভব নির্জনে থাকে। অপারগতা দেবদাসকে করুণ হাস্যকর করেছিল, কিন্তু সমাজের ওই সব মানুষেরা কী জানে না আবুল ফজলের অপারগতা ছিল না, সে ওই অবুঝদের কিছু বলে না, কেন বলবে! যে আগুন পোড়ায়, জ্বালায়, ভস্ম করে দেয়, যে আগুনে পুড়ে সোনা হয়, নিষ্কলূষ করে সেই আগুনকে চিনিয়ে দিতে হবে! গ্রামের লোক কি দেখেনি, একবিন্দু আগুন কেমন মহিরুহ হয়ে ওঠে! একজন মানুষ তার গ্রাস এড়াতে পারে না। কীভাবে একচিলতে আগুনকে শরীরের সীমা ছাড়িয়ে বৃহৎ হতে দিয়েছিল! আগুনের ক্রম প্রজ্বলনের ক্ষমতা নিজের শরীর দিয়ে বিস্তৃত করে তুলেছিল।

বাজার থেকে কাঠের খড়ি কিনে আনে, গ্রাম থেকে পাঠখড়ি, আরও সংগ্রহ করে আম কাঁঠাল হিজলের শুকনা পাতা। একেক রাতে যখন তার ইচ্ছা হয়, যখন তার সঙ্গ ও দর্শনে আপ্লুত হতে চায় তখন ওই আগুনের কেন্দ্রে তাকে পেয়ে যায়। তারা পরস্পর কত কথায় উদ্দীপ্ত হয়, অভিমান করে, হাসে। আগুন আর বাতাসের সঙ্গমের ধ্বনি মুখর হয়ে উঠলে কেউ সে-সব শুনতে পারে না। ঠোঁটের নীরব বাক্সময়তাও কেউ দেখতে পায় না। তাদের চোখ ঘিরে থাকে আগুন, আগুন মুখে পাগলা ফজল। কখনো অবশ্য তারা দেখতে পায় আলোর ছায়া কেমন করে আবুল ফজলের শরীরে কিলবিল করে। কখনো দুহাত আগুনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয় আবুল ফজল, আগুনের অভ্যন্তর থেকেও দুটি হাত সেই হাতকে আঁকড়ে ধরে, তখন নিমেষের জন্য হলেও তারা পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। হয়তো আবুল ফজল নিজেই আগুনে প্রবেশ করে অথবা আগুন থেকে নির্গত হয়ে তাকে আলিঙ্গন দেয়। আবুল ফজলের ইচ্ছা এই আলিঙ্গন আরও দীর্ঘ, অনন্ত হোক। আবেগের জলে কণ্ঠস্বর আটকে যায়,

আরও একটু...।

পূর্ণিমা বাধা দেয়, না থাক।

কেন এমন হলো পূর্ণিমা!

আর কী হতো, আগুনই তো নিয়তি।

আবুল ফজল আর বলতে পারে না, তার স্বর অথই জলে ডুবে থাকে। চোখের কোল ঘিরেও জলের সর। তখন সব দৃশ্য ঝাপসা হয়ে ওঠে, দৃশ্য অন্তর্হিত হয়, আগুন নিভে ক্রমে চিকন ধোঁয়া অন্ধকারে মেশে।

পেট ও বুকের তলে হাত রেখে পূর্ণিমাকে সাঁতার শিখিয়ে ছিল আবুল ফজল। পেয়ারা বা আম না চাইবার আগেই পেড়ে দিত। আর পূর্ণিমা কাঁচা আম মাখিয়ে বলত, ‘আবুল ভাই বেশি ঝাল, কমে করে খান।’ তখন কারও মনে হয়নি ওই কাঁচা আমের টকে জিভে একরকম রস আসে, সেই রস সহজে নিবৃত্ত হতে চায় না। এইসব বিধি-সম্মতও নয়। মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষার একজোড়া মাস বাকি, এ-সময়ের মধ্যে পূর্ণিমাকে অঙ্কে লেটার পাইয়ে দেওয়ার জন্য আবুল ফজল দুপুর সন্ধ্যা পাটিগণিতের সকল কৌশল শিখিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এক বিকেলে পূর্ণিমার বাবা রমেন দাস হালটের মাঝখানে আবুল ফজলকে থামায়। যথারীতি নমস্কার জানিয়ে আবুল ফজল জানতে চায়, কি খবর? রমেন দাস একটু সময় নেয়। তার একটি হাত আবুল ফজলের কাঁধের ওপর রেখে মাথা নিচু করে থাকে। সে আরও সময় নিয়ে দুটি কথা বলে এবং তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হেঁটে চলে যায়। এবার আবুল ফজল পা বাড়াতে সময় নেয়, তার পায়ে সহজে গতি ফিরে আসে না। রমেন দাসের দুটি কথা সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, শূন্যে ছুড়ে দিয়ে তা আবার শোনে, ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করে। হালটের দুপাশের গমখেতে, মাঘী সরিষার হলুদ উচ্ছ্বাসে বসন্তের আগাম বাতাস শিরশির করে কাঁপতে কাঁপতে তাকেও কাঁপিয়ে দেয়। আবুল ফজল তবুও ওই দুটি কথার বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারে না, বুঝতে চায়ও না। চুলের মধ্যে সব আঙুল ডুবিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে, ‘সম্ভব না, বাবা সম্ভব না।’ দ্বিতীয় কথাটি আর পুনরাবৃত্তি না করে আবুল ফজল পূর্ণিমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে যায়। গ্রামের পশ্চিম-উত্তর কোণে সাত আটটি বাড়ি নিয়ে পূর্ণিমাদের পাড়া। সকলে এখন নেই, গ্রামের অবশিষ্টাংশের মতো এখানে জনবসতি ঘন নয়, বরং কোনো এক বিস্ময়কর নিয়মে জনবসতি ক্রমে ক্ষীয়মান। যদিও এখানে মাঘের শেষ অপরাহ্ণে বসন্তের বাতাস একই রকম প্রবহমান। হালকা চাদর জড়িয়ে রমেন দাস বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আবুল ফজলকে দেখে চোখে একবার বেশি পলক পড়ে মাত্র, আর কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না, আবুল ফজলও তাকে পাশ কাটিয়ে বরাবরের মতো ভেতরের উঠানে যায়। আলা মাটিতে লেপা ঘরের সাদা ডোয়ার পাশে গাঁদাফুল, তার পাশে লাল টকটকে জবা, এক চিলতে রঙিন রোদ জবাফুলগুলোকে খুব উজ্জ্বল করে তুলেছে। অদূরে পাড় বাঁধানো তুলসীগাছ, তুলসীগাছের নিচে পূর্ণিমার মা শুকনা নারকেলের পাতা থেকে সলা তুলছে। আবুল ফজল পূর্ণিমাকে দেখতে পায় না। পূর্ণিমার মা একবার চোখ তুলে পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয়। কোনোকিছুই বলে না। তখন সে তার উপস্থিতি এইভাবে সরব করে তুলতে চায় নমস্কার মাসি মা।

বসো, বাবা।

শীত তো চলে গেল, এখনো আপনাদের কুল পাকল না!

