১১১ নম্বর রুমের বোতলগুলো

ইকরাম কবীর

চার মাস হতে চললো আমি এই হোটেলে কাজ করছি। কাজ হাউসকীপিং বিভাগে। প্রতিদিন অতিথিদের ঘর গোছাই। যারাই এই হোটেলে কয়েক দিনের জন্যে থাকতে আসেন তাদের জীবন যাপন নিয়ে, তাদের অভ্যাস নিয়ে আমি অনেক গল্প বলতে পারি। একেকজনের যাপন একেক রকম। হয়তো তারা নিজেরাও জানেন না তাদের যাপন কেমন। বেলা এগারোটা-বারোটার দিকে কোন এক কক্ষে ঢুকে বাথরুমের ফ্লাশটা মাঝে মাঝে যখন আমাকেই করতে হয়, তখন আমি বুঝে যাই ঘরের অন্যান্য স্থানে আর কী কী পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখতে হবে। প্রায়ই বিরক্ত হই কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমার হাসি পায়। বুঝি না শুধু মিঃ ফরিদ আহমেদকে। প্রতি মাসেই তিনি আমাদের হোটেলে থাকতে আসেন। এই হোটেলের বাঁধা খদ্দের বলা যায়। তিনি-চারদিন থাকেন। চালচলন দেখে বোঝা যায় এ শহরেই কোন কাজে আসেন। আমার সাথে মাঝে-মধ্যে দেখা হয়েছে যেমন অনেক অতিথীর সাথেই হয়। ‘গুড মর্নিং, স্যার; হ্যাভ এ নাইস ডে, স্যার’- এটুকুই শুধু বলা হয়েছে। মিঃ ফরিদের যাপনটা কেমন যেন অভিনব; বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না; তার অভ্যাসে কোনো খুঁত জো নেই; কিছুই পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় না তার রুমে। তিনি রুমে চারদিন থাকার পরও মনে হয় না যে এই কক্ষ তিনি ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি ঠিকই কাপড় ছেড়েছেন, ঘুমিয়েছেন, বাথরুমে গেছেন, রুম থেকে বেরিয়ে কাজে গেছেন বা বেড়াতে গেছেন। কিছুই বোঝা যায় না। তার রুম গোছাতে আসলেই দেখি কোনো কিছুই এলোমেলো নয়। সবই গোছানো। কাল যেমন ছিল, তেমনই।

শুধু একটা বিষয় আমার নজর কেড়েছে। মিঃ ফরিদ বাথরুম থেকে শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল ও বডি ল্যোশনের সবুজ রঙের সরু বোতলগুলো এনে তার ডাবল-বেড বিছানার একটা বালিশের ওপর সাজিয়ে রাখেন। প্রতিদিন ঐ বালিশের ওপরই বোতলগুলো থাকে। আমি ধারনা করে নিই যে তার পাশের বালিশে তিনি মাথা পেতে ঘুমান; আসলে ঘুমান কিনা আমি তাও জানি না। বেশিরভাগ অতিথি এই শ্যাম্পু-সাবানের বোতলগুলো সাথে করে নিয়ে যান। মাঝে মাঝে আমিও তাদের অব্যবহৃত শ্যাম্পু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রানুকে দেই। বোতলগুলো সত্যিই খুব সুন্দর। সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা; গোলাকৃতি এবং সরু। বোতলগুলো এতই সুন্দর যে মাঝে মাঝে মনে হয় ওগুলোর ভেতরে যা আছে তা গলায় ঢেলে খেয়ে ফেলি।

