স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আমরা যারা হলে আবাসিক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি, বা বলা যায় যারাই এমনভাবে পড়াশোনা করেছে, তাদের সবারই দুটি জীবন যাপন ছিলো- একটি হলের আবাসিক জীবন এবং অপরটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটি আবার দু’ভাগে বিভক্ত: বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের জীবন, এবং যে বিভাগে পড়াশোনা করতাম সেই বিভাগের জীবন। সত্যি বলতে কি হলের আবাসিক জীবনটা বিশেষ অভিঘাতময় জীবন ছিলো। এর বিবিধ কারণ ছিলো- প্রথমত, এই প্রথম আমরা একটি স্বাধীন জীবন যাপনের প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হই এবং নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবতে শিখি; দ্বিতীয়ত, এই স্বাধীন জীবন যাপন এবং প্রাপ্তবয়স্ক হবার কষ্টসাধ্য কার্যপরম্পরার সাথে সমন্বয় করা; এবং সর্বোপরি ভিন্ন-ভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক এবং স্বভাবের মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করার অনুশীলন- যে কাজটি মানব গোষ্ঠীর জীবনযাপনের দুরুহতম অধ্যায়। সত্যি বলতে কি আমাদের জীবনে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার চাইতে এই শিক্ষাটা অনেক ক্ষেত্রেই অতি জরুরি কারণ আজকের অধিকাংশ শিক্ষার্থিই স্বাধীনভাবে একটি দায়িত্ববান জীবন যাপনের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে না পারিবারিকভাবে অত্যধিক প্রশ্রয়ী ও নির্দেশিত জীবনের আবর্তে বেড়ে ওঠে বলে- যাকে ইংরেজিতে বলা হয় spoon feeding।

আমার দীর্ঘ একান্ন বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি লক্ষ্য করেছি আজকাল অধিকাংশ ছেলেমেয়ে তাদের শিক্ষার বিষয় নির্বাচনে পিতামাতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে এবং কোন কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট শিক্ষক পরীক্ষাতে বেশি নম্বর পাবার জন্য যোগ্যতম নোটদাতা তা ঠিক করে দেয় ঐ পিতামাতাই। ফলে উচ্চশিক্ষাতে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) এসেও এই পরনির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে উঠতে না পেরে তাদের শিক্ষকদের, অর্থাৎ আমাদের, জিজ্ঞেস করে পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হবে, কোন প্রশ্নের উত্তর কতটুকু লিখতে হবে, বেশি নম্বর পেতে হলে মূল টেক্সট বইয়ের কোন কোন অংশ পড়লে চলবে ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্যি আজকাল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত বাংলা দৈনিক প্রতি সপ্তাহে একটি বিশেষ পৃষ্ঠা এই জাতীয় বিষয় নিয়েই লেখালেখি করে- ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল চিন্তার ভারটা তারাই দখল করেছে তাদের পত্রিকার বিক্রি বাড়াবার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্বমানের শিক্ষা গ্রহণের স্থান সেটা তারা কখোনই বুঝতে চায় না কারণ স্কুল-কলেজ থেকেই তাদের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়, এবং নম্বর বেশি পাবার চাইতে জ্ঞান বেশি হওয়াটা যে বাস্তব জীবনের প্রকৃত পাথেয় তা পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে তাদের জানার কোনই সুযোগ হয় না। আমি এও দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় পড়া বহু ছাত্রছাত্রীকে স্কুল-কলেজে আনা-নেয়ার মতো করে, বিশেষ করে মায়েরা, সারা দিন বসে থাকেন। আমি মনে করি হল/হস্টেল জীবন একটি শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবন যাপনের প্রস্তুতিপর্ব। জীবনকে সঠিক উপলব্ধি করা এবং সে জীবনটা যে নিজের সাফল্যের জন্যই শুধু নয়, অন্যের জীবন ও গোষ্ঠীর জন্যও বটে, এবং সত্যিকার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়াটা কি ও কেমন, ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কি তা শেখার একটি অন্যতম বিদ্যাপিঠ হলো হস্টেল/হল জীবন।

আমি আগেই বলেছি আমি হলজীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রাথমিক ভাবে পারিনি, কিন্তু এই জীবন যাপনে আমি ক্রমে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে ছুটিতে বাবামার কাছে যেয়েও অনেক সময়-ই হলজীবনকে, ইংরেজিতে যাকে বলে, “মিস” করতাম। হলের জীবন যে কতটা বিচিত্র ছিলো তার একটি উদাহরণ দিই। মনে পড়ে একদিন বেশ রাতে হঠাৎ করেই আমার রুমের উপর তলাতে বেশ চেঁচামেচি হতে শুনলাম। দৌড়ে উপরে যেয়ে দেখি ঐ রুমের চার জনের একজন- নাম সম্ভবত আদিল- যে কোনো একটি ইংরেজি পত্রিকাতে ছাত্র সাংবাদিক হিশেবে কাজ করতো (আমাদের সময় দু’টি বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো, The Pakistan Observer Ges The Morning News, যেখানে অনেক ছাত্রই ছাত্র সাংবাদিকতা করতো), প্রতি দিনই বেশি রাত করে রুমে ফিরে বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতো। কারণটা বোধগম্য- যেহেতু তাকে রাত করে পত্রিকা অফিসে থাকতে হতো রুমে ফিরতে দেরি হতো এবং ফলে তার পড়াশোনার সময়টা ছিল ঐ গভীর রাত যখন তার রুমমেটদের ঘুমাবার সময়।