পূর্ণিমার মা হাতের শুকনা নারকেলপাতা আর বটির ওপর থেকে চোখ না তুলেই বলে, ‘পুনিরে ওর মামা নিয়া গ্যাছে, কাপুড়া সদরদী।’

আবুল ফজল কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়, আর একমাসও নাই ফাইন্যাল পরীক্ষার, এখন বেড়াতে যাওয়া কেন সে তা উচ্চারণ করতে পারে না। সহসাই তার মনে হয় এই প্রশ্নের মধ্যে হয়তো সেই সত্যিই লুকিয়ে আছে যা পূর্ণিমার বাবা আজ বিকালে বলেছে। আবুল ফজল দ্রুত পায়ে হালটে নেমে হাঁটতে থাকে। পথে একজন ছাত্র তাকে সালাম জানায়, কেউ কেউ তাকে এড়িয়ে যায়, তাদের হাতের মুঠায় স্টার সিগারেটের ধোঁয়া চিকন হয়ে বেরিয়ে মাঘের কুয়াশায় মেশে। ক্রমে আলো কমতে কমতে যখন রাত্রির পূর্ণ অন্ধকার নেমে আসে, আবুল ফজল তখন আবিষ্কার করে সে কাপুড়া সদরদী পৌঁছে গেছে। তার পায়ে ধাক্কা লাগে পূর্ণিমার মামা শ্রীমন্ত দাসের বাড়ির সামনে বিশাল বটগাছের শিকড়। বটগাছের প্রশস্ত গোড়া ঘিরে একটি চায়ের দোকানের পাশে দুটি মুদি দোকানও আছে। আবুল ফজল লক্ষ করে এক কোনায় কিছু মাটি লেপা, সেখানে একটা খোলা প্রদীপ জ্বলছে। কিছু জবাফুল এবং একটা ভাঙা নারকেল। বেঞ্চের কোনায় বসে সে একটা চা নেয়। চা দোকানের ছোট বিক্রেতাটি আবুল ফজলকে চমকে দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনি? পুনিদি এতক্ষণ এইহানে বইসা ছিল। কাইলই আবার চইলা যাবে।’ সে চায়ে শেষ চুমুক দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে ওই জবাফুল নারকেল আর খোলা প্রদীপ দেখতে চায়, পারে না। বাতাসে প্রদীপ নিভে গেছে, জবা দেখা যায় না। সেখানে গাঢ় অন্ধকার।

দুপুরের পর অন্যদিনের মতো আবুল ফজল অঙ্ক শেখাতে ওদের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। দূর থেকেই পূর্ণিমা তাকে দেখতে পেয়ে হালটে নেমে আসে। তার চোখে আনন্দ আর মুখে কথা বিগলিত। আবুল ফজল অবাক হয়, পূর্ণিমার এই সহজ আচরণ খুব প্রত্যাশিত নয়। পূর্ণিমা দুঃখ করে কালকে পড়া হলো না আজ কোচিং ক্লাসে যেতে পারল না। আবুল ফজল পূর্ণ চোখে পূর্ণিমাকে দেখে। পূর্ণিমা সেই চোখের ওপর তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। হাতের পেন্সিল শক্ত করে ধরে। তার চোখ চিবুক ঠোঁট ঘিরে হঠাৎ ছায়া নামে। এবং খুব ধীরে বলে, ‘আমরা বোধ হয় চলে যাব, বাবা বাড়ি বিক্রির চেষ্টা করছে।’ আবুল ফজল এখন বুঝতে পারে অথবা না বুঝে তার উপায় থাকে না রমেন দাসের দ্বিতীয় কথাটি।

আমি তো কাকাকে বলেছিলাম তোমাদের কোনো ভয় নাই। আমি আছি। আবুল ফজলের স্বর গাঢ় শোনায়।

পূর্ণিমা মাথা উঁচু করে, ‘বাবা হয়তো কারো ভরসায় থাকতে চায় না।’

ওর স্বর একটু কাঁপে। আবুল ফজল পূর্ণিমার হাত ধরে চাপ দেয়।

আমাদের কী হবে পূর্ণিমা!

হাত ছাড়িয়ে পূর্ণিমা জ্যামিতি বক্স টেনে নেয়। সেখান থেকে স্কেল কম্প্যাস বের করতে করতে বলে, ‘আজ সম্পাদ্যগুলো শেষ করে ফেলি।’

পড়ার টেবিল ঘেষে চৌকিতে এসে বসে বিধবা পিসি। সেখানে বসে কাঁথা সেলাই করছে। গত কয়েকদিন থেকেই পিসি এ-সময় এখানে বসে কাঁথা সেলাই করে। আজ মনে হলো এই কাঁথা সেলাই পিসির কখনো শেষ হবে না। অন্তত যতদিন সে পড়াতে আসবে। তখন তার আরও মনে হয়, স্কুলের ছেলেদের বাথরুমে সে একটি লেখা পড়েছে। সে-সব শব্দ কখনো মুখে উচ্চারণ করতে পারেনি। সে-সব লেখকেরা পূর্ণিমা লিখতে দুটি বানান ভুল করেছে, তার নাম লিখেছে আবুইল্লা। আবুল ফজলের ইচ্ছা হয় পূর্ণিমাকে জিজ্ঞেস করে, স্কুলের বন্ধুরা তাকে এই প্রসঙ্গে কী বলে। কিন্তু পিসি সূচের ওপর অসতর্ক চোখ এবং কথার ওপর সতর্ক কান রেখে সেলাই করে যাচ্ছে। কাজেই কিছু জিজ্ঞেস না করে সে সরাসরি পিসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘পিসিমা, মনটা ভালো না, কিছু বলেন তো।’

পিসি একটু নড়েচড়ে বলে, ‘কী জানি বাবা, আমি মুখ্যু মানুষ।’

‘ভাবছি হিন্দু হব, পারব তো?’

পিসিমা এবার হাতের সূচ ফেলে মুখ উঁচু করে তোলে, ‘তুমি হিন্দু হবা, তোমার কপাল পুড়ছেনি?’

আবুল ফজল পিসির ওপর খোলা চোখ রেখে বলে, ‘আমি পূর্ণিমাকে পরীক্ষার পরই যে বিয়ে করব।’

পিসির শীর্ণ শরীর ক্ষোভে কাঁপছিল। এবার উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘তার আগে ও গলায় দড়ি দিয়ে মরবে, ওরে আগুনে পুড়াইয়া মরব।’

আবুল ফজলকে এলাকায় তত বিব্রত হতে হয় না, অথবা সে হয় না। যখন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অফিসঘরে ডেকে নিয়ে বলে, ‘ইসলামে বিধর্মীকে বিয়ে করার অনুমতি আছে, একজন ভিন্নধর্মীকে মোসলমান করলে তার সোওয়াবও মেলে, কিন্তু ছাত্রীর সাথে এসব কি ভালো দেখায়?’

