অন্য লোকালয়

জাকির তালুকদার

অ্যানা বিড়ি না টানলে চলে না! সালেহার গলায় কপট রাগের সাথে একটু অনুযোগও।

তারা, স্বামী-স্ত্রী শুতে যাবার আগেই দুইবার রাতের শেয়াল ডেকে চলে গেছে। গাঁয়ে এত রাত অব্দি কোনো ঘরেই আলো জ্বলে না বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া। আজ তাদের বাড়িতে বিশেষ রাতই বটে। কেননা এরফান কাল সকালেই চলে যাবে ঢাকায়।

কেননা গাঁয়ে তার দিন গুজরানোর মতো আর কিছু করার নেই। কিছু করার সুযোগও নেই। যেহেতু তারা জেনেছে ঢাকায় গেলে কিছু না কিছু উপায় হয়েই যায়। দুই বছর আগে এই রকম পরিস্থিতিতেই ঢাকায় পাড়ি দিয়েছিল মকবুল। তার সংস্থান হয়েছে। সে গাঁয়ে এসেছে ঢাকার জেল্লা মেখে। বলে কয়ে রাজি করিয়েছে। তার সাথেই ঢাকা যাবে এরফান।

মেয়ে তিনজন ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দশটা। ছোটটা আবার বাপ-ন্যাওটা। দিনে একবেলা অন্তত ভাতের গরাস বাপের হাত থেকে নেওয়া চাই। তিন, সাড়ে পাঁচ আর সাত। সাড়ে পাঁচ আর সাত বাপের ঢাকা যাত্রায় মহাখুশি। কী কী আনতে হবে, সেই ফর্দ বানিয়েছে দিনভর। রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত। ফর্দ আর কী! কয়টা জিনিসের নামই বা তারা জানে! সরকারবাড়ির বাচ্চাদের যেসব খেলনা নিয়ে খেলতে দেখেছে, সেগুলোর নামও তাদের জানা নেই। তার মধ্যেও বাপকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেছে জিনিসগুলো ঠিক কোন ধরনের আর তা দিয়ে সরকারবাড়ির মেয়েরা কী কী করে, কীভাবে খেলে। বাপ তাদের কথায় তাল মিলিয়েছে। খুব বুঝেছে সে জিনিসগুলো সম্পর্কে। আর এই আনল বলে! যেহেতু ঢাকাতে যাচ্ছে।

তো সেই মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে রাত দশটা।

তারপর সালেহা শুরু করল এরফানের জিনিসপত্র গোছানো। কিছুদিন ব্র্র্যাকের সেবিকার কাজ করেছিল সে। টিবি রোগীকে আট মাস ধরে ওষুধ খাওয়াতে হতো তখন। ব্র্যাকের স্যারেরা টিবির ওষুধ রাখার জন্য দিয়েছিল ছোট সাইজের টিনের ট্রাংক। এতদিন সালেহার কাছে ওটা ছিল নিজের গোপনীয়তার একমাত্র কুঠুরি। আর নিজের গোপনীয়তা এবং সঞ্চয়কে উগড়ে দিয়ে ট্রাংকে সাজানো হলো এরফানের ঢাকা যাত্রার সম্বল। লুঙ্গি-জামা-গামছা-তেলের শিশি-দাঁত মাজার নিমের ডাল ও মাজন-আয়না-চিরুনি-দাদের মলম। পেতে শোয়ার কাঁথা আর বালিশ মিলিয়ে আরেকটা বেডিং। এইসবে আরো এক ঘণ্টা। তারপরে নিজেকে তৈরি করা। স্বামী বিদায় নেবে আজ রাত পোয়ালেই। কতদিনের জন্য তার এই যাত্রা- ঠিক নেই। মন যতই ভারাক্রান্ত হোক, পারস্পরিক শারীরিক আস্বাদ গ্রহণে রাতটাকে সহনীয় করে তোলার উদ্যোগ তাকে নিতেই হয়। তো সেইভাবে নিজেকে মেজে-ঘষে প্রস্তুত করে যখন সে শয্যায় এল, দেখল বিছানার একপাশে বসে বিড়ি ফুঁকছে এরফান।

কোনোদিন দেয়নি, কিন্তু আজ বউয়ের এই আহ্লাদি অনুযোগকে যথেষ্ট মূল্য দিল এরফান। জানালা দিয়ে বিড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে গিয়ে কুলকুচা করে এল। ততক্ষণে সালেহা কাপড়-চোপড় আলগা করে আধা আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে। এরফান এসে পাশে শুতেই তার বগলে মুখ গুঁজে দিল সালেহা। তার চুলে বিলি কাটল এরফান। আঙুলে স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা। একটু একটু কাঁপছেও আঙুলগুলো। কাঁপুনির পেছনে কতখানি কাম, কতখানি আগামীকাল শুরু হতে যাওয়া অনিশ্চিত যাত্রা তা বোঝা মুশকিল। শুধু সালেহা অনুভব করে, এতখানি প্রীতিময় স্পর্শ সে বহুদিন পায়নি। তার নাক আর গলা দিয়ে আদুরে বেড়ালের মতো উম্ম্ বেরায়। সে আরো ঘন হয় এরফানের। এরফান তার চুলে হাত বুলিয়েই চলে। আর রাত বেড়ে চলে।

তাদের স্বাভাবিক রাতগুলোতে এই সময়েরও বহু আগে প্রাক-নিদ্রা মৈথুন শেষে তারা ঘুমে তলিয়ে যায়। আজ রাত বাড়ে। কিন্তু মনে হয় কারোই, বিশেষত এরফানের, তাড়া নেই।

ঢাকাত যায়্যা যে কী আছে কপালোত!

ফোঁওশ্ দীর্ঘশ্বাসের সাথে শব্দগুলো বেরিয়ে আসে এরফানের বুক চিরে। আর সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে যায় সালেহার শরীর।

অন্য কোনো উপায় না থাকাতে যে সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাধ্য হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তের অনিশ্চিতির তীক্ষèতা তাদের মুহূর্তের মধ্যেই আক্রমণ করে। ঢাকায় গিয়ে কতদিন লাগবে এরফানের কাজ পেতে, কোথায় থাকবে সে, যদিও মকবুলের ভরসাতেই সে পাড়ি দিচ্ছে অচেনা রাজধানীতে- সেই মকবুলই বা কতখানি কী করতে পারবে, যতদিন না এরফান টাকা পাঠাতে পারছে ততদিন এখানে তিন মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলবে সালেহা- এইসব প্রশ্ন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দুজনের ওপর। তখন অন্ধকারেও বোঝা যায়, সালেহার চোখ এখন সম্পূর্ণ সাদা, ব্রীড়া উধাও, আর এরফান সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তার আক্রমণে পুরোপুরি শিথিল।

অ্যানা এত ভাবনার কিছু নাই, সব ঠিক হয়া যাবি!

