বারবার রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন, নানা দিকে সন্দেহ

রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ পুড়ছে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি। অনেক সময় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের প্রাণহানি নজিরও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রিত শিবিরে গত পাঁচ বছরে ৩০০ শতাধিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে হাজার হাজার ঘর পুড়েছে, নিঃস্ব হয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। ঘুরে ফিরে কেন ক্যাম্পেগুলোতে আগুন লাগছে, এর কারণ কী এমন প্রশ্ন সর্বমহলে।

সর্বশেষ গত রবিবার বিকেলে উখিয়া বালুখালীতে তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে প্রায় দুই হাজার ঘরবাড়ি এবং দোকাপাট সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্পে আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসব বাড়িঘর পুড়ে যায়।

অগ্নিকান্ডে কোন হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ছাড়াও দাতা সংস্থার কিছু অফিস এবং কয়েকশ’ দোকানপাট আগুনে পুড়ে গেছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে ছয়শ’ ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। এর দুই মাস পরে মার্চ মাসে এই বালুখালী ক্যাম্পেই আরেকটি অগ্নিকান্ডে ১০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। তখন ১৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।

তথ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আশ্রয় শিবিরে ২২২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি। সংসদীয় কমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকান্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এর বেশ কয়েকবার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয়েছে। এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আরেক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ক্যাম্পে বারবার অগ্নিকান্ডের পেছনে মিয়ানমারের বিচ্ছিনতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নাশকতামূলক তৎপরতা থাকতে পারে। ফলে সেটি খতিয়ে দেখা খুবই দরকার।

রোহিঙ্গা নেতারা আরও বলছেন, প্রতি বছর শিবিরগুলোতে ৫০ থেকে ৬০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলেও মাইকিং আর মহড়া ছাড়া সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে না। শিবিরে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না।

এ বিষয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা রফিক বলেন, ক্যাম্পের বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে। কিছু দিন যেতে না যেতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কেন ঘটে? তিনি বলেন, আগের আগুনের ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এতদিন ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্প্রতি ক্যাম্পে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো সশস্ত্র সংগঠন আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা। ফলে ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এর জের ধরে একপক্ষ অন্যপক্ষকে ফাঁসাতে শিবিরে আগুন দিতে পারে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা বলেছেন, এই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

তিনি বলেন, সেখানে আরাকান স্যালভেশন আর্মি আরসা, আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন আরএসও, আল-ইয়াকিনসহ রোহিঙ্গাদের বিশটির বেশি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে এর আগে সংঘর্ষ হয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে তাদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮টি, ২০১৯ সালে ১০, ২০২১ সালে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে ২২২টি ছিল। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর গত তিন মাসে ছোট-বড় ১৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

গত রোববার অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ২ হাজার পরিবারের ১২ হাজার মানুষের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে। আগুন লাগার পেছনে নাশকতার অভিযোগে সন্দেহজনক স্থানীয় ১৭ বছরের এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আমির জাফর বলেন, আগুন লাগার কারণে জানতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আর অগ্নিকান্ডের ঘটনার পেছনে অন্য কারণ আছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, আগের তুলনায় ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কমেছে। তাছাড়া আগুন লাগার সঠিক কারণ জানাও কঠিন। তিনি বলেন, ‘মূলত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে ঝুপড়ি ঘর আছে। তাই আগুন লাগলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। বেশিরভাগ ক্যাম্পে প্রশস্ত রাস্তা না থাকায় ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার পানির সংকটও বেশি হওয়ার ফলে আগুন লাগলে শিবিরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়।

এদিকে গত শুক্রবার রোহিঙ্গা ভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে এক আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাত পরিচয় ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করেন। যারা আরসাকে দমনে জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন তিনি। অডিও বার্তায় বলা হয়, ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়। বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলো।

অডিও বার্তার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান অগ্নিকান্ড নাশকতা কি-না তা জানতে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্রে করে যাতে কেউ ক্যাম্পে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য পুলিশ সর্তক অবস্থানে রয়েছে।

রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকান্ডের পেছনে কোন চক্রের হাত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ বের করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে সব সময়ই এখানকার মানুষের মাঝে আগুন লাগার ভীতি থাকবে। তাই এ ধরনের ঘটনা রোধে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এর আগে রোহিঙ্গারা ব্লকে ব্লকে পাহারা বসিয়েছিল।’

এ নিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনা নাশকতা কি-না, তা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সন্দেহভাজন একজনকে আটক করা হয়েছে। এই অগ্নিকান্ড পরিকল্পিত কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

এর আগে ২০২১ সালে ২২ মার্চ একই ক্যাম্পসহ পাশ্ববর্তী তিনটি ক্যাম্পে বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় আগুনে ১০ হাজারেরও বেশি বসতঘর পুড়ে যায়। অগ্নিকান্ডে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছিল। এছাড়া দগ্ধ হয়ে দুই শিশুসহ ১৫ জন রোহিঙ্গা মারা যায়। ওই ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।

বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ ২০২৩ , ২৪ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৬ শবান ১৪৪৪

