ত্রাণকর্তা

অনন্ত মাহফুজ

আসুরিক ধ্বংসলীলার মাঝখানে এখন সুনসান নীরবতা। কোনোকালে এখানে লোকালয় ছিলো এরকম ধারণা করবার কোনো উপকরণ আর অবশিষ্ট নেই। এখানে প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলো মানুষ। ফসলে ফসলে মাঠের পর মাঠ নানা বর্ণের বিচিত্রতা লাভ করত। এখানে অভিমান ছিলো, ভালোবাসা ছিলো এমকি সন্তান উৎপাদনের ব্যাপকতাও ছিলো। এখন অবারিত জল। কোথাও তিল পরিমাণ মাটি অবশিষ্ট আছে যেখানে পানি ওঠেনি এরকম সংবাদ কারো জানা নেই। দুই একটি গাছ ন্যাড়া-মাথা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। সেরকম একটা গাছে আশ্রয় নিয়েছে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো। মহাপ্রলয়ের রোষানল থেকে এই মানুষগুলোর প্রাণে বেঁচে যাবার ঘটনা কতটা অলৌকিক তা বিশ্লেষণসাপেক্ষ। প্রকৃতি কখন প্রলয় মূর্তি ধারণ করেছিল এবং কখন এই অজাগতিক ঘটনা ঘটে গেছে আর ঘটনার পর কতকাল ধরে তারা গাছের ওপর বসে আছে তা কেউ হিসেব করে বলবার সাহস দেখায় না। আর তখন সেই যে মহাজাগতিক অন্ধকার নেমে এসেছিলো তার আর দূর হচ্ছে না এই জনপদ থেকে। ফলে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো নিরন্তর অপেক্ষা করছে। কতদিন এই অপেক্ষার প্রহর তাদের জীবনে থাকবে এই বিষয়টিও কেউ নিশ্চিত নয়। তবে তারা নিয়ম মেনে গাছের ডালে অপেক্ষা করছে। তারা অপেক্ষা করছে কারণ অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। কেউ এসে তাদের উদ্ধার করবে এরকম ভাবনা থেকে তাদের অপেক্ষার পালা শুরু।

অপরিচিত গাছটির ন্যাড়া ডালগুলোয় যে জনাবিশেক লোক অপেক্ষমাণ তাদের মধ্যে কিয়াং সবচেয়ে বয়স্ক। তিনি তার অভিজ্ঞতার থলে হাতড়ে দেখতে চেষ্টা করলেন তার জীবদ্দশায় অথবা অন্য কোনো কালে এরকম কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইতিহাস আছে কী না। তিনি ভেবে অবাক হলেন যে তার এক জীবনের অভিজ্ঞতার ভিতর এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি ইতিহাসের আরও পশ্চাতে ধাবিত হলেন। তার মনে পড়ল এখন থেকে পাঁচ প্রজন্ম আগের একটি বিপর্যয়ের কথা তিনি শুনেছিলেন তার পিতার কাছে। তার পিতা পিনুকাং শুনেছিলেন তার পিতার কাছে। তবে সেটিও এতটা মারাত্মক ছিল না। তিনি সবার উদ্দেশ্যে হঠাৎ বলে উঠলেন- তবে সেই সময় উদ্ধার কার্য চলেছিলো খুব দ্রুতগতিতে। বেঁচে থাকা লোকগুলোর কেউ আর পরে মারা যায়নি।

একটা বিমর্ষ কণ্ঠ ঝিমুনির সুরে জানতে চাইলো- তবে এখন হচ্ছে না কেন? আমরাতো আর বাঁচব বলে মনে হয় না।

-তখন নেতা ছিলো ভলো। শুনেছি সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজধানী থেকে ছুটে এসেছিলেন। কলার ভেলায় কয়েক দিবস যামিনী কাটিয়ে সবাইকে উদ্ধার করা শেষ হলে তবে তিনি রাজধানী ফিরে গিয়েছিলেন।

-আমাদের নেতা কি আমাদের দুর্দশার কথা শুনেছেন?

-শুনে থাকবেন হয়তো।

-তাহলে তিনি আসছেন না কেন?

বৃদ্ধ তাকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিলেন। ঠিক তখন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় অথবা ইচ্ছাকৃত কোনো কারণে স্তন্যপান- বয়সী একটি শিশু পাতাবিহীন গাছের ডাল থেকে পড়ে গেল নিচে। মা সন্তান হারানোর সত্যিকার কিংবা কৃত্রিম বেদনায় কেঁদে উঠল। বৃদ্ধ তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন- এখন সন্তানের জন্য শোক করবার সময় নয়। ধরে নাও এখন যারা মৃত্যুবরণ করছে তারা এক অর্থে ভাগ্যবান। আমরা বেঁচে থেকে যে দুঃখ-যন্ত্রণা সইব তারা সেইসব থেকে মুক্তি পেয়েছে। তুমি তোমার এক সন্তানকে হারিয়েছ, আমি হারিয়েছি আমার সাত সন্তান। তাদেরও সন্তান ছিলো। আমার নিজের বেঁচে থাকার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? আমি সন্তাপ করছি না কারণ যারা চলে গেছে তারা সামনের ভয়াবহ পরিণতির শিকার হবে না আর। ঈশ্বরকে ডাক, তিনি এগিয়ে এলে আমরা বাঁচতে পারব।

একজন যুবক অন্ধকার ভেদ করে তাকিয়ে ছিলো নক্ষত্রের দিকে। সে খানিকটা নির্মোহ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো বৃদ্ধের দিকে- আমাদের নেতা কি ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরই কি আমাদের নেতা?

বৃদ্ধ ক্ষুব্ধ হলেন- শুনেছি তুমি আধুনিক বিদ্যায় শিক্ষিত। তোমার প্রশ্নটি যুগপৎ বিতর্কিত এবং প্রচ্ছন্ন। অতিমাত্রিক বুদ্ধিজীবিতা কিংবা একটা দ্রোহ তোমার প্রশ্নের মধ্যে আছে। তুমি নিশ্চই জানো আমাদের নেতার নাম ফালুজা?