আবুল ফজল এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল, এবার তার চোখ প্রধান শিক্ষকের ওপর রেখে বলে, ‘তাহলে শিক্ষকতা ছেড়ে দেই।’

প্রধান শিক্ষক তার হাত চেপে ধরে, ‘স্কুল কমিটির দু-একজন কিছু বললেও আপনার প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে। ভুল বুঝবেন না।’

আবুল ফজল হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে যায়।

পূর্ণিমা ক্লাসে আসেনি। এলোমেলো অস্থির পায়ে আবুল ফজল ওদের বাড়িতে চলে আসে। এরকম অপ্রত্যাশিত সময়ে আবুল ফজলকে দেখেও এ-বাড়ির কেউ অবাক হয় না। রমেন দাস হাত থেকে হুক্কা নামিয়ে আবুল ফজলকে বসতে বলে। চারদিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে আবুল ফজল বসে। রমেন দাস ধীর এবং গাঢ় স্বরে বলে, ‘বিন্নার পালানে আমাগো সাড়ে তিন কাঠা জাগা ছিল। দু-একজনরে গোপনে বলছিলাম কিনবে কিনা। তা তারা জানালো ওইখানে আমাগো কোনো জমি নাকি নাই, নকশা-পর্চায় দেখলাম অন্য নাম।’

আবুল ফজলের মাথা আরেকটু ঝুঁকে পড়ে। রমেন দাস সামান্য বিরতি নিয়ে তেমন অনুচ্চ কণ্ঠে কিছু বলতে শুরু করলে শ্লেষ্মা জড়িত কাশি প্রায় দম আটকে ফেলে। তবুও সেই কাশির দমকের মধ্যে চোখে লাল রং আর গরম জল নিয়ে বলে, ‘একটা মাত্র মাইয়া আমার, তারেও কুলত্যাগী করতে চাও? তোমাগো আর কত লাগবে?’

আবুল ফজল নিরেট স্তব্ধ হয়ে যায়। তার শরীরে কোনো সাড়া নাই। রমেন দাস আবার হুক্কায় স্বাভাবিকভাবে টান দিতে শুরু করে। উঠানে উজ্জ্বল রোদ। যদিও সে-রোদে তাপ কম। পিঠের কাপড় সরিয়ে উপুড় হয়ে সেই রোদ পোহায় পূর্ণিমার পিসি। পূর্ণিমার মা ঘাট থেকে উঠে এলো কাঁধে ভেজা কাপড়, হাতে জলভর্তি ছোট একটি পিতলের কলস। দড়িতে কাপড় মেলতে মেলতে ডাক দেয়, ‘অ পুনি।’

আবুল ফজল মাথা উঁচু করে উঠানে চোখ মেলে রাখে। সেই দৃষ্টির ওপর পূর্ণিমার ছায়া পড়ল না। তখন রমেন দাস বলে, ‘কাইল রাইতে মাইয়াডারে পিটাইছি। সকালে দেহি গায়ে জ্বর।’

আবুল ফজল দাঁড়িয়ে পড়ে। তীব্র চোখে একবার রমেন দাসকে দেখে সে তার পরিচিত ঘরে আর সবাইকে উপেক্ষা করেই ঢোকে। পূর্ণিমা উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বালিশের ওপর খোলা চুল ছড়ানো। চিবুকের একপাশ দেখা যায়। ঘুমে বিভোর ওই মুখায়বে কোনো উদ্বিগ্নতা নাই। আবুল ফজল মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই সৌন্দর্য দেখতে থাকে। পিছন থেকে পূর্ণিমার মা ঢুকে বলল, ‘মাইয়াডারে খুন না কইরা ছাড়বা না!’

আবুল ফজল পূর্ণিমার ওপর চোখ রেখে বলে, ‘ওর গায়ে আপনেরা হাত দেবেন না, দরকার হয় আমি আর আসব না।’

আবুল ফজল তিনদিন পূর্ণিমাদের বাড়িতে যায় না, স্কুলেও না। ঘরে ঘরে অবৈতনিক মাস্টার হয়ে অঙ্ক ব্যাকরণ নিয়ে মেতেও থাকে না। সে শুধু ছবি আঁকে অথবা ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু হয় না। এই তিনদিন সে যে ছোবলে দংশিত হয়েছে তার দংশন সে ইচ্ছা করেই নিত। আতঙ্কিত রমেন দাস তাকে দিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে সে তার একমাত্র মেয়েকে হরণ ক’রে নিঃস্ব করতে চায়। রমেন দাসের উদ্বেগের কারণ সেও। পূর্ণিমার মা তাকে বলেছে, তার কারণে পূর্ণিমা খুন হয়ে যাবে। অথচ আবুল ফজল তাকে বাঁচাতে চায়। পূর্ণিমার চোখ আঁকে। সেই পূর্ণ খোলা চোখ আবুল ফজলকে দেখে হাসে। আর সে তখন চারপাশ দেখে নিয়ে চুমু খায়। পানপাতার গড়নে চিবুক আঁকে। ঠোঁটের নিচে কম্পিত একটা তিল বসিয়ে দেয়। সেই তিলের ওপর আঙুল রাখে, তার ঠোঁট তখন নীরবে প্রসারিত হয়ে যায়। আবুল ফজলের বিধবা মা ছেলের সবই দেখে না-দেখার অভিনয় করে। ছেলের জন্য সে দোয়া করা ছাড়া কিছুই করণীয় নেই মনে করে। যদিও তার ইচ্ছা হয় রমেন দাসকে ডেকে বলে অথবা নিজেই একবার যেয়ে পূর্ণিমাকে আদর করে আসে। কী হলো তো অন্য জাতের মেয়ে। নামাজ কলেমা শিখিয়ে নিলেই হলো। আবুল ফজলের মা ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখে কখনো গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কখনো হাসে।

তিনদিন পর আবুল ফজল যখন নিজেই আবার পূর্ণিমাদের বাড়ি যাবে ঠিক করে তখন একটা চিরকুট পায়। এবং সেই চিরকুট মতো দুপুরের একটু পরে অন্যদিনের মতো মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষার পরীক্ষার্থী পূর্ণিমাকে পড়াতে যায়। কারণ পূর্ণিমা লিখেছে, ‘সব অঙ্ক যে ভুলে যাচ্ছি, আজ কি একবার আসবেন?’

