রমজান ঘিরে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, দিশেহারা মানুষ

দুয়ারে কড়া নাড়ছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান। এরই মধ্যে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত আকাশছোঁয়া এ দাম কোথায় গিয়ে থামে তা নিয়েই এখন দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষের যত চিন্তা।

গত কয়েকদিনের ব্যবধানে কি কোন পণ্যের দাম বেড়েছে? গতকাল সকালে এ প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর মানিকনগর বাজারের মুদি ব্যবসায়ী সোহেল ব্যাপারি বলেন, সবকিছুরই তো দাম বেড়ে রয়েছে, আর কত বাড়বে? কোন পণ্যের দাম কমেছে কি না এ প্রশ্নে তার সাফ জবাব, এ দেশে কোনকিছুর দাম বাড়লে আর সেটা কমে না।

জানা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসন ও ট্যাংয়ের দাম। আর আগে থেকে বাড়তি চিনি, তেল, আটা-ময়দার দাম কমেনি। এছাড়া সবজি ও মাছসহ বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম।

এ ব্যাপারে অনেক ক্রেতারাই মনের ক্ষোভে কথাও বলতে চান না তারা। তবে মাঝে মধ্যে দুই/একজন বলতেও তাদের মনের মধ্যে কি যেন একটু কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে এমনভাবে কথা বলেন। তাদের কথা হচ্ছে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, সেভাবে আয় বাড়েনি ফলে কোথায় থেকে এই বাড়তি টাকা আসবে। কিভাবে সংসার চালাবে। আর এভাবে বাড়তে থাকলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে। ক্রেতাদের মধ্যে একটা কষ্টের নিশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।

রমজান সামনে রেখে বাজারে অস্বস্তি বাড়ছে ক্রেতাদের। উদ্বেগ বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তাদের। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরেও সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না অনেকে। প্রতিদিনের ডাল-ভাতের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে চুপচাপ বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

রমজানের আর অল্প কিছুদিন বাকি, তাই অনেকেই রোজার প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো আগে কিনে রাখতে চান। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে তাদের। অনেকে বাজারে গিয়ে দরদাম করেই ফিরে আসছেন। কেউ কেউ দাম একটু কমার অপেক্ষা করছেন। তবে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও যে রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন থাকবে সেটা বুঝতে বাকি নেই সীমিত আয়ের মানুষের। আর সে কারণেই তাদের যত অস্বস্তি।

রোজায় ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসনের বেশি ব্যবহার হয়। গত কয়েকদিনে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। এমনকি শরবত তৈরির জন্য যে ট্যাং লাগে বাজারে সেটার এখন রীতিমতো সংকট। যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে তারাও বিক্রি করছেন গত রমজানের থেকে কেজিপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা বাড়তি দামে। বর্তমান বাজারে ট্যাং ১৪০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এদিকে বাজারে গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। মাসখানেক আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা দরে, যা এখন ৯৫-১০০ টাকা। ছোলার সঙ্গে ছোলাবুটের দামও বেড়েছে ৫-১০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

এছাড়া অ্যাংকর ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে ৭০-৮০ টাকা এবং একইভাবে বেসনের দাম বেড়ে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

গত কয়েক মাস ধরেই বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে তেল-চিনি মিলছে না। বেঁধে দেয়া দামে প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১১৭ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। একইভাবে সরকার নির্ধারিত প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকার পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে ১৭২ থেকে ১৭৫ টাকায়। খোলা চিনির ক্ষেত্রে নির্ধারিত দাম ১০৭ টাকা হলেও এখনও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে।

এদিকে মসলার বাজারে আদা-রসুনের বাড়তি দাম কমেনি। উল্টো পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে ৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুরগির বাজার এক-দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি এখন ২৫০-২৫৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ৫ টাকা কেজিতে বেড়েছে। যা গত সপ্তাহে ছিল ২৫০ টাকা। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩৪০-৩৫০ টাকা। প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা দরে।

মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে এখন প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস এক হাজার ১০০ টাকা, লাল লেয়ার ২৭০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৫০, ব্রয়লার ২৫০-২৫৫, কক মুরগি ২৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মানিক নগর বাজারের খাসির মাংসের দোকানি বলেন, বাজারে মাংসের দাম বেশি। ক্রেতা একবারে নেই বললেই চলে। আগে ২-৩টা খাসি জবাই করতাম। প্রচুর ক্রেতা থাকত। এখন সাহস করে একটি ছোট খাসি জবাই করি। মাঝে মধ্যে সেটিও পরোপুরি বিক্রি করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, দাম তো আর আমরা বাড়াই না। আমাদের খাসি কিনতেই হয় বেশি দামে। তাই আমাদের করার কিছু থাকে না।