প্রথম দিন যখন মিঃ ফরিদের ঘর গোছাতে গিয়েছিলাম, বালিশের ওপর তিনটে বোতল দেখে, সেগুলো আবার বাথরুমে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যায়ই আমার সুপারভাইজার জসীম ভাই ধমকের সুরে বললেন- ‘আর কক্ষনো মিঃ ফরিদের রুমে গিয়ে কিছু ধরবে না, কিছু স্পর্শ করবে না; উনি চেক-আউট করলে তারপর যা পরিষ্কার করার করবে।’ আমি বলেছিলাম - ‘তাহলে ঐ রুমে আমার ঢোকার দরকার কী? উনি চেক-আউট করলে পরে ঢুকি!’ বস বলেছিলেন- না, তোমাকে প্রতিদিনই রুম চেক করতে হবে; শুধু কোন কিছু তুমি ছোঁবে না।’

একদিন কী মনে হলো, তার বাথরুমে আরও তিনটে বোতল রেখে আসলাম। ফরিদ সাহেবের যদি শ্যাম্পু-সাবানের বোতল এতই পছন্দ তাহলে উনি বেশি বেশি করে জমিয়ে রাখুক। পরদিন তার ১১১-তে গিয়ে দেখি বালিশের ওপর ছয়টা বোতল। পরদিন আরও তিনটে রেখে এলাম। তিনি সেগুলোও ঐ বালিশের ওপর রেখে দিলেন। নয়টা বোতল। ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম তার রুম নাম্বারটার কথা বলতে। লবির পাশের সিঁড়ি দিয়ে একতলায় উঠে বাঁয়ে ঘুরে করিডোর দিয়ে হেঁটে একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষে এই রুম। এখানেই মিঃ ফরিদ সব সময় ওঠেন। আমি এও বলতে ভুলে গেছি যে এই ১১১ অন্যান্য সময় খালি পড়ে থাকে। ফরিদ সাহেব ছাড়া এই রুমে আর কেউ থাকেন না। আমাদের হোটেলে সাড়ে তিন শ’ রুম। শুধু এই ঘরেই অন্য কেউ থাকেন না। একবার সহকর্মী জয়তুনের কাছে কথার ছলে কারণ জানতে চেয়েছিলাম; সে শুধু বলেছিল এই ঘরে কে নাকি আত্মহত্যা করেছিল। সেই ঘটনা রটে যাওয়ার পর এখানে আর কেউ থাকতে চায় না। অনেকে নাকি এই রুমে থাকতে এসে ভয়ও পেয়েছিল। এর বেশি কিছু বলেনি জয়তুন। এমন উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা নিয়ে কম কথা বলার প্রবণতা দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম।

মিঃ ফরিদ এখানে এসে শুধু রাতে থাকেন। সারাদিন তিনি হোটেলের বাইরে। মানুষটাকে আমার অতি-রহস্যময় মনে হয়। আমি প্রথম প্রথম জানতে চেয়েছি; কেউ আমায় কিছুই জানায়নি। আমার সুপারভাইজারও এড়িয়ে গেছেন। আমাদের নিজেদের মধ্যে কত আড্ডাই তো হয়; হোটেলের একজন অতিথী সম্পর্কে আমাকে জানালে কী অসুবিধা হতে পারে আমি বুঝিনি।

তবে মিঃ ফরিদ মানুষটার সাথে আমার শ্যাম্পু-সাবানের বোতলগুলো নিয়ে খেলতে ভাল লাগে। উনি এখানে এলে আমি বেশি বেশি করে তার বাথরুমে বোতল রেখে দিই। উনি সব বোতলগুলোই বালিশের ওপর শুইয়ে রাখেন। আমি কয়েকটা বোতল দাঁড় করিয়ে দিই। তিনি আবার সেগুলো তার মতো করে সাজিয়ে রাখেন। আমি বাথরুমে দশটা রেখে গেলে দশটাই তিনি বিছানায় এনে বালিশে শুইয়ে রাখেন। একদিন তিনি একটা চিরকুট লিখে রেখে গেলেন। ‘এগুলো এলোমেলো করবেন না’। আমি বুঝতে পারি যে উনি আমার দুষ্টুমি লক্ষ্য করছেন এবং মনে হয় রাগান্বিত হয়েছেন। তবে তার সাথে এই খেলার ইচ্ছেটা থেকেই যায়।