আবুল ফজল পূর্ণিমাকে দেখে আঁতকে ওঠে। তার ঘরে পিসিমা বসে কাঁথা সেলাই করছে না। পূর্ণিমার দুই চিবুকে রক্ত জমে আছে। চোখ দেখে মনে হয় এই কিছুক্ষণ আগেও সে কেঁদেছে। তার কণ্ঠস্বরও জল কেটে কেটে বের হয়, ‘আমার জন্মের আগের রাতে মা স্বপ্নে দেখেছিল আমাদের বাড়িতে আগুন লেগে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেই তার পেট ব্যথা হয়। তারপর জীবন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আমার জন্ম। সেই ঘোরের মধ্যে থাকতে থাকতে আমার জন্মের খবর পেয়ে মা’র মুখে দীর্ঘদিন কেউ হাসি দেখেনি। আর ভাইবোনও হলো না। গতরাতে আমি সেরকম একটা স্বপ্ন দেখলাম। এইঘর দাউদাউ করে পুড়ছে আর আমরা দুজন হাত ধরে এই চেয়ারে বসে খুব হাসছি। আগুন আমাদের ঘিরে ধরলেও হাসি থামে না। তারপর যখন আমার চুলে আগুন ধরল কে যেন চুল ধরে টান দেয়। তখন ঘুম ভেঙে যায়। দেখি মা মাথায় হাত রেখে ডাকছে। তার চোখে জল। পিসিমাও কাঁদছে। তবে তা খুবই নিঃশব্দে। সকালেই এই অভাবিত দৃশ্য দেখে আমিও কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতেই একটি সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।’

আবুল ফজলের নিশ্বাস ঘনঘন পড়ছে। তার চোখে উৎকণ্ঠা, পূর্ণিমার হাত চেপে ধরে। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু পূর্ণিমা বুঝে তার সিদ্ধান্ত এই শব্দটির অর্থ বুঝে সে এমন উৎকণ্ঠিত। কিন্তু এই উৎকণ্ঠা প্রশমনের চেষ্টা করে না। বলে, ‘বাড়ি জমি সবই নাকি অন্যদের নামে, বাবা অন্তত আমাকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে আজ রাতেই চলে যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু গতরাতের ওই স্বপ্ন আমি ভুলতে পারছি না। আবুল ফজলের কণ্ঠে কোনো শব্দ আসে না। তার হৃৎপিন্ডের দ্রুত রক্ত চলাচলের শব্দ শুধু সে টের পায়। তার কেবল কামিয়ে আসা চিবুকে তাপ বাড়ে। সে অবশিষ্ট কথাও পূর্ণিমাকে বলার সুযোগ দেয়। দাউদাউ আগুনের মধ্যে আমরা পুড়ছি অথচ মুখে হাসি, এর অর্থ আমি বুঝতে চাই। আবুল ফজলের চোখের তারা জ্বলে ওঠে, কিন্তু পূর্ণিমা আর কিছু বলে না। এবং এই প্রথম প্রবল কান্নার তোড়ে সে ভেঙে পড়ে। বিহ্বল আবুল ফজল ডান হাত ওর খোলা চুলের ওপর রাখে। কিন্তু সে হাতে কোনো সাড়া নাই, মুখেও কোনো কথা আসে না, কর্নিয়ার শিরা উপশিরায় শুধু জলের বেগ, গভীর প্রস্রবণে দৃষ্টি ঝাপসা। তখন পিসিমা এসে পূর্ণিমাকে জাপটে ধরে। তার কান্না আর নিঃশব্দ থাকে না। আবুল ফজল দাঁড়ালেও পা ফেলার শক্তি পায় না। কোনোরকম করে বাড়ি ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে।

আবুল ফজল দেখে একটুকরো আগুনের ফুলকি চোখের সামনে শুধু নাচছে, সে হাত দিয়ে সেই আগুন ধরতে চায়, পারে না, আগুনের ফুলকি পিছিয়ে পড়ে। সে আবার ধরতে হাত বাড়ায়। হঠাৎ আগুনের ফুলকি লাফ দিয়ে পূর্ণিমার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়ে পড়ে। সেই লাল পাড়ের ওপর আগুনের বিন্দুকে আর দেখা যায় না। একই রঙের মধ্যে লুপ্ত হয় অথবা আগুনের বিধ্বংসী সংক্রাম গ্রাস করে ফেলে সব। আবুল ফজলের চোখের সামনে কী ব্যাকুল আগুনের দাহ বিন্দু থেকে বিশাল হয়ে ওঠে। পূর্ণিমা সেই আগুনের মহা উল্লাসের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে হাসতে পোড়ে। আবুল ফজলকে শেষ সময় আহ্বান করে, কিন্তু সে যেতে পারে না, পা বাড়াতে চাইলেও পারে না, পূর্ণিমা তবুও তাকে আহ্বান করে। যখন আগুনের মধ্যে পূর্ণিমা ছায়ার মতো মিলিয়ে যায় তখন সে শুধু চিৎকার দিয়ে উঠতে পারে। ‘পূর্ণিমা’ বলে আতঙ্কিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলে তার ঘুম ভেঙে যায়।

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর এই স্বপ্ন সবটাই মনে করতে পারে, অথবা মনে হয় এইমাত্র সে চাক্ষুষ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিমার স্বপ্নের কথাও মনে হয়। সেখানে সে আর পূর্ণিমা জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে হা হা করে হাসছে। তবে এখন কেন আগুনের মধ্যে পূর্ণিমার আহ্বান সত্ত্বেও প্রবেশ করতে পারল না! রাত্রির দ্রুত সঞ্চারে সন্ধ্যা লুপ্ত হয়ে গেলে আবুল ফজল রান্নাঘর থেকে শুকনা পাটখড়ি বের করে এনে জড়ো করে, তার ওপর কাঠের খড়িও সাজায়। পাটখড়িতে জড়িয়ে আছে পাটের আঁশ। কাজেই কেরোসিনের চেয়ে দ্রুত ওই আঁশ আগুন বিস্তার করতে পারবে। যখন আগুন মানুষের আয়তন ঢেকে ফেলে, আগুনের ওপর থেকে কোনো দন্ডায়মান মানুষের মাথাও দেখা যায় না তখন আবুল ফজলের মা আর্তচিৎকার দিয়ে ছুটে আসে। কিন্তু সে কাছে এগুতে পারে না। সেই হাহাকারও স্তব্ধ হয়ে যায় বিস্ময়ে। তার বিস্ময়পীড়িত চোখ দেখে আবুল ফজল সেই আগুনের পাশে ধ্যানীর মতো তাকিয়ে আছে। একসময় তার ঠোঁট প্রসারিত হয়। তার বিস্তৃত চিবুকে আগুনের রং টকটক করে। আবুল ফজলের মা’র চোখে পলক পড়ে না। আবুল ফজল কথা বলে। হয়তো দুহাত আগুনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়, সেই দৃশ্য আর আবুল ফজলের মা দেখতে পারে না, তার চোখ বুজে আসে ॥

***

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

পূর্ণিমার গ্রহণ

সাদ কামালী

image

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সঞ্জয় দে রিপন

আবুল ফজল নিশ্চিত আগুনই তার স্ত্রী, আগুনের মমতাময় স্পর্শে তার দৃষ্টি ঠান্ডা এবং হৃদয় হয় উষ্ণ। শরীরে বোধ করে বিলাস বৈভব। আগুনের ছোঁয়ায় কর্নিয়া আরও বড় বৃত্ত হলে চতুর্পাশে রং টলটল করে, দৃষ্টি হয় প্রখর। সকল ইন্দ্রিয় সে-সময় দৃষ্টির ¯স্নায়ুতে অতিরিক্ত শক্তি ও ক্ষমতার যোগান দেয়। ফলে আগুনের উজ্জ্বল আয়তক্ষেত্রের মধ্যে সে দর্শন পায় সেই রূপের বিমূর্ত-মূর্ত, স্থির-অস্থির, তরল বায়বীয় রূপ। আবুল ফজলের অপলক চোখের তারায় সে-রূপের প্রতিবিম্ব জাগে। ঠোঁট চিবুক কপালও আকুল মগ্নতায় আগুনের ওপর নিবদ্ধ করে রাখে। তখন তাকে আগুনপূজারি অথবা যজ্ঞের ঋষি মনে হতে পারে। মুখমন্ডলের ঘামে আগুনের ছায়া চকচক করে উঠলে ঋজু প্রতিজ্ঞ সন্ন্যাসী মনে হতে পারে, কিন্তু আবুল ফজলের অদূরে বিস্ময় কৌতূহল আর মজার দৃশ্য দেখার আনন্দে অপেক্ষমাণ প্রতিবেশীদের কাছে ঋষি সন্ন্যাসী কিছুই মনে হয় না। তারা কেউ তাকে পাগল বলে, বলে পাগলা ফজল, কেউ দেবদাস। তরুণ দু-একজন আরও বিদ্রুপ করে বলে দেবুদা।