এমন আরও অনেক ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। যেমন ডাইনিং হলে খাবার নিয়ে চেঁচামেচি, এমনকি প্লেট ভাংচুর- বিশেষ করে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন-এর সদস্যদের। হলের প্রবেশ পথের করিডোরে একটা পাবলিক ফোন ছিলো, মনে পড়ে। এই ফোনটি প্রায়ই অকেজো থাকতো। কিন্তু যে কয়দিন কাজ করতো তার প্রায় প্রতি রাত আটটা থেকে ঘণ্টা তিনেক একজন ক্ষমতাবান ন্যাশনাল সস্টুডেন্টস ফেডারেশন সদস্য- যিনি আইয়ুব খান-এর মতো টুপি মাথায় এঁটে কোনো এক অজ্ঞাত কারও সাথে কথা বলতেন- আমাকে তখন অনেকেই বলেছে তিনি তার প্রেমিকার সাথে কথা বলেন। কিন্তু আমাদের সময় প্রেমিকার সাথে কথা বলার মতো সুযোগ, বিশেষ করে ফোনে, তেমন ছিলো না বল্লেই চলে, যার অন্যতম কারণ তখন ল্যান্ডফোন সবার বাড়িতে যেমন ছিলো না তেমনি এতো সময় নিয়ে কোনো মেয়েকে ফোনে কথা বলতে কোনো পিতামাতা দিতো কিনা আমার সন্দেহ। এখন অবশ্য সেল ফোনের বদৌলতে এসব তেমন কোনো সমস্যা নয়।

আর ছিলো নারী শরীরের প্রতি অদম্য কৌতূহল। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়া আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী মেসবাহ উদ্দিন ইকবাল শখের পেইন্টার ছিলো। আমার কোনো এক অনুরোধে সে পাশ ফিরে বসে থাকা এক নগ্ন নারীর ছবি একে দিয়েছিলো যেটি আমি দুঃসাহসিক ভাবে আমার রুমের দেয়ালে টাঙিয়েছিলাম। এ ছবিটি টাঙ্গাবার পর আমার রুমটি বিখ্যাত হয়ে যায়- প্রায় প্রতিদিনই অনেকে এটি দেখতে আসতো- দু’একজন যে নিন্দা জানায়নি তা নয়- তবে এই নিন্দুকরাও যেমন দেখতে এসেছে তেমনি যারা এর পক্ষে ছিলো তারাও এসেছে- এমনকি কেউ-কেউ চুরি করে নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে। মনে আছে আমার রুমে যারা নামাজী ছিলো তারা আপত্তি জানালেও তেমনভাবে আমাকে বলেনি ছবিটা সরিয়ে ফেলতে। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে বিখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন-এর লেখা ইভস স্টোরি-র কথা। মার্ক টোয়েন ঐ শিরনামে একটি হাস্যরসাত্মক ছোটগল্প রচনা করেছিলেন ১৯০৬ সালের দিকে। গল্পটি তাঁর ডাইরিজ অব অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ গ্রন্থের অন্তর্গত যার পঞ্চান্নটি চিত্রালংকরণ করেছিলেন তাঁরই বন্ধু Lester Ralph। চিত্রে আদম এবং হাওয়াকে সম্পূর্ণ নগ্নভাবে এঁকেছিলেন তিনি। ঐ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীর নগ্ন চিত্রকে অশ্লীলবৃত্তি (pornography) বলে গণ্য করা হতো। তো বইটি মুদ্রিত হবার পর একজন মহিলা গ্রন্থাগারিক তাঁর গ্রন্থাগারে এই বইটি হঠাৎ আবিষ্কার করেন এবং ছবিগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণার আবেদন জানান। টোয়েন-এর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন- ঘটনাটার কয়েকটি দিক আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছে; প্রথমত ছবিগুলো আমি আঁকিনি যদিও গল্পটি আমার লেখা- অভিযোগকারীরা ছবির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছে, আমার গল্পের বিরুদ্ধে নয়, যদিও ছবিগুলো আমার ভীষণ পছন্দ। এই তথাকথিত অশ্লীল চিত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন একজন মহিলা গ্রন্থাগারিক যিনি তাঁর গ্রন্থাগার থেকে বইটি বাড়িতে নিয়ে যান এবং বেশ লম্বা সময় নিয়ে ছবিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তারপর তিনি তাঁর এক পুরুষ সহকর্মীকে সেটি দেখান। পরবর্তিকালে সেই পুরুষ সহকর্মী বইটি তাঁর কাছেও বেশ কিছুদিন রেখে দেন পর্যবেক্ষণের জন্য। ফলে আমার ধারণা জন্মেছে তাঁদের দুজনের কাছেই আসলে ওই নগ্ন ছবিগুলো আমার মতোই ভাল লেগেছে। মার্ক টোয়েন-এর চূড়ান্ত মন্তব্য ছিলো: Clothes make the man, but they do not improve the woman- অর্থাৎ পোশাক মানুষকে মানুষ বানায় ঠিকই, কিন্তু মেয়েমানুষের শ্রী বা জ্ঞানবৃদ্ধি করে না। মন্তব্যটি একটু নারীবাদবিরোধী শোনালো কি? শোনালে মনে করিয়ে দিচ্ছি মন্তব্যটি আমার নয়, মার্ক টোয়েন-এর। আমার সেই ছবিটা আমার হলজীবনের পর আমার কাছে বেশ কিছুদিন ছিলো- তারপর জীবনের অনেক টানাপোড়েনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

