যেকোন দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। ফায়ার ফাইটাররাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিচ্ছেন উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু বড় দুর্যোগে পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতার ছাপ ফুটে ওঠে সংস্থাটিতে। ছোট আগুন দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসলেও বড় অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে দীর্ঘ সময়। বড় বিস্ফোরণেও দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। এতে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাণহানিও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো অপ্রতুল। নেই ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারা মেডিকেল টিম।
ফলে বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হয় সংস্থাটিকে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রশিক্ষণে জোর দিয়ে উন্নত বিশ্বের ফায়ার সার্ভিসের আদলে আধুনিক সরঞ্জাম বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাড়াতে হবে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ। না হলে উদ্ধার অভিযানে সময় লাগবে অনেক। বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও।
এদিকে রাজধানীর সিদ্দিক বাজারে এলাকায় বিস্ফোরিত কুইন সেনিটারি মার্কেট ভবনে উদ্ধার অভিযানেও সীমাবদ্ধতার কারণে বন্ধ রাখতে দেখা গেছে উদ্ধার অভিযান। বিশেষ করে ভবনটির বেজমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালাতে শোরিং (ঠেক দেয়ার) নামের বিশেষ যন্ত্রের অভাবে বন্ধ রাখা হয় উদ্ধার অভিযান। যা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই। পরে ঘটনার দুই দিন পর রাজউক সেখানে বিম বসানোর কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে বেজমেন্টে আর লাশ নেই নিশ্চিত হয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায় ফায়ার সার্ভিস।
এদিকে, বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট কাজ করলেও বেজমেন্টের সবশেষ লাশ উদ্ধার করা হয় দুই দিন পর। তাও ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়, মাছি ওড়া দেখে লাশের অবস্থান নিশ্চিত হয় তারা। বিস্ফোরণের পরদিন ফায়ার সার্ভিসের কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেক স্বজনকেও।
শুধু এই ঘটনাই নয়, ২০২১ সালে রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার নিচতলায় অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৭ ইউনিট কাজ করলেও আগুন ঠিকই ছড়িয়ে পড়ে কারখানার সবগুলো ফ্লোরে। আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে প্রায় দুই দিন। ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতার কারণেই হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও তখন অভিযোগ করে এলাকাবাসী। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর ডেমরায় কোনাপাড়া মাদ্রাসা রোডে পাশা টাওয়ার নামে ১০তলা ভবনে অগ্নিকান্ডের পর সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতেও হিমশিম খেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। ১৬ ইউনিটের ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে পুড়ে যায় ভবনটির ৬টি তলা।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডে ঘটনাতেও হিমশিম খেতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসকে। এফ আর টাওয়ারে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের আগুন নেভাতেই সময় লেগে যায় সাত ঘণ্টার বেশি। ২০১৬ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের একটি ফ্লোরের একাংশের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিটের সময় লাগে ১০ ঘণ্টারও বেশি। আর ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট, নৌবাহিনী, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্টের কর্মীদের লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা।
সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আন্তরিকতা, সাহস এবং মানবিক তৎপরতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে হলেও জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সংস্থাটির দুর্বলতা তাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে এ সংস্থার প্রাধিকারপ্রাপ্ত মোট জনবল ১৩ হাজার ১১০ জন। কর্মরত আছেন ১০ হাজার ৮৯৩ জন। যার মধ্যে ফায়ারম্যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফায়ার সার্ভিসে অন্তত ৩০ হাজার জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের ল্যাডার (মই), জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিন, রিমোট কনট্রোল ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, টোয়িং ভিহিক্যাল, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস ও স্মোক ইজেক্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
সূত্র জানায়, সারাদেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২০টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৯টি। এরমধ্যে সম্প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের দুটি ল্যাডার কেনা হয়েছে। ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হয়েছে।