সালেহা স্বামীকে সাহস যোগানোর চেষ্টা করে। আর এরফানও চেষ্টা করে সেখান থেকে যতটা পারে সাহস শুষে নিতে নিজের মধ্যে। সে আবার সালেহার দিকে পাশ ফেরে। কতদিন পরে যে আবার তারা মিলিত হতে পারবে ঠিক নেই। তাই আজকের রাতটা অন্তত মিলনহীন কাটানো ঠিক হবে না। তারা আবার ঘনিষ্ঠতার উদ্যোগ নেয়, পরস্পরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু দুজনেই টের পায়, কোথায় যেন ছন্দটা বার বার কেটে যাচ্ছে। আর সেই ছন্দপতনের জায়গাটা পেরিয়ে আসতে না পেরে তারা দুজনেই বিরক্ত হয় মনে মনে। ফলে খুব অসংলগ্ন একটা বাক্যের মতো সালেহার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে- ঢাকাত যায়্যা যদি রিকশা চালান, অ্যানা সাবধান! ঐ জাগাত নাকি গাড়ি-ঘোড়ার অন্ত নাই। কখন কী হয়, কে কবার পারে!

এরফান যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সালেহার গায়ের সাথে নিজেকে সংলগ্ন রেখেও তাৎক্ষণিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তারপর ঠেসলাগানো গলায় বলে- ঢাকা শহরেত রিকশা চালাবার ইচ্ছা আমি করিছি কি সাধে? একখান ভ্যান যদি কিনা গেলনি, বউ-বেটিক ফালায় দ্যাশ ছাড়ে কেডা!

তার কথার লুকানো খোঁচা সালেহা ঠিকই টের পায়। তার ভাইদের কাছ থেকে টাকা এনে একটা ভ্যান কিনে দেয়ার প্রস্তাব করেছিল এরফান। কিন্তু সালেহা রাজি হয়নি ভাইদের কাছে হাত পাততে। সালেহা জানে, তার ভাইয়েরা আজো এরফানের সাথে তার বিয়েটা ভালোভাবে নিতে পারেনি। এই গ্রামে বাড়ি হলেও সালেহার বাপেরা একটু উঁচু ঘর। পয়সা বেশি। এরফানের থাকার মধ্যে ছিল বাবরি দুলিয়ে হাডুডু খেলায় মেডেল পাওয়া আর বাঁশি বাজানো। তাই দিয়েই সালেহাকে কুপোকাত করে ফেলেছিল সে। ভালোবাসা-টাসা করা হয়নি তাদের। গ্রামে সে পরিবেশও ছিল না। তবে ভাব তো হয়েছিলই। তাই যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল, সালেহা তার ভাবীদের কাছে মুখ ফুটে বলেই ফেলল- বিয়ে করলে, এরফান।

ভাইয়েরা রাজি ছিল না। কেননা তারা জানে, বাঁশি বাজানদার সংসারে কুনো খেয়াল রাখে না। ঐ রকম মাইনষের সাথোত পিরিত জমে, বিয়া-শাদি চলে না।

তবু সালেহার গোঁ।

শেষে চাপে পড়ে ভাইয়েরা মেনে নিল বিয়ে। কিন্তু বিয়ে বলতে দেশ-গেরামে যে হই-চই, আনা-নেয়া বোঝায় তা হয়নি। সামর্থ্য ছিল। তবু ভাইয়েরা কোনো আয়োজনই প্রায় করেনি।

তাই বিয়ের পরে পারতপক্ষে স্বামীকে নিয়ে ভাইদের কাছে ভিড়ত না সালেহা। মুখে না বললেও এরফানের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাত তার ভাইয়েরা। সেই ভাইদের কাছে ভ্যান কেনার টাকা কীভাবে চাইতে পারে সালেহা! টাকা হয়তো দেবে। তার আগে বলবে- বাঁশিঅলা তাইলে অ্যানা ভ্যান চালাবার চায়!

আর তাদের গলায় যে শ্লেষ থাকবে, তার ভারে সালেহার ইচ্ছা হবে মাটির নিচে সেঁধিয়ে যাবার।

এই প্রসঙ্গ পাশ কাটানোর জন্য সালেহা দুই হাতে এরফানের মুখ ধরে ঠোঁট কামড়ানোর মতো করে চুমু খায়। বলে, তুমি নিজের পায়ের উপরোত খাড়ায়া দেখায়া দ্যান। যে কয়মাস লাগে। হামি ঠিক এই দিন সামাল দিবার পারমো।

এইসব বলে সালেহা শুরু হতে হতে যাওয়া মিথুনভঙ্গি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ করে। কিন্তু কী আশ্চর্য! শাড়িমুক্ত পেলব উরু এবং লুঙ্গিমুক্ত পুরুষালি উরুর পারস্পরিক সংঘর্ষে বিদ্যুৎ ঝলসায় না। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে পরস্পরকে জাগরিত করার। ঠিক এই সময়ে কেঁধে ওঠে ছোট মেয়েটা- বাজান! সাপ! সাপ!

ত্বরিতে উঠে বসে দুইজন। চট করে হারিকেনের আলো বাড়ায় এরফান। নাহ কোনো সরীসৃপের চিহ্ন চোখে পড়ে না তাদের। মেয়েরা ঘুমাচ্ছে অঘোরে। ছোট মেয়েটাও দুঃস্বপ্ন দেখে বোধ হয়। তার বুক-গলার ঘাম মুছিয়ে তাকে পাশ ফিরিয়ে শোয়ায় এরফান। পরম মমতায় হাত বোলায় মেয়ের শরীরে। তারপর তারা নিজেদের চৌকিতে ফেরে।

তবে কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে দুজনেই। বাতি ফের কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই আবছা অন্ধকারেও সালেহা টের পায় এরফানের চোখ খোলা। ঘরের চালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এরফান। সেই চোখে কি সজলতা! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এরফান নিঃশব্দে কাঁদছে, এই সম্ভাবনার কথা মনে হতে সালেহার নিজের চোখেই পানি আসে।

আহারে, কইলজ্যার টুকরা কয়ডা পাছোত ফালায়া কেইবা দূরের দ্যাশোত যায় শখ কর‌্যা!

