সুফিসাধনা তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ

জোবায়ের মিলন

প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মেই একটি বাহ্যিক ধারার পাশাপাশি একটি অভ্যন্তরীণ ধারা রয়েছে। ইসলামি দর্শনে এই অভ্যন্তরীণ ধারাটির নাম সুফিবাদ। সুফিবাদকে আরবিতে ইলমে তাসাউফ বলে। এছাড়া ইলমে লাদুনি, এলমে বুশদা, ইলমে মুফিদ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। দিব্যজ্ঞান, দিব্যানুভূতি, আল্লাহতত্ত্ব এসব অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এটি একটি মরমি ধারা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই উপমহাদেশসহ আরো অনেক দেশেই ইসলাম প্রচার করেছেন সুফিসাধকগণ। অনেক মানুষ যে তাদের পূর্বপুরুষদের শত সহস্র বছরের ধর্মটিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করেন, তার মূলে ছিলো এই মরমি সাধকদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামের শুভ্রতা, শুদ্ধতা, মানবতা ও প্রেমের প্রত্যুজ্জ্বল প্রকাশ। তারা ধর্মের মৌলসত্যটিকে সর্বজনীন ও বিশ্বসযোগ্য করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। লেখকের মতে বস্তুত সুফিসাধনা ইসলামের মৌলসত্তা ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের ধারক ও বাহক। কিন্তু এই ধারাটি বিভিন্ন কারণে বিকৃত হয়ে ইসলামের মূল কাঠামো থেকে দূরে চলে যাচ্ছে- যা কোনমতেই কাম্য নয়। এও তার মত যে, শরিয়তকে অস্বীকার করে সুফিবাদের বিকাশ ইতিহাসস্বীকৃত নয়। ইসলাম ধর্মের মহামানবগণের ব্যবস্থাপত্রও নয়। তবে যেকোনো তত্ত্বেরই একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ থাকা প্রয়োজন।

পরিতাপের বিষয় যে, তত্ত্ব নানা কারণে বিকৃত হয়। ধর্মের তত্ত্ব বিকৃত হয় আরো বেশি। কারণ এর সংশ্লিষ্টতা মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত বলে তা নিয়ে ফায়দা হাসিল করা সহজ, দুষ্টু ব্যবসার ফাঁদ পাতা সম্ভব। সারাবিশ্বেই সকল ধর্মের অপব্যবহার রয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রয়েয়ে তর্কের তুমুল ঘি। লেখক এখানে তর্কে অগ্নি ধরাতে প্রস্তুত হননি। বিতর্কের পক্ষে-বিপক্ষ্যে সমান তালিও দেননি। শরিয়ত ও সুফিবাদকে পাশাপাশি রেখে বুঝাতেও চাননি কার ¯্রােত বেশি, কার কম। লেখক নিষ্ঠার সাথে তার পাঠ, অনুসন্ধান ও আত্মানুসন্ধানের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সুফিসাধনার একটি তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ পরিক্রমা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কোথাও আত্মসৃষ্ট মত আরোপ করেননি বিধায় একে সুফিসাধনার পর্যাক্রম বা ইতিহাস ছাঁয়া বা চর্চার রূপরেখার গবেষণা শাস্ত্র বলা যায়।

অনুশীলনের পাঠ পরিক্রমা, সুফিসাধনার পর্যায়ক্রম, ইতিহাস ছাঁয়া যাই বলা হোক না কেন, বলাগুলো অন্যত্রও হয়তো পাওয়া যাবে বিচ্ছিন্নভাবে কিন্তু অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল খায়ের যেভাবে মগ্ন পর্যটক হয়ে সুফিতত্ত্বের আদি থেকে কালপর্যন্ত আত্মোপলুব্ধ বিচার বিশ্লেষন করে তত্ত্বটির ভূৎপত্তি, ব্যবহার ও বর্ণনা এক-চৌকাঠে এমন চমৎকৃতভাবে সন্নিবেশিত করেছেন যে, তা প্রশংসার। তিনি সাহিত্যগুণে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন, শব্দে সহজতা মেনেছেন, বাক্যে রেখেছেন মার্জিত রূপ। বলতে যেয়ে অতি উৎসাহে বা আবেগে বা মতাদর্শে লেখক সত্তা থেকে বের হয়ে যাননি। মোট দশটি অধ্যায়ে তিনি পরিবেশন করেছেন, ‘সুফিসাধনা ও প্রসঙ্গকথা, সুফিবাদের ক্রমবিকাশ, সুফিসাধনার স্বরূপ ও সুফির দৃষ্টিভঙ্গি, গুরুত্ব, সাধনাতত্ত্ব, ইসলামের ভিত্তিসমূহ, চর্চা ও উপলব্ধির নতুন দিগন্ত, সাধনার আরো গভীরে অবগাহন, বিলীনে মগ্ন, নবীন সাধুদের প্রতি-প্রসঙ্গ’।

মোহাম্মদ আবুল খায়ের তার ‘সুফিসাধনা: তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ’ এই বইটিতে সুফিসাধনার যে পর্যায়সমূহ তুলে ধরেছেন তা নবীন-প্রবীণ সকল সাধকদেরই তথা জ্ঞানপিপাসুদের জন্যই প্রয়োজন বলে মনে করি। যারা সাধনায় নিমগ্ন হবেন, তাদের জন্যও এই প্রমিত পাঠটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