-আমরা কোনোদিন তাকে দেখিনি। তিনি কখনো এই জনপদে আসেননি।

-এটাই কি ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য বলে তুমি মনে কর?

-আমি কিছু মনে করলে ফালুজা কি ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য হারাবেন?

বৃদ্ধ চুপ করে গেলেন? এই অভিযোগের দায় তার নেবার কথা নয়। বস্তুত তিনি ফালুজার প্রতিনিধিও নন। নেতার কাজকর্মে তিনি নিজেও সন্তুষ্ট নন। তবে তিনি মনে করেন নেতা নিজে ঈশ্বর না হলেও তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি।

সদ্য সন্তান হারানো নারীর নিয়ন্ত্রিত বিলাপ উপেক্ষা করে কেউ একজন বলল- আমরা প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। বহুকাল আমাদের কোনো খাদ্য নেই। আমরাতো আর অপেক্ষা করতে পারি না।

কিয়াং এতগুলো মুখের ভার স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারতেন যদি না তিনিও তাদের মতো অসহায় হয়ে না পড়তেন। তবু নিজের কাছে তাকে অপরাধী মনে হতে তাকে। তিনি পুনরায় একই কথা বলেন- ঈশ্বরকে ডাক। এই বিপদে তিনিই আমাদের একমাত্র ত্রাতা।

অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়। আশেপাশে হয়তো কোনো ন্যাড়া বৃক্ষে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে দুই একটা কুকুর, মানুষও থাকতে পারে তাদের সঙ্গে। এমনকি সাপ, ব্যাঙ, শিয়ালও নিশ্চুপ নিরাপদ সময়ের অপেক্ষায় থাকতে পারে। এই জনপদে আর কোথায় জীবনের চিহ্ন বর্তমান তার হিসেব রাখবার কেউ নেই। নফুসি নামের এক তরুণী বহু দিনের পরিণয় পার করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান না হবার সম্ভাবনা দেখে স্বামী হারাবার অসহনীয় বেদনা ক্রমাগত গাঢ় হতে থাকে তার ভিতর। সে অসহিষ্ণু হয়ে পক্বকেশ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে- এখান থেকে ডাঙ্গা কতদূর হতে পারে?

-ডাঙ্গা মানেতো রাজধানী। রাজধানী বাদে এমন কোনো ভূখন্ড নেই যা জলাক্রান্ত হয়নি। রাজধানী তো অনেক দূর। কেন জিজ্ঞেস করছো?

-সাঁতরে যাওয়া যায় না?

-মানবকুলের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন অপেক্ষা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।

এদের মধ্যে একজন নুহু নবীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করল। তখন অবিশ্বাসী লোকসকল নবীর কথা না শুনে কীভাবে ধ্বংস হয়েছিলো সে তার বিশদ বর্ণনা শেষ করে জীবিতদের উদ্দেশে বলল- নুহু নবীর কথা যারা শোনেনি, ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন। আমাদের জীবিতদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে, যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। কেউ আবার সমাজ ও রাষ্ট্র নির্ধারিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছে মতো জীবন যাপন করেছে। এইখানে এমন এক নারী আছে যার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিদ্যমান। সংক্ষেপে যদি বলি আমরা পথভ্রষ্ট। এই বিপর্যয় আমাদের স্রষ্টা নির্ধারিত। গাছে আশ্রয় নেয়া সুঠামদেহী যুবক অপমানিত বোধ করায় তার ঐ লোকের ওপর অপরিমিত রাগ হলো। যে নারীর প্রসঙ্গ সে আলোচনায় এনেছে অবজ্ঞা আর অপমানের সুরে তার কিছুটা তার ওপরও বর্তায় বটে। সে রেগে অভিযোগ খন্ডন করতে চাইল- আমরা পথভ্রষ্ট নই। আমাদের পথ প্রদর্শকগণ পথভ্রষ্ট।

বৃদ্ধ এবার কিছুটা ক্রুদ্ধ হলেন কারণ এক অর্থে তিনিও এ তল্লাটের পথ প্রদর্শনকারী পথ প্রদর্শক বলতে তুমি কাদের বোঝাতে চাও?

-আমি আপনার প্রসঙ্গ টানিনি। আমাদের নেতার কথা বোঝাতে চেয়েছি।

অন্য একজন যে এতক্ষণ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কথা বলেনি সে হঠাৎ বলে উঠল- ঝড়ের আভাস পেয়ে আমাদের নেতা রাজার ত্রাণভান্ডার থেকে নাকি ঢেউ খেলানো এক ধরনের ধাতব পাত সংগ্রহ করেছেন আমাদের জন্য। এগুলো ঘরের বেড়া ও ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয়। তিনি আমাদের জন্য অনেক খাবারও নাকি সংগ্রহ করেছেন।

যুবক গভীর ক্ষোভে বলল- কিন্তু আমরা তার কিছুই পেলাম না এখনো।

বৃদ্ধ আশাহতের মতো বললেন- নিশ্চই আমরা সব পাবো।

অবরুদ্ধ মানুষগুলোর জীবনে অন্ধকার আর কাটে না। চারদিকে অপার্থিব অন্ধকার, ক্ষুধা আর কামহীন সময় তাদের মৃত্যু ভাবনার দিকে ঠেলে দেয়। সন্তান বাৎসল্য, সমাজ ও গোত্র ভাবনা বহু আগেই ত্যাগ করেছে তারা। অন্ধকার ঠেলে ঠেলে বড় হতে থাকলে কে আর নিজের ছায়ার বাইরে তাকাতে পারে বস্তুত যেখানে নিজের ছায়াও দুষ্কর। এইখানে এই ন্যাড়া-মাথা বৃক্ষে বসবাসরত মানুষেরা ক্রমাগত নিজের দিকে গুটায়মান।