স্বামীর এই মনঃকষ্ট এই মুহূর্তে দূর করার জন্য অন্য কোনো পথ জানা নেই সালেহার। সে তাই জানা পথটাতেই আরেকবার চেষ্টা করে। প্রথমে মমতার স্পর্শ রাখে এরফানের চুলে, কাপালে, গালে, ঠোঁটে। তারপর সেই স্পর্শে ক্রমান্বয়ে উষ্ণতা মেশাতে থাকে। উষ্ণ হতে থাকে তার হাতের তালু। কিন্তু এরফান বরফ। চকিতে সালেহার মনে একটা পূর্বস্মৃতি খেলে যায়।

তাদের বিয়ে তখন বছরখানেক হয়েছে। হঠাৎ পর পর কয়েক রাত ধরে দেখা যায়, এরফান শারীরিক সম্পর্কে উদাসীন। ঘরেও ফেরে রাত করে। সালেহা সাজে গা ধুয়ে, গন্ধরাজ তেলের সুবাস ছড়িয়ে চুলে বিনুনি করে। পানের সাথে খয়ের বেশি করে মেশায়, যাতে চুন-খয়েরের রসায়নে ঠোঁট-জিভ টুকটুকে দেখায়। পরনের শাড়ি পাট করে পরে। কিন্তু রাতের পর রাত দেখা যায়, এরফান বিন্দুমাত্র উদ্রিক্ত হয় না। সালেহার তখন মনে শংকা। সেই ভয় তার ভেতরে ঢোকে, স্বামীকে নিয়ে কম বেশি সব তরুণী বধূ যে ভয়ে ভোগে। সালেহা পর্যবেক্ষণ বাড়িয়ে দেয়। এরফানের শরীরে কি অন্য কোনো সুবাস? তার চোখে কি অন্য কারো ছায়া? তার মনে কি অন্য কারো অধিষ্ঠান?

দিনেও কি এরফান তার দিকে ভালো করে তাকায়!

রাতের পর রাত যায়। এরফান ঘরে ফেরে। হারিকেনের আলোয় ভাত খায়। তারপর বারান্দায় বসে বিড়ি টানে। ঘরে এসে উন্মুখ সালেহার পাশে শুয়ে থাকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে ঘুমিয়ে পড়ে।

অবশেষে সালেহা তার সইকে নিয়ে যায় পানবুড়ির কাছে। পানবুড়ির সব তুকতাক পান দিয়ে। বুড়ি সব শুনে তাকে অভয় দেয়। আবার এমন সোনার পিততিমা ফেলে অন্যদিকে মন দেবার জন্য এরফানকে গালমন্দও করে। তারপর তাকে পান দেয়। শিখিয়ে দেয় মন্ত্রও। রাতের খাবারের পর মন্ত্র ফুঁকে এই পান গুঁজে দিতে হবে এরফানের মুখে। বুড়ির সাথে বার বার আউড়ে মন্ত্র মুখস্থ করে সালেহা-

‘হাট মোহিনী ঘাট মোহিনী

অমুকি মোহিনীর নাম বাঁজা

আই দন্ড চক্র ধরি তাক মহিমা যাং প্রজা

মোহিনীয়ে মোহিনীয়ে চড়ায় হাতী।

পাত্র মন্ত্রী মোহিলুং ভরি তলার মাটি।।

উত্তরের পরে আছিল তেলি

ডাক লৈলুং ঘুরত তুলি।

সোনার যামি রূপার খাটি।

মুই মোর চচুং উল্টা করি

মুই কান্দিলুং খোপা

রাজা রানির মুখত দিলং সোপা।

মুই মারেছো পাক

সোয়ামী মোর পানে চায়া থাক।’

মন্ত্র তো হলো। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। এরফান পান খায় না। তার নেশা বিড়ির। রাতে মন্ত্র ফুঁকে পান হাতে নিয়ে বসে রইল সালেহা। দ্বিধা কাটিয়ে সেই পান কিছুতেই তুলে দিতে পারল না স্বামীর মুখে।

কী আশ্চর্য! তার দরকারও হলো না। সে রাতেই তাকে তুমুল ভাসিয়ে নিয়েছিল এরফান। তখনই বোধহয় গর্ভে আসে বড় মেয়েটি।

তারপরেও আর পানমন্ত্রের দরকার কখনো পড়েনি। কিন্তু মন্ত্রটা মুখস্থ আছে সালেহার। আজ কি কাজে লাগবে? কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তো আলাদা।

এরফান বিড়বিড় করে- অঘ্রাণ মাসে ধানের কামে নওগাঁ-জয়পুরত গেলে বোধ হয় ভ্যানের টাকা জুটান গেলনি।

কামলা দিতে যাবার কথা বলছে এরফান। বছরে সাত মাস এই এলাকার মানুষের কোনো কাজ থাকে না। বছরে দুইবার পুরুষরা দলে দলে কাজের জন্য হিজরত করে। একবার ধান রোপণের সময়, একবার ধান কাটার সময়। যারা রোপণ এবং কর্তনের কাজ জানে, তারা সবাই পনের বছরের কিশোর থেকে পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ় পর্যন্ত ট্রেনে-বাসের ছাদে-ট্রাকে বোঝাই হয়ে দলে দলে চলে যায় নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, শান্তাহারে। এরফান এবার যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সালেহা যেতে দেয়নি- তুমি শ্যাষে কামলা দিব্যান।

সম্মানের ভয় ছাড়াও আরো ভয় ছিল সালেহার। সে দেখেছে ধানের কাজের মৌসুমে যারা গ্রাম ছাড়ে, তাদের সবাই কাজ শেষে ঘরে ফেরে না। কেউ মারা যায় সাপ-খোপের কামড়ে, অসুখে-বিসুখে, কেউ মরে বাসের ছাদ চেপে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি উল্টে পিষ্ট হয়ে। আবার কেউ কেউ বেঁচে থেকেও ফেরে না। বিয়ে-শাদি করে, কাজ-কাম জুটিয়ে থেকে যায় ঐসব অঞ্চলেই। এতগুলো ঝুঁকি নিয়ে এরফানকে পাঠাতে চায়নি সালেহা। আর এখন সালেহা তাকে যেতে দিচ্ছে আরো অনেক দূরে, ভয়ানক রকম অচেনা এক শহরে। এরফানের মুখ থেকে তিক্ততা ঝরে, মিয়্যা মাইনষের কথা শুনলে দুইন্যা চলে না।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হয় সালেহার। চাপা ঝাঁঝালো গলায় বলে, দোষ এখন মিয়্যা মাইনষের না! সুমায় থাকতে কত হাত-পাও ধরনু। আপনের বাপ জমিনখানি বান্ধা রাখিছিল সোনামিয়ার কাছত। হামি গায়ের গয়না খুল্যা তোমাক দিনু। জমিডা ছাড়া করেন। না তুমি সেই টাকা দিয়া দোকান বসালেন বন্দরে। এক বছরে দোকান শ্যাষ। আজ ঐ চার বিঘা জমি নিজের থাকলে! দুই বিঘাত কলার বোগ পুঁতলে সারা বছরে বাজার খরচ হয়। আর যদি আলু-পিঁয়াজ দুই বিঘাত, তাহলে খালি বুন্যা দেওয়া আর একবার নিড়ানি। আর একবার ছাই ছিটায় দেওয়া। দুই মাস বরফঘরে রাখলে দাম ডবল। জমিখান ছাড় করালে আজ অ্যানা খারাপ অবস্থা হয়।