এবার এসে তিনি প্রায় এক সপ্তাহ ১১১-তে থাকলেন। এই মানুষটি কখন কী করেন বা করবেন তা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করি তবে কিছুই অনুমান করতে পারি না। তাকে নিয়ে আমার কৌতূহল বাড়তে বাড়তে একেবারে আকাশের সীমানায় পৌঁছে যায়। এবারে, সাতদিনে, তার কাছে প্রায় ত্রিশটা বোতল জমেছিল। আমি গুনেছি। আমি নিজেও এই বোতলগুলোর প্রতি অদ্ভুত এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করে সম্মোহিত হতে শিখে গিয়েছিলাম। দিনের অনেকটা সময় বোতলগুলো নিয়েই চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম। হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের মতো মিঃ ফরিদ কখনই বোতলগুলো লাগেজে ঢুকিয়ে চেক-আউট করেন না। কিন্তু এবার চলে যাওয়ার পর আমি বোতলগুলো আর খুঁজে পেলাম না। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। তারপর নিজেকে বুঝিয়েছি যে মিঃ ফরিদ ত্রিশটা বোতল সাথে করে নিয়ে গেছেন।

১১১ নম্বর রুম হঠাৎ করে এমন বোতল-শূন্য হয়ে পড়ায় আমার মাঝেও এক শূন্যতা ভর করে। আমি বোতলগুলোর মাধ্যমেই মিঃ ফরিদের সাথে এক তরঙ্গহীন এক যোগাযোগের আনন্দ পেতাম। মাধ্যম না থাকায় আমার মনে এক অতিপ্রাকৃত অস্বস্তি তৈরি হয়। তিনি আবার কবে আসবেন সেই অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু মিঃ ফরিদ একমাস পর এলেন না। তিনি না আসায় আমার সহকর্মীদের মনেও এক চরম অস্বস্তি জন্ম নেয়। যে বিষয় নিয়ে, যেই মানুষটাকে নিয়ে তারা আলাপ করতে চাইতো না, তারাই কথা বলতে শুরু করলো। আমিও কৌতূহল দমন করার সুযোগ পেয়ে যাই। সুপারভাইজার জসীম ভাইয়ের কাছে মিঃ ফরিদের ইতিহাস জানতে চাই। তিনি এনার আর বিরক্তি প্রকাশ করেন না। জসীম ভাই বলেন শিফট শেষ করে কথা বলবেন।

সন্ধ্যায় তিনি জানালেন- ‘গল্প খুব লম্বা নয়; প্রায় পাঁচ বছর আগে মিসেস ফরিদ ঐ কক্ষে অনেকগুলো বোতল জমিয়ে, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল আর বডি ল্যোশন একসাথে খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এ নিয়ে অনেক হট্টগোল হয়েছিল। সবাই প্রথমে মনে করেছিল মিঃ ফরিদই তার স্ত্রীকে খুন করেছেন; তবে পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। তারপর থেকে তিনি এই রুমে এলে শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল ও ল্যোশনের বোতল জমিয়ে ওগুলোর মাধ্যমে তার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। স্ত্রীর আত্মাহুতির কারণ তিনি তার কাছ থেকেই জানতে চান।‘

শুনে আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। পাথরের মতো নিশ্চুপ। নিজের অতীত মনে পড়ে; আমার জীবনের অসম এক গোপন প্রেমের কথা মনে পড়ে। বিবাহিত এক নারীর প্রেমে পাগল হয়েছিলাম আমি। তার নাম ছিল প্রীতি। সেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস আমার ছিল না। ভয়ে আমাকে প্রেমের ইতি টানতে হয়েছিল। পরে খবরের কাগজে পড়েছিলাম এক হোটেল কক্ষে প্রীতির মৃত্যু হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