যখন অগ্নিসংযোগ করে আবুল ফজল ধ্যানে তন্ময় থাকে না, যখন তাকে সামাজিক জীবন অতিবাহিত করতে হয়, তখন সে অপমানবোধ করে, ক্ষুব্ধ হয়, এবং যতদূর সম্ভব নির্জনে থাকে। অপারগতা দেবদাসকে করুণ হাস্যকর করেছিল, কিন্তু সমাজের ওই সব মানুষেরা কী জানে না আবুল ফজলের অপারগতা ছিল না, সে ওই অবুঝদের কিছু বলে না, কেন বলবে! যে আগুন পোড়ায়, জ্বালায়, ভস্ম করে দেয়, যে আগুনে পুড়ে সোনা হয়, নিষ্কলূষ করে সেই আগুনকে চিনিয়ে দিতে হবে! গ্রামের লোক কি দেখেনি, একবিন্দু আগুন কেমন মহিরুহ হয়ে ওঠে! একজন মানুষ তার গ্রাস এড়াতে পারে না। কীভাবে একচিলতে আগুনকে শরীরের সীমা ছাড়িয়ে বৃহৎ হতে দিয়েছিল! আগুনের ক্রম প্রজ্বলনের ক্ষমতা নিজের শরীর দিয়ে বিস্তৃত করে তুলেছিল।

বাজার থেকে কাঠের খড়ি কিনে আনে, গ্রাম থেকে পাঠখড়ি, আরও সংগ্রহ করে আম কাঁঠাল হিজলের শুকনা পাতা। একেক রাতে যখন তার ইচ্ছা হয়, যখন তার সঙ্গ ও দর্শনে আপ্লুত হতে চায় তখন ওই আগুনের কেন্দ্রে তাকে পেয়ে যায়। তারা পরস্পর কত কথায় উদ্দীপ্ত হয়, অভিমান করে, হাসে। আগুন আর বাতাসের সঙ্গমের ধ্বনি মুখর হয়ে উঠলে কেউ সে-সব শুনতে পারে না। ঠোঁটের নীরব বাক্সময়তাও কেউ দেখতে পায় না। তাদের চোখ ঘিরে থাকে আগুন, আগুন মুখে পাগলা ফজল। কখনো অবশ্য তারা দেখতে পায় আলোর ছায়া কেমন করে আবুল ফজলের শরীরে কিলবিল করে। কখনো দুহাত আগুনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয় আবুল ফজল, আগুনের অভ্যন্তর থেকেও দুটি হাত সেই হাতকে আঁকড়ে ধরে, তখন নিমেষের জন্য হলেও তারা পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। হয়তো আবুল ফজল নিজেই আগুনে প্রবেশ করে অথবা আগুন থেকে নির্গত হয়ে তাকে আলিঙ্গন দেয়। আবুল ফজলের ইচ্ছা এই আলিঙ্গন আরও দীর্ঘ, অনন্ত হোক। আবেগের জলে কণ্ঠস্বর আটকে যায়,

আরও একটু...।

পূর্ণিমা বাধা দেয়, না থাক।

কেন এমন হলো পূর্ণিমা!

আর কী হতো, আগুনই তো নিয়তি।

আবুল ফজল আর বলতে পারে না, তার স্বর অথই জলে ডুবে থাকে। চোখের কোল ঘিরেও জলের সর। তখন সব দৃশ্য ঝাপসা হয়ে ওঠে, দৃশ্য অন্তর্হিত হয়, আগুন নিভে ক্রমে চিকন ধোঁয়া অন্ধকারে মেশে।

পেট ও বুকের তলে হাত রেখে পূর্ণিমাকে সাঁতার শিখিয়ে ছিল আবুল ফজল। পেয়ারা বা আম না চাইবার আগেই পেড়ে দিত। আর পূর্ণিমা কাঁচা আম মাখিয়ে বলত, ‘আবুল ভাই বেশি ঝাল, কমে করে খান।’ তখন কারও মনে হয়নি ওই কাঁচা আমের টকে জিভে একরকম রস আসে, সেই রস সহজে নিবৃত্ত হতে চায় না। এইসব বিধি-সম্মতও নয়। মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষার একজোড়া মাস বাকি, এ-সময়ের মধ্যে পূর্ণিমাকে অঙ্কে লেটার পাইয়ে দেওয়ার জন্য আবুল ফজল দুপুর সন্ধ্যা পাটিগণিতের সকল কৌশল শিখিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এক বিকেলে পূর্ণিমার বাবা রমেন দাস হালটের মাঝখানে আবুল ফজলকে থামায়। যথারীতি নমস্কার জানিয়ে আবুল ফজল জানতে চায়, কি খবর? রমেন দাস একটু সময় নেয়। তার একটি হাত আবুল ফজলের কাঁধের ওপর রেখে মাথা নিচু করে থাকে। সে আরও সময় নিয়ে দুটি কথা বলে এবং তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হেঁটে চলে যায়। এবার আবুল ফজল পা বাড়াতে সময় নেয়, তার পায়ে সহজে গতি ফিরে আসে না। রমেন দাসের দুটি কথা সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, শূন্যে ছুড়ে দিয়ে তা আবার শোনে, ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করে। হালটের দুপাশের গমখেতে, মাঘী সরিষার হলুদ উচ্ছ্বাসে বসন্তের আগাম বাতাস শিরশির করে কাঁপতে কাঁপতে তাকেও কাঁপিয়ে দেয়। আবুল ফজল তবুও ওই দুটি কথার বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারে না, বুঝতে চায়ও না। চুলের মধ্যে সব আঙুল ডুবিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে, ‘সম্ভব না, বাবা সম্ভব না।’ দ্বিতীয় কথাটি আর পুনরাবৃত্তি না করে আবুল ফজল পূর্ণিমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে যায়। গ্রামের পশ্চিম-উত্তর কোণে সাত আটটি বাড়ি নিয়ে পূর্ণিমাদের পাড়া। সকলে এখন নেই, গ্রামের অবশিষ্টাংশের মতো এখানে জনবসতি ঘন নয়, বরং কোনো এক বিস্ময়কর নিয়মে জনবসতি ক্রমে ক্ষীয়মান। যদিও এখানে মাঘের শেষ অপরাহ্ণে বসন্তের বাতাস একই রকম প্রবহমান। হালকা চাদর জড়িয়ে রমেন দাস বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আবুল ফজলকে দেখে চোখে একবার বেশি পলক পড়ে মাত্র, আর কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না, আবুল ফজলও তাকে পাশ কাটিয়ে বরাবরের মতো ভেতরের উঠানে যায়। আলা মাটিতে লেপা ঘরের সাদা ডোয়ার পাশে গাঁদাফুল, তার পাশে লাল টকটকে জবা, এক চিলতে রঙিন রোদ জবাফুলগুলোকে খুব উজ্জ্বল করে তুলেছে। অদূরে পাড় বাঁধানো তুলসীগাছ, তুলসীগাছের নিচে পূর্ণিমার মা শুকনা নারকেলের পাতা থেকে সলা তুলছে। আবুল ফজল পূর্ণিমাকে দেখতে পায় না। পূর্ণিমার মা একবার চোখ তুলে পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয়। কোনোকিছুই বলে না। তখন সে তার উপস্থিতি এইভাবে সরব করে তুলতে চায় নমস্কার মাসি মা।