এবার আর কথা খুঁজে পায় না এরফান। বাপের বাড়ি থেকে যে গয়নাগুলো এনেছিল, সেগুলোও খোয়া গেছে এরফানের কারণে, তা এই সুযোগে মনে করিয়ে দিল সালেহা।

এভাবে কথাগুলো বলে ফেলে একটু আফসোস হয় সালেহার। এই সময়ে কথাগুলো না বললেও চলত। সে তাৎক্ষণিক আপসের উদ্যোগ নেয়। এরফানের বুকের লোমে আঙুলের ঢেউ তোলে। বলে, যাউক ঐসব কথা। তুমি তো ঢাকাত যাচ্ছেনই। হাতোত টাকা জমলেই জমিখান ছাড়ান করা লাগবি। চিরকাল তো আর ঢাকা টাউনোত থাকা যাবি না।

এরফান উত্তর করে না।

বাইরে থেকে রাতের নিজস্ব শব্দগুলো তাদের ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। একটু পর পর তক্ষকের ডাক ভেসে আসে, আর লোমকূপের গোড়ায় একটু একটু শিরশিরানি অনুভব করে সালেহা। হাতবিশেক দূরেই সোনামিয়ার বাগানের শুরু। তার মধ্যে পুকুর। তার চারধারে লাগানো গাছগুলো থেকে কুঁড়ি টুপ করে পড়ে আর সাথে সাথে পুকুরের আফ্রিকান মাগুরগুলো পানিতে খলবল করে ঘাই মারে। একটু পর পর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কানের পর্দারও ওপর আছড়ে পড়ে। বাগান পাহাড়াদার এয়াকুব বুড়ার ঘর থেকে দমক দমক কাশির আওয়াজ ভেসে আসে। তাদের উঠোনের একমাত্র পেয়ারা ডাল থেকে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে আর তাদের মনে করিয়ে দেয় এখন রাত ধীরে ধীরে শেষের দিকে যাচ্ছে।

সালেহা আবার কথা শুরু করতে চায়। কিন্তু এবার দেখা যায়, সারাদিনের ক্লান্তি, রাত জাগার ক্লান্তি এবং ঘুমের আগ্রাসন মিলে তার গলাটাকে একটু জড়ানো এবং ভারি করে তুলেছে। তবু সে স্ত্রীর দায়িত্ববোধ থেকে আবার অগ্রসর হয়। বলতে থাকে- ঢাকা টাউনের মিয়া মাইনসেরা... আল্লারে কী বেশরম! শরীল ঢাকার জন্যে তো না, কাপড় পিন্দে শরীর আরো উদলা করার জন্যে। মিয়্যা মানুষ ঐ রকম কাপড় পিন্দে ছি ছি!

তুমি জানলে ক্যাংকা কর‌্যা? এরফানের গলাতেও ঘুমের রেশ, তুমিতো আর ঢাকাত যাওনি।

ক্যা সিনামাত দেখিছি না। কামিজ পিন্দে তো একদিক পুরাডাই ফাঁড়া। ছি!

এরফান সাড়া দেয় না। সে কি মনের চোখে একদিকে কামিজ ফাঁড়া উরু দুলিয়ে চলা কোনো মেয়েমানুষকে দেখতে শুরু করেছে!

কিছুক্ষণ পরে সালেহা শাসনের সুরে বলে, খবরদার, তুমি কিন্তু ঐসব মিয়্যা মাইনষের দিকে অ্যানাও তাকাবেন না। ঐসব দেখলেও গুনা হয়। আল্লার কাছে কিয়ামতের দিন চোখের পাপের হিসাব দেওয়া লাগবি।

এরফানের তরফ থেকে এবারও কোনো উত্তর আসে না।

সালেহার হাই ওঠে। তবু বলে চলে- আর যারা শাড়ি-বেলাউজ পরে ... কী যে ফিনফিন্যা শাড়ি, য্যান পিঁয়াজের খোসা! আর বেলাউজ! গলার দিকত এত্ত কাটা যে বুটির গোড়াতক দেখা যায়। মারে মা! ঐভাবে মিয়্যা মানুষ কী করা ব্যাটা মাইনষের সামনোত বার হয়!

নিজের ব্লাউজের ওপরের দুটি বোতাম খুলে ওপরের অংশ ভাঁজ দিয়ে নিজের বুকের উদোমতা পরিমাপ করে সালেহা- ছি ছি এতখানি উদলা বুক লিয়্যা মিয়্যামানুষ লোকের সামনোত খাড়ায়! দ্যাখেন, এই এতখানি উদলা!

নিজের উন্মোচিত বুক নিয়ে স্বামীর দিকে ফেরে সালেহা। স্বামী নিশ্চুপ। তখন তার বুকে হাত দেয় সালেহা। টের পায় এরফানের বুক উঠছে-নামছে খুব নিয়মিতভাবে। তার নিশ্বাস যথেষ্ট গভীরও। অনিশ্চয়তার ভীতি জমতে জমতে ক্লান্তিতে পরিণত হয়েছে। সেই ক্লান্তিতে এরফান এখন গভীর ঘুমে।

নিশ্বাস ফেলে নিজেও পাশ ফিরে শোয় সালেহা। রাতের আর বেশি বাকি নেই। তিন প্রহরের শেয়াল ডাকার সময় বোধ হয় এসেই গেল। চোখ বন্ধ করল সালেহাও। সামনে যা-ই হোক, ক্লান্তি সবাইকেই বিশ্রাম নিতে বাধ্য করে।

আর বিশ্রামের অধিকার সকলেরই আছে।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