আমরা বেশ ক’জন তখনকার গুলিস্তান সিনেমা হলের উপরে ‘নাজ’ সিনেমা হলে নিয়মিত ইংরেজি সিনেমা দেখতাম- রবিবারে মর্নিং শো এবং অন্যান্য দিনে স্বাভাবিক শো। ছোট পরিসরের এই হলে (সম্ভবত ১০০ সিটের) ইংরেজি ছাড়া আর কোনো সিনেমা প্রদর্শন হতো না। আমরা রিয়ার স্টল বলে যে টিকিট ছিলো সেটা কিনতাম- যেটি ছিলো আমাদের মধ্যবিত্ত ছাত্রদের আর্থিক সামর্থের আওতায়। হল থেকে আমরা অনেক সময়ই বাসে করে বা রিক্সা করে যেতাম জিন্নাহ এভিন্যুতে ‘নাজ’ হলে। অনেক সন্ধ্যাতে আমরা গুলিস্তানেও দলবেঁধে লাহোরি বা ঢালিউডের (তখনও এই নামটি প্রচলিত ছিলো না যদিও) উর্দু বা বাংলা সিনেমা দেখতে যেতাম। মনে পড়ছে একবার রাতে আমার রুমে পড়াশোনা করছি, পরদিন কিছু একটা টিউটরিয়াল পরীক্ষা ছিলো, হঠাৎ একদল এসে বই-পত্র কেড়ে নিয়ে বললো, “চল নিশাতে নিলুর ‘চিংগাড়ি’ সিনেমা দেখতে হবে’। আমি অনেক অনুনয়, অজুহাত করলাম পরদিনের পরীক্ষা নিয়ে, কিন্তু আমার এসব অনুনয়, অজুহাত কোনই কাজে এলো না। আমাদের ঐ বয়সে পাকিস্তানি অভিনেত্রী ‘নিলুর’ প্রতি বেশ আকর্ষণ ছিলো যাকে তখনকার সিনেমা জগতে যৌন আবেদনের জন্য প্রথম স্থান দেয়া হতো। আমাকে যেতে হয়েছিলো রাত সাড়ে ন’টার সেকেন্ড শো সিনেমা দেখতে, তাও পায়ে হেঁটে পুরোনো ঢাকাতে যাওয়া-আসা করে- কারণ নিশাত সিনেমা হল একটা গুদামঘরের মতো বিল্ডিঙে ছিলো পুরোনো ঢাকাতে এবং রিক্সা করে সেখানে যাবার ভেতর কোনো মজাই ছিলো না। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল-এর একদল উজ্জ্বল উচ্ছল ছাত্র হৈ হৈ করতে করতে এতো রাতে পায়ে হেঁটে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে এবং পায়ে হেঁটে ফিরছে এর ভেতর যে এক অনাবিল শিহরন তা কল্পনাও করা যায় না! রুমে এসে আবার পড়তে বসেছি আমি এবং পরদিন পরীক্ষাও দিয়েছি- খারাপ দিইনি!

একবার আমরা সবাই ঠিক করলাম নবাবপুরে ‘মরণ চাঁদ’ মিষ্টির দোকানের কাছে উল্টো দিকে যে পতিতালয় আছে (এটি এখন আর নেই, দেশ স্বাধীন হবার পর এটিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে) সেখানে যেতে হবে অভিজ্ঞতা অর্জনের কারণে- কারণ আমরা সাহিত্যের ছাত্ররা তখন আধুনিক কবিতার জনক ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার-এর- যার উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং রুপকের প্রভাব আমাদের সত্যিকার বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ-এর উপর স্পষ্ট- পতিতালয়ে বসে বসে কবিতা রচনার কথা এবং মুত্যুবরণ করার কথা জানা হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমরা যারা কবিতা লিখবার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম তারা দলে বেশ ভারি হয়ে প্রায় দশ/বারো জন রাতের খাবার খেয়ে হাঁটা দিই নবাবপুর। আমাদের পোশাক ও চেহারা দেখেই সারিসারি খুপরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্চ- প্রসাধন এবং খোলামেলা পোশাকের নারীরা খিলখিল করে হেসে স্বাগত জানায়, আর সেই সাথে সুর করে বলে উঠে, “ঢাকাইয়া টেডি অইছে রে, আহেন আহেন!” আমাদের সময় চামড়ার সাথে এঁটে থাকা প্যান্ট পরার ভীষণ চল ছিলো তরুণ সমাজে, যাদেরকে বলা হতো ‘টেডি’। তবে আমি তেমন সরু প্যান্ট পরতে পারতাম না কৃশকায় হবার কারণে। আমি ঐ সারিবদ্ধ নারীদের ভেতর দিয়ে এভাবে হাঁটার সময় লক্ষ্য করলাম অনেকেই, যারা এখানে সম্ভবত নিয়মিত যাতায়াত করে, তাদের অধিকাংশই কোনো-না-কোনো নারীর খদ্দের হিশেবে ঐ খুপরি ঘরে ঢুকে পড়ছে, এবং আশ্চর্য জনকভাবে অনুভব করলাম আমি আসলে একা হয়ে গেছি- আমার যে হল-বন্ধুরা এসেছিলো তারা কেউ আমার সাথে আর নেই- কোথায় যেনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আমি ভয় পেলাম এবং মুহূর্তে দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে একটি রিক্সা ধরে হলে ফিরে এলাম।

