ভগ্নাংশেরও কম নাম্বারের জন্য বেআইনিভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওযার ৫০ বছর ও মৃত্যুর এক বছর পর হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পেলেন জিল হোসেন। ৭ মার্চ বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে এ রায় দেন। এর ফলে ২০০৮ সালে দেওয়া রায় অনুযায়ী দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন জিল হোসেনের পরিবার। সেই সাথে ২০০৮ সাল থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত জিল হোসেনের রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লুকোচুরি করেছে উল্লেখ করে বলেন, এই আচরণের কারণে জিল হোসেনের জীবন ধ্বংস হয়েছে। সময় মতো ফলাফল প্রকাশিত হলে ও সনদ হাতে পেলে জিল হোসেনের জীবন অন্যরকম হতে পারতো।
১৯৭৩ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দশমিক পাঁচ নাম্বারের জন্য জিল হোসেনকে বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে আবারও পরীক্ষায় বসলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে আদালতে মামলা করলে দীর্ঘ ২২ বছর পর এবং হাইকোর্টের রায়ের ১৪ বছর পর ১৯৯৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে সনদ হাতে পান তিনি। এরপর ২০০০ সালে ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন জিল হোসেন। ২০০৮ সালে আদালত ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদনে হাইকোর্ট সে রায় স্থগিত করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান জিল হোসেন। পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্নাতক পাসের পর তার বন্ধু-সহপাঠীরা যখন একে একে চাকরিতে ঢুকেছেন, তখন তাকে আইনি লড়াইয়ে যেতে হয়েছে সেই সনদ পেতে। আদালতের রায়ের পর ৪৭ বছর বয়সে তার হাতে পরীক্ষা পাসের সনদ আসে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ওই ঘটনার পর তিনি আর কোনো চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাননি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। তার চার ছেলে ও চার মেয়ে। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি জিল হোসেন মারা যান।
আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী তানিয়া আমীর ও মিয়া মো. ইশতিয়াক শুনানিতে ছিলেন। প্রয়াত জিল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস। জিল হোসেনের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে নিয়োগ দেয়।
রায়ের পর চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই কোটি টাকা দাবি করে মামলা করা হয়। এ মামলায় বিচারিক আদালত ২০০৮ সালে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন। ওই দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে আরও ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হবে। মোট টাকা থেকে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদালতে জমা করা ২৫ লাখ টাকা বাদ যাবে। প্রয়াত জিল হোসেনের স্ত্রী ও আট সন্তান ওই অর্থ পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য ও অবহেলার কারণে জিল হোসেনকে ভুগতে হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে এসেছে। কেননা, ভগ্নাংশ যোগ করা হলে ১৯৭৩ সালে কৃতকার্য থাকতেন জিল হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী মিয়া মো. ইশতিয়াক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (অ্যাগ্রি) স্নাতক দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফলে জিল হোসেনকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হন তিনি। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তার প্রাপ্ত নম্বরের ১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায় সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪
জেলা বার্তা পরিবেশক, সিরাজগঞ্জ
ভগ্নাংশেরও কম নাম্বারের জন্য বেআইনিভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওযার ৫০ বছর ও মৃত্যুর এক বছর পর হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পেলেন জিল হোসেন। ৭ মার্চ বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে এ রায় দেন। এর ফলে ২০০৮ সালে দেওয়া রায় অনুযায়ী দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন জিল হোসেনের পরিবার। সেই সাথে ২০০৮ সাল থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত জিল হোসেনের রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লুকোচুরি করেছে উল্লেখ করে বলেন, এই আচরণের কারণে জিল হোসেনের জীবন ধ্বংস হয়েছে। সময় মতো ফলাফল প্রকাশিত হলে ও সনদ হাতে পেলে জিল হোসেনের জীবন অন্যরকম হতে পারতো।
১৯৭৩ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দশমিক পাঁচ নাম্বারের জন্য জিল হোসেনকে বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে আবারও পরীক্ষায় বসলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে আদালতে মামলা করলে দীর্ঘ ২২ বছর পর এবং হাইকোর্টের রায়ের ১৪ বছর পর ১৯৯৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে সনদ হাতে পান তিনি। এরপর ২০০০ সালে ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন জিল হোসেন। ২০০৮ সালে আদালত ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদনে হাইকোর্ট সে রায় স্থগিত করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান জিল হোসেন। পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্নাতক পাসের পর তার বন্ধু-সহপাঠীরা যখন একে একে চাকরিতে ঢুকেছেন, তখন তাকে আইনি লড়াইয়ে যেতে হয়েছে সেই সনদ পেতে। আদালতের রায়ের পর ৪৭ বছর বয়সে তার হাতে পরীক্ষা পাসের সনদ আসে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ওই ঘটনার পর তিনি আর কোনো চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাননি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। তার চার ছেলে ও চার মেয়ে। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি জিল হোসেন মারা যান।
আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী তানিয়া আমীর ও মিয়া মো. ইশতিয়াক শুনানিতে ছিলেন। প্রয়াত জিল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস। জিল হোসেনের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে নিয়োগ দেয়।
রায়ের পর চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই কোটি টাকা দাবি করে মামলা করা হয়। এ মামলায় বিচারিক আদালত ২০০৮ সালে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন। ওই দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে আরও ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হবে। মোট টাকা থেকে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদালতে জমা করা ২৫ লাখ টাকা বাদ যাবে। প্রয়াত জিল হোসেনের স্ত্রী ও আট সন্তান ওই অর্থ পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য ও অবহেলার কারণে জিল হোসেনকে ভুগতে হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে এসেছে। কেননা, ভগ্নাংশ যোগ করা হলে ১৯৭৩ সালে কৃতকার্য থাকতেন জিল হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী মিয়া মো. ইশতিয়াক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (অ্যাগ্রি) স্নাতক দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফলে জিল হোসেনকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হন তিনি। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তার প্রাপ্ত নম্বরের ১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায় সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।