বসো, বাবা।

শীত তো চলে গেল, এখনো আপনাদের কুল পাকল না!

পূর্ণিমার মা হাতের শুকনা নারকেলপাতা আর বটির ওপর থেকে চোখ না তুলেই বলে, ‘পুনিরে ওর মামা নিয়া গ্যাছে, কাপুড়া সদরদী।’

আবুল ফজল কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়, আর একমাসও নাই ফাইন্যাল পরীক্ষার, এখন বেড়াতে যাওয়া কেন সে তা উচ্চারণ করতে পারে না। সহসাই তার মনে হয় এই প্রশ্নের মধ্যে হয়তো সেই সত্যিই লুকিয়ে আছে যা পূর্ণিমার বাবা আজ বিকালে বলেছে। আবুল ফজল দ্রুত পায়ে হালটে নেমে হাঁটতে থাকে। পথে একজন ছাত্র তাকে সালাম জানায়, কেউ কেউ তাকে এড়িয়ে যায়, তাদের হাতের মুঠায় স্টার সিগারেটের ধোঁয়া চিকন হয়ে বেরিয়ে মাঘের কুয়াশায় মেশে। ক্রমে আলো কমতে কমতে যখন রাত্রির পূর্ণ অন্ধকার নেমে আসে, আবুল ফজল তখন আবিষ্কার করে সে কাপুড়া সদরদী পৌঁছে গেছে। তার পায়ে ধাক্কা লাগে পূর্ণিমার মামা শ্রীমন্ত দাসের বাড়ির সামনে বিশাল বটগাছের শিকড়। বটগাছের প্রশস্ত গোড়া ঘিরে একটি চায়ের দোকানের পাশে দুটি মুদি দোকানও আছে। আবুল ফজল লক্ষ করে এক কোনায় কিছু মাটি লেপা, সেখানে একটা খোলা প্রদীপ জ্বলছে। কিছু জবাফুল এবং একটা ভাঙা নারকেল। বেঞ্চের কোনায় বসে সে একটা চা নেয়। চা দোকানের ছোট বিক্রেতাটি আবুল ফজলকে চমকে দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনি? পুনিদি এতক্ষণ এইহানে বইসা ছিল। কাইলই আবার চইলা যাবে।’ সে চায়ে শেষ চুমুক দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে ওই জবাফুল নারকেল আর খোলা প্রদীপ দেখতে চায়, পারে না। বাতাসে প্রদীপ নিভে গেছে, জবা দেখা যায় না। সেখানে গাঢ় অন্ধকার।

দুপুরের পর অন্যদিনের মতো আবুল ফজল অঙ্ক শেখাতে ওদের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। দূর থেকেই পূর্ণিমা তাকে দেখতে পেয়ে হালটে নেমে আসে। তার চোখে আনন্দ আর মুখে কথা বিগলিত। আবুল ফজল অবাক হয়, পূর্ণিমার এই সহজ আচরণ খুব প্রত্যাশিত নয়। পূর্ণিমা দুঃখ করে কালকে পড়া হলো না আজ কোচিং ক্লাসে যেতে পারল না। আবুল ফজল পূর্ণ চোখে পূর্ণিমাকে দেখে। পূর্ণিমা সেই চোখের ওপর তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। হাতের পেন্সিল শক্ত করে ধরে। তার চোখ চিবুক ঠোঁট ঘিরে হঠাৎ ছায়া নামে। এবং খুব ধীরে বলে, ‘আমরা বোধ হয় চলে যাব, বাবা বাড়ি বিক্রির চেষ্টা করছে।’ আবুল ফজল এখন বুঝতে পারে অথবা না বুঝে তার উপায় থাকে না রমেন দাসের দ্বিতীয় কথাটি।

আমি তো কাকাকে বলেছিলাম তোমাদের কোনো ভয় নাই। আমি আছি। আবুল ফজলের স্বর গাঢ় শোনায়।

পূর্ণিমা মাথা উঁচু করে, ‘বাবা হয়তো কারো ভরসায় থাকতে চায় না।’

ওর স্বর একটু কাঁপে। আবুল ফজল পূর্ণিমার হাত ধরে চাপ দেয়।

আমাদের কী হবে পূর্ণিমা!

হাত ছাড়িয়ে পূর্ণিমা জ্যামিতি বক্স টেনে নেয়। সেখান থেকে স্কেল কম্প্যাস বের করতে করতে বলে, ‘আজ সম্পাদ্যগুলো শেষ করে ফেলি।’

পড়ার টেবিল ঘেষে চৌকিতে এসে বসে বিধবা পিসি। সেখানে বসে কাঁথা সেলাই করছে। গত কয়েকদিন থেকেই পিসি এ-সময় এখানে বসে কাঁথা সেলাই করে। আজ মনে হলো এই কাঁথা সেলাই পিসির কখনো শেষ হবে না। অন্তত যতদিন সে পড়াতে আসবে। তখন তার আরও মনে হয়, স্কুলের ছেলেদের বাথরুমে সে একটি লেখা পড়েছে। সে-সব শব্দ কখনো মুখে উচ্চারণ করতে পারেনি। সে-সব লেখকেরা পূর্ণিমা লিখতে দুটি বানান ভুল করেছে, তার নাম লিখেছে আবুইল্লা। আবুল ফজলের ইচ্ছা হয় পূর্ণিমাকে জিজ্ঞেস করে, স্কুলের বন্ধুরা তাকে এই প্রসঙ্গে কী বলে। কিন্তু পিসি সূচের ওপর অসতর্ক চোখ এবং কথার ওপর সতর্ক কান রেখে সেলাই করে যাচ্ছে। কাজেই কিছু জিজ্ঞেস না করে সে সরাসরি পিসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘পিসিমা, মনটা ভালো না, কিছু বলেন তো।’

পিসি একটু নড়েচড়ে বলে, ‘কী জানি বাবা, আমি মুখ্যু মানুষ।’

‘ভাবছি হিন্দু হব, পারব তো?’

পিসিমা এবার হাতের সূচ ফেলে মুখ উঁচু করে তোলে, ‘তুমি হিন্দু হবা, তোমার কপাল পুড়ছেনি?’