আমি এই ঘটনাটা নিয়ে একটা চেতনা-প্রবাহের গল্প লিখেছিলাম যেটি একটি লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিলো। আসলে ঐ সময় জেমস জয়েস-এর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরচয় সুবাদে স্ট্রিম অব কনশাসনেস নিয়ে আতিশয্য দেখা দিয়েছিলো। বোদলেয়ার ও জয়েস-এর পতিতালয়ে যাবার অভিজ্ঞতাও আমাদের অনেকভাবে প্রভাবিত করে। হলে থাকে কালে বার্ট্রান্ড রাসেল-এর আত্মজীবনী, এবং অনেক পরে, যখন জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করতাম সেই সত্তরের দশকের মধ্যভাগে, তখন নেরুদারর মেমোয়ার্স পড়ে অবাক হয়েছি কীভাবে তাঁরা সবাই বাস্তব জীবনের যৌন অভিজ্ঞতাগুলোকে অবাধে ব্যবহার করেছেন তাঁদের স্মৃতিকথাতে কিম্বা সাহিত্যকর্মে। এমনটা আমাদের দেশের কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির ভেতর লক্ষ্য করিনি শুধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাড়া।

এক সন্ধ্যাতে মুসলিম হলের সামনের সেই বিখ্যাত সিঁড়ির এক কোনাতে বসে আড্ডা দেবার সময় একটি টোয়োটা করোনা সাদা গাড়ি এসে থামলো। আমাদের সময় জাপানে তৈরি টয়োটা করোনা গাড়ির ভীষণ আভিজাত্য ছিলো। সিনেমা হলে এর একটা সুন্দর বিজ্ঞাপন দেখানো হতো। প্রচ- যন্ত্রসংগীতের সাথে আকাশ থেকে একটা ঝকঝকে টোয়োটা করোনা গাড়ি মাটির উপর নেমে আসতো এমং সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণে বলা হতো:HereÕs something new under the sun! Toyta Corona! এই টোয়োটা করোনা থেকে অভিজাত যাত্রিরা নেমে হলের ভেতর ঢুকে গেলে আমরা আবিষ্কার করলাম গাড়ির পেছনে একটি লাইট কনফেকশনারি-র পেটিসের প্যাকেট আছে। লাইট কনফেকশনারি-র পেটিস ঐ সময়ের একটি সর্বজনপ্রিয় সুস্বাদু স্ন্যাক্স ছিলো। আমি ইতিমধ্যে বেশ দুষ্টু হয়ে উঠতে শুরু করেছি। বন্ধুদের বললাম ওটা বের করা যায় কিনা দেখা যাক, এবং বিস্ময়কর মনে হলেও দেখা গেলো গাড়ির পেছনের জানালার কাঁচটি কিছুটা নামানো যার ভেতর আমার সরু হাত চেষ্টা করলেই ঢোকানো সম্ভব। যা ভাবে তাই কাজ- প্যাকেটটি বের করে আমরা হলের পেছন দিয়ে ভোঁ দৌড় তখনকার ইকবাল হলে রশিদ নামে আমাদের এক সহপাঠির রুমে। রশিদ আমাদের সাথে ইংরেজি পড়তো। অনেক মজা করে পেটিসগুলো সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে, ভাল মানুষের মতো মুখ মুছে ফিরে এসেছিলাম হলে। ইতিমধ্যে সেই টোয়োটা করোনা গাড়িটা চলে গেছে।

আমরা এভাবেই হলের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি: এক রুমে চারজন কীভাবে ঝগড়া করেও মানিয়ে থাকতে হয় শিখেছি; মতাদর্শ এক না হলেও মানুষের কাজকে সহ্য করা, যেমন ঐ আইয়ুব খানের টুপি পরা লাভার বয় দীর্ঘ সময় টেলিফোনে আলাপরত দেখেও আমরা দৃশ্যটাকে গ্রহণ করেছি; বুঝতে শিখেছি যৌন কৌতূহল মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা; বন্ধুদের চাপে পড়ে কোনও কাজ করার পরও নিজের কর্তব্যে স্থির থাকা যায় কিভাবে তার শিক্ষা নিয়েছি; জীবনের সব অভিজ্ঞতাই মূল্যবান এবং রবীন্দ্রনাথের সেই বক্তব্যে আস্থা রাখা যে জীবনের কোনো অর্জনই ফেলনা নয়; আর সব শেষে ঐ যে চুরি করে পেটিস খাওয়া- সেটাও জীবনেরই অংশ। মনে উঠে আসে পথের পাঁচালী এবং অপরাজিত-র সর্বজয়া তার মৃত্যুকালে মনে করছে সে একবার তার প্রতিবেশির মাচান থেকে শসা চুরি করে খেয়েছিলো। আসলে মানুষ মানুষই, তার জীবনে এমন একসময় আসে যখন অপরাধের স্মরণ ও স্বীকৃতি অপরাধ মোচনের প্রক্রিয়া হয়ে সামনে দাঁড়ায়। (ক্রমশ...)