অন্য লোকালয়

জাকির তালুকদার

image

অ্যানা বিড়ি না টানলে চলে না! সালেহার গলায় কপট রাগের সাথে একটু অনুযোগও।

তারা, স্বামী-স্ত্রী শুতে যাবার আগেই দুইবার রাতের শেয়াল ডেকে চলে গেছে। গাঁয়ে এত রাত অব্দি কোনো ঘরেই আলো জ্বলে না বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া। আজ তাদের বাড়িতে বিশেষ রাতই বটে। কেননা এরফান কাল সকালেই চলে যাবে ঢাকায়।

কেননা গাঁয়ে তার দিন গুজরানোর মতো আর কিছু করার নেই। কিছু করার সুযোগও নেই। যেহেতু তারা জেনেছে ঢাকায় গেলে কিছু না কিছু উপায় হয়েই যায়। দুই বছর আগে এই রকম পরিস্থিতিতেই ঢাকায় পাড়ি দিয়েছিল মকবুল। তার সংস্থান হয়েছে। সে গাঁয়ে এসেছে ঢাকার জেল্লা মেখে। বলে কয়ে রাজি করিয়েছে। তার সাথেই ঢাকা যাবে এরফান।

মেয়ে তিনজন ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দশটা। ছোটটা আবার বাপ-ন্যাওটা। দিনে একবেলা অন্তত ভাতের গরাস বাপের হাত থেকে নেওয়া চাই। তিন, সাড়ে পাঁচ আর সাত। সাড়ে পাঁচ আর সাত বাপের ঢাকা যাত্রায় মহাখুশি। কী কী আনতে হবে, সেই ফর্দ বানিয়েছে দিনভর। রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত। ফর্দ আর কী! কয়টা জিনিসের নামই বা তারা জানে! সরকারবাড়ির বাচ্চাদের যেসব খেলনা নিয়ে খেলতে দেখেছে, সেগুলোর নামও তাদের জানা নেই। তার মধ্যেও বাপকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেছে জিনিসগুলো ঠিক কোন ধরনের আর তা দিয়ে সরকারবাড়ির মেয়েরা কী কী করে, কীভাবে খেলে। বাপ তাদের কথায় তাল মিলিয়েছে। খুব বুঝেছে সে জিনিসগুলো সম্পর্কে। আর এই আনল বলে! যেহেতু ঢাকাতে যাচ্ছে।

তো সেই মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে রাত দশটা।

তারপর সালেহা শুরু করল এরফানের জিনিসপত্র গোছানো। কিছুদিন ব্র্র্যাকের সেবিকার কাজ করেছিল সে। টিবি রোগীকে আট মাস ধরে ওষুধ খাওয়াতে হতো তখন। ব্র্যাকের স্যারেরা টিবির ওষুধ রাখার জন্য দিয়েছিল ছোট সাইজের টিনের ট্রাংক। এতদিন সালেহার কাছে ওটা ছিল নিজের গোপনীয়তার একমাত্র কুঠুরি। আর নিজের গোপনীয়তা এবং সঞ্চয়কে উগড়ে দিয়ে ট্রাংকে সাজানো হলো এরফানের ঢাকা যাত্রার সম্বল। লুঙ্গি-জামা-গামছা-তেলের শিশি-দাঁত মাজার নিমের ডাল ও মাজন-আয়না-চিরুনি-দাদের মলম। পেতে শোয়ার কাঁথা আর বালিশ মিলিয়ে আরেকটা বেডিং। এইসবে আরো এক ঘণ্টা। তারপরে নিজেকে তৈরি করা। স্বামী বিদায় নেবে আজ রাত পোয়ালেই। কতদিনের জন্য তার এই যাত্রা- ঠিক নেই। মন যতই ভারাক্রান্ত হোক, পারস্পরিক শারীরিক আস্বাদ গ্রহণে রাতটাকে সহনীয় করে তোলার উদ্যোগ তাকে নিতেই হয়। তো সেইভাবে নিজেকে মেজে-ঘষে প্রস্তুত করে যখন সে শয্যায় এল, দেখল বিছানার একপাশে বসে বিড়ি ফুঁকছে এরফান।

কোনোদিন দেয়নি, কিন্তু আজ বউয়ের এই আহ্লাদি অনুযোগকে যথেষ্ট মূল্য দিল এরফান। জানালা দিয়ে বিড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে গিয়ে কুলকুচা করে এল। ততক্ষণে সালেহা কাপড়-চোপড় আলগা করে আধা আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে। এরফান এসে পাশে শুতেই তার বগলে মুখ গুঁজে দিল সালেহা। তার চুলে বিলি কাটল এরফান। আঙুলে স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা। একটু একটু কাঁপছেও আঙুলগুলো। কাঁপুনির পেছনে কতখানি কাম, কতখানি আগামীকাল শুরু হতে যাওয়া অনিশ্চিত যাত্রা তা বোঝা মুশকিল। শুধু সালেহা অনুভব করে, এতখানি প্রীতিময় স্পর্শ সে বহুদিন পায়নি। তার নাক আর গলা দিয়ে আদুরে বেড়ালের মতো উম্ম্ বেরায়। সে আরো ঘন হয় এরফানের। এরফান তার চুলে হাত বুলিয়েই চলে। আর রাত বেড়ে চলে।

তাদের স্বাভাবিক রাতগুলোতে এই সময়েরও বহু আগে প্রাক-নিদ্রা মৈথুন শেষে তারা ঘুমে তলিয়ে যায়। আজ রাত বাড়ে। কিন্তু মনে হয় কারোই, বিশেষত এরফানের, তাড়া নেই।

ঢাকাত যায়্যা যে কী আছে কপালোত!

ফোঁওশ্ দীর্ঘশ্বাসের সাথে শব্দগুলো বেরিয়ে আসে এরফানের বুক চিরে। আর সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে যায় সালেহার শরীর।

অন্য কোনো উপায় না থাকাতে যে সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাধ্য হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তের অনিশ্চিতির তীক্ষèতা তাদের মুহূর্তের মধ্যেই আক্রমণ করে। ঢাকায় গিয়ে কতদিন লাগবে এরফানের কাজ পেতে, কোথায় থাকবে সে, যদিও মকবুলের ভরসাতেই সে পাড়ি দিচ্ছে অচেনা রাজধানীতে- সেই মকবুলই বা কতখানি কী করতে পারবে, যতদিন না এরফান টাকা পাঠাতে পারছে ততদিন এখানে তিন মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলবে সালেহা- এইসব প্রশ্ন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দুজনের ওপর। তখন অন্ধকারেও বোঝা যায়, সালেহার চোখ এখন সম্পূর্ণ সাদা, ব্রীড়া উধাও, আর এরফান সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তার আক্রমণে পুরোপুরি শিথিল।

অ্যানা এত ভাবনার কিছু নাই, সব ঠিক হয়া যাবি!