আবুল ফজল পিসির ওপর খোলা চোখ রেখে বলে, ‘আমি পূর্ণিমাকে পরীক্ষার পরই যে বিয়ে করব।’

পিসির শীর্ণ শরীর ক্ষোভে কাঁপছিল। এবার উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘তার আগে ও গলায় দড়ি দিয়ে মরবে, ওরে আগুনে পুড়াইয়া মরব।’

আবুল ফজলকে এলাকায় তত বিব্রত হতে হয় না, অথবা সে হয় না। যখন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অফিসঘরে ডেকে নিয়ে বলে, ‘ইসলামে বিধর্মীকে বিয়ে করার অনুমতি আছে, একজন ভিন্নধর্মীকে মোসলমান করলে তার সোওয়াবও মেলে, কিন্তু ছাত্রীর সাথে এসব কি ভালো দেখায়?’

আবুল ফজল এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল, এবার তার চোখ প্রধান শিক্ষকের ওপর রেখে বলে, ‘তাহলে শিক্ষকতা ছেড়ে দেই।’

প্রধান শিক্ষক তার হাত চেপে ধরে, ‘স্কুল কমিটির দু-একজন কিছু বললেও আপনার প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে। ভুল বুঝবেন না।’

আবুল ফজল হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে যায়।

পূর্ণিমা ক্লাসে আসেনি। এলোমেলো অস্থির পায়ে আবুল ফজল ওদের বাড়িতে চলে আসে। এরকম অপ্রত্যাশিত সময়ে আবুল ফজলকে দেখেও এ-বাড়ির কেউ অবাক হয় না। রমেন দাস হাত থেকে হুক্কা নামিয়ে আবুল ফজলকে বসতে বলে। চারদিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে আবুল ফজল বসে। রমেন দাস ধীর এবং গাঢ় স্বরে বলে, ‘বিন্নার পালানে আমাগো সাড়ে তিন কাঠা জাগা ছিল। দু-একজনরে গোপনে বলছিলাম কিনবে কিনা। তা তারা জানালো ওইখানে আমাগো কোনো জমি নাকি নাই, নকশা-পর্চায় দেখলাম অন্য নাম।’

আবুল ফজলের মাথা আরেকটু ঝুঁকে পড়ে। রমেন দাস সামান্য বিরতি নিয়ে তেমন অনুচ্চ কণ্ঠে কিছু বলতে শুরু করলে শ্লেষ্মা জড়িত কাশি প্রায় দম আটকে ফেলে। তবুও সেই কাশির দমকের মধ্যে চোখে লাল রং আর গরম জল নিয়ে বলে, ‘একটা মাত্র মাইয়া আমার, তারেও কুলত্যাগী করতে চাও? তোমাগো আর কত লাগবে?’

আবুল ফজল নিরেট স্তব্ধ হয়ে যায়। তার শরীরে কোনো সাড়া নাই। রমেন দাস আবার হুক্কায় স্বাভাবিকভাবে টান দিতে শুরু করে। উঠানে উজ্জ্বল রোদ। যদিও সে-রোদে তাপ কম। পিঠের কাপড় সরিয়ে উপুড় হয়ে সেই রোদ পোহায় পূর্ণিমার পিসি। পূর্ণিমার মা ঘাট থেকে উঠে এলো কাঁধে ভেজা কাপড়, হাতে জলভর্তি ছোট একটি পিতলের কলস। দড়িতে কাপড় মেলতে মেলতে ডাক দেয়, ‘অ পুনি।’

আবুল ফজল মাথা উঁচু করে উঠানে চোখ মেলে রাখে। সেই দৃষ্টির ওপর পূর্ণিমার ছায়া পড়ল না। তখন রমেন দাস বলে, ‘কাইল রাইতে মাইয়াডারে পিটাইছি। সকালে দেহি গায়ে জ্বর।’

আবুল ফজল দাঁড়িয়ে পড়ে। তীব্র চোখে একবার রমেন দাসকে দেখে সে তার পরিচিত ঘরে আর সবাইকে উপেক্ষা করেই ঢোকে। পূর্ণিমা উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বালিশের ওপর খোলা চুল ছড়ানো। চিবুকের একপাশ দেখা যায়। ঘুমে বিভোর ওই মুখায়বে কোনো উদ্বিগ্নতা নাই। আবুল ফজল মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই সৌন্দর্য দেখতে থাকে। পিছন থেকে পূর্ণিমার মা ঢুকে বলল, ‘মাইয়াডারে খুন না কইরা ছাড়বা না!’

আবুল ফজল পূর্ণিমার ওপর চোখ রেখে বলে, ‘ওর গায়ে আপনেরা হাত দেবেন না, দরকার হয় আমি আর আসব না।’

আবুল ফজল তিনদিন পূর্ণিমাদের বাড়িতে যায় না, স্কুলেও না। ঘরে ঘরে অবৈতনিক মাস্টার হয়ে অঙ্ক ব্যাকরণ নিয়ে মেতেও থাকে না। সে শুধু ছবি আঁকে অথবা ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু হয় না। এই তিনদিন সে যে ছোবলে দংশিত হয়েছে তার দংশন সে ইচ্ছা করেই নিত। আতঙ্কিত রমেন দাস তাকে দিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে সে তার একমাত্র মেয়েকে হরণ ক’রে নিঃস্ব করতে চায়। রমেন দাসের উদ্বেগের কারণ সেও। পূর্ণিমার মা তাকে বলেছে, তার কারণে পূর্ণিমা খুন হয়ে যাবে। অথচ আবুল ফজল তাকে বাঁচাতে চায়। পূর্ণিমার চোখ আঁকে। সেই পূর্ণ খোলা চোখ আবুল ফজলকে দেখে হাসে। আর সে তখন চারপাশ দেখে নিয়ে চুমু খায়। পানপাতার গড়নে চিবুক আঁকে। ঠোঁটের নিচে কম্পিত একটা তিল বসিয়ে দেয়। সেই তিলের ওপর আঙুল রাখে, তার ঠোঁট তখন নীরবে প্রসারিত হয়ে যায়। আবুল ফজলের বিধবা মা ছেলের সবই দেখে না-দেখার অভিনয় করে। ছেলের জন্য সে দোয়া করা ছাড়া কিছুই করণীয় নেই মনে করে। যদিও তার ইচ্ছা হয় রমেন দাসকে ডেকে বলে অথবা নিজেই একবার যেয়ে পূর্ণিমাকে আদর করে আসে। কী হলো তো অন্য জাতের মেয়ে। নামাজ কলেমা শিখিয়ে নিলেই হলো। আবুল ফজলের মা ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখে কখনো গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কখনো হাসে।

তিনদিন পর আবুল ফজল যখন নিজেই আবার পূর্ণিমাদের বাড়ি যাবে ঠিক করে তখন একটা চিরকুট পায়। এবং সেই চিরকুট মতো দুপুরের একটু পরে অন্যদিনের মতো মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষার পরীক্ষার্থী পূর্ণিমাকে পড়াতে যায়। কারণ পূর্ণিমা লিখেছে, ‘সব অঙ্ক যে ভুলে যাচ্ছি, আজ কি একবার আসবেন?’