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ১১

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আমরা যারা হলে আবাসিক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি, বা বলা যায় যারাই এমনভাবে পড়াশোনা করেছে, তাদের সবারই দুটি জীবন যাপন ছিলো- একটি হলের আবাসিক জীবন এবং অপরটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটি আবার দু’ভাগে বিভক্ত: বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের জীবন, এবং যে বিভাগে পড়াশোনা করতাম সেই বিভাগের জীবন। সত্যি বলতে কি হলের আবাসিক জীবনটা বিশেষ অভিঘাতময় জীবন ছিলো। এর বিবিধ কারণ ছিলো- প্রথমত, এই প্রথম আমরা একটি স্বাধীন জীবন যাপনের প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হই এবং নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবতে শিখি; দ্বিতীয়ত, এই স্বাধীন জীবন যাপন এবং প্রাপ্তবয়স্ক হবার কষ্টসাধ্য কার্যপরম্পরার সাথে সমন্বয় করা; এবং সর্বোপরি ভিন্ন-ভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক এবং স্বভাবের মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করার অনুশীলন- যে কাজটি মানব গোষ্ঠীর জীবনযাপনের দুরুহতম অধ্যায়। সত্যি বলতে কি আমাদের জীবনে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার চাইতে এই শিক্ষাটা অনেক ক্ষেত্রেই অতি জরুরি কারণ আজকের অধিকাংশ শিক্ষার্থিই স্বাধীনভাবে একটি দায়িত্ববান জীবন যাপনের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে না পারিবারিকভাবে অত্যধিক প্রশ্রয়ী ও নির্দেশিত জীবনের আবর্তে বেড়ে ওঠে বলে- যাকে ইংরেজিতে বলা হয় spoon feeding।

আমার দীর্ঘ একান্ন বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি লক্ষ্য করেছি আজকাল অধিকাংশ ছেলেমেয়ে তাদের শিক্ষার বিষয় নির্বাচনে পিতামাতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে এবং কোন কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট শিক্ষক পরীক্ষাতে বেশি নম্বর পাবার জন্য যোগ্যতম নোটদাতা তা ঠিক করে দেয় ঐ পিতামাতাই। ফলে উচ্চশিক্ষাতে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) এসেও এই পরনির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে উঠতে না পেরে তাদের শিক্ষকদের, অর্থাৎ আমাদের, জিজ্ঞেস করে পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হবে, কোন প্রশ্নের উত্তর কতটুকু লিখতে হবে, বেশি নম্বর পেতে হলে মূল টেক্সট বইয়ের কোন কোন অংশ পড়লে চলবে ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্যি আজকাল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত বাংলা দৈনিক প্রতি সপ্তাহে একটি বিশেষ পৃষ্ঠা এই জাতীয় বিষয় নিয়েই লেখালেখি করে- ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল চিন্তার ভারটা তারাই দখল করেছে তাদের পত্রিকার বিক্রি বাড়াবার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্বমানের শিক্ষা গ্রহণের স্থান সেটা তারা কখোনই বুঝতে চায় না কারণ স্কুল-কলেজ থেকেই তাদের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়, এবং নম্বর বেশি পাবার চাইতে জ্ঞান বেশি হওয়াটা যে বাস্তব জীবনের প্রকৃত পাথেয় তা পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে তাদের জানার কোনই সুযোগ হয় না। আমি এও দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় পড়া বহু ছাত্রছাত্রীকে স্কুল-কলেজে আনা-নেয়ার মতো করে, বিশেষ করে মায়েরা, সারা দিন বসে থাকেন। আমি মনে করি হল/হস্টেল জীবন একটি শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবন যাপনের প্রস্তুতিপর্ব। জীবনকে সঠিক উপলব্ধি করা এবং সে জীবনটা যে নিজের সাফল্যের জন্যই শুধু নয়, অন্যের জীবন ও গোষ্ঠীর জন্যও বটে, এবং সত্যিকার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়াটা কি ও কেমন, ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কি তা শেখার একটি অন্যতম বিদ্যাপিঠ হলো হস্টেল/হল জীবন।

আমি আগেই বলেছি আমি হলজীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রাথমিক ভাবে পারিনি, কিন্তু এই জীবন যাপনে আমি ক্রমে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে ছুটিতে বাবামার কাছে যেয়েও অনেক সময়-ই হলজীবনকে, ইংরেজিতে যাকে বলে, “মিস” করতাম। হলের জীবন যে কতটা বিচিত্র ছিলো তার একটি উদাহরণ দিই। মনে পড়ে একদিন বেশ রাতে হঠাৎ করেই আমার রুমের উপর তলাতে বেশ চেঁচামেচি হতে শুনলাম। দৌড়ে উপরে যেয়ে দেখি ঐ রুমের চার জনের একজন- নাম সম্ভবত আদিল- যে কোনো একটি ইংরেজি পত্রিকাতে ছাত্র সাংবাদিক হিশেবে কাজ করতো (আমাদের সময় দু’টি বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো, The Pakistan Observer Ges The Morning News, যেখানে অনেক ছাত্রই ছাত্র সাংবাদিকতা করতো), প্রতি দিনই বেশি রাত করে রুমে ফিরে বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতো। কারণটা বোধগম্য- যেহেতু তাকে রাত করে পত্রিকা অফিসে থাকতে হতো রুমে ফিরতে দেরি হতো এবং ফলে তার পড়াশোনার সময়টা ছিল ঐ গভীর রাত যখন তার রুমমেটদের ঘুমাবার সময়।