চারদিকে আবদ্ধ জলে মরে থাকা অসংখ্য জীবের পচনধরা শরীরের বীভৎস গন্ধ জীবিতদের ইন্দ্রিয়গুলোকেও রোগাক্রান্ত করে তোলে। খাদ্য এবং রোগ নিরাময় সামগ্রী এখন তাদের যুগপৎ চাওয়া। অথচ তাদের নেতা এখনো এসে পৌঁছাননি। বিষয়টি তাদের রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। সুঠামদেহী যুবক তার অগ্নিঝরা চোখ বৃদ্ধের দিকে তুলে বলল- যদি অনুমতি মেলে আমি একবার যেতে পারি রাজধানীর দিকে।

-কী করে যাবে? এত জল চারদিকে। এই ক্ষুধার্ত শরীরে রাজধানী পর্যন্ত সাঁতরে যাওয়া সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।

-এই গাছের নিচে একটা কলাগাছ আটকে থাকতে দেখেছিলাম। সেটা বোধ হয় এখনো আছে। একবার চেষ্টা করে দেখি। এতগুলো মানুষের জীবন অনাহারে শেষ হয়ে যাবে তা তো হতে পারে না।

বৃদ্ধ রাজি হলেন। এখন এই নিয়ন্ত্রণহীন সময়ে একটি যুবক তার অনুমতি প্রার্থনা করেছে এটিই বোধহয় অনেক সম্মানের বিষয়। সে যদি তার অনুমতি না চাইত তাহলেইবা কী করার ছিলো। তাছাড়া তার কাছে অনুমতি চাইবার কোনো কারণও নেই। তার নিজের পক্ষে যেহেতু বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করবার সামর্থ্য নেই, সেহেতু কেউ যদি কাজটি স্বেচ্ছায় করতে চায় তাকে বাধা দেবার অধিকারও তার নেই। তবে তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে এই সফর সফল হবে না। এত দূরের পথ, চারদিকে থৈ থৈ জল। একজন ক্ষুধার্ত মানুষ কী করে করতে পারে এমন অসম্ভব কাজ।

যুবক গাছ থেকে ধীরে নিচে নেমে আসে। তার এই দীর্ঘ এবং আপাত অসফল যাত্রা এবং তার সম্ভাব্য পরিণতির কথা স্মরণ করে কোনো এক তরুণীর চোখ ভিজে আসে। তবে তার রোদনভরা শব্দমালা নৈঃশব্দ্যের ইস্পাত-সমান দৃঢ়তা ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। তাদের ভিতরকার মানসিক পরিবর্তনগুলোর পর যখন অপেক্ষার পালা সমাপ্তির পথে, যখন তারা ভেবে নেয় নিরর্থক কালক্ষেপনের কোনো মানে নেই এবং এই জনপদে এই রকম মানসিক আর মানুষিক দেয়া-নেয়া বাঁকা চোখে দেখা হলেও ঘটনার ইতিবৃত্ত উন্মোচিত হওয়া দরকার তখনই প্রকৃতি বিরূপ হয়। এখন এই রকম যুদ্ধদিনেও তাদের লালিত স্বপ্নবীজ কী এক অমোঘ নিয়মে এইতো কিছুক্ষণ আগেও মহাসমারোহে সতেজ ছিলো। এই বিপর্যস্ত জীবনে নিরালম্ব অন্ধকারের ভিতর কোনো এক আশার আলো তাকে বিভোর করে রেখেছিলো। ক্ষুধা অন্ধকার আর অনিদ্রার ভিতর জীবনের প্রবাহ তার কাছে অর্থবহই ছিলো। এখন এই মুহূর্তে যুবকের গাছ থেকে অবরোহন তার সংগ্রাম-স্বপ্নবীজের অঙ্কুরোদগম থামিয়ে দিলো বলে তার চোখ ছল ছল করে। অন্ধকারেও বৃদ্ধ তা লক্ষ্য করলেন এবং বুঝেও নিলেন অশ্রু পতনের নিগূঢ় রহস্যের কথা।

যুবক রাজধানীর পথে যাত্রা শুরু করে। পথ বলতে অন্তহীন নিস্তরঙ্গ জলরাশি এবং তার ওপর বিরামহীন সন্তরণ। স্রোতহীনতা যুবকের পথচলাকে মসৃণ করে নাকি তা আরও কঠিন হয় তা বোঝা মুসকিল হয়। কলাগাছ তাকে কাক্সিক্ষত সুবিধা দিতে পারছে না। তবে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলে কিছুটা সময় বিশ্রামের উপকরণ হয়ে থাকছে কলাগাছটি। সময় এখানে অসংজ্ঞায়িত কোনো বিষয়। পৌরাণিক নিয়মে যুবকের পথচলা নিরুপণ হয়ে থাকতে পারে বলে সময় আসলে থেমে থাকছে না, চলছে সামনের দিকে তার হিসেব কিছুটা অনর্থের সৃষ্টি করে। নিরন্তর পথ চলার পর যুবক একসময় তার শরীর দেখতে পায়। দেখতে পায় শ্যাওলাজমা সবুজাভ কলাগাছটিকেও। চারদিকে অন্ধকার ফ্যাকাসে হয়ে আসতে থাকে এবং সামনে জলের কিনারে সুরম্য অট্টালিকার রেখা স্পষ্ট হলে যুবকের প্রচন্ড ক্ষিধে পায় এবং শরীর নেতিয়ে আসতে থাকে। মানুষের কোলাহল আর যানবাহন থেকে উদ্গত অর্থহীন কিংবা দারুণ অর্থবহ শব্দসমাহার তার কানে পীতরঙা স্বাদ তৈরি করে। একসময় জল ঘেঁষে শুয়ে থাকা মাটির স্পর্শ পাবার পর যুবক জ্ঞান হারায়।

সূর্য ক্রমাগত অমিততেজি হয়ে আকাশের মাঝ বরাবর এসে গেলে তার শরীরে নুনচোষা ঘাম জমে। তাপ এবং আলোর ঝলকানিতে জ্ঞান ফিরে এলে যুবক দেখতে পায় এখানে নিয়মিত সূর্য ওঠে, মানুষেরা প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারে। বিষয়গুলো তাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে। দূরত্ব অনেক হলেও একইতো ভূন্ডখন্ড। অথচ নিয়মগুলো কেমন আলাদা। শেষ কবে তারা সূর্য দেখেছে সেই ইতিহাস তার মনে নেই। জলের কিনার ঘেঁষে রোদে ঝলমল প্রাসাদগুলোর দিকে তাকায় সে। পার্থিব কোনো বস্তু থেকে এত আলো প্রতিফলিত হতে পারে এ-রকমটা তার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিলো। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ম্রিয়মাণ যুবকের চোখ ঝলসে দিয়ে সেইসব বিম্বিত আলোকরেখা জলে গিয়ে পড়ে। সে সদ্যপ্রসূত ছাগশিশুর মতো দাঁড়াতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সে এই প্রথম বুঝতে পারে প্রাসাদের সামনের মাটিও সুবাসিত। কিছুদূর এগিয়ে গেলে আরও একটি বিষয় তাকে ভীষণ আহত করে। প্রাসাদের তুলতুলে রাস্তার পাশে শুকনো পাতার মতো কিছু মানুষ বসে আছে। বোঝা যায় তারা কারো জন্য অপেক্ষমাণ। রাস্তা বরাবর অফুরন্ত মানুষের মিছিল। কারো পা নেই, হাত নেই, কেউ আবার চোখে দেখে না। একজন ক্ষয়ে যাওয়া উরুর মাংস জনসমক্ষে উম্মুক্ত করে বসে আছে বিকারহীন। একপাশে একপাল মানুষের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়।

নেতার প্রাসাদ থেকে খানিক দূরে সদ্যনির্মিত ঘরের চালে ও বেড়ায় সূর্যালোক খেলা করে। এরকম ঝকঝকে বস্তু এবং তা দিয়ে নির্মিত ঘর যুবক এর আগে দেখেনি। যে বস্তু দ্বারা ঘরগুলো নির্মিত তার নামও সে জানে না। তাদের জনপদে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে যাবার পর রাজধানীর পথে যাত্রার আগে কারো একজনের কথার জবাবে শুভ্রকেশ বৃদ্ধ বলেছিলেন- আমরা এবার সেই ঢেউ খেলানো ঝলমলে শক্ত পাত ঘর নির্মাণের জন্য পাবো। মনে করি পাতগুলো লৌহনির্মিত। আমাদের ঘরের চালে ও বেড়ায় সেইসব আলো বিকিরণকারি বস্তু শোভা পাবে। এরকম ঝড় জলোচ্ছ্বাসে সেসবের কোনো ক্ষতিই হবে না। তাছাড়া শুনেছি বৃষ্টি পতনের সময় তাতে এক ধরনের মায়াবী সুর ঝংকার তৈরি হয়। ঘরের চাল তোমাদের কেবল বৃষ্টির ফোঁটা আর ঝড় থেকে রক্ষাই করবে না, তোমাদের নান্দনিক চাহিদাও মেটাবে। এ এক আশ্চর্য আবিষ্কার মানুষের। আমাদের নেতা ফালুজা সেগুলো নিয়ে আসবেন।

বৃদ্ধের কথার সঙ্গে বস্তুগুলো মিলিয়ে নিতে চাইলে যুবকের কাছে তা অনাবি®কৃত আনন্দে মিলে যেতে থাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কেতাদুরস্তকে তবু সে দ্বিধার বাষ্পটুকু দূর করবার নিমিত্তে জিজ্ঞেস করে- ঐযে ঝকমক করছে বাড়িগুলো ওগুলো কী দিয়ে তৈরি?

-টিন দিয়ে।

বস্তুটার নাম তাহলে টিন।

-বাড়িগুলো কে বানিয়েছে?

-নেতা।

-তিনি কি ওখানে থাকেন?

-আপনার এত কী প্রয়োজন শুনি? নেতা কেন টিনের ঘরে থাকতে যাবেন? তিনি এই প্রাসাদে থাকেন।

লোকটি চলে যায় প্রাসাদের গেটের দিকে। যুবক বিষয়টি নিয়ে আর ভাবতে চায় না। হতে পারে তিনি কোনো মহৎ কাজে ঘরগুলো তৈরি করেছেন। সে এখন কেবল ভাবতে চায় ন্যাড়ামাতা গাছের ওপর আটকে থাকা মানুষগুলোর কথা। তারা কতকাল সেখানে আছে আর থাকতে হবে এরকম চিন্তা তাকে ক্রমাগত অবশ করে তোলে। লোকটির কাছে গিয়ে আবার সে জিজ্ঞেস করে- নেতার সঙ্গে দেখা করা যায় না?

কেতাদুরস্তের চোখ ছোট হয়ে আসে, মুখমন্ডলে তৈরি হয় নানা রকম সংকোচন। সে বোঝাতে সক্ষম হয় এই জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপন অপরাধের শামিল।

-তুমি এসেছো কোথা থেকে?

-সুবর্ণগ্রাম।

-এখন জলাক্রান্ত। ওখানে কোনো মানুষ জীবিত আছে?

-আছে, আছে। আমি তাদের জন্যই এসেছি। তাদের খাদ্য, ওষুধ আর থাকবার জন্য ঘর দরকার।

-নেতার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিতে পারতাম যদি তোমার হাতে কিছু মুদ্রা থাকতো। তুমিতো একেবারে নিঃস্ব। তবে একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি, রাজার ত্রাণভান্ডার থেকে নেতা যা এনেছিলেন তা ইতোমধ্যে ফুরিয়ে গেছে। তোমাকে ফিরতে হবে খালি হাতেই। তাছাড়া নেতা এখনো ঘুমে। কবে তিনি ঘুম থেকে উঠবেন আমরা কেউ তা জানি না। এই যে লোকগুলোকে দেখছ সার ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে, তারা বহুকাল ধরে নেতার সাক্ষাতের অপেক্ষায়। নেতাকে দেখার ইচ্ছেটাই যদি কেবল থাকে তবে তুমিও তাদের দলে মিশে যেতে পারো। অন্য কোনো সাধ এই নগরে পূরণ হয় না।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

