বিস্ফোরণে দগ্ধ ও আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে

রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ও আহত ব্যক্তিরা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের অনেকেই এখন মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। তাদের শরীরের ৪০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত বার্ন বা দগ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে যাদের শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাই বেশি ঝুঁকিতে আছে। আহতদের একজন নোয়াখালীর মো. হাসান। যার শরীরের ৮৮ ভাগই দগ্ধ হয়েছে। তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৯ জন এবং ঢামেকে ১৫ জন চিকিৎসাধীন আছেন।

হাসানের স্বজনরা জানান, হাসানের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাপুরে। সিদ্দিক বাজারে যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেই ভবনের নিচে ফুটপাতে বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগের ব্যবসা করেন। বিস্ফোরণে তিনি ছিটকে পড়েন দূরে। তার শরীরের ৮৮ ভাগই দগ্ধ হয়েছে। হাসানের শ্যালক জামাল জানান, তিনিও তার ভগ্নিপতির সঙ্গে পাশাপাশি ব্যবসা করেন। জামাল ঘরের পর্দা বিক্রি করেন। বিস্ফোরণের সময় আমি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম বলে বেঁচে যাই। মসজিদের ভেতর থেকেই এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন, হাসানের শরীরের ৮৮ ভাগই দগ্ধ হয়েছে। খুবই আশঙ্কাজনক অবস্থা। হাসানের ছোট ছোট তিন সন্তান আছে। পরিবারে ছোট ভাই-বোনও আছে। পরিবারের সবার বড় হওয়ায় সবাইকেই দেখতে হতো তাকে। এখন পুরো পরিবারটিই পড়েছে অনিশ্চয়তায়।

দগ্ধদের মধ্যে চিকিৎসাধীন আরেকজন হচ্ছেন- বাচ্চু মিয়া (৫৫)। ২৫ বছর আগে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে রাজধানীর সিদ্দিক বাজার এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। তখন থেকেই সিদ্দিক বাজারের একটি জুতার কারখানায় কাজ করছেন বাচ্চু মিয়া। গ্রামের বাড়িতেও তেমন জমিজমা না থাকায় নারায়ণগঞ্জের রূপসা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের উঠিয়ে নিজে একাই থাকেন কর্মস্থলে। বিস্ফোণের দিন মঙ্গলবার সকালে বাচ্চু মিয়া স্ত্রী রোকিয়া খাতুনকে ফোন করে বলেছিলেন বাসায় গিয়ে শবেবরাতের নামাজ পড়বেন। কিন্তু তার বাসায় যাওয়া হলো না। তিনি এখন হাসপাতালের বিছানায় কাঁতরাচ্ছেন। ৪০ ভাগ দগ্ধ হয়ে এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পোস্ট ওপারেটিভে চিকিৎসাধীন আছেন।

বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী-সন্তান হাসপাতালের মেঝেতে বসে আহাজারি করছেন। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে আহত বাবাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান বড় মেয়ে নাঈমা আক্তার। বাবার এমন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাঈমা। বাচ্চু মিয়ার ছোট ভাই হানিফ মিয়া বলেন, আমার ভাইয়ের দুই পা, গলা, মুখের এক পাশে পুড়ে মাংস আলগা হয়ে গেছে। আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ। আমার ভাইয়ের কিছু হয়ে গেলে তার পরিবারটা কে দেখবে?

শরীয়তপুর জেলার নোয়াপাড়া এলাকার আল আমিন মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে গত এক বছর ধরে কাজ করছেন। সিদ্দিক বাজারের ওই মার্কেটের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে তিনি বিস্ফোরণের মধ্যে পড়েন। তার শরীরের ৫০ ভাগ দগ্ধ হয়। গুরুতর অবস্থায় ভর্তি আছেন বার্ন ইউনিটের পোস্ট ওপারেটিভে। পাশেই অপেক্ষা করছিলেন আল আমিনের স্বজনরা। তার বড় ভাই মনিরুল ইসলাম বলেন, আল আমিনকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। ডাক্তারি পড়া শেষ করে মাত্র আট মাস হয়েছে বিয়ে করেছেন আল আমিন। এরই মধ্যে আমার ভাই এত বড় দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ল। এসব বলে মনিরুল কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এদিকে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৯ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাকিরাও শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসাধীনরা হলেন- মো. হাসান আলী (৩২), মো. ইয়াছিন আলী (২৬), খলিল সিকদার (৫০), অলিল সিকদার (৬০), মো. আজম মিয়া (৩৬), মো. আল-আমিন (২৫), মো. বাচ্চু মিয়া (৫৫), মো. জাহান মিয়া (২৫), মো. বাবুল মিয়া (২৫)।

ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এসএম আইউব হোসেন বলেন, গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে ১১ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একজন রয়েছেন হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)। বাকি পাঁচজনকে পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, চিকিৎসাধীনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দগ্ধ মো. আজম। তার শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। মো. ইয়াসিন নামে আরেকজনের শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ। আর মো. হাসানের শরীরের ১২ শতাংশ, মো. বাচ্চু মিয়ার ৪০ শতাংশ, মো. অলিল শিকদারের ২০ শতাংশ, মো. আল-আমিনের ১৫ শতাংশ, খলিল সিকদারের শরীরের ৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।

বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. শামন্ত লাল সেন বার্ন ইউনিটে এক ব্রিফিং এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে লাইফ সাপোর্টে আছেন তিনজন। বাকিদের কেবিনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অবস্থা বুঝে পরবর্তী চিকিৎসা দেয়া হবে। তাদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা কিছুটা ভালো, তবে শঙ্কামুক্ত নয়।

অন্যদিকে বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক। গতকাল সকালে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। মো. নাজমুল হক বলেন, গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাদের জন্য সব ধরনের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছি। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আমাদের এখানে ২০ জন ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আমাদের এখানে ১৫ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা বার্নে ৯ জন ভর্তি আছেন। গত বুধবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছেন। আমরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১১ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকান্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকান্ডে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।

এদিকে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর গুলিস্তানে ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে ঝড়ে যায় ২৩টি প্রাণ। আহত হয় দুই শতাধিক। ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণ এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে, সব লাশ উদ্ধারের পর ভবনটি ধসে পড়ার শঙ্কায় বন্ধ রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কার্যক্রম। নিমতলি, চূড়িহাট্টা, আরমানিটোলা ট্রাজেডির পর এই ঘটনায় আবারো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।

সিদ্দিক বাজারের স্যানিটারি ব্যবসায়ী ‘ফরহাদ ট্রেডিংয়ের’ মালিক ফরহাদ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এরপরেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এখানে থাকছি, ব্যবসা করছি। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, একের পর এক বড় ট্রাজেডির সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের। সর্বশেষ ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পরিচিত অনেককে হারাতে হলো। যাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি, চোখের সামনে তাদের চাপা পড়া লাশ উদ্ধার করতে দেখেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। আমরা আর আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে চাই না। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হোক। গ্যাস লাইন সংস্কার করে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।

গত মঙ্গলবার গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড কাউন্টারের পাশে একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এর সাত মিনিটের মাথায় ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, সিটিটিসি, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করা হয়। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্যমতে, বুধবার বিকেলে মমিন উদ্দিন সুমন (৪৪) ও রবিন হোসেন শান্ত (২০) নামে দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া বুধবার রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুসাসহ আরও দুইজনের মৃত্যু হয়। এতে বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৩ জন মারা গেলেন। এ ঘটনায় আহত শতাধিক। এদিকে সিদ্দিক বাজারের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সাধারণ ডায়েরি নথিভুক্তির পর বুধবার বংশাল থানায় এ অপমৃত্যুর মামলা হয়।

image
আরও খবর
বিস্ফোরণ ঘটে ভবনের বেসমেন্টে অবৈধ গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে
শান্তর ঝড়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারালো টাইগাররা
প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা
স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন ৯ ব্যক্তি ও ১ প্রতিষ্ঠান
বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও একজনের মৃত্যু, সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩
উত্তরায় সোয়া ১১ কোটি টাকা লুট ৯ ঘণ্টা পর ৯ কোটি উদ্ধার
দাম কমানোর আলোচনার মধ্যেই আদানির বিদ্যুৎ এলো বাংলাদেশে
বড় কোন দুর্যোগে নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কাজের দুর্বলতা কেন?
ধসেপড়া ভবনে তল্লাশি কার্যক্রম বন্ধ
রমজান ঘিরে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, দিশেহারা মানুষ
সড়কের এক পাশ দিয়ে চলছে যাওয়া আসা, ভোগান্তিতে মানুষ
খালেদা জিয়া রাজনীতি ও নির্বাচন করতে পারবে কিনা বলবে আদালত : কাদের
উদ্ধার হওয়া টাকার অঙ্ক নিয়ে বিভ্রান্তি
আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থে সংবিধান বারবার কাটাছেঁড়া করেছে : ফখরুল
ভারত থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল আসবে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে

শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪

বিস্ফোরণে দগ্ধ ও আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে

মাসুদ রানা

image

রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ও আহত ব্যক্তিরা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের অনেকেই এখন মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। তাদের শরীরের ৪০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত বার্ন বা দগ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে যাদের শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাই বেশি ঝুঁকিতে আছে। আহতদের একজন নোয়াখালীর মো. হাসান। যার শরীরের ৮৮ ভাগই দগ্ধ হয়েছে। তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৯ জন এবং ঢামেকে ১৫ জন চিকিৎসাধীন আছেন।

হাসানের স্বজনরা জানান, হাসানের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাপুরে। সিদ্দিক বাজারে যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেই ভবনের নিচে ফুটপাতে বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগের ব্যবসা করেন। বিস্ফোরণে তিনি ছিটকে পড়েন দূরে। তার শরীরের ৮৮ ভাগই দগ্ধ হয়েছে। হাসানের শ্যালক জামাল জানান, তিনিও তার ভগ্নিপতির সঙ্গে পাশাপাশি ব্যবসা করেন। জামাল ঘরের পর্দা বিক্রি করেন। বিস্ফোরণের সময় আমি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম বলে বেঁচে যাই। মসজিদের ভেতর থেকেই এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন, হাসানের শরীরের ৮৮ ভাগই দগ্ধ হয়েছে। খুবই আশঙ্কাজনক অবস্থা। হাসানের ছোট ছোট তিন সন্তান আছে। পরিবারে ছোট ভাই-বোনও আছে। পরিবারের সবার বড় হওয়ায় সবাইকেই দেখতে হতো তাকে। এখন পুরো পরিবারটিই পড়েছে অনিশ্চয়তায়।

দগ্ধদের মধ্যে চিকিৎসাধীন আরেকজন হচ্ছেন- বাচ্চু মিয়া (৫৫)। ২৫ বছর আগে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে রাজধানীর সিদ্দিক বাজার এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। তখন থেকেই সিদ্দিক বাজারের একটি জুতার কারখানায় কাজ করছেন বাচ্চু মিয়া। গ্রামের বাড়িতেও তেমন জমিজমা না থাকায় নারায়ণগঞ্জের রূপসা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের উঠিয়ে নিজে একাই থাকেন কর্মস্থলে। বিস্ফোণের দিন মঙ্গলবার সকালে বাচ্চু মিয়া স্ত্রী রোকিয়া খাতুনকে ফোন করে বলেছিলেন বাসায় গিয়ে শবেবরাতের নামাজ পড়বেন। কিন্তু তার বাসায় যাওয়া হলো না। তিনি এখন হাসপাতালের বিছানায় কাঁতরাচ্ছেন। ৪০ ভাগ দগ্ধ হয়ে এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পোস্ট ওপারেটিভে চিকিৎসাধীন আছেন।

বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী-সন্তান হাসপাতালের মেঝেতে বসে আহাজারি করছেন। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে আহত বাবাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান বড় মেয়ে নাঈমা আক্তার। বাবার এমন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাঈমা। বাচ্চু মিয়ার ছোট ভাই হানিফ মিয়া বলেন, আমার ভাইয়ের দুই পা, গলা, মুখের এক পাশে পুড়ে মাংস আলগা হয়ে গেছে। আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ। আমার ভাইয়ের কিছু হয়ে গেলে তার পরিবারটা কে দেখবে?