১১১ নম্বর রুমের বোতলগুলো

ইকরাম কবীর

image

চার মাস হতে চললো আমি এই হোটেলে কাজ করছি। কাজ হাউসকীপিং বিভাগে। প্রতিদিন অতিথিদের ঘর গোছাই। যারাই এই হোটেলে কয়েক দিনের জন্যে থাকতে আসেন তাদের জীবন যাপন নিয়ে, তাদের অভ্যাস নিয়ে আমি অনেক গল্প বলতে পারি। একেকজনের যাপন একেক রকম। হয়তো তারা নিজেরাও জানেন না তাদের যাপন কেমন। বেলা এগারোটা-বারোটার দিকে কোন এক কক্ষে ঢুকে বাথরুমের ফ্লাশটা মাঝে মাঝে যখন আমাকেই করতে হয়, তখন আমি বুঝে যাই ঘরের অন্যান্য স্থানে আর কী কী পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখতে হবে। প্রায়ই বিরক্ত হই কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমার হাসি পায়। বুঝি না শুধু মিঃ ফরিদ আহমেদকে। প্রতি মাসেই তিনি আমাদের হোটেলে থাকতে আসেন। এই হোটেলের বাঁধা খদ্দের বলা যায়। তিনি-চারদিন থাকেন। চালচলন দেখে বোঝা যায় এ শহরেই কোন কাজে আসেন। আমার সাথে মাঝে-মধ্যে দেখা হয়েছে যেমন অনেক অতিথীর সাথেই হয়। ‘গুড মর্নিং, স্যার; হ্যাভ এ নাইস ডে, স্যার’- এটুকুই শুধু বলা হয়েছে। মিঃ ফরিদের যাপনটা কেমন যেন অভিনব; বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না; তার অভ্যাসে কোনো খুঁত জো নেই; কিছুই পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় না তার রুমে। তিনি রুমে চারদিন থাকার পরও মনে হয় না যে এই কক্ষ তিনি ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি ঠিকই কাপড় ছেড়েছেন, ঘুমিয়েছেন, বাথরুমে গেছেন, রুম থেকে বেরিয়ে কাজে গেছেন বা বেড়াতে গেছেন। কিছুই বোঝা যায় না। তার রুম গোছাতে আসলেই দেখি কোনো কিছুই এলোমেলো নয়। সবই গোছানো। কাল যেমন ছিল, তেমনই।

শুধু একটা বিষয় আমার নজর কেড়েছে। মিঃ ফরিদ বাথরুম থেকে শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল ও বডি ল্যোশনের সবুজ রঙের সরু বোতলগুলো এনে তার ডাবল-বেড বিছানার একটা বালিশের ওপর সাজিয়ে রাখেন। প্রতিদিন ঐ বালিশের ওপরই বোতলগুলো থাকে। আমি ধারনা করে নিই যে তার পাশের বালিশে তিনি মাথা পেতে ঘুমান; আসলে ঘুমান কিনা আমি তাও জানি না। বেশিরভাগ অতিথি এই শ্যাম্পু-সাবানের বোতলগুলো সাথে করে নিয়ে যান। মাঝে মাঝে আমিও তাদের অব্যবহৃত শ্যাম্পু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রানুকে দেই। বোতলগুলো সত্যিই খুব সুন্দর। সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা; গোলাকৃতি এবং সরু। বোতলগুলো এতই সুন্দর যে মাঝে মাঝে মনে হয় ওগুলোর ভেতরে যা আছে তা গলায় ঢেলে খেয়ে ফেলি।