ত্রাণকর্তা

অনন্ত মাহফুজ

image

আসুরিক ধ্বংসলীলার মাঝখানে এখন সুনসান নীরবতা। কোনোকালে এখানে লোকালয় ছিলো এরকম ধারণা করবার কোনো উপকরণ আর অবশিষ্ট নেই। এখানে প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলো মানুষ। ফসলে ফসলে মাঠের পর মাঠ নানা বর্ণের বিচিত্রতা লাভ করত। এখানে অভিমান ছিলো, ভালোবাসা ছিলো এমকি সন্তান উৎপাদনের ব্যাপকতাও ছিলো। এখন অবারিত জল। কোথাও তিল পরিমাণ মাটি অবশিষ্ট আছে যেখানে পানি ওঠেনি এরকম সংবাদ কারো জানা নেই। দুই একটি গাছ ন্যাড়া-মাথা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। সেরকম একটা গাছে আশ্রয় নিয়েছে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো। মহাপ্রলয়ের রোষানল থেকে এই মানুষগুলোর প্রাণে বেঁচে যাবার ঘটনা কতটা অলৌকিক তা বিশ্লেষণসাপেক্ষ। প্রকৃতি কখন প্রলয় মূর্তি ধারণ করেছিল এবং কখন এই অজাগতিক ঘটনা ঘটে গেছে আর ঘটনার পর কতকাল ধরে তারা গাছের ওপর বসে আছে তা কেউ হিসেব করে বলবার সাহস দেখায় না। আর তখন সেই যে মহাজাগতিক অন্ধকার নেমে এসেছিলো তার আর দূর হচ্ছে না এই জনপদ থেকে। ফলে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো নিরন্তর অপেক্ষা করছে। কতদিন এই অপেক্ষার প্রহর তাদের জীবনে থাকবে এই বিষয়টিও কেউ নিশ্চিত নয়। তবে তারা নিয়ম মেনে গাছের ডালে অপেক্ষা করছে। তারা অপেক্ষা করছে কারণ অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। কেউ এসে তাদের উদ্ধার করবে এরকম ভাবনা থেকে তাদের অপেক্ষার পালা শুরু।

অপরিচিত গাছটির ন্যাড়া ডালগুলোয় যে জনাবিশেক লোক অপেক্ষমাণ তাদের মধ্যে কিয়াং সবচেয়ে বয়স্ক। তিনি তার অভিজ্ঞতার থলে হাতড়ে দেখতে চেষ্টা করলেন তার জীবদ্দশায় অথবা অন্য কোনো কালে এরকম কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইতিহাস আছে কী না। তিনি ভেবে অবাক হলেন যে তার এক জীবনের অভিজ্ঞতার ভিতর এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি ইতিহাসের আরও পশ্চাতে ধাবিত হলেন। তার মনে পড়ল এখন থেকে পাঁচ প্রজন্ম আগের একটি বিপর্যয়ের কথা তিনি শুনেছিলেন তার পিতার কাছে। তার পিতা পিনুকাং শুনেছিলেন তার পিতার কাছে। তবে সেটিও এতটা মারাত্মক ছিল না। তিনি সবার উদ্দেশ্যে হঠাৎ বলে উঠলেন- তবে সেই সময় উদ্ধার কার্য চলেছিলো খুব দ্রুতগতিতে। বেঁচে থাকা লোকগুলোর কেউ আর পরে মারা যায়নি।

একটা বিমর্ষ কণ্ঠ ঝিমুনির সুরে জানতে চাইলো- তবে এখন হচ্ছে না কেন? আমরাতো আর বাঁচব বলে মনে হয় না।

-তখন নেতা ছিলো ভলো। শুনেছি সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজধানী থেকে ছুটে এসেছিলেন। কলার ভেলায় কয়েক দিবস যামিনী কাটিয়ে সবাইকে উদ্ধার করা শেষ হলে তবে তিনি রাজধানী ফিরে গিয়েছিলেন।

-আমাদের নেতা কি আমাদের দুর্দশার কথা শুনেছেন?

-শুনে থাকবেন হয়তো।

-তাহলে তিনি আসছেন না কেন?

বৃদ্ধ তাকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিলেন। ঠিক তখন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় অথবা ইচ্ছাকৃত কোনো কারণে স্তন্যপান- বয়সী একটি শিশু পাতাবিহীন গাছের ডাল থেকে পড়ে গেল নিচে। মা সন্তান হারানোর সত্যিকার কিংবা কৃত্রিম বেদনায় কেঁদে উঠল। বৃদ্ধ তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন- এখন সন্তানের জন্য শোক করবার সময় নয়। ধরে নাও এখন যারা মৃত্যুবরণ করছে তারা এক অর্থে ভাগ্যবান। আমরা বেঁচে থেকে যে দুঃখ-যন্ত্রণা সইব তারা সেইসব থেকে মুক্তি পেয়েছে। তুমি তোমার এক সন্তানকে হারিয়েছ, আমি হারিয়েছি আমার সাত সন্তান। তাদেরও সন্তান ছিলো। আমার নিজের বেঁচে থাকার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? আমি সন্তাপ করছি না কারণ যারা চলে গেছে তারা সামনের ভয়াবহ পরিণতির শিকার হবে না আর। ঈশ্বরকে ডাক, তিনি এগিয়ে এলে আমরা বাঁচতে পারব।

একজন যুবক অন্ধকার ভেদ করে তাকিয়ে ছিলো নক্ষত্রের দিকে। সে খানিকটা নির্মোহ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো বৃদ্ধের দিকে- আমাদের নেতা কি ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরই কি আমাদের নেতা?

বৃদ্ধ ক্ষুব্ধ হলেন- শুনেছি তুমি আধুনিক বিদ্যায় শিক্ষিত। তোমার প্রশ্নটি যুগপৎ বিতর্কিত এবং প্রচ্ছন্ন। অতিমাত্রিক বুদ্ধিজীবিতা কিংবা একটা দ্রোহ তোমার প্রশ্নের মধ্যে আছে। তুমি নিশ্চই জানো আমাদের নেতার নাম ফালুজা?