এমন আরও অনেক ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। যেমন ডাইনিং হলে খাবার নিয়ে চেঁচামেচি, এমনকি প্লেট ভাংচুর- বিশেষ করে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন-এর সদস্যদের। হলের প্রবেশ পথের করিডোরে একটা পাবলিক ফোন ছিলো, মনে পড়ে। এই ফোনটি প্রায়ই অকেজো থাকতো। কিন্তু যে কয়দিন কাজ করতো তার প্রায় প্রতি রাত আটটা থেকে ঘণ্টা তিনেক একজন ক্ষমতাবান ন্যাশনাল সস্টুডেন্টস ফেডারেশন সদস্য- যিনি আইয়ুব খান-এর মতো টুপি মাথায় এঁটে কোনো এক অজ্ঞাত কারও সাথে কথা বলতেন- আমাকে তখন অনেকেই বলেছে তিনি তার প্রেমিকার সাথে কথা বলেন। কিন্তু আমাদের সময় প্রেমিকার সাথে কথা বলার মতো সুযোগ, বিশেষ করে ফোনে, তেমন ছিলো না বল্লেই চলে, যার অন্যতম কারণ তখন ল্যান্ডফোন সবার বাড়িতে যেমন ছিলো না তেমনি এতো সময় নিয়ে কোনো মেয়েকে ফোনে কথা বলতে কোনো পিতামাতা দিতো কিনা আমার সন্দেহ। এখন অবশ্য সেল ফোনের বদৌলতে এসব তেমন কোনো সমস্যা নয়।

আর ছিলো নারী শরীরের প্রতি অদম্য কৌতূহল। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়া আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী মেসবাহ উদ্দিন ইকবাল শখের পেইন্টার ছিলো। আমার কোনো এক অনুরোধে সে পাশ ফিরে বসে থাকা এক নগ্ন নারীর ছবি একে দিয়েছিলো যেটি আমি দুঃসাহসিক ভাবে আমার রুমের দেয়ালে টাঙিয়েছিলাম। এ ছবিটি টাঙ্গাবার পর আমার রুমটি বিখ্যাত হয়ে যায়- প্রায় প্রতিদিনই অনেকে এটি দেখতে আসতো- দু’একজন যে নিন্দা জানায়নি তা নয়- তবে এই নিন্দুকরাও যেমন দেখতে এসেছে তেমনি যারা এর পক্ষে ছিলো তারাও এসেছে- এমনকি কেউ-কেউ চুরি করে নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে। মনে আছে আমার রুমে যারা নামাজী ছিলো তারা আপত্তি জানালেও তেমনভাবে আমাকে বলেনি ছবিটা সরিয়ে ফেলতে। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে বিখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন-এর লেখা ইভস স্টোরি-র কথা। মার্ক টোয়েন ঐ শিরনামে একটি হাস্যরসাত্মক ছোটগল্প রচনা করেছিলেন ১৯০৬ সালের দিকে। গল্পটি তাঁর ডাইরিজ অব অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ গ্রন্থের অন্তর্গত যার পঞ্চান্নটি চিত্রালংকরণ করেছিলেন তাঁরই বন্ধু Lester Ralph। চিত্রে আদম এবং হাওয়াকে সম্পূর্ণ নগ্নভাবে এঁকেছিলেন তিনি। ঐ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারীর নগ্ন চিত্রকে অশ্লীলবৃত্তি (pornography) বলে গণ্য করা হতো। তো বইটি মুদ্রিত হবার পর একজন মহিলা গ্রন্থাগারিক তাঁর গ্রন্থাগারে এই বইটি হঠাৎ আবিষ্কার করেন এবং ছবিগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণার আবেদন জানান। টোয়েন-এর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন- ঘটনাটার কয়েকটি দিক আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছে; প্রথমত ছবিগুলো আমি আঁকিনি যদিও গল্পটি আমার লেখা- অভিযোগকারীরা ছবির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছে, আমার গল্পের বিরুদ্ধে নয়, যদিও ছবিগুলো আমার ভীষণ পছন্দ। এই তথাকথিত অশ্লীল চিত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন একজন মহিলা গ্রন্থাগারিক যিনি তাঁর গ্রন্থাগার থেকে বইটি বাড়িতে নিয়ে যান এবং বেশ লম্বা সময় নিয়ে ছবিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তারপর তিনি তাঁর এক পুরুষ সহকর্মীকে সেটি দেখান। পরবর্তিকালে সেই পুরুষ সহকর্মী বইটি তাঁর কাছেও বেশ কিছুদিন রেখে দেন পর্যবেক্ষণের জন্য। ফলে আমার ধারণা জন্মেছে তাঁদের দুজনের কাছেই আসলে ওই নগ্ন ছবিগুলো আমার মতোই ভাল লেগেছে। মার্ক টোয়েন-এর চূড়ান্ত মন্তব্য ছিলো: Clothes make the man, but they do not improve the woman- অর্থাৎ পোশাক মানুষকে মানুষ বানায় ঠিকই, কিন্তু মেয়েমানুষের শ্রী বা জ্ঞানবৃদ্ধি করে না। মন্তব্যটি একটু নারীবাদবিরোধী শোনালো কি? শোনালে মনে করিয়ে দিচ্ছি মন্তব্যটি আমার নয়, মার্ক টোয়েন-এর। আমার সেই ছবিটা আমার হলজীবনের পর আমার কাছে বেশ কিছুদিন ছিলো- তারপর জীবনের অনেক টানাপোড়েনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