আবুল ফজল পূর্ণিমাকে দেখে আঁতকে ওঠে। তার ঘরে পিসিমা বসে কাঁথা সেলাই করছে না। পূর্ণিমার দুই চিবুকে রক্ত জমে আছে। চোখ দেখে মনে হয় এই কিছুক্ষণ আগেও সে কেঁদেছে। তার কণ্ঠস্বরও জল কেটে কেটে বের হয়, ‘আমার জন্মের আগের রাতে মা স্বপ্নে দেখেছিল আমাদের বাড়িতে আগুন লেগে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেই তার পেট ব্যথা হয়। তারপর জীবন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আমার জন্ম। সেই ঘোরের মধ্যে থাকতে থাকতে আমার জন্মের খবর পেয়ে মা’র মুখে দীর্ঘদিন কেউ হাসি দেখেনি। আর ভাইবোনও হলো না। গতরাতে আমি সেরকম একটা স্বপ্ন দেখলাম। এইঘর দাউদাউ করে পুড়ছে আর আমরা দুজন হাত ধরে এই চেয়ারে বসে খুব হাসছি। আগুন আমাদের ঘিরে ধরলেও হাসি থামে না। তারপর যখন আমার চুলে আগুন ধরল কে যেন চুল ধরে টান দেয়। তখন ঘুম ভেঙে যায়। দেখি মা মাথায় হাত রেখে ডাকছে। তার চোখে জল। পিসিমাও কাঁদছে। তবে তা খুবই নিঃশব্দে। সকালেই এই অভাবিত দৃশ্য দেখে আমিও কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতেই একটি সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।’

আবুল ফজলের নিশ্বাস ঘনঘন পড়ছে। তার চোখে উৎকণ্ঠা, পূর্ণিমার হাত চেপে ধরে। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু পূর্ণিমা বুঝে তার সিদ্ধান্ত এই শব্দটির অর্থ বুঝে সে এমন উৎকণ্ঠিত। কিন্তু এই উৎকণ্ঠা প্রশমনের চেষ্টা করে না। বলে, ‘বাড়ি জমি সবই নাকি অন্যদের নামে, বাবা অন্তত আমাকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে আজ রাতেই চলে যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু গতরাতের ওই স্বপ্ন আমি ভুলতে পারছি না। আবুল ফজলের কণ্ঠে কোনো শব্দ আসে না। তার হৃৎপিন্ডের দ্রুত রক্ত চলাচলের শব্দ শুধু সে টের পায়। তার কেবল কামিয়ে আসা চিবুকে তাপ বাড়ে। সে অবশিষ্ট কথাও পূর্ণিমাকে বলার সুযোগ দেয়। দাউদাউ আগুনের মধ্যে আমরা পুড়ছি অথচ মুখে হাসি, এর অর্থ আমি বুঝতে চাই। আবুল ফজলের চোখের তারা জ্বলে ওঠে, কিন্তু পূর্ণিমা আর কিছু বলে না। এবং এই প্রথম প্রবল কান্নার তোড়ে সে ভেঙে পড়ে। বিহ্বল আবুল ফজল ডান হাত ওর খোলা চুলের ওপর রাখে। কিন্তু সে হাতে কোনো সাড়া নাই, মুখেও কোনো কথা আসে না, কর্নিয়ার শিরা উপশিরায় শুধু জলের বেগ, গভীর প্রস্রবণে দৃষ্টি ঝাপসা। তখন পিসিমা এসে পূর্ণিমাকে জাপটে ধরে। তার কান্না আর নিঃশব্দ থাকে না। আবুল ফজল দাঁড়ালেও পা ফেলার শক্তি পায় না। কোনোরকম করে বাড়ি ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে।

আবুল ফজল দেখে একটুকরো আগুনের ফুলকি চোখের সামনে শুধু নাচছে, সে হাত দিয়ে সেই আগুন ধরতে চায়, পারে না, আগুনের ফুলকি পিছিয়ে পড়ে। সে আবার ধরতে হাত বাড়ায়। হঠাৎ আগুনের ফুলকি লাফ দিয়ে পূর্ণিমার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়ে পড়ে। সেই লাল পাড়ের ওপর আগুনের বিন্দুকে আর দেখা যায় না। একই রঙের মধ্যে লুপ্ত হয় অথবা আগুনের বিধ্বংসী সংক্রাম গ্রাস করে ফেলে সব। আবুল ফজলের চোখের সামনে কী ব্যাকুল আগুনের দাহ বিন্দু থেকে বিশাল হয়ে ওঠে। পূর্ণিমা সেই আগুনের মহা উল্লাসের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে হাসতে পোড়ে। আবুল ফজলকে শেষ সময় আহ্বান করে, কিন্তু সে যেতে পারে না, পা বাড়াতে চাইলেও পারে না, পূর্ণিমা তবুও তাকে আহ্বান করে। যখন আগুনের মধ্যে পূর্ণিমা ছায়ার মতো মিলিয়ে যায় তখন সে শুধু চিৎকার দিয়ে উঠতে পারে। ‘পূর্ণিমা’ বলে আতঙ্কিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলে তার ঘুম ভেঙে যায়।

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর এই স্বপ্ন সবটাই মনে করতে পারে, অথবা মনে হয় এইমাত্র সে চাক্ষুষ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিমার স্বপ্নের কথাও মনে হয়। সেখানে সে আর পূর্ণিমা জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে হা হা করে হাসছে। তবে এখন কেন আগুনের মধ্যে পূর্ণিমার আহ্বান সত্ত্বেও প্রবেশ করতে পারল না! রাত্রির দ্রুত সঞ্চারে সন্ধ্যা লুপ্ত হয়ে গেলে আবুল ফজল রান্নাঘর থেকে শুকনা পাটখড়ি বের করে এনে জড়ো করে, তার ওপর কাঠের খড়িও সাজায়। পাটখড়িতে জড়িয়ে আছে পাটের আঁশ। কাজেই কেরোসিনের চেয়ে দ্রুত ওই আঁশ আগুন বিস্তার করতে পারবে। যখন আগুন মানুষের আয়তন ঢেকে ফেলে, আগুনের ওপর থেকে কোনো দন্ডায়মান মানুষের মাথাও দেখা যায় না তখন আবুল ফজলের মা আর্তচিৎকার দিয়ে ছুটে আসে। কিন্তু সে কাছে এগুতে পারে না। সেই হাহাকারও স্তব্ধ হয়ে যায় বিস্ময়ে। তার বিস্ময়পীড়িত চোখ দেখে আবুল ফজল সেই আগুনের পাশে ধ্যানীর মতো তাকিয়ে আছে। একসময় তার ঠোঁট প্রসারিত হয়। তার বিস্তৃত চিবুকে আগুনের রং টকটক করে। আবুল ফজলের মা’র চোখে পলক পড়ে না। আবুল ফজল কথা বলে। হয়তো দুহাত আগুনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়, সেই দৃশ্য আর আবুল ফজলের মা দেখতে পারে না, তার চোখ বুজে আসে ॥

***