-আমরা কোনোদিন তাকে দেখিনি। তিনি কখনো এই জনপদে আসেননি।

-এটাই কি ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য বলে তুমি মনে কর?

-আমি কিছু মনে করলে ফালুজা কি ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য হারাবেন?

বৃদ্ধ চুপ করে গেলেন? এই অভিযোগের দায় তার নেবার কথা নয়। বস্তুত তিনি ফালুজার প্রতিনিধিও নন। নেতার কাজকর্মে তিনি নিজেও সন্তুষ্ট নন। তবে তিনি মনে করেন নেতা নিজে ঈশ্বর না হলেও তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি।

সদ্য সন্তান হারানো নারীর নিয়ন্ত্রিত বিলাপ উপেক্ষা করে কেউ একজন বলল- আমরা প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। বহুকাল আমাদের কোনো খাদ্য নেই। আমরাতো আর অপেক্ষা করতে পারি না।

কিয়াং এতগুলো মুখের ভার স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারতেন যদি না তিনিও তাদের মতো অসহায় হয়ে না পড়তেন। তবু নিজের কাছে তাকে অপরাধী মনে হতে তাকে। তিনি পুনরায় একই কথা বলেন- ঈশ্বরকে ডাক। এই বিপদে তিনিই আমাদের একমাত্র ত্রাতা।

অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়। আশেপাশে হয়তো কোনো ন্যাড়া বৃক্ষে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে দুই একটা কুকুর, মানুষও থাকতে পারে তাদের সঙ্গে। এমনকি সাপ, ব্যাঙ, শিয়ালও নিশ্চুপ নিরাপদ সময়ের অপেক্ষায় থাকতে পারে। এই জনপদে আর কোথায় জীবনের চিহ্ন বর্তমান তার হিসেব রাখবার কেউ নেই। নফুসি নামের এক তরুণী বহু দিনের পরিণয় পার করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান না হবার সম্ভাবনা দেখে স্বামী হারাবার অসহনীয় বেদনা ক্রমাগত গাঢ় হতে থাকে তার ভিতর। সে অসহিষ্ণু হয়ে পক্বকেশ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে- এখান থেকে ডাঙ্গা কতদূর হতে পারে?

-ডাঙ্গা মানেতো রাজধানী। রাজধানী বাদে এমন কোনো ভূখন্ড নেই যা জলাক্রান্ত হয়নি। রাজধানী তো অনেক দূর। কেন জিজ্ঞেস করছো?

-সাঁতরে যাওয়া যায় না?

-মানবকুলের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন অপেক্ষা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।

এদের মধ্যে একজন নুহু নবীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করল। তখন অবিশ্বাসী লোকসকল নবীর কথা না শুনে কীভাবে ধ্বংস হয়েছিলো সে তার বিশদ বর্ণনা শেষ করে জীবিতদের উদ্দেশে বলল- নুহু নবীর কথা যারা শোনেনি, ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন। আমাদের জীবিতদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে, যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। কেউ আবার সমাজ ও রাষ্ট্র নির্ধারিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছে মতো জীবন যাপন করেছে। এইখানে এমন এক নারী আছে যার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিদ্যমান। সংক্ষেপে যদি বলি আমরা পথভ্রষ্ট। এই বিপর্যয় আমাদের স্রষ্টা নির্ধারিত। গাছে আশ্রয় নেয়া সুঠামদেহী যুবক অপমানিত বোধ করায় তার ঐ লোকের ওপর অপরিমিত রাগ হলো। যে নারীর প্রসঙ্গ সে আলোচনায় এনেছে অবজ্ঞা আর অপমানের সুরে তার কিছুটা তার ওপরও বর্তায় বটে। সে রেগে অভিযোগ খন্ডন করতে চাইল- আমরা পথভ্রষ্ট নই। আমাদের পথ প্রদর্শকগণ পথভ্রষ্ট।

বৃদ্ধ এবার কিছুটা ক্রুদ্ধ হলেন কারণ এক অর্থে তিনিও এ তল্লাটের পথ প্রদর্শনকারী পথ প্রদর্শক বলতে তুমি কাদের বোঝাতে চাও?

-আমি আপনার প্রসঙ্গ টানিনি। আমাদের নেতার কথা বোঝাতে চেয়েছি।

অন্য একজন যে এতক্ষণ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কথা বলেনি সে হঠাৎ বলে উঠল- ঝড়ের আভাস পেয়ে আমাদের নেতা রাজার ত্রাণভান্ডার থেকে নাকি ঢেউ খেলানো এক ধরনের ধাতব পাত সংগ্রহ করেছেন আমাদের জন্য। এগুলো ঘরের বেড়া ও ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয়। তিনি আমাদের জন্য অনেক খাবারও নাকি সংগ্রহ করেছেন।

যুবক গভীর ক্ষোভে বলল- কিন্তু আমরা তার কিছুই পেলাম না এখনো।

বৃদ্ধ আশাহতের মতো বললেন- নিশ্চই আমরা সব পাবো।

অবরুদ্ধ মানুষগুলোর জীবনে অন্ধকার আর কাটে না। চারদিকে অপার্থিব অন্ধকার, ক্ষুধা আর কামহীন সময় তাদের মৃত্যু ভাবনার দিকে ঠেলে দেয়। সন্তান বাৎসল্য, সমাজ ও গোত্র ভাবনা বহু আগেই ত্যাগ করেছে তারা। অন্ধকার ঠেলে ঠেলে বড় হতে থাকলে কে আর নিজের ছায়ার বাইরে তাকাতে পারে বস্তুত যেখানে নিজের ছায়াও দুষ্কর। এইখানে এই ন্যাড়া-মাথা বৃক্ষে বসবাসরত মানুষেরা ক্রমাগত নিজের দিকে গুটায়মান।