সুফিসাধনা তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ

জোবায়ের মিলন

প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মেই একটি বাহ্যিক ধারার পাশাপাশি একটি অভ্যন্তরীণ ধারা রয়েছে। ইসলামি দর্শনে এই অভ্যন্তরীণ ধারাটির নাম সুফিবাদ। সুফিবাদকে আরবিতে ইলমে তাসাউফ বলে। এছাড়া ইলমে লাদুনি, এলমে বুশদা, ইলমে মুফিদ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। দিব্যজ্ঞান, দিব্যানুভূতি, আল্লাহতত্ত্ব এসব অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এটি একটি মরমি ধারা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই উপমহাদেশসহ আরো অনেক দেশেই ইসলাম প্রচার করেছেন সুফিসাধকগণ। অনেক মানুষ যে তাদের পূর্বপুরুষদের শত সহস্র বছরের ধর্মটিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করেন, তার মূলে ছিলো এই মরমি সাধকদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামের শুভ্রতা, শুদ্ধতা, মানবতা ও প্রেমের প্রত্যুজ্জ্বল প্রকাশ। তারা ধর্মের মৌলসত্যটিকে সর্বজনীন ও বিশ্বসযোগ্য করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। লেখকের মতে বস্তুত সুফিসাধনা ইসলামের মৌলসত্তা ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের ধারক ও বাহক। কিন্তু এই ধারাটি বিভিন্ন কারণে বিকৃত হয়ে ইসলামের মূল কাঠামো থেকে দূরে চলে যাচ্ছে- যা কোনমতেই কাম্য নয়। এও তার মত যে, শরিয়তকে অস্বীকার করে সুফিবাদের বিকাশ ইতিহাসস্বীকৃত নয়। ইসলাম ধর্মের মহামানবগণের ব্যবস্থাপত্রও নয়। তবে যেকোনো তত্ত্বেরই একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ থাকা প্রয়োজন।

পরিতাপের বিষয় যে, তত্ত্ব নানা কারণে বিকৃত হয়। ধর্মের তত্ত্ব বিকৃত হয় আরো বেশি। কারণ এর সংশ্লিষ্টতা মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত বলে তা নিয়ে ফায়দা হাসিল করা সহজ, দুষ্টু ব্যবসার ফাঁদ পাতা সম্ভব। সারাবিশ্বেই সকল ধর্মের অপব্যবহার রয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রয়েয়ে তর্কের তুমুল ঘি। লেখক এখানে তর্কে অগ্নি ধরাতে প্রস্তুত হননি। বিতর্কের পক্ষে-বিপক্ষ্যে সমান তালিও দেননি। শরিয়ত ও সুফিবাদকে পাশাপাশি রেখে বুঝাতেও চাননি কার ¯্রােত বেশি, কার কম। লেখক নিষ্ঠার সাথে তার পাঠ, অনুসন্ধান ও আত্মানুসন্ধানের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সুফিসাধনার একটি তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ পরিক্রমা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কোথাও আত্মসৃষ্ট মত আরোপ করেননি বিধায় একে সুফিসাধনার পর্যাক্রম বা ইতিহাস ছাঁয়া বা চর্চার রূপরেখার গবেষণা শাস্ত্র বলা যায়।

অনুশীলনের পাঠ পরিক্রমা, সুফিসাধনার পর্যায়ক্রম, ইতিহাস ছাঁয়া যাই বলা হোক না কেন, বলাগুলো অন্যত্রও হয়তো পাওয়া যাবে বিচ্ছিন্নভাবে কিন্তু অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল খায়ের যেভাবে মগ্ন পর্যটক হয়ে সুফিতত্ত্বের আদি থেকে কালপর্যন্ত আত্মোপলুব্ধ বিচার বিশ্লেষন করে তত্ত্বটির ভূৎপত্তি, ব্যবহার ও বর্ণনা এক-চৌকাঠে এমন চমৎকৃতভাবে সন্নিবেশিত করেছেন যে, তা প্রশংসার। তিনি সাহিত্যগুণে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন, শব্দে সহজতা মেনেছেন, বাক্যে রেখেছেন মার্জিত রূপ। বলতে যেয়ে অতি উৎসাহে বা আবেগে বা মতাদর্শে লেখক সত্তা থেকে বের হয়ে যাননি। মোট দশটি অধ্যায়ে তিনি পরিবেশন করেছেন, ‘সুফিসাধনা ও প্রসঙ্গকথা, সুফিবাদের ক্রমবিকাশ, সুফিসাধনার স্বরূপ ও সুফির দৃষ্টিভঙ্গি, গুরুত্ব, সাধনাতত্ত্ব, ইসলামের ভিত্তিসমূহ, চর্চা ও উপলব্ধির নতুন দিগন্ত, সাধনার আরো গভীরে অবগাহন, বিলীনে মগ্ন, নবীন সাধুদের প্রতি-প্রসঙ্গ’।

মোহাম্মদ আবুল খায়ের তার ‘সুফিসাধনা: তত্ত্ব ও অনুশীলনের প্রমিত পাঠ’ এই বইটিতে সুফিসাধনার যে পর্যায়সমূহ তুলে ধরেছেন তা নবীন-প্রবীণ সকল সাধকদেরই তথা জ্ঞানপিপাসুদের জন্যই প্রয়োজন বলে মনে করি। যারা সাধনায় নিমগ্ন হবেন, তাদের জন্যও এই প্রমিত পাঠটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস।