নিহতের স্বজনদের আহাজারি

রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ১৯ জনের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের করিডোর। স্বজনদের খোঁজে অনেকে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। একবার জরুরি বিভাগ, আরেকবার মর্গে। আবার কেউ অপেক্ষা করছেন অ্যাম্বুলেন্স আসার। গত মঙ্গলবার বিকেলে বিস্ফোরণের পর থেকে সেখানে থাকা ব্যবসায়ী, কর্মচারীদের পরিবারের লোকজন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন। কারো তাৎক্ষণিক খোঁজ মিলেছে। কারো এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এখনও খোঁজ মেলেনি। আর কারো খোঁজ মিললেও সাক্ষাতের সুযোগ হবে না কখনো। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢামেকে দেখা গেছে এ দৃশ্য।

দ্বিতীয় দিন ঢামেকের টিকেট কাউন্টার থেকে মো. সুমন বলেন, সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত ১৭২ জন টিকেট নিয়ে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে ২০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন ১০ জন।

ঢামেক সূত্রে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে কাতার থেকে বিয়ে করতে দেশে এসেছিলেন সুমন (২১)। তার মা শবেবরাতের রোজা রেখেছিলেন। মায়ের জন্য ইফতার কিনতে এসেছিলেন সিদ্দিক বাজারে। গলিতে ইফতার কেনার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে আহত হন সুমন। তাকে তাৎক্ষণিক ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যার পর মারা যান তিনি। মর্গে রাখা অনেকগুলো লাশের মধ্যে শুধু তার বুকের উপর লেখা ছিল নাম ও বয়স। মাথা থেঁতলে যাওয়া এ যুবকের পায়ে একজোড়া বেল্টের জুতা তখনও নতুন রয়েছে। জুতার বেল্ট তখনও খুলেনি।

হাসপাতালে একের পর এক তার স্বজনরা আসছেন। তার বন্ধুরা এসে ?‘বন্ধু...’ বলে চিৎকার করছেন। চলে স্বজনদের আহাজারি। বোন এসেছিলেন মর্গে। ভাইয়ের মরদেহ দেখেই মূর্ছা যান তিনি। এসেছিলেন মা। শোকে পাথর মায়ের মুখ থেকে বেরোইনি কোন কথা। মানিকগঞ্জ বাড়ি বাবুল হোসেনের। তিনি গুলিস্তানে দুর্ঘটনাস্থলে তার বন্ধু বাশার মিয়ার দোকানে এসেছিলেন। বাশার মিয়া তার বন্ধুকে দোকানে রেখে বাইরে গিয়েছিলেন। বাইরে থেকে আসার আগেই বিস্ফোরণে নিখোঁজ হন বাবুল। সাড়ে আটটার দিকে ঢামেকের মর্গে তার মরদেহ শনাক্ত করেন শ্যালিকা নুরুন্নাহার বেগম। নুরুন্নাহার বেগম হাত দিয়ে দেখান। বাশার মিয়া কাছে গিয়ে তার বন্ধুকে দেখতে পান। এ সময় দুইজনই কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্যানিটারির দোকান ছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ইসমাইলের। তার খোঁজে দোয়া ও মোনাজাত করেন তার ভাতিজা জোবায়ের। সন্ধান মেলেনি ইসমাইলের। সন্ধ্যার দিকে মর্গে ইসমাইলের মরদেহ পান বড় ভাই মো. হানিফ। হানিফকে দেখা যায় নির্বাক ঘুরতে। চোখ দিয়ে ঝরছিল পানি। বিস্ফোরণ হওয়া মার্কেটের দোকানি মমিন উদ্দিন সুমনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু মৃত্যুর এ খবর এখনও মানেনি তার পরিবার। সুমন জীবিত বলে আশা পরিবারের লোকজনের। তাদের দাবি মরদেহটি সুমনের নয়, দোকান কর্মচারী সম্রাটের। এভাবেই ঢামেক এলাকায় অপেক্ষা করছেন শত শত মানুষ। রাত যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে তাদের শঙ্কা আর আহাজারি।

এদিকে গত মঙ্গলবার বিকেলে ব্যবসার কাজে আল-আমিনকে সঙ্গে নিয়ে মানসুর সিদ্দিক বাজারে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তারা দুজনই ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। রাত ১০টার দিকে উদ্ধারকর্মীরা বিস্ফোরণস্থলের ধ্বংসস্তূপ থেকে তাদের দুইজনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে রাখেন। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। সকালে আল-আমিন ও মানসুরের লাশ তারা গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় নিয়ে যান।

পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিস্ফোরণে মারা যাওয়া মানসুর মিয়ার বাড়ি মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মোশারফ হোসেন মিয়াজীর ছেলে। মানসুর ঢাকার ফুলবাড়িয়া মার্কেটে মশারি ও লেপ-তোশকের ব্যবসা করতেন। ‘হাবিব বেডিং স্টোর’ নামে সেখানে তার একটি দোকান আছে। চার ভাইয়ের মধ্যে মানসুর মেজ। এদিকে আল-আমিনের বাড়ি উপজেলার পশ্চিম লালপুর এলাকায়। ওই এলাকার মো. বিল্লাল হোসেন ব্যাপারীর বড় ছেলে তিনি। আল-আমিন ঢাকার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। মানসুর ও আল-আমিন সম্পর্কে আপন খালাতো ভাই। তারা দুইজনই ঢাকায় থাকতেন।

আল-আমিনের বাবা মো. বিল্লাল হোসেন ব্যাপারী বলেন, ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন ও আশা মাটি হয়ে গেল। উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে বাড়িতে ফিরল লাশ হয়ে। এ কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানসুর মিয়ার বাবা মোশারফ হোসেন মিয়াজী বলেন, তার ছেলের আয়েই পরিবারের খরচ চলত। এখন সব শেষ। ছেলেকে হারিয়ে তিনি পাগলপ্রায়। ছেলে হারানোর এই কষ্ট ও শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন তা শুধু আল্লাহ জানেন।

বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের দুইজন রয়েছেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন জেলার আরও একজন। নিহতরা হলেন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের বালুয়াকান্দি (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মোজাম্মেল হক খোকার ছেলে আবু জাফর সিদ্দিক তারেক (৩৩) ও মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের সৈয়দপুর এলাকার মৃত সমির আখন্দের ছেলে মহিউদ্দিন আখন্দ (৫০)।

তাদের মধ্যে আবু জাফর সিদ্দিক তারেক নির্মাণাধীন নিজ বাড়ির জন্য স্যানেটারি পণ্য কিনতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। পরে ক্যাফে কুইন রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এ সময় বিস্ফোরণে তার মৃত্যু হয়। তার সঙ্গে যাওয়া খালাতো ভাই আলাদ হোসেনের (২৫) শরীরের ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে রয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহত তারেকের স্বজন আমিরুল ইসলাম জানান, পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারেক ঢাকা বসবাস করতেন। বিয়ে করার জন্য কিছুদিন যাবত পাত্রী দেখছিলেন। মূলত বিয়ের জন্যই নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ করতে বাবার পৈতৃক বাড়ি গজারিয়ায় এসেছিলেন। বিস্ফোরণের দিন ঢাকায় গিয়েছিলেন স্যানেটারি মালামাল কিনতে। আকস্মিক বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তিনি আরও বলেন, গতকাল সকাল ৮টার দিকে বালুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তারেকের জানাজা শেষে কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়। তারেক খুব ভালো ছেলে হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিল। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

নিহত অন্যজন মহিউদ্দিন আখন্দ ক্যাফে কুইন মার্কেটের একটি স্যানেটারি দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। গত দুই বছর যাবত ওই মার্কেটের আজাদ স্যানেটারি দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। এর আগে আলুবাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তার। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় দোকান ছেড়ে দেন। নিহত মহিউদ্দিনের ভাতিজি পারভিন বেগম বলেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি (মহিউদ্দিন) দোকানেই বসা ছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন তিনি। তার মৃত্যুর খবরে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন তার স্ত্রী। কিছুক্ষণ পরপর তার দাঁত লেগে যাচ্ছে। যখন হুঁশ ফেরে তখনই বলছেন ‘গতকালকে আমাকে বলেছিল সে বাসায় আসবে, শবেবরাতের নামাজ পড়বে। আর বিকেল বেলা জানতে পারলাম সেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে। আমার স্বামী তো এলো তবে লাশ হয়ে এলো। এখন আমি আমার দুইটা সন্তান নিয়ে কোথায় যাব? কী করব? তিনি জানান, গতকাল সকালে আধারার সৈয়দপুর আল আমিন দাখিল মাদ্রাসার মাঠে জানাজা শেষে এলাকার একটি সামাজিক কবরস্থানে মহিউদ্দিন আখন্দের মরদেহ দাফন করা হয়েছে।

বিস্ফোরণের ঘটনায় সর্বশেষ মারা যান মুহাম্মদ সিয়াম (১৮)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই তরুণ। দিনমজুর বাবা মো. দুলাল মিয়ার ছেলে সিয়াম পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের হাল ধরার জন্য সিদ্দিক বাজারের একটি স্যানেটারি দোকানে চাকরি করতেন। সিয়াম যে স্যানেটারি দোকানে কাজ করতেন, সেটি বিস্ফোরণের শিকার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় ছিল।

বাল্যবন্ধুর বিদায় বেলায় ঢামেকের জরুরি বিভাগে এসেছেন সিয়ামের ছয়জন বন্ধু। গতকাল হাসপাতালে তীব্র আর্তনাদ আর হাহাকারের মধ্যেই আলাদা করে চোখে পড়ে ছয় তরুণের একটি দলকে। তারা সবাই সিয়ামের বন্ধু। তাদের আহাজারিতে হাসপাতালে উপস্থিত সবার চোখ ভারি হয়ে ওঠে। ছয় বন্ধুর মধ্যে রাতুল নামে একজন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার নিজের কোন ভাইবোন নেই। সাতটা বন্ধু ছিলাম আমরা। এখন আল্লাহ আমাদের একজনকে কেড়ে নিলেন। রাতুল, ইয়াসিন, ইব্রাহিম, আকাশ, সাকিব ও জুবায়ের এই ছয় বন্ধু ছিল সিয়ামের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। গত মঙ্গলবার দ্রুত কাজ সেরে সাত বন্ধু মিলে একসঙ্গে শবেবরাতের নামাজ আদায় করবে এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু বিস্ফোরণের পর থেকে সিয়ামকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গতকাল সকালে হাসপাতালের মর্গে সিয়ামের প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় গুরুতর আহতদের ২৫ হাজার টাকা এবং আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের ১৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তবে তা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হবে।

এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ঘটনা জানার পর ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের লোক ঘটনাস্থলে গেছে। আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে আমাদের কন্ট্রোল সেন্টার খুলেছি। গত মঙ্গলবার ১৭ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং ঢাকা জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। আহতদের যাচাই-বাচাই করে তাদেরও ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

নিহতের স্বজনদের আহাজারি

মাসুদ রানা

image

স্বজনরা মোবাইলে ছবি নিয়ে খুঁজছে নিখোঁজদের -সংবাদ

রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ১৯ জনের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের করিডোর। স্বজনদের খোঁজে অনেকে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। একবার জরুরি বিভাগ, আরেকবার মর্গে। আবার কেউ অপেক্ষা করছেন অ্যাম্বুলেন্স আসার। গত মঙ্গলবার বিকেলে বিস্ফোরণের পর থেকে সেখানে থাকা ব্যবসায়ী, কর্মচারীদের পরিবারের লোকজন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন। কারো তাৎক্ষণিক খোঁজ মিলেছে। কারো এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এখনও খোঁজ মেলেনি। আর কারো খোঁজ মিললেও সাক্ষাতের সুযোগ হবে না কখনো। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢামেকে দেখা গেছে এ দৃশ্য।

দ্বিতীয় দিন ঢামেকের টিকেট কাউন্টার থেকে মো. সুমন বলেন, সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত ১৭২ জন টিকেট নিয়ে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে ২০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন ১০ জন।

ঢামেক সূত্রে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে কাতার থেকে বিয়ে করতে দেশে এসেছিলেন সুমন (২১)। তার মা শবেবরাতের রোজা রেখেছিলেন। মায়ের জন্য ইফতার কিনতে এসেছিলেন সিদ্দিক বাজারে। গলিতে ইফতার কেনার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে আহত হন সুমন। তাকে তাৎক্ষণিক ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যার পর মারা যান তিনি। মর্গে রাখা অনেকগুলো লাশের মধ্যে শুধু তার বুকের উপর লেখা ছিল নাম ও বয়স। মাথা থেঁতলে যাওয়া এ যুবকের পায়ে একজোড়া বেল্টের জুতা তখনও নতুন রয়েছে। জুতার বেল্ট তখনও খুলেনি।

হাসপাতালে একের পর এক তার স্বজনরা আসছেন। তার বন্ধুরা এসে ?‘বন্ধু...’ বলে চিৎকার করছেন। চলে স্বজনদের আহাজারি। বোন এসেছিলেন মর্গে। ভাইয়ের মরদেহ দেখেই মূর্ছা যান তিনি। এসেছিলেন মা। শোকে পাথর মায়ের মুখ থেকে বেরোইনি কোন কথা। মানিকগঞ্জ বাড়ি বাবুল হোসেনের। তিনি গুলিস্তানে দুর্ঘটনাস্থলে তার বন্ধু বাশার মিয়ার দোকানে এসেছিলেন। বাশার মিয়া তার বন্ধুকে দোকানে রেখে বাইরে গিয়েছিলেন। বাইরে থেকে আসার আগেই বিস্ফোরণে নিখোঁজ হন বাবুল। সাড়ে আটটার দিকে ঢামেকের মর্গে তার মরদেহ শনাক্ত করেন শ্যালিকা নুরুন্নাহার বেগম। নুরুন্নাহার বেগম হাত দিয়ে দেখান। বাশার মিয়া কাছে গিয়ে তার বন্ধুকে দেখতে পান। এ সময় দুইজনই কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্যানিটারির দোকান ছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ইসমাইলের। তার খোঁজে দোয়া ও মোনাজাত করেন তার ভাতিজা জোবায়ের। সন্ধান মেলেনি ইসমাইলের। সন্ধ্যার দিকে মর্গে ইসমাইলের মরদেহ পান বড় ভাই মো. হানিফ। হানিফকে দেখা যায় নির্বাক ঘুরতে। চোখ দিয়ে ঝরছিল পানি। বিস্ফোরণ হওয়া মার্কেটের দোকানি মমিন উদ্দিন সুমনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু মৃত্যুর এ খবর এখনও মানেনি তার পরিবার। সুমন জীবিত বলে আশা পরিবারের লোকজনের। তাদের দাবি মরদেহটি সুমনের নয়, দোকান কর্মচারী সম্রাটের। এভাবেই ঢামেক এলাকায় অপেক্ষা করছেন শত শত মানুষ। রাত যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে তাদের শঙ্কা আর আহাজারি।

এদিকে গত মঙ্গলবার বিকেলে ব্যবসার কাজে আল-আমিনকে সঙ্গে নিয়ে মানসুর সিদ্দিক বাজারে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তারা দুজনই ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। রাত ১০টার দিকে উদ্ধারকর্মীরা বিস্ফোরণস্থলের ধ্বংসস্তূপ থেকে তাদের দুইজনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে রাখেন। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। সকালে আল-আমিন ও মানসুরের লাশ তারা গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় নিয়ে যান।

পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিস্ফোরণে মারা যাওয়া মানসুর মিয়ার বাড়ি মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মোশারফ হোসেন মিয়াজীর ছেলে। মানসুর ঢাকার ফুলবাড়িয়া মার্কেটে মশারি ও লেপ-তোশকের ব্যবসা করতেন। ‘হাবিব বেডিং স্টোর’ নামে সেখানে তার একটি দোকান আছে। চার ভাইয়ের মধ্যে মানসুর মেজ। এদিকে আল-আমিনের বাড়ি উপজেলার পশ্চিম লালপুর এলাকায়। ওই এলাকার মো. বিল্লাল হোসেন ব্যাপারীর বড় ছেলে তিনি। আল-আমিন ঢাকার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। মানসুর ও আল-আমিন সম্পর্কে আপন খালাতো ভাই। তারা দুইজনই ঢাকায় থাকতেন।

আল-আমিনের বাবা মো. বিল্লাল হোসেন ব্যাপারী বলেন, ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন ও আশা মাটি হয়ে গেল। উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে বাড়িতে ফিরল লাশ হয়ে। এ কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানসুর মিয়ার বাবা মোশারফ হোসেন মিয়াজী বলেন, তার ছেলের আয়েই পরিবারের খরচ চলত। এখন সব শেষ। ছেলেকে হারিয়ে তিনি পাগলপ্রায়। ছেলে হারানোর এই কষ্ট ও শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন তা শুধু আল্লাহ জানেন।

বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের দুইজন রয়েছেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন জেলার আরও একজন। নিহতরা হলেন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের বালুয়াকান্দি (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মোজাম্মেল হক খোকার ছেলে আবু জাফর সিদ্দিক তারেক (৩৩) ও মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের সৈয়দপুর এলাকার মৃত সমির আখন্দের ছেলে মহিউদ্দিন আখন্দ (৫০)।

তাদের মধ্যে আবু জাফর সিদ্দিক তারেক নির্মাণাধীন নিজ বাড়ির জন্য স্যানেটারি পণ্য কিনতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। পরে ক্যাফে কুইন রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এ সময় বিস্ফোরণে তার মৃত্যু হয়। তার সঙ্গে যাওয়া খালাতো ভাই আলাদ হোসেনের (২৫) শরীরের ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে রয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহত তারেকের স্বজন আমিরুল ইসলাম জানান, পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারেক ঢাকা বসবাস করতেন। বিয়ে করার জন্য কিছুদিন যাবত পাত্রী দেখছিলেন। মূলত বিয়ের জন্যই নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ করতে বাবার পৈতৃক বাড়ি গজারিয়ায় এসেছিলেন। বিস্ফোরণের দিন ঢাকায় গিয়েছিলেন স্যানেটারি মালামাল কিনতে। আকস্মিক বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তিনি আরও বলেন, গতকাল সকাল ৮টার দিকে বালুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তারেকের জানাজা শেষে কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়। তারেক খুব ভালো ছেলে হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিল। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

নিহত অন্যজন মহিউদ্দিন আখন্দ ক্যাফে কুইন মার্কেটের একটি স্যানেটারি দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। গত দুই বছর যাবত ওই মার্কেটের আজাদ স্যানেটারি দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। এর আগে আলুবাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তার। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় দোকান ছেড়ে দেন। নিহত মহিউদ্দিনের ভাতিজি পারভিন বেগম বলেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি (মহিউদ্দিন) দোকানেই বসা ছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন তিনি। তার মৃত্যুর খবরে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন তার স্ত্রী। কিছুক্ষণ পরপর তার দাঁত লেগে যাচ্ছে। যখন হুঁশ ফেরে তখনই বলছেন ‘গতকালকে আমাকে বলেছিল সে বাসায় আসবে, শবেবরাতের নামাজ পড়বে। আর বিকেল বেলা জানতে পারলাম সেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে। আমার স্বামী তো এলো তবে লাশ হয়ে এলো। এখন আমি আমার দুইটা সন্তান নিয়ে কোথায় যাব? কী করব? তিনি জানান, গতকাল সকালে আধারার সৈয়দপুর আল আমিন দাখিল মাদ্রাসার মাঠে জানাজা শেষে এলাকার একটি সামাজিক কবরস্থানে মহিউদ্দিন আখন্দের মরদেহ দাফন করা হয়েছে।

বিস্ফোরণের ঘটনায় সর্বশেষ মারা যান মুহাম্মদ সিয়াম (১৮)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই তরুণ। দিনমজুর বাবা মো. দুলাল মিয়ার ছেলে সিয়াম পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের হাল ধরার জন্য সিদ্দিক বাজারের একটি স্যানেটারি দোকানে চাকরি করতেন। সিয়াম যে স্যানেটারি দোকানে কাজ করতেন, সেটি বিস্ফোরণের শিকার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় ছিল।

বাল্যবন্ধুর বিদায় বেলায় ঢামেকের জরুরি বিভাগে এসেছেন সিয়ামের ছয়জন বন্ধু। গতকাল হাসপাতালে তীব্র আর্তনাদ আর হাহাকারের মধ্যেই আলাদা করে চোখে পড়ে ছয় তরুণের একটি দলকে। তারা সবাই সিয়ামের বন্ধু। তাদের আহাজারিতে হাসপাতালে উপস্থিত সবার চোখ ভারি হয়ে ওঠে। ছয় বন্ধুর মধ্যে রাতুল নামে একজন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার নিজের কোন ভাইবোন নেই। সাতটা বন্ধু ছিলাম আমরা। এখন আল্লাহ আমাদের একজনকে কেড়ে নিলেন। রাতুল, ইয়াসিন, ইব্রাহিম, আকাশ, সাকিব ও জুবায়ের এই ছয় বন্ধু ছিল সিয়ামের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। গত মঙ্গলবার দ্রুত কাজ সেরে সাত বন্ধু মিলে একসঙ্গে শবেবরাতের নামাজ আদায় করবে এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু বিস্ফোরণের পর থেকে সিয়ামকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গতকাল সকালে হাসপাতালের মর্গে সিয়ামের প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় গুরুতর আহতদের ২৫ হাজার টাকা এবং আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের ১৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তবে তা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হবে।

এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ঘটনা জানার পর ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের লোক ঘটনাস্থলে গেছে। আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে আমাদের কন্ট্রোল সেন্টার খুলেছি। গত মঙ্গলবার ১৭ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং ঢাকা জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। আহতদের যাচাই-বাচাই করে তাদেরও ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।