চারদিকে আবদ্ধ জলে মরে থাকা অসংখ্য জীবের পচনধরা শরীরের বীভৎস গন্ধ জীবিতদের ইন্দ্রিয়গুলোকেও রোগাক্রান্ত করে তোলে। খাদ্য এবং রোগ নিরাময় সামগ্রী এখন তাদের যুগপৎ চাওয়া। অথচ তাদের নেতা এখনো এসে পৌঁছাননি। বিষয়টি তাদের রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। সুঠামদেহী যুবক তার অগ্নিঝরা চোখ বৃদ্ধের দিকে তুলে বলল- যদি অনুমতি মেলে আমি একবার যেতে পারি রাজধানীর দিকে।

-কী করে যাবে? এত জল চারদিকে। এই ক্ষুধার্ত শরীরে রাজধানী পর্যন্ত সাঁতরে যাওয়া সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।

-এই গাছের নিচে একটা কলাগাছ আটকে থাকতে দেখেছিলাম। সেটা বোধ হয় এখনো আছে। একবার চেষ্টা করে দেখি। এতগুলো মানুষের জীবন অনাহারে শেষ হয়ে যাবে তা তো হতে পারে না।

বৃদ্ধ রাজি হলেন। এখন এই নিয়ন্ত্রণহীন সময়ে একটি যুবক তার অনুমতি প্রার্থনা করেছে এটিই বোধহয় অনেক সম্মানের বিষয়। সে যদি তার অনুমতি না চাইত তাহলেইবা কী করার ছিলো। তাছাড়া তার কাছে অনুমতি চাইবার কোনো কারণও নেই। তার নিজের পক্ষে যেহেতু বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করবার সামর্থ্য নেই, সেহেতু কেউ যদি কাজটি স্বেচ্ছায় করতে চায় তাকে বাধা দেবার অধিকারও তার নেই। তবে তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে এই সফর সফল হবে না। এত দূরের পথ, চারদিকে থৈ থৈ জল। একজন ক্ষুধার্ত মানুষ কী করে করতে পারে এমন অসম্ভব কাজ।

যুবক গাছ থেকে ধীরে নিচে নেমে আসে। তার এই দীর্ঘ এবং আপাত অসফল যাত্রা এবং তার সম্ভাব্য পরিণতির কথা স্মরণ করে কোনো এক তরুণীর চোখ ভিজে আসে। তবে তার রোদনভরা শব্দমালা নৈঃশব্দ্যের ইস্পাত-সমান দৃঢ়তা ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। তাদের ভিতরকার মানসিক পরিবর্তনগুলোর পর যখন অপেক্ষার পালা সমাপ্তির পথে, যখন তারা ভেবে নেয় নিরর্থক কালক্ষেপনের কোনো মানে নেই এবং এই জনপদে এই রকম মানসিক আর মানুষিক দেয়া-নেয়া বাঁকা চোখে দেখা হলেও ঘটনার ইতিবৃত্ত উন্মোচিত হওয়া দরকার তখনই প্রকৃতি বিরূপ হয়। এখন এই রকম যুদ্ধদিনেও তাদের লালিত স্বপ্নবীজ কী এক অমোঘ নিয়মে এইতো কিছুক্ষণ আগেও মহাসমারোহে সতেজ ছিলো। এই বিপর্যস্ত জীবনে নিরালম্ব অন্ধকারের ভিতর কোনো এক আশার আলো তাকে বিভোর করে রেখেছিলো। ক্ষুধা অন্ধকার আর অনিদ্রার ভিতর জীবনের প্রবাহ তার কাছে অর্থবহই ছিলো। এখন এই মুহূর্তে যুবকের গাছ থেকে অবরোহন তার সংগ্রাম-স্বপ্নবীজের অঙ্কুরোদগম থামিয়ে দিলো বলে তার চোখ ছল ছল করে। অন্ধকারেও বৃদ্ধ তা লক্ষ্য করলেন এবং বুঝেও নিলেন অশ্রু পতনের নিগূঢ় রহস্যের কথা।

যুবক রাজধানীর পথে যাত্রা শুরু করে। পথ বলতে অন্তহীন নিস্তরঙ্গ জলরাশি এবং তার ওপর বিরামহীন সন্তরণ। স্রোতহীনতা যুবকের পথচলাকে মসৃণ করে নাকি তা আরও কঠিন হয় তা বোঝা মুসকিল হয়। কলাগাছ তাকে কাক্সিক্ষত সুবিধা দিতে পারছে না। তবে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলে কিছুটা সময় বিশ্রামের উপকরণ হয়ে থাকছে কলাগাছটি। সময় এখানে অসংজ্ঞায়িত কোনো বিষয়। পৌরাণিক নিয়মে যুবকের পথচলা নিরুপণ হয়ে থাকতে পারে বলে সময় আসলে থেমে থাকছে না, চলছে সামনের দিকে তার হিসেব কিছুটা অনর্থের সৃষ্টি করে। নিরন্তর পথ চলার পর যুবক একসময় তার শরীর দেখতে পায়। দেখতে পায় শ্যাওলাজমা সবুজাভ কলাগাছটিকেও। চারদিকে অন্ধকার ফ্যাকাসে হয়ে আসতে থাকে এবং সামনে জলের কিনারে সুরম্য অট্টালিকার রেখা স্পষ্ট হলে যুবকের প্রচন্ড ক্ষিধে পায় এবং শরীর নেতিয়ে আসতে থাকে। মানুষের কোলাহল আর যানবাহন থেকে উদ্গত অর্থহীন কিংবা দারুণ অর্থবহ শব্দসমাহার তার কানে পীতরঙা স্বাদ তৈরি করে। একসময় জল ঘেঁষে শুয়ে থাকা মাটির স্পর্শ পাবার পর যুবক জ্ঞান হারায়।