গরুর মাংসের দোকানি বাদল হোসেন বলেন, এখন সাধারণ মানুষের কাছে টাকা কম। বাজারদর বেশি। আজ দুটি গরু মিলে ৫ মণ মাংস হয়েছে। বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিয়ে এখানে অল্প এনেছি। একটা সময় প্রতিদিনই ৮-১০ মণ মাংসের ব্যবসা ছিল। সেটা কমে গেছে। আজ বাজারে এখন পর্যন্ত কোন ক্রেতাই পেলাম না।

মুরগি ব্যবসায়ী শরিফ উদ্দিন বলেন, গত ২০-২৫ দিন ধরে মুরগির দাম বাড়তি। গরু-খাসির দাম বাড়তি থাকায় সাধারণ মানুষ এই মুরগিই বেশি কিনত। আগে যে পরিমাণ বেচতাম, গত ২ সপ্তাহে বেচা-বিক্রি তার অর্ধেকে নেমেছে। আজকের বাজারেও আমাদের মুরগি কিনতে হয়েছে ২৩৫ টাকায়। বিক্রি করছি ২৫০-২৫৫ টাকায়। এই ১৫-২০ টাকার মধ্যেই আমার দোকানের যাবতীয় খরচ, আমাদের লাভটা থাকে কই? দোকানে এনে মুরগিকে তো খাবার দিতে হয়, সেটার দাম তো আরও আগে থেকে বেড়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, শিং ৪০০ টাকা, কই ৩০০ টাকা, টেংড়া ৬০০ টাকা, পাঙাস ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কাতল মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়, শোল মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী হানিফ মিয়া বলেন, ‘বর্তমান বাজারে মাংস কেনা তো মুশকিল আবার মাছের বাজারও চড়া। তবে আগে তেলাপিয়া, পাঙাস, চাষের কই এমন জাতীয় মাছগুলো কিনে খাওয়া যেত কিন্তু এখন আর এগুলোর কম দাম নেই। এসবের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আয়-ব্যয়ের হিসাব এখন মেলানো যাচ্ছে না। ডাল, ভাত, মাছ সবজি খেয়ে যারা কোনভাবে টিকে থাকছে তাদেরও এখন বিপদ। অতিরিক্ত দামের কারণে আমরা সাধারণ মানুষ আগে থেকেই ভালো মাছ খেতে পারি না। আর যেসব কমদামি মাছ ছিল এখন সেগুলোর দামও বেড়ে গেছে। একইভাবে বেড়েছে সবজির দাম। আমরা সাধারণ ক্রেতারা কোথায় যাবো?

এদিকে সবজির বাজারে ইফতার শুরুর আগেই বেড়ে গেছে লেবুর দাম। এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকা পর্যন্ত। একই কারণে বাড়ছে বেগুনের দামও। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন ৫০-৭০ টাকা, যা সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে শীতের শেষের দিক থেকেই বাড়তি দামে সব ধরনের সবজি বিক্রি শুরু হয়েছে। দুই একটি সবজি ছাড়া কোন সবজিই ৪০/৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। পটোল প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, টমেটো প্রতি কেজি ৪০ টাকা, শসা ৪০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, করল্লা ৮০ টাকা, সজনে ২০০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, শিম ৬০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, ফুলকপি ৪০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৪০ টাকা এবং কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

image
আরও খবর
বিস্ফোরণ ঘটে ভবনের বেসমেন্টে অবৈধ গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে
শান্তর ঝড়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারালো টাইগাররা
প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা
স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন ৯ ব্যক্তি ও ১ প্রতিষ্ঠান
বিস্ফোরণে দগ্ধ ও আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে
বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও একজনের মৃত্যু, সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩
উত্তরায় সোয়া ১১ কোটি টাকা লুট ৯ ঘণ্টা পর ৯ কোটি উদ্ধার
দাম কমানোর আলোচনার মধ্যেই আদানির বিদ্যুৎ এলো বাংলাদেশে
বড় কোন দুর্যোগে নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কাজের দুর্বলতা কেন?
ধসেপড়া ভবনে তল্লাশি কার্যক্রম বন্ধ
সড়কের এক পাশ দিয়ে চলছে যাওয়া আসা, ভোগান্তিতে মানুষ
খালেদা জিয়া রাজনীতি ও নির্বাচন করতে পারবে কিনা বলবে আদালত : কাদের
উদ্ধার হওয়া টাকার অঙ্ক নিয়ে বিভ্রান্তি
আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থে সংবিধান বারবার কাটাছেঁড়া করেছে : ফখরুল
ভারত থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল আসবে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে

শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪

রমজান ঘিরে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, দিশেহারা মানুষ

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

দুয়ারে কড়া নাড়ছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান। এরই মধ্যে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত আকাশছোঁয়া এ দাম কোথায় গিয়ে থামে তা নিয়েই এখন দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষের যত চিন্তা।

গত কয়েকদিনের ব্যবধানে কি কোন পণ্যের দাম বেড়েছে? গতকাল সকালে এ প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর মানিকনগর বাজারের মুদি ব্যবসায়ী সোহেল ব্যাপারি বলেন, সবকিছুরই তো দাম বেড়ে রয়েছে, আর কত বাড়বে? কোন পণ্যের দাম কমেছে কি না এ প্রশ্নে তার সাফ জবাব, এ দেশে কোনকিছুর দাম বাড়লে আর সেটা কমে না।

জানা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসন ও ট্যাংয়ের দাম। আর আগে থেকে বাড়তি চিনি, তেল, আটা-ময়দার দাম কমেনি। এছাড়া সবজি ও মাছসহ বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম।

এ ব্যাপারে অনেক ক্রেতারাই মনের ক্ষোভে কথাও বলতে চান না তারা। তবে মাঝে মধ্যে দুই/একজন বলতেও তাদের মনের মধ্যে কি যেন একটু কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে এমনভাবে কথা বলেন। তাদের কথা হচ্ছে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, সেভাবে আয় বাড়েনি ফলে কোথায় থেকে এই বাড়তি টাকা আসবে। কিভাবে সংসার চালাবে। আর এভাবে বাড়তে থাকলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে। ক্রেতাদের মধ্যে একটা কষ্টের নিশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।

রমজান সামনে রেখে বাজারে অস্বস্তি বাড়ছে ক্রেতাদের। উদ্বেগ বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তাদের। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরেও সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না অনেকে। প্রতিদিনের ডাল-ভাতের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে চুপচাপ বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

রমজানের আর অল্প কিছুদিন বাকি, তাই অনেকেই রোজার প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো আগে কিনে রাখতে চান। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে তাদের। অনেকে বাজারে গিয়ে দরদাম করেই ফিরে আসছেন। কেউ কেউ দাম একটু কমার অপেক্ষা করছেন। তবে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও যে রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন থাকবে সেটা বুঝতে বাকি নেই সীমিত আয়ের মানুষের। আর সে কারণেই তাদের যত অস্বস্তি।

রোজায় ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসনের বেশি ব্যবহার হয়। গত কয়েকদিনে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। এমনকি শরবত তৈরির জন্য যে ট্যাং লাগে বাজারে সেটার এখন রীতিমতো সংকট। যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে তারাও বিক্রি করছেন গত রমজানের থেকে কেজিপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা বাড়তি দামে। বর্তমান বাজারে ট্যাং ১৪০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এদিকে বাজারে গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। মাসখানেক আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা দরে, যা এখন ৯৫-১০০ টাকা। ছোলার সঙ্গে ছোলাবুটের দামও বেড়েছে ৫-১০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

এছাড়া অ্যাংকর ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে ৭০-৮০ টাকা এবং একইভাবে বেসনের দাম বেড়ে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

গত কয়েক মাস ধরেই বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে তেল-চিনি মিলছে না। বেঁধে দেয়া দামে প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১১৭ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। একইভাবে সরকার নির্ধারিত প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকার পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে ১৭২ থেকে ১৭৫ টাকায়। খোলা চিনির ক্ষেত্রে নির্ধারিত দাম ১০৭ টাকা হলেও এখনও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে।