শরীয়তপুর জেলার নোয়াপাড়া এলাকার আল আমিন মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে গত এক বছর ধরে কাজ করছেন। সিদ্দিক বাজারের ওই মার্কেটের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে তিনি বিস্ফোরণের মধ্যে পড়েন। তার শরীরের ৫০ ভাগ দগ্ধ হয়। গুরুতর অবস্থায় ভর্তি আছেন বার্ন ইউনিটের পোস্ট ওপারেটিভে। পাশেই অপেক্ষা করছিলেন আল আমিনের স্বজনরা। তার বড় ভাই মনিরুল ইসলাম বলেন, আল আমিনকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। ডাক্তারি পড়া শেষ করে মাত্র আট মাস হয়েছে বিয়ে করেছেন আল আমিন। এরই মধ্যে আমার ভাই এত বড় দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ল। এসব বলে মনিরুল কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এদিকে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৯ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাকিরাও শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসাধীনরা হলেন- মো. হাসান আলী (৩২), মো. ইয়াছিন আলী (২৬), খলিল সিকদার (৫০), অলিল সিকদার (৬০), মো. আজম মিয়া (৩৬), মো. আল-আমিন (২৫), মো. বাচ্চু মিয়া (৫৫), মো. জাহান মিয়া (২৫), মো. বাবুল মিয়া (২৫)।

ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এসএম আইউব হোসেন বলেন, গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে ১১ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একজন রয়েছেন হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)। বাকি পাঁচজনকে পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, চিকিৎসাধীনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দগ্ধ মো. আজম। তার শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। মো. ইয়াসিন নামে আরেকজনের শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ। আর মো. হাসানের শরীরের ১২ শতাংশ, মো. বাচ্চু মিয়ার ৪০ শতাংশ, মো. অলিল শিকদারের ২০ শতাংশ, মো. আল-আমিনের ১৫ শতাংশ, খলিল সিকদারের শরীরের ৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।

বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. শামন্ত লাল সেন বার্ন ইউনিটে এক ব্রিফিং এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে লাইফ সাপোর্টে আছেন তিনজন। বাকিদের কেবিনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অবস্থা বুঝে পরবর্তী চিকিৎসা দেয়া হবে। তাদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা কিছুটা ভালো, তবে শঙ্কামুক্ত নয়।

অন্যদিকে বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক। গতকাল সকালে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। মো. নাজমুল হক বলেন, গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাদের জন্য সব ধরনের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছি। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আমাদের এখানে ২০ জন ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আমাদের এখানে ১৫ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা বার্নে ৯ জন ভর্তি আছেন। গত বুধবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছেন। আমরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১১ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকান্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকান্ডে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে।

এদিকে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর গুলিস্তানে ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে ঝড়ে যায় ২৩টি প্রাণ। আহত হয় দুই শতাধিক। ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণ এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে, সব লাশ উদ্ধারের পর ভবনটি ধসে পড়ার শঙ্কায় বন্ধ রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কার্যক্রম। নিমতলি, চূড়িহাট্টা, আরমানিটোলা ট্রাজেডির পর এই ঘটনায় আবারো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।

সিদ্দিক বাজারের স্যানিটারি ব্যবসায়ী ‘ফরহাদ ট্রেডিংয়ের’ মালিক ফরহাদ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এরপরেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এখানে থাকছি, ব্যবসা করছি। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, একের পর এক বড় ট্রাজেডির সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের। সর্বশেষ ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পরিচিত অনেককে হারাতে হলো। যাদের দেখে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি, চোখের সামনে তাদের চাপা পড়া লাশ উদ্ধার করতে দেখেছি। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। আমরা আর আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে চাই না। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হোক। গ্যাস লাইন সংস্কার করে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।

গত মঙ্গলবার গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড কাউন্টারের পাশে একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এর সাত মিনিটের মাথায় ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, সিটিটিসি, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করা হয়। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্যমতে, বুধবার বিকেলে মমিন উদ্দিন সুমন (৪৪) ও রবিন হোসেন শান্ত (২০) নামে দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া বুধবার রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুসাসহ আরও দুইজনের মৃত্যু হয়। এতে বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৩ জন মারা গেলেন। এ ঘটনায় আহত শতাধিক। এদিকে সিদ্দিক বাজারের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সাধারণ ডায়েরি নথিভুক্তির পর বুধবার বংশাল থানায় এ অপমৃত্যুর মামলা হয়।