রাজধানীর সিদ্দিক বাজারে হোটেল ক্যাফে কুইন ভবনে রিফরেকটেড ব্লাস্ট ওয়েব (বিস্ফোরিত হওয়ার পর ধংসাবশেষ বাধা পেয়ে কয়েকগুণ শক্তি নিয়ে আঘাত হানে) এর কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও বেশি প্রাণহানী ঘটেছে। ভবনটির বেসমেন্ট হোটেলের রান্নাঘরে বাণিজ্যক গ্যাসের সংযোগ ছিল যা অবৈধ ছিল। ওই সংযোগ বন্ধ থাকলেও আবাসিক গ্যাসের সংযোগ চালু ছিল। কোনভাবে গ্যাস লিকেজ থেকেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। দুর্ঘনাস্থলে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সিটিটিসির পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানে এমন তথ্য মিলেছে।
এদিকে বিস্ফোরণে ধসে পড়া হোটেল ক্যাফে কুইন ভবনে মরদেহের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিশ্চিত না হলেও তল্লাশি কার্যক্রম চালু রেখেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। দুর্ঘটনায় ৩ দিন নিখোঁজ থাকা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মেহেদী হাসান স্বপনের মরদেহ গতকাল উদ্ধারের পর তারা তল্লাশি বন্ধ রাখলেও কার্যক্রম শেষ ঘোষণা করেনি। অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভেতরে প্রবেশ করতে না পারায় ফায়ার সার্ভিস সতর্কভাবে তল্লাশি করছে। যদি কোন ব্যক্তি এসে তার স্বজন নিখোঁজের দাবি করে তাহলে তারা তল্লাশি চালাবেন বলে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটির ক্ষতিগ্রস্ত পিলার সংস্কারের মাধ্যমে ভবনটিকে ঝুঁকিমুক্ত করার কাজ শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। গতকাল রাজউকের টেকনিক্যাল টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর এমন কার্যক্রম শুরু করে। ভবনটিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেটি ভেঙে ফেলা হবে নাকি সংস্কার করা হবে। এছাড়া বিস্ফোরণে ২১ জনের প্রাণহানির ঘটনায় দুই ভবন মালিকসহ তিনজনকে রিমান্ড হেফাজতে নিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল ভবন মালিক ওয়াহিদুর রহমান, মতিউর রহমান এবং ব্যবসায়ী আবদুল মোতালেব মিন্টুকে গ্রেপ্তার করার পর আদালতে হাজির করা হয় রিমান্ড আবেদন জানিয়ে। শুনানী শেষে আদালত ২ দিনের রিমান্ড হেফাজত মঞ্জুর করে। যদিও ‘দুর্ঘটনায়’ প্রাণহানির ঘটনায় গত বুধবার রাতে বংশাল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে পুলিশ।
গত মঙ্গলবার আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবন বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে গতকাল পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এর মধ্যে ঘটনাস্থলে ২০ জন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনায় শতাদিক আহত হলেও হাতাপালে ভর্তি হয়েছে ৪০ জনের মতো। এর মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন ভর্তি রয়েছে। ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, র্যাব, পুলিশসহ একাধিক সংস্থার বিশেষজ্ঞ টিম অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরিত ভবনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অপেক্ষায় আছে। সকালে এক দফা উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করার পর তারা তল্লাসি কার্যক্রম বন্ধ রাখে। পুলিশ সদস্যরা ভবনটির সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। ঘটনার পর থেকে সড়ক বন্ধ করার পর গতকালও তা চালু করা সম্ভব হয়নি। দফায় দফায় রাজউক, সিটি করপোরেশন, পুলিশ, র্যাব, ডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরির্দশন করছেন। তারা নানা ধরনের তথ্য উপাত্তা নিচ্ছেন। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
