সারাদেশে ৩৫ দিনে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ৮টি

গত রোববার রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এ নিয়ে গত ৩৫ দিনে সারাদেশে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৮টি।

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের আগে ঘটে যাওয়া ৭টি অগ্নিকান্ড বা বিস্ফোরণের ঘটনাগুলোকেও দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিস্ফোরণের ঘটনার সঠিক কারণ এখনও জানা না গেলেও ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা, বিশেষজ্ঞরা তা তদন্ত করে দেখছেন। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।

তবে বারবার কেন এই দুর্ঘটনা এ নিয়ে নগরবিদরা বলছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্যুয়ারেজের কোন কিছুই ঠিক নেই বলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এজন্য সরকারের সঙ্গে বাড়ি মালিক, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এক জোট হয়ে কাজ করারও তাগিদ দেন।

পরপর ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণ বিষয়ে সংবাদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হলেও বাড়ি মালিক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ফায়ার ব্রিগেড যৌথভাবে পুরো শহরে ব্লক ধরে ধরে ছোট ছোট এলাকা ভাগ করে একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বা প্রোগ্রাম নিতে পারে। এরা সমন্বিতভাবে প্রতিটি বাড়ি পরিদর্শন করবে এবং কি ধরনের ঝুঁকি আছে তা চিহ্নিত করে সেগুলো সারিয়ে তুলবে।’

বিস্ফোরণের বিষয়ে তিনি বলেন ‘আগুন লাগা বা বিস্ফোরণ কোনটার সঙ্গে কোন সাদৃশ্য থাকুক বা না থাকুক যেখানে যে ঘটনা ঘটুক এর কারণ বিশ্লেষণ এখন জরুরি। সিদ্দিকবাজার এবং সায়েন্স ল্যাবের ঘটনা দুটির মধ্যে এক ধরনের সাদৃশ্য আছে। এর বেশ কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে এমন ঘটনা ঘটেছিল। এর সোর্স কী এবং কী কারণে ঘটেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সাধারণভাবে আলামত দেখে মনে হচ্ছে গ্যাসের লিকেজ। মিথেন এবং সালফার ডাই অক্সাইডের যে গ্যাস বের হয় সেটা কোথাও না কোথাও ট্রাপট হয়ে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

অধ্যাপক আকতার বলেন, ‘অবকাঠামোগতভাবে ত্রুটি আছে। আমাদের এই রাজধানীতে আমরা যেভাবে বিল্ডিং ব্যবহার করি এটা তে ঝামেলা আছে। প্রচুর আলো বাতাস আসে কিন্তু আমরা আর্টিফিসিয়াল এনভায়রনমেন্ট (কৃত্রিম পরিবেশ) তৈরি করি এসির বাতাসের জন্য। ফলে আমাদের লিকেজ বা দুর্বল অবকাঠামোর কারণে গ্যাসের লিকেজ হয় সেগুলোর ভেতরে গ্যাস আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। গ্যাস বের হতে না পারায় এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে’।

এ ধরনের বিস্ফোরণ থেকে নিরপাদ থাকার বিষয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘নগর সংস্কারে সরকারের অনেকগুলো জায়গা আছে। এর মধ্যে প্রথমত গ্যাসের লাইনের ম্যাপিং দরকার। গ্যাসের লাইন পুরনো হয়ে গেছে। এই ম্যাপিংয়ের সঙ্গে দরকার তদারকির। তবে শুধু সরকার না যারা ইউজার (ব্যবহারকারী) ভবনের মালিক তারাও বাড়িঘর সঠিকভাবে মেইনটেনেন্স (রক্ষণাবেক্ষণ) করে না। বিশেষ করে সিদ্দিকবাজার ও এর আশপাশের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা ভবন যেভাবে তৈরি করি এটা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করি না। প্ল্যান ভায়োলেশন (পরিকল্পনা লঙ্ঘন) আছে এবং সর্বোচ্চ লাভ পাওয়ার জন্য রাজউকের প্ল্যান ভায়োলেট করে বাড়ি বানায়। নিজেরাই নিজেদের দুর্ঘটনার মুখে ফেলি। সরকারের তো এত জনবল নাই যে প্রত্যেকটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদারকি করবে।’

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটা নিছক দুর্ঘটনা। তারপরেও তদন্ত চলছে। তদন্তের পর পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।’

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল সিদ্দিকবাজারের ভবনটি পরিদর্শন করে বলেছে, ভবনের ধ্বংসস্তূপ, আহত ও নিহত হওয়ার ধরন দেখে বোমা মনে হচ্ছে ভবনের বেজমেন্টের বদ্ধ কোন কক্ষে গ্যাস জমে সেটি ‘গ্যাস চেম্বারে’ পরিণত হয়েছিল। সেখানে যেকোন উপায়ে স্পার্ক বা আগুনের স্ফূলিঙ্গ হওয়ার পরই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে।