প্রথম দিন যখন মিঃ ফরিদের ঘর গোছাতে গিয়েছিলাম, বালিশের ওপর তিনটে বোতল দেখে, সেগুলো আবার বাথরুমে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যায়ই আমার সুপারভাইজার জসীম ভাই ধমকের সুরে বললেন- ‘আর কক্ষনো মিঃ ফরিদের রুমে গিয়ে কিছু ধরবে না, কিছু স্পর্শ করবে না; উনি চেক-আউট করলে তারপর যা পরিষ্কার করার করবে।’ আমি বলেছিলাম - ‘তাহলে ঐ রুমে আমার ঢোকার দরকার কী? উনি চেক-আউট করলে পরে ঢুকি!’ বস বলেছিলেন- না, তোমাকে প্রতিদিনই রুম চেক করতে হবে; শুধু কোন কিছু তুমি ছোঁবে না।’

একদিন কী মনে হলো, তার বাথরুমে আরও তিনটে বোতল রেখে আসলাম। ফরিদ সাহেবের যদি শ্যাম্পু-সাবানের বোতল এতই পছন্দ তাহলে উনি বেশি বেশি করে জমিয়ে রাখুক। পরদিন তার ১১১-তে গিয়ে দেখি বালিশের ওপর ছয়টা বোতল। পরদিন আরও তিনটে রেখে এলাম। তিনি সেগুলোও ঐ বালিশের ওপর রেখে দিলেন। নয়টা বোতল। ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম তার রুম নাম্বারটার কথা বলতে। লবির পাশের সিঁড়ি দিয়ে একতলায় উঠে বাঁয়ে ঘুরে করিডোর দিয়ে হেঁটে একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষে এই রুম। এখানেই মিঃ ফরিদ সব সময় ওঠেন। আমি এও বলতে ভুলে গেছি যে এই ১১১ অন্যান্য সময় খালি পড়ে থাকে। ফরিদ সাহেব ছাড়া এই রুমে আর কেউ থাকেন না। আমাদের হোটেলে সাড়ে তিন শ’ রুম। শুধু এই ঘরেই অন্য কেউ থাকেন না। একবার সহকর্মী জয়তুনের কাছে কথার ছলে কারণ জানতে চেয়েছিলাম; সে শুধু বলেছিল এই ঘরে কে নাকি আত্মহত্যা করেছিল। সেই ঘটনা রটে যাওয়ার পর এখানে আর কেউ থাকতে চায় না। অনেকে নাকি এই রুমে থাকতে এসে ভয়ও পেয়েছিল। এর বেশি কিছু বলেনি জয়তুন। এমন উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা নিয়ে কম কথা বলার প্রবণতা দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম।

মিঃ ফরিদ এখানে এসে শুধু রাতে থাকেন। সারাদিন তিনি হোটেলের বাইরে। মানুষটাকে আমার অতি-রহস্যময় মনে হয়। আমি প্রথম প্রথম জানতে চেয়েছি; কেউ আমায় কিছুই জানায়নি। আমার সুপারভাইজারও এড়িয়ে গেছেন। আমাদের নিজেদের মধ্যে কত আড্ডাই তো হয়; হোটেলের একজন অতিথী সম্পর্কে আমাকে জানালে কী অসুবিধা হতে পারে আমি বুঝিনি।

তবে মিঃ ফরিদ মানুষটার সাথে আমার শ্যাম্পু-সাবানের বোতলগুলো নিয়ে খেলতে ভাল লাগে। উনি এখানে এলে আমি বেশি বেশি করে তার বাথরুমে বোতল রেখে দিই। উনি সব বোতলগুলোই বালিশের ওপর শুইয়ে রাখেন। আমি কয়েকটা বোতল দাঁড় করিয়ে দিই। তিনি আবার সেগুলো তার মতো করে সাজিয়ে রাখেন। আমি বাথরুমে দশটা রেখে গেলে দশটাই তিনি বিছানায় এনে বালিশে শুইয়ে রাখেন। একদিন তিনি একটা চিরকুট লিখে রেখে গেলেন। ‘এগুলো এলোমেলো করবেন না’। আমি বুঝতে পারি যে উনি আমার দুষ্টুমি লক্ষ্য করছেন এবং মনে হয় রাগান্বিত হয়েছেন। তবে তার সাথে এই খেলার ইচ্ছেটা থেকেই যায়।