আমরা বেশ ক’জন তখনকার গুলিস্তান সিনেমা হলের উপরে ‘নাজ’ সিনেমা হলে নিয়মিত ইংরেজি সিনেমা দেখতাম- রবিবারে মর্নিং শো এবং অন্যান্য দিনে স্বাভাবিক শো। ছোট পরিসরের এই হলে (সম্ভবত ১০০ সিটের) ইংরেজি ছাড়া আর কোনো সিনেমা প্রদর্শন হতো না। আমরা রিয়ার স্টল বলে যে টিকিট ছিলো সেটা কিনতাম- যেটি ছিলো আমাদের মধ্যবিত্ত ছাত্রদের আর্থিক সামর্থের আওতায়। হল থেকে আমরা অনেক সময়ই বাসে করে বা রিক্সা করে যেতাম জিন্নাহ এভিন্যুতে ‘নাজ’ হলে। অনেক সন্ধ্যাতে আমরা গুলিস্তানেও দলবেঁধে লাহোরি বা ঢালিউডের (তখনও এই নামটি প্রচলিত ছিলো না যদিও) উর্দু বা বাংলা সিনেমা দেখতে যেতাম। মনে পড়ছে একবার রাতে আমার রুমে পড়াশোনা করছি, পরদিন কিছু একটা টিউটরিয়াল পরীক্ষা ছিলো, হঠাৎ একদল এসে বই-পত্র কেড়ে নিয়ে বললো, “চল নিশাতে নিলুর ‘চিংগাড়ি’ সিনেমা দেখতে হবে’। আমি অনেক অনুনয়, অজুহাত করলাম পরদিনের পরীক্ষা নিয়ে, কিন্তু আমার এসব অনুনয়, অজুহাত কোনই কাজে এলো না। আমাদের ঐ বয়সে পাকিস্তানি অভিনেত্রী ‘নিলুর’ প্রতি বেশ আকর্ষণ ছিলো যাকে তখনকার সিনেমা জগতে যৌন আবেদনের জন্য প্রথম স্থান দেয়া হতো। আমাকে যেতে হয়েছিলো রাত সাড়ে ন’টার সেকেন্ড শো সিনেমা দেখতে, তাও পায়ে হেঁটে পুরোনো ঢাকাতে যাওয়া-আসা করে- কারণ নিশাত সিনেমা হল একটা গুদামঘরের মতো বিল্ডিঙে ছিলো পুরোনো ঢাকাতে এবং রিক্সা করে সেখানে যাবার ভেতর কোনো মজাই ছিলো না। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল-এর একদল উজ্জ্বল উচ্ছল ছাত্র হৈ হৈ করতে করতে এতো রাতে পায়ে হেঁটে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে এবং পায়ে হেঁটে ফিরছে এর ভেতর যে এক অনাবিল শিহরন তা কল্পনাও করা যায় না! রুমে এসে আবার পড়তে বসেছি আমি এবং পরদিন পরীক্ষাও দিয়েছি- খারাপ দিইনি!

একবার আমরা সবাই ঠিক করলাম নবাবপুরে ‘মরণ চাঁদ’ মিষ্টির দোকানের কাছে উল্টো দিকে যে পতিতালয় আছে (এটি এখন আর নেই, দেশ স্বাধীন হবার পর এটিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে) সেখানে যেতে হবে অভিজ্ঞতা অর্জনের কারণে- কারণ আমরা সাহিত্যের ছাত্ররা তখন আধুনিক কবিতার জনক ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার-এর- যার উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং রুপকের প্রভাব আমাদের সত্যিকার বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ-এর উপর স্পষ্ট- পতিতালয়ে বসে বসে কবিতা রচনার কথা এবং মুত্যুবরণ করার কথা জানা হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমরা যারা কবিতা লিখবার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম তারা দলে বেশ ভারি হয়ে প্রায় দশ/বারো জন রাতের খাবার খেয়ে হাঁটা দিই নবাবপুর। আমাদের পোশাক ও চেহারা দেখেই সারিসারি খুপরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্চ- প্রসাধন এবং খোলামেলা পোশাকের নারীরা খিলখিল করে হেসে স্বাগত জানায়, আর সেই সাথে সুর করে বলে উঠে, “ঢাকাইয়া টেডি অইছে রে, আহেন আহেন!” আমাদের সময় চামড়ার সাথে এঁটে থাকা প্যান্ট পরার ভীষণ চল ছিলো তরুণ সমাজে, যাদেরকে বলা হতো ‘টেডি’। তবে আমি তেমন সরু প্যান্ট পরতে পারতাম না কৃশকায় হবার কারণে। আমি ঐ সারিবদ্ধ নারীদের ভেতর দিয়ে এভাবে হাঁটার সময় লক্ষ্য করলাম অনেকেই, যারা এখানে সম্ভবত নিয়মিত যাতায়াত করে, তাদের অধিকাংশই কোনো-না-কোনো নারীর খদ্দের হিশেবে ঐ খুপরি ঘরে ঢুকে পড়ছে, এবং আশ্চর্য জনকভাবে অনুভব করলাম আমি আসলে একা হয়ে গেছি- আমার যে হল-বন্ধুরা এসেছিলো তারা কেউ আমার সাথে আর নেই- কোথায় যেনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আমি ভয় পেলাম এবং মুহূর্তে দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে একটি রিক্সা ধরে হলে ফিরে এলাম।