সালেহা স্বামীকে সাহস যোগানোর চেষ্টা করে। আর এরফানও চেষ্টা করে সেখান থেকে যতটা পারে সাহস শুষে নিতে নিজের মধ্যে। সে আবার সালেহার দিকে পাশ ফেরে। কতদিন পরে যে আবার তারা মিলিত হতে পারবে ঠিক নেই। তাই আজকের রাতটা অন্তত মিলনহীন কাটানো ঠিক হবে না। তারা আবার ঘনিষ্ঠতার উদ্যোগ নেয়, পরস্পরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু দুজনেই টের পায়, কোথায় যেন ছন্দটা বার বার কেটে যাচ্ছে। আর সেই ছন্দপতনের জায়গাটা পেরিয়ে আসতে না পেরে তারা দুজনেই বিরক্ত হয় মনে মনে। ফলে খুব অসংলগ্ন একটা বাক্যের মতো সালেহার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে- ঢাকাত যায়্যা যদি রিকশা চালান, অ্যানা সাবধান! ঐ জাগাত নাকি গাড়ি-ঘোড়ার অন্ত নাই। কখন কী হয়, কে কবার পারে!

এরফান যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সালেহার গায়ের সাথে নিজেকে সংলগ্ন রেখেও তাৎক্ষণিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তারপর ঠেসলাগানো গলায় বলে- ঢাকা শহরেত রিকশা চালাবার ইচ্ছা আমি করিছি কি সাধে? একখান ভ্যান যদি কিনা গেলনি, বউ-বেটিক ফালায় দ্যাশ ছাড়ে কেডা!

তার কথার লুকানো খোঁচা সালেহা ঠিকই টের পায়। তার ভাইদের কাছ থেকে টাকা এনে একটা ভ্যান কিনে দেয়ার প্রস্তাব করেছিল এরফান। কিন্তু সালেহা রাজি হয়নি ভাইদের কাছে হাত পাততে। সালেহা জানে, তার ভাইয়েরা আজো এরফানের সাথে তার বিয়েটা ভালোভাবে নিতে পারেনি। এই গ্রামে বাড়ি হলেও সালেহার বাপেরা একটু উঁচু ঘর। পয়সা বেশি। এরফানের থাকার মধ্যে ছিল বাবরি দুলিয়ে হাডুডু খেলায় মেডেল পাওয়া আর বাঁশি বাজানো। তাই দিয়েই সালেহাকে কুপোকাত করে ফেলেছিল সে। ভালোবাসা-টাসা করা হয়নি তাদের। গ্রামে সে পরিবেশও ছিল না। তবে ভাব তো হয়েছিলই। তাই যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল, সালেহা তার ভাবীদের কাছে মুখ ফুটে বলেই ফেলল- বিয়ে করলে, এরফান।

ভাইয়েরা রাজি ছিল না। কেননা তারা জানে, বাঁশি বাজানদার সংসারে কুনো খেয়াল রাখে না। ঐ রকম মাইনষের সাথোত পিরিত জমে, বিয়া-শাদি চলে না।

তবু সালেহার গোঁ।

শেষে চাপে পড়ে ভাইয়েরা মেনে নিল বিয়ে। কিন্তু বিয়ে বলতে দেশ-গেরামে যে হই-চই, আনা-নেয়া বোঝায় তা হয়নি। সামর্থ্য ছিল। তবু ভাইয়েরা কোনো আয়োজনই প্রায় করেনি।

তাই বিয়ের পরে পারতপক্ষে স্বামীকে নিয়ে ভাইদের কাছে ভিড়ত না সালেহা। মুখে না বললেও এরফানের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাত তার ভাইয়েরা। সেই ভাইদের কাছে ভ্যান কেনার টাকা কীভাবে চাইতে পারে সালেহা! টাকা হয়তো দেবে। তার আগে বলবে- বাঁশিঅলা তাইলে অ্যানা ভ্যান চালাবার চায়!

আর তাদের গলায় যে শ্লেষ থাকবে, তার ভারে সালেহার ইচ্ছা হবে মাটির নিচে সেঁধিয়ে যাবার।

এই প্রসঙ্গ পাশ কাটানোর জন্য সালেহা দুই হাতে এরফানের মুখ ধরে ঠোঁট কামড়ানোর মতো করে চুমু খায়। বলে, তুমি নিজের পায়ের উপরোত খাড়ায়া দেখায়া দ্যান। যে কয়মাস লাগে। হামি ঠিক এই দিন সামাল দিবার পারমো।

এইসব বলে সালেহা শুরু হতে হতে যাওয়া মিথুনভঙ্গি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ করে। কিন্তু কী আশ্চর্য! শাড়িমুক্ত পেলব উরু এবং লুঙ্গিমুক্ত পুরুষালি উরুর পারস্পরিক সংঘর্ষে বিদ্যুৎ ঝলসায় না। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে পরস্পরকে জাগরিত করার। ঠিক এই সময়ে কেঁধে ওঠে ছোট মেয়েটা- বাজান! সাপ! সাপ!

ত্বরিতে উঠে বসে দুইজন। চট করে হারিকেনের আলো বাড়ায় এরফান। নাহ কোনো সরীসৃপের চিহ্ন চোখে পড়ে না তাদের। মেয়েরা ঘুমাচ্ছে অঘোরে। ছোট মেয়েটাও দুঃস্বপ্ন দেখে বোধ হয়। তার বুক-গলার ঘাম মুছিয়ে তাকে পাশ ফিরিয়ে শোয়ায় এরফান। পরম মমতায় হাত বোলায় মেয়ের শরীরে। তারপর তারা নিজেদের চৌকিতে ফেরে।

তবে কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে দুজনেই। বাতি ফের কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই আবছা অন্ধকারেও সালেহা টের পায় এরফানের চোখ খোলা। ঘরের চালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এরফান। সেই চোখে কি সজলতা! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এরফান নিঃশব্দে কাঁদছে, এই সম্ভাবনার কথা মনে হতে সালেহার নিজের চোখেই পানি আসে।

আহারে, কইলজ্যার টুকরা কয়ডা পাছোত ফালায়া কেইবা দূরের দ্যাশোত যায় শখ কর‌্যা!

স্বামীর এই মনঃকষ্ট এই মুহূর্তে দূর করার জন্য অন্য কোনো পথ জানা নেই সালেহার। সে তাই জানা পথটাতেই আরেকবার চেষ্টা করে। প্রথমে মমতার স্পর্শ রাখে এরফানের চুলে, কাপালে, গালে, ঠোঁটে। তারপর সেই স্পর্শে ক্রমান্বয়ে উষ্ণতা মেশাতে থাকে। উষ্ণ হতে থাকে তার হাতের তালু। কিন্তু এরফান বরফ। চকিতে সালেহার মনে একটা পূর্বস্মৃতি খেলে যায়।

তাদের বিয়ে তখন বছরখানেক হয়েছে। হঠাৎ পর পর কয়েক রাত ধরে দেখা যায়, এরফান শারীরিক সম্পর্কে উদাসীন। ঘরেও ফেরে রাত করে। সালেহা সাজে গা ধুয়ে, গন্ধরাজ তেলের সুবাস ছড়িয়ে চুলে বিনুনি করে। পানের সাথে খয়ের বেশি করে মেশায়, যাতে চুন-খয়েরের রসায়নে ঠোঁট-জিভ টুকটুকে দেখায়। পরনের শাড়ি পাট করে পরে। কিন্তু রাতের পর রাত দেখা যায়, এরফান বিন্দুমাত্র উদ্রিক্ত হয় না। সালেহার তখন মনে শংকা। সেই ভয় তার ভেতরে ঢোকে, স্বামীকে নিয়ে কম বেশি সব তরুণী বধূ যে ভয়ে ভোগে। সালেহা পর্যবেক্ষণ বাড়িয়ে দেয়। এরফানের শরীরে কি অন্য কোনো সুবাস? তার চোখে কি অন্য কারো ছায়া? তার মনে কি অন্য কারো অধিষ্ঠান?

দিনেও কি এরফান তার দিকে ভালো করে তাকায়!

রাতের পর রাত যায়। এরফান ঘরে ফেরে। হারিকেনের আলোয় ভাত খায়। তারপর বারান্দায় বসে বিড়ি টানে। ঘরে এসে উন্মুখ সালেহার পাশে শুয়ে থাকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে ঘুমিয়ে পড়ে।

অবশেষে সালেহা তার সইকে নিয়ে যায় পানবুড়ির কাছে। পানবুড়ির সব তুকতাক পান দিয়ে। বুড়ি সব শুনে তাকে অভয় দেয়। আবার এমন সোনার পিততিমা ফেলে অন্যদিকে মন দেবার জন্য এরফানকে গালমন্দও করে। তারপর তাকে পান দেয়। শিখিয়ে দেয় মন্ত্রও। রাতের খাবারের পর মন্ত্র ফুঁকে এই পান গুঁজে দিতে হবে এরফানের মুখে। বুড়ির সাথে বার বার আউড়ে মন্ত্র মুখস্থ করে সালেহা-

‘হাট মোহিনী ঘাট মোহিনী

অমুকি মোহিনীর নাম বাঁজা

আই দন্ড চক্র ধরি তাক মহিমা যাং প্রজা

মোহিনীয়ে মোহিনীয়ে চড়ায় হাতী।

পাত্র মন্ত্রী মোহিলুং ভরি তলার মাটি।।

উত্তরের পরে আছিল তেলি

ডাক লৈলুং ঘুরত তুলি।

সোনার যামি রূপার খাটি।

মুই মোর চচুং উল্টা করি

মুই কান্দিলুং খোপা

রাজা রানির মুখত দিলং সোপা।

মুই মারেছো পাক

সোয়ামী মোর পানে চায়া থাক।’

মন্ত্র তো হলো। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। এরফান পান খায় না। তার নেশা বিড়ির। রাতে মন্ত্র ফুঁকে পান হাতে নিয়ে বসে রইল সালেহা। দ্বিধা কাটিয়ে সেই পান কিছুতেই তুলে দিতে পারল না স্বামীর মুখে।

কী আশ্চর্য! তার দরকারও হলো না। সে রাতেই তাকে তুমুল ভাসিয়ে নিয়েছিল এরফান। তখনই বোধহয় গর্ভে আসে বড় মেয়েটি।

তারপরেও আর পানমন্ত্রের দরকার কখনো পড়েনি। কিন্তু মন্ত্রটা মুখস্থ আছে সালেহার। আজ কি কাজে লাগবে? কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তো আলাদা।

এরফান বিড়বিড় করে- অঘ্রাণ মাসে ধানের কামে নওগাঁ-জয়পুরত গেলে বোধ হয় ভ্যানের টাকা জুটান গেলনি।

কামলা দিতে যাবার কথা বলছে এরফান। বছরে সাত মাস এই এলাকার মানুষের কোনো কাজ থাকে না। বছরে দুইবার পুরুষরা দলে দলে কাজের জন্য হিজরত করে। একবার ধান রোপণের সময়, একবার ধান কাটার সময়। যারা রোপণ এবং কর্তনের কাজ জানে, তারা সবাই পনের বছরের কিশোর থেকে পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ় পর্যন্ত ট্রেনে-বাসের ছাদে-ট্রাকে বোঝাই হয়ে দলে দলে চলে যায় নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, শান্তাহারে। এরফান এবার যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সালেহা যেতে দেয়নি- তুমি শ্যাষে কামলা দিব্যান।

সম্মানের ভয় ছাড়াও আরো ভয় ছিল সালেহার। সে দেখেছে ধানের কাজের মৌসুমে যারা গ্রাম ছাড়ে, তাদের সবাই কাজ শেষে ঘরে ফেরে না। কেউ মারা যায় সাপ-খোপের কামড়ে, অসুখে-বিসুখে, কেউ মরে বাসের ছাদ চেপে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি উল্টে পিষ্ট হয়ে। আবার কেউ কেউ বেঁচে থেকেও ফেরে না। বিয়ে-শাদি করে, কাজ-কাম জুটিয়ে থেকে যায় ঐসব অঞ্চলেই। এতগুলো ঝুঁকি নিয়ে এরফানকে পাঠাতে চায়নি সালেহা। আর এখন সালেহা তাকে যেতে দিচ্ছে আরো অনেক দূরে, ভয়ানক রকম অচেনা এক শহরে। এরফানের মুখ থেকে তিক্ততা ঝরে, মিয়্যা মাইনষের কথা শুনলে দুইন্যা চলে না।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হয় সালেহার। চাপা ঝাঁঝালো গলায় বলে, দোষ এখন মিয়্যা মাইনষের না! সুমায় থাকতে কত হাত-পাও ধরনু। আপনের বাপ জমিনখানি বান্ধা রাখিছিল সোনামিয়ার কাছত। হামি গায়ের গয়না খুল্যা তোমাক দিনু। জমিডা ছাড়া করেন। না তুমি সেই টাকা দিয়া দোকান বসালেন বন্দরে। এক বছরে দোকান শ্যাষ। আজ ঐ চার বিঘা জমি নিজের থাকলে! দুই বিঘাত কলার বোগ পুঁতলে সারা বছরে বাজার খরচ হয়। আর যদি আলু-পিঁয়াজ দুই বিঘাত, তাহলে খালি বুন্যা দেওয়া আর একবার নিড়ানি। আর একবার ছাই ছিটায় দেওয়া। দুই মাস বরফঘরে রাখলে দাম ডবল। জমিখান ছাড় করালে আজ অ্যানা খারাপ অবস্থা হয়।