পুলিশের বোম ডিস্ফোজাল ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার মো. রহমত উল্লাহ জানান, ভবনটিতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের অস্তিত্ব মিলিছে। বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। আমরা ধারণা করছি রিফলেক্ট ব্লাস্ট ওয়েব এর কারণে ক্ষয়ক্ষতি এতো বেশি হয়েছে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বেসমেন্ট চারদিক থেকে বন্ধ ছিল, তাই বিস্ফোরণের পর এক ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয়। দেয়াল ও ছাদের কংক্রিট বিস্ফোরণে পর বাদাপ্রাপ্ত হয়ে তা কয়েকগুন শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। এর ফলে বিস্ফোরণ অতিমাত্রায় শক্তি নিয়ে আশেপাশে আঘাত হেনেছে। সবকিছু গুড়িয়ে দিয়েছে। যা আইইডি বা গ্রেনেড বিস্ফোরণের শক্তির চেয়ে বেশি ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্য, বিস্ফোরিত ভবনের ধ্বংসস্তুপে আর কোন মরদেহ ‘নেই’। কেউ নিখোঁজ আছে এমন কোন দাবিও নেই। ভবনটিকে ঝুকিপূর্ণ ঘোষণা করে সেটিকে স্ট্রেবল (স্থিতিশীল) করার পর ভবনটির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার বা তল্লাসি শেষ ঘোষণার আগে সেখানে অবস্থান করবে।
ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেছেন, গত মঙ্গলবার ভবনটি বিস্ফোরণের পর আংশিক ধসে পড়ে। সেদিনই ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। গত বুধবার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারপরও নিখোঁজ ছিলেন ওই ভবনের একটি দোকানের কর্মী মেহেদী হাসান স্বপন। গতকাল দুপুরে স্বপনের লাশ উদ্ধারের পর নিখোঁজ থাকার দাবি নিয়ে আর কেউ আসেনি। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে রয়েছেন।
বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ সর্বশেষ মেহেদী হাসান স্বপনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন তল্লাশি না চললেও উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা হয়নি। ভবনের ভেতরে আর কেউ নিখোঁজ নেই, তা নিশ্চিত না হওয়ায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করছে না ফায়ার সার্ভিস ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভেতরে কনক্রিটের স্তুপ সরিয়েও তল্লাশি করা যাচ্ছে না। যেহেতু পুরো বেসমেন্ট তল্লাশি করা যাচ্ছে না, তাই ভেতরে কারও মরদেহ আছে কি না, তা নিশ্চিত নই। ‘তাই কোন (নিখোঁজের) দাবিদার যদি আসে, তখন হালকা টুলস ব্যবহার করে তল্লাশি করব।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ থাকা মেহেদী হাসান স্বপনের স্বজনরা ভবনের সামনেই অবস্থান করছিল। স্বজনদের অনুরোধে ঝুঁকি নিয়ে ভবনটির বেইজমেন্টে তল্লাশি চালায় ফায়ার সার্ভিস। ধ্বংসস্তু সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা স্বপনের মরদেহ বের করে নিয়ে আসে। লাশ পাওয়া গেছে জানার পরও স্বপনের স্বজনদের আহাজারি দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিস সাদা ব্যাগে স্বপনের লাশ ঢুকিয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। পরে সেখান থেকে লাশ বুঝে নেয় স্বপনের ভাই। স্বপনের লাশ উদ্ধারের পর ভেতরে আর লাশ নেই জানিয়ে ভবনটির সামনে এসে অবস্থান নেয় উদ্ধার কর্মীরা। এরপর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
মালিকসহ ৩ জন রিমান্ডে
ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় গত বুধবার ভবনের মালিক ও বিস্ফোরণের স্থল বাংলাদেশ স্যানিটারি নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ৩ জনকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগার গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির লালবাগ বিভাগ। গতকাল তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর পর আদালতে হাজির করা হয়। এরপর ৫৪ ধারায় ভবনটির মূল মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমানের দুই ছেলে মো. ওয়াহিদুর রহমান (৪৬) ও মতিউর রহমান (৩৫) এবং ওই ভবনের বেসমেন্ট ভাড়া নিয়ে শো রুম করা বাংলাদেশ স্যানিটারি দোকানের মালিক আ. মোতালেব মিন্টু (৩৬)কে ২ দিনের রিমান্ড হেফাজতে পায় পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা ডিবি) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এতবড় একটি দুর্ঘটনার দায় ভবনের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এড়াতে পারে না। ভবনটিতে কোন সংস্কার হত না, পয়ঃনিস্কাশন নিয়মিত তদারকি হত না, পার্কিং এলাকায় গুদাম ভাড়া দেয়ার নিষেধ থাকার পরেও দেয়া হয়েছে, ব্যবসায়ীরা জেনেও নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদারকিরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’ এসব কারণে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে হারুন বলেন, আরও কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার দুই ভবন মালিকসহ তিন জনকে ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আবদুল মাবুদ। ঢাকা মেট্রোপলিট ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আহম্মেদ এর আদালতে এ বিষয় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে ২ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়।