সূর্য ক্রমাগত অমিততেজি হয়ে আকাশের মাঝ বরাবর এসে গেলে তার শরীরে নুনচোষা ঘাম জমে। তাপ এবং আলোর ঝলকানিতে জ্ঞান ফিরে এলে যুবক দেখতে পায় এখানে নিয়মিত সূর্য ওঠে, মানুষেরা প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারে। বিষয়গুলো তাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে। দূরত্ব অনেক হলেও একইতো ভূন্ডখন্ড। অথচ নিয়মগুলো কেমন আলাদা। শেষ কবে তারা সূর্য দেখেছে সেই ইতিহাস তার মনে নেই। জলের কিনার ঘেঁষে রোদে ঝলমল প্রাসাদগুলোর দিকে তাকায় সে। পার্থিব কোনো বস্তু থেকে এত আলো প্রতিফলিত হতে পারে এ-রকমটা তার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিলো। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ম্রিয়মাণ যুবকের চোখ ঝলসে দিয়ে সেইসব বিম্বিত আলোকরেখা জলে গিয়ে পড়ে। সে সদ্যপ্রসূত ছাগশিশুর মতো দাঁড়াতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সে এই প্রথম বুঝতে পারে প্রাসাদের সামনের মাটিও সুবাসিত। কিছুদূর এগিয়ে গেলে আরও একটি বিষয় তাকে ভীষণ আহত করে। প্রাসাদের তুলতুলে রাস্তার পাশে শুকনো পাতার মতো কিছু মানুষ বসে আছে। বোঝা যায় তারা কারো জন্য অপেক্ষমাণ। রাস্তা বরাবর অফুরন্ত মানুষের মিছিল। কারো পা নেই, হাত নেই, কেউ আবার চোখে দেখে না। একজন ক্ষয়ে যাওয়া উরুর মাংস জনসমক্ষে উম্মুক্ত করে বসে আছে বিকারহীন। একপাশে একপাল মানুষের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়।

নেতার প্রাসাদ থেকে খানিক দূরে সদ্যনির্মিত ঘরের চালে ও বেড়ায় সূর্যালোক খেলা করে। এরকম ঝকঝকে বস্তু এবং তা দিয়ে নির্মিত ঘর যুবক এর আগে দেখেনি। যে বস্তু দ্বারা ঘরগুলো নির্মিত তার নামও সে জানে না। তাদের জনপদে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে যাবার পর রাজধানীর পথে যাত্রার আগে কারো একজনের কথার জবাবে শুভ্রকেশ বৃদ্ধ বলেছিলেন- আমরা এবার সেই ঢেউ খেলানো ঝলমলে শক্ত পাত ঘর নির্মাণের জন্য পাবো। মনে করি পাতগুলো লৌহনির্মিত। আমাদের ঘরের চালে ও বেড়ায় সেইসব আলো বিকিরণকারি বস্তু শোভা পাবে। এরকম ঝড় জলোচ্ছ্বাসে সেসবের কোনো ক্ষতিই হবে না। তাছাড়া শুনেছি বৃষ্টি পতনের সময় তাতে এক ধরনের মায়াবী সুর ঝংকার তৈরি হয়। ঘরের চাল তোমাদের কেবল বৃষ্টির ফোঁটা আর ঝড় থেকে রক্ষাই করবে না, তোমাদের নান্দনিক চাহিদাও মেটাবে। এ এক আশ্চর্য আবিষ্কার মানুষের। আমাদের নেতা ফালুজা সেগুলো নিয়ে আসবেন।

বৃদ্ধের কথার সঙ্গে বস্তুগুলো মিলিয়ে নিতে চাইলে যুবকের কাছে তা অনাবি®কৃত আনন্দে মিলে যেতে থাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কেতাদুরস্তকে তবু সে দ্বিধার বাষ্পটুকু দূর করবার নিমিত্তে জিজ্ঞেস করে- ঐযে ঝকমক করছে বাড়িগুলো ওগুলো কী দিয়ে তৈরি?

-টিন দিয়ে।

বস্তুটার নাম তাহলে টিন।

-বাড়িগুলো কে বানিয়েছে?

-নেতা।

-তিনি কি ওখানে থাকেন?

-আপনার এত কী প্রয়োজন শুনি? নেতা কেন টিনের ঘরে থাকতে যাবেন? তিনি এই প্রাসাদে থাকেন।

লোকটি চলে যায় প্রাসাদের গেটের দিকে। যুবক বিষয়টি নিয়ে আর ভাবতে চায় না। হতে পারে তিনি কোনো মহৎ কাজে ঘরগুলো তৈরি করেছেন। সে এখন কেবল ভাবতে চায় ন্যাড়ামাতা গাছের ওপর আটকে থাকা মানুষগুলোর কথা। তারা কতকাল সেখানে আছে আর থাকতে হবে এরকম চিন্তা তাকে ক্রমাগত অবশ করে তোলে। লোকটির কাছে গিয়ে আবার সে জিজ্ঞেস করে- নেতার সঙ্গে দেখা করা যায় না?

কেতাদুরস্তের চোখ ছোট হয়ে আসে, মুখমন্ডলে তৈরি হয় নানা রকম সংকোচন। সে বোঝাতে সক্ষম হয় এই জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপন অপরাধের শামিল।

-তুমি এসেছো কোথা থেকে?

-সুবর্ণগ্রাম।

-এখন জলাক্রান্ত। ওখানে কোনো মানুষ জীবিত আছে?

-আছে, আছে। আমি তাদের জন্যই এসেছি। তাদের খাদ্য, ওষুধ আর থাকবার জন্য ঘর দরকার।

-নেতার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিতে পারতাম যদি তোমার হাতে কিছু মুদ্রা থাকতো। তুমিতো একেবারে নিঃস্ব। তবে একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি, রাজার ত্রাণভান্ডার থেকে নেতা যা এনেছিলেন তা ইতোমধ্যে ফুরিয়ে গেছে। তোমাকে ফিরতে হবে খালি হাতেই। তাছাড়া নেতা এখনো ঘুমে। কবে তিনি ঘুম থেকে উঠবেন আমরা কেউ তা জানি না। এই যে লোকগুলোকে দেখছ সার ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে, তারা বহুকাল ধরে নেতার সাক্ষাতের অপেক্ষায়। নেতাকে দেখার ইচ্ছেটাই যদি কেবল থাকে তবে তুমিও তাদের দলে মিশে যেতে পারো। অন্য কোনো সাধ এই নগরে পূরণ হয় না।