সিদ্দিক বাজারের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী রিপন বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা শুনি। সেই নিমতলি ট্রাজেডি থেকে এসব আশার বাণী শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। এখন আমরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চাই। সব কেমিক্যাল গুদাম ও জুতার কারখানাসহ পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সবকিছু সরিয়ে নেয়া হোক। এক প্রশ্নের জবাবে রিপন বলেন, কেমিক্যাল কারখানা মানেই তো মৃত্যুকূপ। কিছু লোভী বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া পাওয়ার আশায় এসব কারখানা করার সুযোদগ দিচ্ছে। প্রশাসন সব জেনেও চুপ। আগুন আর বিস্ফোরণে আর কত প্রাণ ঝড়লে প্রশাসনের হুশ ফিরবে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সেখানকার আরেক বাসিন্দা নবাবপুরের একটি মোটর পার্টস দোকানের কর্মচারী সুজন শিকদার বলেন, ঝুঁকির কথা বলে কি লাভ। দুর্ঘটনা ঘটার দু’দিন পর সবাই ভুলে যায়। সিদ্দিক বাজারে এই যে বিস্ফোরণ ঘটল, এটি নিয়ে সবাই ব্যস্ত। অথচ ওই ভবনের পেছনে কয়েক’ জুতার কারখানা, যেখান থেকে আবারও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে সেদিকে কারো নজর নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য দেশে ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার নেই। উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত পরিচালনার জন্য যে ধরনের প্রযুক্তি থাকা দরকার তা আমাদের সংস্থাগুলোর নেই। আবার যেসব আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে তা ব্যবহার করতে জানা কর্মীর অভাব রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমদ খান বলেন, বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। যেমন কোন ভবন ধস হলে সেখানে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে শোরিং সাপোর্ট দরকার। যা ফায়ার সার্ভিসের নেই। ফলে গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। শুধু শোরিং সিস্টেম নয়, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত করতে হবে ফায়ার সার্ভিসে।
সেইসঙ্গে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ আরও বাড়াতে হবে। কারণ বড় অগ্নিকান্ড হোক কিংবা বিস্ফোরণ বা ভবন ধস, এসব ক্ষেত্রে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দ্রুত সময়ের মধ্যে হতাহতের শিকার ব্যক্তিকে উদ্ধার করা না গেলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। আর এই কাজগুলো টেকনিকক্যাল প্রশিক্ষণ নেয়া ফায়ার ফাইটার ছাড়া সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের স্বক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ভলেন্টিয়ার ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। সেইসঙ্গে বিল্ডিং কোড ব্যতীত যাতে কোন ভবন গড়ে না ওঠে সেদিকে কঠোর নজরদাড়ি বাড়াতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা নেই, তা নয়। তবে ধাপে ধাপে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর আদলে ফায়ার সার্ভিস আধুনিক সরঞ্জামে সমৃদ্ধ হচ্ছে। তার মানে এই নয়, যেকানো বড় দুর্যোগ ফায়ার সার্ভিস মোকাবিলা করার স্বক্ষমতা রাখে। এই স্বক্ষমতা হয়তো বিশ্বের কোন দেশের ফায়ার সার্ভিসের নেই। তবে দুর্যোগ মোকাবিলা করা একটি স্বমন্বিত কাজ। বড় ঘটনা ঘটলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করে থাকে। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই। এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জনবল স্বল্পতা ফায়ার সার্ভিসের একটি বড় সংকট। সরকার জনবল বাড়ানোর কাজ করছে। এর পাশাপাশি প্যারা মেডিকেল টিম যুক্ত হলে উদ্ধারকাজে আরও ভালো হবে।
শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪
মাসুদ রানা
যেকোন দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। ফায়ার ফাইটাররাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিচ্ছেন উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু বড় দুর্যোগে পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতার ছাপ ফুটে ওঠে সংস্থাটিতে। ছোট আগুন দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসলেও বড় অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে দীর্ঘ সময়। বড় বিস্ফোরণেও দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। এতে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাণহানিও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো অপ্রতুল। নেই ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারা মেডিকেল টিম।
ফলে বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হয় সংস্থাটিকে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রশিক্ষণে জোর দিয়ে উন্নত বিশ্বের ফায়ার সার্ভিসের আদলে আধুনিক সরঞ্জাম বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাড়াতে হবে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ। না হলে উদ্ধার অভিযানে সময় লাগবে অনেক। বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও।
এদিকে রাজধানীর সিদ্দিক বাজারে এলাকায় বিস্ফোরিত কুইন সেনিটারি মার্কেট ভবনে উদ্ধার অভিযানেও সীমাবদ্ধতার কারণে বন্ধ রাখতে দেখা গেছে উদ্ধার অভিযান। বিশেষ করে ভবনটির বেজমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালাতে শোরিং (ঠেক দেয়ার) নামের বিশেষ যন্ত্রের অভাবে বন্ধ রাখা হয় উদ্ধার অভিযান। যা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই। পরে ঘটনার দুই দিন পর রাজউক সেখানে বিম বসানোর কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে বেজমেন্টে আর লাশ নেই নিশ্চিত হয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায় ফায়ার সার্ভিস।
এদিকে, বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট কাজ করলেও বেজমেন্টের সবশেষ লাশ উদ্ধার করা হয় দুই দিন পর। তাও ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়, মাছি ওড়া দেখে লাশের অবস্থান নিশ্চিত হয় তারা। বিস্ফোরণের পরদিন ফায়ার সার্ভিসের কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেক স্বজনকেও।