এদিকে মসলার বাজারে আদা-রসুনের বাড়তি দাম কমেনি। উল্টো পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে ৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুরগির বাজার এক-দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি এখন ২৫০-২৫৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ৫ টাকা কেজিতে বেড়েছে। যা গত সপ্তাহে ছিল ২৫০ টাকা। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩৪০-৩৫০ টাকা। প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা দরে।

মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে এখন প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস এক হাজার ১০০ টাকা, লাল লেয়ার ২৭০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৫০, ব্রয়লার ২৫০-২৫৫, কক মুরগি ২৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মানিক নগর বাজারের খাসির মাংসের দোকানি বলেন, বাজারে মাংসের দাম বেশি। ক্রেতা একবারে নেই বললেই চলে। আগে ২-৩টা খাসি জবাই করতাম। প্রচুর ক্রেতা থাকত। এখন সাহস করে একটি ছোট খাসি জবাই করি। মাঝে মধ্যে সেটিও পরোপুরি বিক্রি করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, দাম তো আর আমরা বাড়াই না। আমাদের খাসি কিনতেই হয় বেশি দামে। তাই আমাদের করার কিছু থাকে না।

গরুর মাংসের দোকানি বাদল হোসেন বলেন, এখন সাধারণ মানুষের কাছে টাকা কম। বাজারদর বেশি। আজ দুটি গরু মিলে ৫ মণ মাংস হয়েছে। বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিয়ে এখানে অল্প এনেছি। একটা সময় প্রতিদিনই ৮-১০ মণ মাংসের ব্যবসা ছিল। সেটা কমে গেছে। আজ বাজারে এখন পর্যন্ত কোন ক্রেতাই পেলাম না।

মুরগি ব্যবসায়ী শরিফ উদ্দিন বলেন, গত ২০-২৫ দিন ধরে মুরগির দাম বাড়তি। গরু-খাসির দাম বাড়তি থাকায় সাধারণ মানুষ এই মুরগিই বেশি কিনত। আগে যে পরিমাণ বেচতাম, গত ২ সপ্তাহে বেচা-বিক্রি তার অর্ধেকে নেমেছে। আজকের বাজারেও আমাদের মুরগি কিনতে হয়েছে ২৩৫ টাকায়। বিক্রি করছি ২৫০-২৫৫ টাকায়। এই ১৫-২০ টাকার মধ্যেই আমার দোকানের যাবতীয় খরচ, আমাদের লাভটা থাকে কই? দোকানে এনে মুরগিকে তো খাবার দিতে হয়, সেটার দাম তো আরও আগে থেকে বেড়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, শিং ৪০০ টাকা, কই ৩০০ টাকা, টেংড়া ৬০০ টাকা, পাঙাস ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কাতল মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়, শোল মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী হানিফ মিয়া বলেন, ‘বর্তমান বাজারে মাংস কেনা তো মুশকিল আবার মাছের বাজারও চড়া। তবে আগে তেলাপিয়া, পাঙাস, চাষের কই এমন জাতীয় মাছগুলো কিনে খাওয়া যেত কিন্তু এখন আর এগুলোর কম দাম নেই। এসবের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আয়-ব্যয়ের হিসাব এখন মেলানো যাচ্ছে না। ডাল, ভাত, মাছ সবজি খেয়ে যারা কোনভাবে টিকে থাকছে তাদেরও এখন বিপদ। অতিরিক্ত দামের কারণে আমরা সাধারণ মানুষ আগে থেকেই ভালো মাছ খেতে পারি না। আর যেসব কমদামি মাছ ছিল এখন সেগুলোর দামও বেড়ে গেছে। একইভাবে বেড়েছে সবজির দাম। আমরা সাধারণ ক্রেতারা কোথায় যাবো?

এদিকে সবজির বাজারে ইফতার শুরুর আগেই বেড়ে গেছে লেবুর দাম। এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকা পর্যন্ত। একই কারণে বাড়ছে বেগুনের দামও। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন ৫০-৭০ টাকা, যা সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে শীতের শেষের দিক থেকেই বাড়তি দামে সব ধরনের সবজি বিক্রি শুরু হয়েছে। দুই একটি সবজি ছাড়া কোন সবজিই ৪০/৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। পটোল প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, টমেটো প্রতি কেজি ৪০ টাকা, শসা ৪০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, করল্লা ৮০ টাকা, সজনে ২০০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, শিম ৬০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, ফুলকপি ৪০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৪০ টাকা এবং কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।