গত মঙ্গলবার আনুমানিক বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত বিস্ফোরণের মূল কারণ জানা যায়নি। আর কত তলা থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে তাও জানা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশের বেশ কয়েকটি ভবনও। এই ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন শতাধিক মানুষ। আহতদের মধ্যে রয়েছেন বাসযাত্রী, পথচারী, বেসরকারি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন।

এর আগে গত রোববার রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছে। বিস্ফোরণের এই ঘটনাটি দুর্ঘটনা ছিল বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, সম্ভবত দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ হয়েছে।

একই দিন অর্থাৎ ৫ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ধ্যা ৬টা ১৭ মিনিটের দিকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এই অগ্নিকান্ডে প্রায় পাঁচশ’ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। এদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। স্থানীয়দের দাবি এটি নিছক কোন দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা।

তার আগে ৪ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে স্টিল কারখানায় অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৬ জন মারা যায় এবং আহত হয় ৩০ জনের বেশি। দগ্ধ হয়েছেন আরও অনেকেই।

এরও আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় নান্নু স্পিনিং মিলে আগুন লাগে। খবর পেয়ে সেখানে যায় ফায়ার সার্ভিসের ১টি ইউনিট। পরে ধারাবাহিকভাবে সেখানে মোট ৯টি ইউনিট কাজ করে। অন্যদিকে একই সময় আড়াইহাজারের এসপি কেমিক্যালে আগুনের খবর আসে দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে। সেখানে অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে ১১টি ইউনিট।

ওই দিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী থানার দেউলিয়াবাড়ি এলাকায় ঝুট গুদামে আগুনের ঘটনা ঘটে।

এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে বিকেল ৫টা ৩৩ মিনিটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা প্রায় এক ঘণ্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। যদিও কোন হতাহতের ঘটনা জানা যায়নি।

তার আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে একটি ১২ তলা আবাসিক ভবনে আগুন লাগে। এ ঘটনায় একজনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে ধারাবাহিকভাবে।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে এসব ঘটনা কি শুধুই নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এগুলোকে দুর্ঘটনা বলে বলা হয়েছে। কিন্তু একের পর এক এ ধরনের ধারাবাহিক অগ্নিকান্ডের সব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ সচেতন মহলের একটি বড় অংশ। তারা বলছেন, সব অগ্নিকান্ড হয়তো নাশকতা নয় এটা ঠিক আবার সব অগ্নিকান্ডের ঘটনাকেও দুর্ঘটনা বলা যাবে না। তবে এসব অগ্নিকান্ড নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা সময়ই বলে দেবে। আর এজন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

সারাদেশে ৩৫ দিনে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ৮টি

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

গত রোববার রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এ নিয়ে গত ৩৫ দিনে সারাদেশে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৮টি।

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের আগে ঘটে যাওয়া ৭টি অগ্নিকান্ড বা বিস্ফোরণের ঘটনাগুলোকেও দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিস্ফোরণের ঘটনার সঠিক কারণ এখনও জানা না গেলেও ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা, বিশেষজ্ঞরা তা তদন্ত করে দেখছেন। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।

তবে বারবার কেন এই দুর্ঘটনা এ নিয়ে নগরবিদরা বলছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্যুয়ারেজের কোন কিছুই ঠিক নেই বলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এজন্য সরকারের সঙ্গে বাড়ি মালিক, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এক জোট হয়ে কাজ করারও তাগিদ দেন।

পরপর ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণ বিষয়ে সংবাদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হলেও বাড়ি মালিক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ফায়ার ব্রিগেড যৌথভাবে পুরো শহরে ব্লক ধরে ধরে ছোট ছোট এলাকা ভাগ করে একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বা প্রোগ্রাম নিতে পারে। এরা সমন্বিতভাবে প্রতিটি বাড়ি পরিদর্শন করবে এবং কি ধরনের ঝুঁকি আছে তা চিহ্নিত করে সেগুলো সারিয়ে তুলবে।’

বিস্ফোরণের বিষয়ে তিনি বলেন ‘আগুন লাগা বা বিস্ফোরণ কোনটার সঙ্গে কোন সাদৃশ্য থাকুক বা না থাকুক যেখানে যে ঘটনা ঘটুক এর কারণ বিশ্লেষণ এখন জরুরি। সিদ্দিকবাজার এবং সায়েন্স ল্যাবের ঘটনা দুটির মধ্যে এক ধরনের সাদৃশ্য আছে। এর বেশ কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে এমন ঘটনা ঘটেছিল। এর সোর্স কী এবং কী কারণে ঘটেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সাধারণভাবে আলামত দেখে মনে হচ্ছে গ্যাসের লিকেজ। মিথেন এবং সালফার ডাই অক্সাইডের যে গ্যাস বের হয় সেটা কোথাও না কোথাও ট্রাপট হয়ে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