এবার এসে তিনি প্রায় এক সপ্তাহ ১১১-তে থাকলেন। এই মানুষটি কখন কী করেন বা করবেন তা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করি তবে কিছুই অনুমান করতে পারি না। তাকে নিয়ে আমার কৌতূহল বাড়তে বাড়তে একেবারে আকাশের সীমানায় পৌঁছে যায়। এবারে, সাতদিনে, তার কাছে প্রায় ত্রিশটা বোতল জমেছিল। আমি গুনেছি। আমি নিজেও এই বোতলগুলোর প্রতি অদ্ভুত এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করে সম্মোহিত হতে শিখে গিয়েছিলাম। দিনের অনেকটা সময় বোতলগুলো নিয়েই চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম। হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের মতো মিঃ ফরিদ কখনই বোতলগুলো লাগেজে ঢুকিয়ে চেক-আউট করেন না। কিন্তু এবার চলে যাওয়ার পর আমি বোতলগুলো আর খুঁজে পেলাম না। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। তারপর নিজেকে বুঝিয়েছি যে মিঃ ফরিদ ত্রিশটা বোতল সাথে করে নিয়ে গেছেন।

১১১ নম্বর রুম হঠাৎ করে এমন বোতল-শূন্য হয়ে পড়ায় আমার মাঝেও এক শূন্যতা ভর করে। আমি বোতলগুলোর মাধ্যমেই মিঃ ফরিদের সাথে এক তরঙ্গহীন এক যোগাযোগের আনন্দ পেতাম। মাধ্যম না থাকায় আমার মনে এক অতিপ্রাকৃত অস্বস্তি তৈরি হয়। তিনি আবার কবে আসবেন সেই অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু মিঃ ফরিদ একমাস পর এলেন না। তিনি না আসায় আমার সহকর্মীদের মনেও এক চরম অস্বস্তি জন্ম নেয়। যে বিষয় নিয়ে, যেই মানুষটাকে নিয়ে তারা আলাপ করতে চাইতো না, তারাই কথা বলতে শুরু করলো। আমিও কৌতূহল দমন করার সুযোগ পেয়ে যাই। সুপারভাইজার জসীম ভাইয়ের কাছে মিঃ ফরিদের ইতিহাস জানতে চাই। তিনি এনার আর বিরক্তি প্রকাশ করেন না। জসীম ভাই বলেন শিফট শেষ করে কথা বলবেন।

সন্ধ্যায় তিনি জানালেন- ‘গল্প খুব লম্বা নয়; প্রায় পাঁচ বছর আগে মিসেস ফরিদ ঐ কক্ষে অনেকগুলো বোতল জমিয়ে, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল আর বডি ল্যোশন একসাথে খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এ নিয়ে অনেক হট্টগোল হয়েছিল। সবাই প্রথমে মনে করেছিল মিঃ ফরিদই তার স্ত্রীকে খুন করেছেন; তবে পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। তারপর থেকে তিনি এই রুমে এলে শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল ও ল্যোশনের বোতল জমিয়ে ওগুলোর মাধ্যমে তার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। স্ত্রীর আত্মাহুতির কারণ তিনি তার কাছ থেকেই জানতে চান।‘

শুনে আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। পাথরের মতো নিশ্চুপ। নিজের অতীত মনে পড়ে; আমার জীবনের অসম এক গোপন প্রেমের কথা মনে পড়ে। বিবাহিত এক নারীর প্রেমে পাগল হয়েছিলাম আমি। তার নাম ছিল প্রীতি। সেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস আমার ছিল না। ভয়ে আমাকে প্রেমের ইতি টানতে হয়েছিল। পরে খবরের কাগজে পড়েছিলাম এক হোটেল কক্ষে প্রীতির মৃত্যু হয়েছিল।