শুধু এই ঘটনাই নয়, ২০২১ সালে রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার নিচতলায় অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৭ ইউনিট কাজ করলেও আগুন ঠিকই ছড়িয়ে পড়ে কারখানার সবগুলো ফ্লোরে। আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে প্রায় দুই দিন। ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতার কারণেই হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও তখন অভিযোগ করে এলাকাবাসী। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর ডেমরায় কোনাপাড়া মাদ্রাসা রোডে পাশা টাওয়ার নামে ১০তলা ভবনে অগ্নিকান্ডের পর সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতেও হিমশিম খেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। ১৬ ইউনিটের ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে পুড়ে যায় ভবনটির ৬টি তলা।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডে ঘটনাতেও হিমশিম খেতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসকে। এফ আর টাওয়ারে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের আগুন নেভাতেই সময় লেগে যায় সাত ঘণ্টার বেশি। ২০১৬ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের একটি ফ্লোরের একাংশের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিটের সময় লাগে ১০ ঘণ্টারও বেশি। আর ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট, নৌবাহিনী, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্টের কর্মীদের লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা।
সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আন্তরিকতা, সাহস এবং মানবিক তৎপরতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে হলেও জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সংস্থাটির দুর্বলতা তাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে এ সংস্থার প্রাধিকারপ্রাপ্ত মোট জনবল ১৩ হাজার ১১০ জন। কর্মরত আছেন ১০ হাজার ৮৯৩ জন। যার মধ্যে ফায়ারম্যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফায়ার সার্ভিসে অন্তত ৩০ হাজার জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের ল্যাডার (মই), জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিন, রিমোট কনট্রোল ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, টোয়িং ভিহিক্যাল, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস ও স্মোক ইজেক্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
সূত্র জানায়, সারাদেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২০টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৯টি। এরমধ্যে সম্প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের দুটি ল্যাডার কেনা হয়েছে। ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হয়েছে।
সিদ্দিক বাজারের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী রিপন বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা শুনি। সেই নিমতলি ট্রাজেডি থেকে এসব আশার বাণী শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। এখন আমরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চাই। সব কেমিক্যাল গুদাম ও জুতার কারখানাসহ পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সবকিছু সরিয়ে নেয়া হোক। এক প্রশ্নের জবাবে রিপন বলেন, কেমিক্যাল কারখানা মানেই তো মৃত্যুকূপ। কিছু লোভী বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া পাওয়ার আশায় এসব কারখানা করার সুযোদগ দিচ্ছে। প্রশাসন সব জেনেও চুপ। আগুন আর বিস্ফোরণে আর কত প্রাণ ঝড়লে প্রশাসনের হুশ ফিরবে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সেখানকার আরেক বাসিন্দা নবাবপুরের একটি মোটর পার্টস দোকানের কর্মচারী সুজন শিকদার বলেন, ঝুঁকির কথা বলে কি লাভ। দুর্ঘটনা ঘটার দু’দিন পর সবাই ভুলে যায়। সিদ্দিক বাজারে এই যে বিস্ফোরণ ঘটল, এটি নিয়ে সবাই ব্যস্ত। অথচ ওই ভবনের পেছনে কয়েক’ জুতার কারখানা, যেখান থেকে আবারও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে সেদিকে কারো নজর নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য দেশে ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার নেই। উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত পরিচালনার জন্য যে ধরনের প্রযুক্তি থাকা দরকার তা আমাদের সংস্থাগুলোর নেই। আবার যেসব আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে তা ব্যবহার করতে জানা কর্মীর অভাব রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমদ খান বলেন, বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। যেমন কোন ভবন ধস হলে সেখানে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে শোরিং সাপোর্ট দরকার। যা ফায়ার সার্ভিসের নেই। ফলে গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। শুধু শোরিং সিস্টেম নয়, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত করতে হবে ফায়ার সার্ভিসে।
সেইসঙ্গে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ আরও বাড়াতে হবে। কারণ বড় অগ্নিকান্ড হোক কিংবা বিস্ফোরণ বা ভবন ধস, এসব ক্ষেত্রে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দ্রুত সময়ের মধ্যে হতাহতের শিকার ব্যক্তিকে উদ্ধার করা না গেলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। আর এই কাজগুলো টেকনিকক্যাল প্রশিক্ষণ নেয়া ফায়ার ফাইটার ছাড়া সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের স্বক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ভলেন্টিয়ার ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। সেইসঙ্গে বিল্ডিং কোড ব্যতীত যাতে কোন ভবন গড়ে না ওঠে সেদিকে কঠোর নজরদাড়ি বাড়াতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা নেই, তা নয়। তবে ধাপে ধাপে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর আদলে ফায়ার সার্ভিস আধুনিক সরঞ্জামে সমৃদ্ধ হচ্ছে। তার মানে এই নয়, যেকানো বড় দুর্যোগ ফায়ার সার্ভিস মোকাবিলা করার স্বক্ষমতা রাখে। এই স্বক্ষমতা হয়তো বিশ্বের কোন দেশের ফায়ার সার্ভিসের নেই। তবে দুর্যোগ মোকাবিলা করা একটি স্বমন্বিত কাজ। বড় ঘটনা ঘটলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করে থাকে। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই। এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জনবল স্বল্পতা ফায়ার সার্ভিসের একটি বড় সংকট। সরকার জনবল বাড়ানোর কাজ করছে। এর পাশাপাশি প্যারা মেডিকেল টিম যুক্ত হলে উদ্ধারকাজে আরও ভালো হবে।