আমি এই ঘটনাটা নিয়ে একটা চেতনা-প্রবাহের গল্প লিখেছিলাম যেটি একটি লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিলো। আসলে ঐ সময় জেমস জয়েস-এর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরচয় সুবাদে স্ট্রিম অব কনশাসনেস নিয়ে আতিশয্য দেখা দিয়েছিলো। বোদলেয়ার ও জয়েস-এর পতিতালয়ে যাবার অভিজ্ঞতাও আমাদের অনেকভাবে প্রভাবিত করে। হলে থাকে কালে বার্ট্রান্ড রাসেল-এর আত্মজীবনী, এবং অনেক পরে, যখন জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করতাম সেই সত্তরের দশকের মধ্যভাগে, তখন নেরুদারর মেমোয়ার্স পড়ে অবাক হয়েছি কীভাবে তাঁরা সবাই বাস্তব জীবনের যৌন অভিজ্ঞতাগুলোকে অবাধে ব্যবহার করেছেন তাঁদের স্মৃতিকথাতে কিম্বা সাহিত্যকর্মে। এমনটা আমাদের দেশের কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির ভেতর লক্ষ্য করিনি শুধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাড়া।

এক সন্ধ্যাতে মুসলিম হলের সামনের সেই বিখ্যাত সিঁড়ির এক কোনাতে বসে আড্ডা দেবার সময় একটি টোয়োটা করোনা সাদা গাড়ি এসে থামলো। আমাদের সময় জাপানে তৈরি টয়োটা করোনা গাড়ির ভীষণ আভিজাত্য ছিলো। সিনেমা হলে এর একটা সুন্দর বিজ্ঞাপন দেখানো হতো। প্রচ- যন্ত্রসংগীতের সাথে আকাশ থেকে একটা ঝকঝকে টোয়োটা করোনা গাড়ি মাটির উপর নেমে আসতো এমং সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণে বলা হতো:HereÕs something new under the sun! Toyta Corona! এই টোয়োটা করোনা থেকে অভিজাত যাত্রিরা নেমে হলের ভেতর ঢুকে গেলে আমরা আবিষ্কার করলাম গাড়ির পেছনে একটি লাইট কনফেকশনারি-র পেটিসের প্যাকেট আছে। লাইট কনফেকশনারি-র পেটিস ঐ সময়ের একটি সর্বজনপ্রিয় সুস্বাদু স্ন্যাক্স ছিলো। আমি ইতিমধ্যে বেশ দুষ্টু হয়ে উঠতে শুরু করেছি। বন্ধুদের বললাম ওটা বের করা যায় কিনা দেখা যাক, এবং বিস্ময়কর মনে হলেও দেখা গেলো গাড়ির পেছনের জানালার কাঁচটি কিছুটা নামানো যার ভেতর আমার সরু হাত চেষ্টা করলেই ঢোকানো সম্ভব। যা ভাবে তাই কাজ- প্যাকেটটি বের করে আমরা হলের পেছন দিয়ে ভোঁ দৌড় তখনকার ইকবাল হলে রশিদ নামে আমাদের এক সহপাঠির রুমে। রশিদ আমাদের সাথে ইংরেজি পড়তো। অনেক মজা করে পেটিসগুলো সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে, ভাল মানুষের মতো মুখ মুছে ফিরে এসেছিলাম হলে। ইতিমধ্যে সেই টোয়োটা করোনা গাড়িটা চলে গেছে।

আমরা এভাবেই হলের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি: এক রুমে চারজন কীভাবে ঝগড়া করেও মানিয়ে থাকতে হয় শিখেছি; মতাদর্শ এক না হলেও মানুষের কাজকে সহ্য করা, যেমন ঐ আইয়ুব খানের টুপি পরা লাভার বয় দীর্ঘ সময় টেলিফোনে আলাপরত দেখেও আমরা দৃশ্যটাকে গ্রহণ করেছি; বুঝতে শিখেছি যৌন কৌতূহল মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা; বন্ধুদের চাপে পড়ে কোনও কাজ করার পরও নিজের কর্তব্যে স্থির থাকা যায় কিভাবে তার শিক্ষা নিয়েছি; জীবনের সব অভিজ্ঞতাই মূল্যবান এবং রবীন্দ্রনাথের সেই বক্তব্যে আস্থা রাখা যে জীবনের কোনো অর্জনই ফেলনা নয়; আর সব শেষে ঐ যে চুরি করে পেটিস খাওয়া- সেটাও জীবনেরই অংশ। মনে উঠে আসে পথের পাঁচালী এবং অপরাজিত-র সর্বজয়া তার মৃত্যুকালে মনে করছে সে একবার তার প্রতিবেশির মাচান থেকে শসা চুরি করে খেয়েছিলো। আসলে মানুষ মানুষই, তার জীবনে এমন একসময় আসে যখন অপরাধের স্মরণ ও স্বীকৃতি অপরাধ মোচনের প্রক্রিয়া হয়ে সামনে দাঁড়ায়। (ক্রমশ...)