ভবনের বিষয়ে যেসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ
বিস্ফোরণে ধ্বসে পড়া হোটেল ক্যাফে কুইনের ভবন নির্মাণে ১০ তলা প্ল্যান পাস করা হলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেজমেন্ট ও ১ তলা কমপ্লিট ছিল। বেজমেন্টে রান্নাঘর আর একতলায় ছিল খাবারের হোটেল। পুলিশ বলছে, এই ভবনের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন ছিল যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়। ২০০৪ সালে ভবনটির সাত তলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়। ভবনটির মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান ২০১১ সালে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বর্তমান ভবনটির মালিক।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ভবনটির বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে এক সময় রান্নাঘর ছিল। সর্বশেষ সেখানে বাংলাদেশ স্যানিটারি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্যানিটারি মালামাল বিক্রির দোকান ছিল। প্রায় ১৮০০ বর্গফুটের আন্ডার গ্রাউন্ডের পুরোটাই কাচঘেরা। দোকান ঠান্ডা রাখতে বড় ২টি এসি চালানো হতো এখানে। এখানে আরও আছে একটি বড় পানির ট্যাংক। ভবনটির সুয়ারেজ সেপটিক ট্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নন মালিকরা। ধারণা করা হচ্ছে উত্তর পাশের ভবনের সঙ্গে এ ভবনের মাঝখানে যে আড়াই-তিন ফিটের জায়গা খালি আছে সেখানে থাকতে পারে দুই ভবনের সেপটিক ট্যাংক।
সিটিটিসির সূত্র জানিয়েছে, ভবনটির বেজমেন্টের রান্নাঘরে একসময় বাণিজ্যিক বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো, যা পরে বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে বাড়ির অন্যান্য তলায় আবাসিক লাইন এখনও চলমান। বাণিজ্যিক লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে।
বিস্ফোরণের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে পুলিশের যুক্তি বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকতো। কোনও গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণও হয়তো ঘটতো না। সাত তলা ভবনের বেজমেন্টসহ তিনটি বাণিজ্যিক ফ্লোর ও তার উপরের বাসাবাড়ির লোকজনের পয়বর্জ্য যেখানে জমা হয় দীর্ঘসময় পরিষ্কার না করায় সেখানে বায়োগ্যাসের জন্ম হতে পারে। যা বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করে। এক সময় এই বেজমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো যা পরে বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্য ফ্লোরের ডমেস্টিক লাইন এখনও চলমান। ফলে এই লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও গ্যাস লিক হতে পারে। কোনভাবে জমা গ্যাসে স্ফুলিঙ্গের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে। ভবন মালিকদের তথ্য মতে, মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং তার উত্তরপাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মাঝখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়বর্জ্যরে সেপটিক ট্যাংক, এসির আউটার লাইন ইত্যাদি অবস্থিত। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়বর্জ্যরে গ্যাসের বিস্ফোরণেও এমনটি হতে পারে। ভবনটির আন্ডার গ্রাউন্ডে বড় একটি স্যানিটারি দোকান, নিচতলায় ৫টি দোকান, দোতলায় মালিক সমিতির সেক্রেটারির অফিস এবং কাপড়ের ২টি দোকান ছিল। এসব দোকান ও অফিস কাচ এবং ভারী ইন্টেরিয়র সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা। এগুলোতে উচ্চ শক্তির এসি লাগানো ছিল। এসিগুলোকে সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করা হলে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে। ২/৩ বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে এরকম ঘটেছিল। ব্যক্তি মালিকানাধীন এ ভবনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ছিল। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ডিএমপির সিটিটিসি’র বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত করছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রিপোর্ট দেবেন তাতেই প্রকৃত কারণটি জানা যাবে। তবে এখনও বিস্ফোরক বা অন্তর্ঘাতমূলক কোনও কাজের আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।
ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিসি ক্যামেরার ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের মালিক ও দোকান মালিকদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে এনে বিস্ফোরণের কারণ জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
পুলিশ বলছে, কুইন্স স্যানিটারি মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। এই আন্ডার গ্রাাউন্ড স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোনও ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে নিরসন করা যেতো। জমে থাকা গ্যাসের নির্গমণসহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেতো। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে আন্ডার গ্রাউন্ডকে এক সময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার উপরেই সম্পূর্ণ এয়ারটাইট এসি করা নির্মাণসামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন তারা। দোকানের মালিক বেজমেন্টের ১ ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা না রেখে দোকান বানিয়ে তার কর্মচারি ও ক্রেতা সাধারণের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন। এত প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলাকেই দায়ী করা যায়।
বিধ্বস্ত ভবনের বিষয়ে রাজউক যা জানালো
বিধ্বস্ত ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করার কাজ শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। এরপর ভবনটি রাখা হবে নাকি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হবে সে বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিবে রাজউক। গত বুধবার রাতে বুয়েট বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে রাজউক ভবনটির ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলো ঘুরে দেখে। গতকাল রাজউকের টেকনিক্যাল টিম ঘটনাস্থলে যায়।
টেকনিক্যাল টিমের আহ্বায়ক ও রাজউকের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিস্ফোরণের কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাপোর্ট পিলার বা পাইপ দিয়ে ভবনের ওজন ছড়িয়ে দিতে পারলে সবাই নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। পানির লাইন ভেঙে গেছে। প্রচুর পানি জমছে। সবকিছু মিলিয়ে ভবনটি স্থিতিশীল করতে পারলে সব ধরনের কাজ করা যাবে। এটা নিয়ে গতকাল কাজ শুরু করা হয়েছে।
শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম কাজ হলো ভবনটিকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনা। এর পর ভবনটি ভাঙা বা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, ভবনটি যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে না পড়ে। ভবনের ভেতরে ঝুঁকি থাকায় ফায়ার সার্ভিস কাজ করতে পারছে না।’ ভবনের ৯টি পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই ভবনে ২৪টি পিলার রয়েছে। এর মধ্যে সামনের দিকের ৯টি পিলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনও কোনও পিলারের গোড়ার ঢালাই সরে গিয়েছে। রড বেঁকে গেছে।’ ভবনের নির্মাণ সংক্রান্ত্র নথি পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ভবনটি কত সালে নির্মাণ হয়েছে এ বিষয় সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। আমরা নথিপত্র খোঁজার কাজ করছি। তিনি বলেন ‘রাজউকের এই টেকনিক্যাল কমিটির কাজ হলো ভবনটির সর্বশেষ অবস্থা জানা। ভবন ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটা নিয়েই কাজ করছি। আমাদের কমিটিতে বুয়েটের দুজন শিক্ষক আছেন। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহা পরিচালক আছেন। এছাড়া রাজউকের কর্মকর্তারা আছেন। আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করে সিদ্ধান্ত দিতে পারবো। এরপর যে সিদ্ধান্ত আসে আমরা সেটা সুপারিশ করবো। সব মিলিয়ে যেটা ভালো হবে আমরা সেই সিদ্ধান্ত জানাবো।’
শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪
সাইফ বাবলু
রাজধানীর সিদ্দিক বাজারে হোটেল ক্যাফে কুইন ভবনে রিফরেকটেড ব্লাস্ট ওয়েব (বিস্ফোরিত হওয়ার পর ধংসাবশেষ বাধা পেয়ে কয়েকগুণ শক্তি নিয়ে আঘাত হানে) এর কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও বেশি প্রাণহানী ঘটেছে। ভবনটির বেসমেন্ট হোটেলের রান্নাঘরে বাণিজ্যক গ্যাসের সংযোগ ছিল যা অবৈধ ছিল। ওই সংযোগ বন্ধ থাকলেও আবাসিক গ্যাসের সংযোগ চালু ছিল। কোনভাবে গ্যাস লিকেজ থেকেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। দুর্ঘনাস্থলে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সিটিটিসির পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানে এমন তথ্য মিলেছে।
এদিকে বিস্ফোরণে ধসে পড়া হোটেল ক্যাফে কুইন ভবনে মরদেহের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিশ্চিত না হলেও তল্লাশি কার্যক্রম চালু রেখেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। দুর্ঘটনায় ৩ দিন নিখোঁজ থাকা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মেহেদী হাসান স্বপনের মরদেহ গতকাল উদ্ধারের পর তারা তল্লাশি বন্ধ রাখলেও কার্যক্রম শেষ ঘোষণা করেনি। অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভেতরে প্রবেশ করতে না পারায় ফায়ার সার্ভিস সতর্কভাবে তল্লাশি করছে। যদি কোন ব্যক্তি এসে তার স্বজন নিখোঁজের দাবি করে তাহলে তারা তল্লাশি চালাবেন বলে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটির ক্ষতিগ্রস্ত পিলার সংস্কারের মাধ্যমে ভবনটিকে ঝুঁকিমুক্ত করার কাজ শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। গতকাল রাজউকের টেকনিক্যাল টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর এমন কার্যক্রম শুরু করে। ভবনটিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেটি ভেঙে ফেলা হবে নাকি সংস্কার করা হবে। এছাড়া বিস্ফোরণে ২১ জনের প্রাণহানির ঘটনায় দুই ভবন মালিকসহ তিনজনকে রিমান্ড হেফাজতে নিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল ভবন মালিক ওয়াহিদুর রহমান, মতিউর রহমান এবং ব্যবসায়ী আবদুল মোতালেব মিন্টুকে গ্রেপ্তার করার পর আদালতে হাজির করা হয় রিমান্ড আবেদন জানিয়ে। শুনানী শেষে আদালত ২ দিনের রিমান্ড হেফাজত মঞ্জুর করে। যদিও ‘দুর্ঘটনায়’ প্রাণহানির ঘটনায় গত বুধবার রাতে বংশাল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে পুলিশ।
গত মঙ্গলবার আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবন বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে গতকাল পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এর মধ্যে ঘটনাস্থলে ২০ জন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনায় শতাদিক আহত হলেও হাতাপালে ভর্তি হয়েছে ৪০ জনের মতো। এর মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন ভর্তি রয়েছে। ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, র্যাব, পুলিশসহ একাধিক সংস্থার বিশেষজ্ঞ টিম অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরিত ভবনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অপেক্ষায় আছে। সকালে এক দফা উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করার পর তারা তল্লাসি কার্যক্রম বন্ধ রাখে। পুলিশ সদস্যরা ভবনটির সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। ঘটনার পর থেকে সড়ক বন্ধ করার পর গতকালও তা চালু করা সম্ভব হয়নি। দফায় দফায় রাজউক, সিটি করপোরেশন, পুলিশ, র্যাব, ডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরির্দশন করছেন। তারা নানা ধরনের তথ্য উপাত্তা নিচ্ছেন। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