এবার আর কথা খুঁজে পায় না এরফান। বাপের বাড়ি থেকে যে গয়নাগুলো এনেছিল, সেগুলোও খোয়া গেছে এরফানের কারণে, তা এই সুযোগে মনে করিয়ে দিল সালেহা।

এভাবে কথাগুলো বলে ফেলে একটু আফসোস হয় সালেহার। এই সময়ে কথাগুলো না বললেও চলত। সে তাৎক্ষণিক আপসের উদ্যোগ নেয়। এরফানের বুকের লোমে আঙুলের ঢেউ তোলে। বলে, যাউক ঐসব কথা। তুমি তো ঢাকাত যাচ্ছেনই। হাতোত টাকা জমলেই জমিখান ছাড়ান করা লাগবি। চিরকাল তো আর ঢাকা টাউনোত থাকা যাবি না।

এরফান উত্তর করে না।

বাইরে থেকে রাতের নিজস্ব শব্দগুলো তাদের ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। একটু পর পর তক্ষকের ডাক ভেসে আসে, আর লোমকূপের গোড়ায় একটু একটু শিরশিরানি অনুভব করে সালেহা। হাতবিশেক দূরেই সোনামিয়ার বাগানের শুরু। তার মধ্যে পুকুর। তার চারধারে লাগানো গাছগুলো থেকে কুঁড়ি টুপ করে পড়ে আর সাথে সাথে পুকুরের আফ্রিকান মাগুরগুলো পানিতে খলবল করে ঘাই মারে। একটু পর পর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কানের পর্দারও ওপর আছড়ে পড়ে। বাগান পাহাড়াদার এয়াকুব বুড়ার ঘর থেকে দমক দমক কাশির আওয়াজ ভেসে আসে। তাদের উঠোনের একমাত্র পেয়ারা ডাল থেকে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে আর তাদের মনে করিয়ে দেয় এখন রাত ধীরে ধীরে শেষের দিকে যাচ্ছে।

সালেহা আবার কথা শুরু করতে চায়। কিন্তু এবার দেখা যায়, সারাদিনের ক্লান্তি, রাত জাগার ক্লান্তি এবং ঘুমের আগ্রাসন মিলে তার গলাটাকে একটু জড়ানো এবং ভারি করে তুলেছে। তবু সে স্ত্রীর দায়িত্ববোধ থেকে আবার অগ্রসর হয়। বলতে থাকে- ঢাকা টাউনের মিয়া মাইনসেরা... আল্লারে কী বেশরম! শরীল ঢাকার জন্যে তো না, কাপড় পিন্দে শরীর আরো উদলা করার জন্যে। মিয়্যা মানুষ ঐ রকম কাপড় পিন্দে ছি ছি!

তুমি জানলে ক্যাংকা কর‌্যা? এরফানের গলাতেও ঘুমের রেশ, তুমিতো আর ঢাকাত যাওনি।

ক্যা সিনামাত দেখিছি না। কামিজ পিন্দে তো একদিক পুরাডাই ফাঁড়া। ছি!

এরফান সাড়া দেয় না। সে কি মনের চোখে একদিকে কামিজ ফাঁড়া উরু দুলিয়ে চলা কোনো মেয়েমানুষকে দেখতে শুরু করেছে!

কিছুক্ষণ পরে সালেহা শাসনের সুরে বলে, খবরদার, তুমি কিন্তু ঐসব মিয়্যা মাইনষের দিকে অ্যানাও তাকাবেন না। ঐসব দেখলেও গুনা হয়। আল্লার কাছে কিয়ামতের দিন চোখের পাপের হিসাব দেওয়া লাগবি।

এরফানের তরফ থেকে এবারও কোনো উত্তর আসে না।

সালেহার হাই ওঠে। তবু বলে চলে- আর যারা শাড়ি-বেলাউজ পরে ... কী যে ফিনফিন্যা শাড়ি, য্যান পিঁয়াজের খোসা! আর বেলাউজ! গলার দিকত এত্ত কাটা যে বুটির গোড়াতক দেখা যায়। মারে মা! ঐভাবে মিয়্যা মানুষ কী করা ব্যাটা মাইনষের সামনোত বার হয়!

নিজের ব্লাউজের ওপরের দুটি বোতাম খুলে ওপরের অংশ ভাঁজ দিয়ে নিজের বুকের উদোমতা পরিমাপ করে সালেহা- ছি ছি এতখানি উদলা বুক লিয়্যা মিয়্যামানুষ লোকের সামনোত খাড়ায়! দ্যাখেন, এই এতখানি উদলা!

নিজের উন্মোচিত বুক নিয়ে স্বামীর দিকে ফেরে সালেহা। স্বামী নিশ্চুপ। তখন তার বুকে হাত দেয় সালেহা। টের পায় এরফানের বুক উঠছে-নামছে খুব নিয়মিতভাবে। তার নিশ্বাস যথেষ্ট গভীরও। অনিশ্চয়তার ভীতি জমতে জমতে ক্লান্তিতে পরিণত হয়েছে। সেই ক্লান্তিতে এরফান এখন গভীর ঘুমে।

নিশ্বাস ফেলে নিজেও পাশ ফিরে শোয় সালেহা। রাতের আর বেশি বাকি নেই। তিন প্রহরের শেয়াল ডাকার সময় বোধ হয় এসেই গেল। চোখ বন্ধ করল সালেহাও। সামনে যা-ই হোক, ক্লান্তি সবাইকেই বিশ্রাম নিতে বাধ্য করে।

আর বিশ্রামের অধিকার সকলেরই আছে।