বারবার রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন, নানা দিকে সন্দেহ

জেলা বার্তা পরিবেশক, কক্সবাজার

image

রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ পুড়ছে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি। অনেক সময় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের প্রাণহানি নজিরও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রিত শিবিরে গত পাঁচ বছরে ৩০০ শতাধিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে হাজার হাজার ঘর পুড়েছে, নিঃস্ব হয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। ঘুরে ফিরে কেন ক্যাম্পেগুলোতে আগুন লাগছে, এর কারণ কী এমন প্রশ্ন সর্বমহলে।

সর্বশেষ গত রবিবার বিকেলে উখিয়া বালুখালীতে তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে প্রায় দুই হাজার ঘরবাড়ি এবং দোকাপাট সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্পে আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসব বাড়িঘর পুড়ে যায়।

অগ্নিকান্ডে কোন হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ছাড়াও দাতা সংস্থার কিছু অফিস এবং কয়েকশ’ দোকানপাট আগুনে পুড়ে গেছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে ছয়শ’ ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। এর দুই মাস পরে মার্চ মাসে এই বালুখালী ক্যাম্পেই আরেকটি অগ্নিকান্ডে ১০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। তখন ১৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।

তথ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আশ্রয় শিবিরে ২২২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি। সংসদীয় কমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকান্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এর বেশ কয়েকবার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয়েছে। এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আরেক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ক্যাম্পে বারবার অগ্নিকান্ডের পেছনে মিয়ানমারের বিচ্ছিনতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নাশকতামূলক তৎপরতা থাকতে পারে। ফলে সেটি খতিয়ে দেখা খুবই দরকার।

রোহিঙ্গা নেতারা আরও বলছেন, প্রতি বছর শিবিরগুলোতে ৫০ থেকে ৬০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলেও মাইকিং আর মহড়া ছাড়া সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে না। শিবিরে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না।

এ বিষয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা রফিক বলেন, ক্যাম্পের বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে। কিছু দিন যেতে না যেতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কেন ঘটে? তিনি বলেন, আগের আগুনের ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এতদিন ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্প্রতি ক্যাম্পে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো সশস্ত্র সংগঠন আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা। ফলে ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এর জের ধরে একপক্ষ অন্যপক্ষকে ফাঁসাতে শিবিরে আগুন দিতে পারে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা বলেছেন, এই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

তিনি বলেন, সেখানে আরাকান স্যালভেশন আর্মি আরসা, আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন আরএসও, আল-ইয়াকিনসহ রোহিঙ্গাদের বিশটির বেশি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে এর আগে সংঘর্ষ হয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে তাদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮টি, ২০১৯ সালে ১০, ২০২১ সালে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে ২২২টি ছিল। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর গত তিন মাসে ছোট-বড় ১৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

গত রোববার অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ২ হাজার পরিবারের ১২ হাজার মানুষের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে। আগুন লাগার পেছনে নাশকতার অভিযোগে সন্দেহজনক স্থানীয় ১৭ বছরের এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আমির জাফর বলেন, আগুন লাগার কারণে জানতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আর অগ্নিকান্ডের ঘটনার পেছনে অন্য কারণ আছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, আগের তুলনায় ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কমেছে। তাছাড়া আগুন লাগার সঠিক কারণ জানাও কঠিন। তিনি বলেন, ‘মূলত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে ঝুপড়ি ঘর আছে। তাই আগুন লাগলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। বেশিরভাগ ক্যাম্পে প্রশস্ত রাস্তা না থাকায় ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার পানির সংকটও বেশি হওয়ার ফলে আগুন লাগলে শিবিরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়।

এদিকে গত শুক্রবার রোহিঙ্গা ভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে এক আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাত পরিচয় ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করেন। যারা আরসাকে দমনে জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন তিনি। অডিও বার্তায় বলা হয়, ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়। বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলো।

অডিও বার্তার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান অগ্নিকান্ড নাশকতা কি-না তা জানতে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্রে করে যাতে কেউ ক্যাম্পে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য পুলিশ সর্তক অবস্থানে রয়েছে।

রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকান্ডের পেছনে কোন চক্রের হাত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ বের করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে সব সময়ই এখানকার মানুষের মাঝে আগুন লাগার ভীতি থাকবে। তাই এ ধরনের ঘটনা রোধে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এর আগে রোহিঙ্গারা ব্লকে ব্লকে পাহারা বসিয়েছিল।’

এ নিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনা নাশকতা কি-না, তা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সন্দেহভাজন একজনকে আটক করা হয়েছে। এই অগ্নিকান্ড পরিকল্পিত কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

এর আগে ২০২১ সালে ২২ মার্চ একই ক্যাম্পসহ পাশ্ববর্তী তিনটি ক্যাম্পে বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় আগুনে ১০ হাজারেরও বেশি বসতঘর পুড়ে যায়। অগ্নিকান্ডে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছিল। এছাড়া দগ্ধ হয়ে দুই শিশুসহ ১৫ জন রোহিঙ্গা মারা যায়। ওই ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।