পুলিশের বোম ডিস্ফোজাল ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার মো. রহমত উল্লাহ জানান, ভবনটিতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের অস্তিত্ব মিলিছে। বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। আমরা ধারণা করছি রিফলেক্ট ব্লাস্ট ওয়েব এর কারণে ক্ষয়ক্ষতি এতো বেশি হয়েছে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বেসমেন্ট চারদিক থেকে বন্ধ ছিল, তাই বিস্ফোরণের পর এক ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয়। দেয়াল ও ছাদের কংক্রিট বিস্ফোরণে পর বাদাপ্রাপ্ত হয়ে তা কয়েকগুন শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। এর ফলে বিস্ফোরণ অতিমাত্রায় শক্তি নিয়ে আশেপাশে আঘাত হেনেছে। সবকিছু গুড়িয়ে দিয়েছে। যা আইইডি বা গ্রেনেড বিস্ফোরণের শক্তির চেয়ে বেশি ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্য, বিস্ফোরিত ভবনের ধ্বংসস্তুপে আর কোন মরদেহ ‘নেই’। কেউ নিখোঁজ আছে এমন কোন দাবিও নেই। ভবনটিকে ঝুকিপূর্ণ ঘোষণা করে সেটিকে স্ট্রেবল (স্থিতিশীল) করার পর ভবনটির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার বা তল্লাসি শেষ ঘোষণার আগে সেখানে অবস্থান করবে।
ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেছেন, গত মঙ্গলবার ভবনটি বিস্ফোরণের পর আংশিক ধসে পড়ে। সেদিনই ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। গত বুধবার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারপরও নিখোঁজ ছিলেন ওই ভবনের একটি দোকানের কর্মী মেহেদী হাসান স্বপন। গতকাল দুপুরে স্বপনের লাশ উদ্ধারের পর নিখোঁজ থাকার দাবি নিয়ে আর কেউ আসেনি। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে রয়েছেন।
বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ সর্বশেষ মেহেদী হাসান স্বপনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন তল্লাশি না চললেও উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা হয়নি। ভবনের ভেতরে আর কেউ নিখোঁজ নেই, তা নিশ্চিত না হওয়ায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করছে না ফায়ার সার্ভিস ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভেতরে কনক্রিটের স্তুপ সরিয়েও তল্লাশি করা যাচ্ছে না। যেহেতু পুরো বেসমেন্ট তল্লাশি করা যাচ্ছে না, তাই ভেতরে কারও মরদেহ আছে কি না, তা নিশ্চিত নই। ‘তাই কোন (নিখোঁজের) দাবিদার যদি আসে, তখন হালকা টুলস ব্যবহার করে তল্লাশি করব।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ থাকা মেহেদী হাসান স্বপনের স্বজনরা ভবনের সামনেই অবস্থান করছিল। স্বজনদের অনুরোধে ঝুঁকি নিয়ে ভবনটির বেইজমেন্টে তল্লাশি চালায় ফায়ার সার্ভিস। ধ্বংসস্তু সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা স্বপনের মরদেহ বের করে নিয়ে আসে। লাশ পাওয়া গেছে জানার পরও স্বপনের স্বজনদের আহাজারি দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিস সাদা ব্যাগে স্বপনের লাশ ঢুকিয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। পরে সেখান থেকে লাশ বুঝে নেয় স্বপনের ভাই। স্বপনের লাশ উদ্ধারের পর ভেতরে আর লাশ নেই জানিয়ে ভবনটির সামনে এসে অবস্থান নেয় উদ্ধার কর্মীরা। এরপর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
মালিকসহ ৩ জন রিমান্ডে
ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় গত বুধবার ভবনের মালিক ও বিস্ফোরণের স্থল বাংলাদেশ স্যানিটারি নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ৩ জনকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগার গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির লালবাগ বিভাগ। গতকাল তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর পর আদালতে হাজির করা হয়। এরপর ৫৪ ধারায় ভবনটির মূল মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমানের দুই ছেলে মো. ওয়াহিদুর রহমান (৪৬) ও মতিউর রহমান (৩৫) এবং ওই ভবনের বেসমেন্ট ভাড়া নিয়ে শো রুম করা বাংলাদেশ স্যানিটারি দোকানের মালিক আ. মোতালেব মিন্টু (৩৬)কে ২ দিনের রিমান্ড হেফাজতে পায় পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা ডিবি) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এতবড় একটি দুর্ঘটনার দায় ভবনের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এড়াতে পারে না। ভবনটিতে কোন সংস্কার হত না, পয়ঃনিস্কাশন নিয়মিত তদারকি হত না, পার্কিং এলাকায় গুদাম ভাড়া দেয়ার নিষেধ থাকার পরেও দেয়া হয়েছে, ব্যবসায়ীরা জেনেও নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদারকিরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’ এসব কারণে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে হারুন বলেন, আরও কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার দুই ভবন মালিকসহ তিন জনকে ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আবদুল মাবুদ। ঢাকা মেট্রোপলিট ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আহম্মেদ এর আদালতে এ বিষয় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে ২ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়।
ভবনের বিষয়ে যেসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ
বিস্ফোরণে ধ্বসে পড়া হোটেল ক্যাফে কুইনের ভবন নির্মাণে ১০ তলা প্ল্যান পাস করা হলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেজমেন্ট ও ১ তলা কমপ্লিট ছিল। বেজমেন্টে রান্নাঘর আর একতলায় ছিল খাবারের হোটেল। পুলিশ বলছে, এই ভবনের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন ছিল যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়। ২০০৪ সালে ভবনটির সাত তলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়। ভবনটির মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান ২০১১ সালে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বর্তমান ভবনটির মালিক।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ভবনটির বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে এক সময় রান্নাঘর ছিল। সর্বশেষ সেখানে বাংলাদেশ স্যানিটারি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্যানিটারি মালামাল বিক্রির দোকান ছিল। প্রায় ১৮০০ বর্গফুটের আন্ডার গ্রাউন্ডের পুরোটাই কাচঘেরা। দোকান ঠান্ডা রাখতে বড় ২টি এসি চালানো হতো এখানে। এখানে আরও আছে একটি বড় পানির ট্যাংক। ভবনটির সুয়ারেজ সেপটিক ট্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নন মালিকরা। ধারণা করা হচ্ছে উত্তর পাশের ভবনের সঙ্গে এ ভবনের মাঝখানে যে আড়াই-তিন ফিটের জায়গা খালি আছে সেখানে থাকতে পারে দুই ভবনের সেপটিক ট্যাংক।
সিটিটিসির সূত্র জানিয়েছে, ভবনটির বেজমেন্টের রান্নাঘরে একসময় বাণিজ্যিক বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো, যা পরে বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে বাড়ির অন্যান্য তলায় আবাসিক লাইন এখনও চলমান। বাণিজ্যিক লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে।
বিস্ফোরণের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে পুলিশের যুক্তি বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকতো। কোনও গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণও হয়তো ঘটতো না। সাত তলা ভবনের বেজমেন্টসহ তিনটি বাণিজ্যিক ফ্লোর ও তার উপরের বাসাবাড়ির লোকজনের পয়বর্জ্য যেখানে জমা হয় দীর্ঘসময় পরিষ্কার না করায় সেখানে বায়োগ্যাসের জন্ম হতে পারে। যা বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করে। এক সময় এই বেজমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো যা পরে বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্য ফ্লোরের ডমেস্টিক লাইন এখনও চলমান। ফলে এই লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও গ্যাস লিক হতে পারে। কোনভাবে জমা গ্যাসে স্ফুলিঙ্গের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে। ভবন মালিকদের তথ্য মতে, মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং তার উত্তরপাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মাঝখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়বর্জ্যরে সেপটিক ট্যাংক, এসির আউটার লাইন ইত্যাদি অবস্থিত। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়বর্জ্যরে গ্যাসের বিস্ফোরণেও এমনটি হতে পারে। ভবনটির আন্ডার গ্রাউন্ডে বড় একটি স্যানিটারি দোকান, নিচতলায় ৫টি দোকান, দোতলায় মালিক সমিতির সেক্রেটারির অফিস এবং কাপড়ের ২টি দোকান ছিল। এসব দোকান ও অফিস কাচ এবং ভারী ইন্টেরিয়র সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা। এগুলোতে উচ্চ শক্তির এসি লাগানো ছিল। এসিগুলোকে সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করা হলে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে। ২/৩ বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে এরকম ঘটেছিল। ব্যক্তি মালিকানাধীন এ ভবনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ছিল। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ডিএমপির সিটিটিসি’র বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত করছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রিপোর্ট দেবেন তাতেই প্রকৃত কারণটি জানা যাবে। তবে এখনও বিস্ফোরক বা অন্তর্ঘাতমূলক কোনও কাজের আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।
ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিসি ক্যামেরার ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের মালিক ও দোকান মালিকদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে এনে বিস্ফোরণের কারণ জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
পুলিশ বলছে, কুইন্স স্যানিটারি মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। এই আন্ডার গ্রাাউন্ড স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোনও ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে নিরসন করা যেতো। জমে থাকা গ্যাসের নির্গমণসহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেতো। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে আন্ডার গ্রাউন্ডকে এক সময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার উপরেই সম্পূর্ণ এয়ারটাইট এসি করা নির্মাণসামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন তারা। দোকানের মালিক বেজমেন্টের ১ ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা না রেখে দোকান বানিয়ে তার কর্মচারি ও ক্রেতা সাধারণের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন। এত প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলাকেই দায়ী করা যায়।
বিধ্বস্ত ভবনের বিষয়ে রাজউক যা জানালো
বিধ্বস্ত ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করার কাজ শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। এরপর ভবনটি রাখা হবে নাকি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হবে সে বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিবে রাজউক। গত বুধবার রাতে বুয়েট বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে রাজউক ভবনটির ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলো ঘুরে দেখে। গতকাল রাজউকের টেকনিক্যাল টিম ঘটনাস্থলে যায়।
টেকনিক্যাল টিমের আহ্বায়ক ও রাজউকের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিস্ফোরণের কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাপোর্ট পিলার বা পাইপ দিয়ে ভবনের ওজন ছড়িয়ে দিতে পারলে সবাই নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। পানির লাইন ভেঙে গেছে। প্রচুর পানি জমছে। সবকিছু মিলিয়ে ভবনটি স্থিতিশীল করতে পারলে সব ধরনের কাজ করা যাবে। এটা নিয়ে গতকাল কাজ শুরু করা হয়েছে।
শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম কাজ হলো ভবনটিকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনা। এর পর ভবনটি ভাঙা বা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, ভবনটি যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে না পড়ে। ভবনের ভেতরে ঝুঁকি থাকায় ফায়ার সার্ভিস কাজ করতে পারছে না।’ ভবনের ৯টি পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই ভবনে ২৪টি পিলার রয়েছে। এর মধ্যে সামনের দিকের ৯টি পিলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনও কোনও পিলারের গোড়ার ঢালাই সরে গিয়েছে। রড বেঁকে গেছে।’ ভবনের নির্মাণ সংক্রান্ত্র নথি পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ভবনটি কত সালে নির্মাণ হয়েছে এ বিষয় সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। আমরা নথিপত্র খোঁজার কাজ করছি। তিনি বলেন ‘রাজউকের এই টেকনিক্যাল কমিটির কাজ হলো ভবনটির সর্বশেষ অবস্থা জানা। ভবন ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটা নিয়েই কাজ করছি। আমাদের কমিটিতে বুয়েটের দুজন শিক্ষক আছেন। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহা পরিচালক আছেন। এছাড়া রাজউকের কর্মকর্তারা আছেন। আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করে সিদ্ধান্ত দিতে পারবো। এরপর যে সিদ্ধান্ত আসে আমরা সেটা সুপারিশ করবো। সব মিলিয়ে যেটা ভালো হবে আমরা সেই সিদ্ধান্ত জানাবো।’