অধ্যাপক আকতার বলেন, ‘অবকাঠামোগতভাবে ত্রুটি আছে। আমাদের এই রাজধানীতে আমরা যেভাবে বিল্ডিং ব্যবহার করি এটা তে ঝামেলা আছে। প্রচুর আলো বাতাস আসে কিন্তু আমরা আর্টিফিসিয়াল এনভায়রনমেন্ট (কৃত্রিম পরিবেশ) তৈরি করি এসির বাতাসের জন্য। ফলে আমাদের লিকেজ বা দুর্বল অবকাঠামোর কারণে গ্যাসের লিকেজ হয় সেগুলোর ভেতরে গ্যাস আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। গ্যাস বের হতে না পারায় এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে’।

এ ধরনের বিস্ফোরণ থেকে নিরপাদ থাকার বিষয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘নগর সংস্কারে সরকারের অনেকগুলো জায়গা আছে। এর মধ্যে প্রথমত গ্যাসের লাইনের ম্যাপিং দরকার। গ্যাসের লাইন পুরনো হয়ে গেছে। এই ম্যাপিংয়ের সঙ্গে দরকার তদারকির। তবে শুধু সরকার না যারা ইউজার (ব্যবহারকারী) ভবনের মালিক তারাও বাড়িঘর সঠিকভাবে মেইনটেনেন্স (রক্ষণাবেক্ষণ) করে না। বিশেষ করে সিদ্দিকবাজার ও এর আশপাশের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা ভবন যেভাবে তৈরি করি এটা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করি না। প্ল্যান ভায়োলেশন (পরিকল্পনা লঙ্ঘন) আছে এবং সর্বোচ্চ লাভ পাওয়ার জন্য রাজউকের প্ল্যান ভায়োলেট করে বাড়ি বানায়। নিজেরাই নিজেদের দুর্ঘটনার মুখে ফেলি। সরকারের তো এত জনবল নাই যে প্রত্যেকটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদারকি করবে।’

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটা নিছক দুর্ঘটনা। তারপরেও তদন্ত চলছে। তদন্তের পর পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।’

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল সিদ্দিকবাজারের ভবনটি পরিদর্শন করে বলেছে, ভবনের ধ্বংসস্তূপ, আহত ও নিহত হওয়ার ধরন দেখে বোমা মনে হচ্ছে ভবনের বেজমেন্টের বদ্ধ কোন কক্ষে গ্যাস জমে সেটি ‘গ্যাস চেম্বারে’ পরিণত হয়েছিল। সেখানে যেকোন উপায়ে স্পার্ক বা আগুনের স্ফূলিঙ্গ হওয়ার পরই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে।

গত মঙ্গলবার আনুমানিক বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত বিস্ফোরণের মূল কারণ জানা যায়নি। আর কত তলা থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে তাও জানা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশের বেশ কয়েকটি ভবনও। এই ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন শতাধিক মানুষ। আহতদের মধ্যে রয়েছেন বাসযাত্রী, পথচারী, বেসরকারি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন।

এর আগে গত রোববার রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছে। বিস্ফোরণের এই ঘটনাটি দুর্ঘটনা ছিল বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, সম্ভবত দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ হয়েছে।

একই দিন অর্থাৎ ৫ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ধ্যা ৬টা ১৭ মিনিটের দিকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এই অগ্নিকান্ডে প্রায় পাঁচশ’ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। এদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। স্থানীয়দের দাবি এটি নিছক কোন দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা।

তার আগে ৪ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে স্টিল কারখানায় অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৬ জন মারা যায় এবং আহত হয় ৩০ জনের বেশি। দগ্ধ হয়েছেন আরও অনেকেই।

এরও আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় নান্নু স্পিনিং মিলে আগুন লাগে। খবর পেয়ে সেখানে যায় ফায়ার সার্ভিসের ১টি ইউনিট। পরে ধারাবাহিকভাবে সেখানে মোট ৯টি ইউনিট কাজ করে। অন্যদিকে একই সময় আড়াইহাজারের এসপি কেমিক্যালে আগুনের খবর আসে দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে। সেখানে অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে ১১টি ইউনিট।

ওই দিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী থানার দেউলিয়াবাড়ি এলাকায় ঝুট গুদামে আগুনের ঘটনা ঘটে।

এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে বিকেল ৫টা ৩৩ মিনিটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা প্রায় এক ঘণ্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। যদিও কোন হতাহতের ঘটনা জানা যায়নি।

তার আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে একটি ১২ তলা আবাসিক ভবনে আগুন লাগে। এ ঘটনায় একজনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে ধারাবাহিকভাবে।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে এসব ঘটনা কি শুধুই নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এগুলোকে দুর্ঘটনা বলে বলা হয়েছে। কিন্তু একের পর এক এ ধরনের ধারাবাহিক অগ্নিকান্ডের সব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ সচেতন মহলের একটি বড় অংশ। তারা বলছেন, সব অগ্নিকান্ড হয়তো নাশকতা নয় এটা ঠিক আবার সব অগ্নিকান্ডের ঘটনাকেও দুর্ঘটনা বলা যাবে না। তবে এসব অগ্নিকান্ড নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা সময়ই বলে দেবে। আর এজন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।